দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১৪

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১৪
অবন্তিকা তৃপ্তি

আব্দুর রহমানের বাড়িতে তার মেয়ে জামাই এসেছে, মানুষটা আবার শহরের বড় ডাক্তার! গ্রামে মুহূর্তেই কথাটা পাঁচকান হয়ে গেল। দেখা গেলো অনিরূপ দুপুরের খাবার খেতে উঠতে না উঠতেই উঠোনে কয়েকজন এসে দাঁড়িয়ে আছে। অনিরূপ এত লম্বা লাইন দেখে হতাশ চোখে আশার দিকে তাকাল, আশা মুখ ঝামটি দিয়ে অন্যদিকে তাকাল, অর্থাৎ ‘এখন বুঝো মজা!’

আশার বাবা ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে অনিরূপের দিকে তাকালেন। আমতা আমতা করে বললেন-
‘আসলে গ্রামে তো ভালো ডাক্তার নাই, তাই বোধহয়..’
অনিরূপ হাসার চেষ্টা করল। বড্ড টায়ার্ড লাগছে! ভাত খেয়ে সবসময় ঘুমায় ও। আজকে বোধহয় আর ঘুমানো যাবে না। অনিরূপ বললো-
‘ওদের পরে আসতে বলুন। বিকেলের দিকে!’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আব্দুর রহমান ছুটলেন বাইরে। বললেন, বিকেলে আসার কথা, জামাই এখন ক্লান্ত! কিন্ত মানুষ কী এসব বুঝে? তারা তাদের মতো অনুরোধ করতে লাগল। নরম আবদুর রহমান তাদের অনুরোধ ফেলতে না পেরে জামাইর কাছে আবার ছুটলেন।অগ্যতা অনিরূপ শ্বশুরের কথা রাখতে গিয়ে বাইরে বেরোলো। আব্দুর রহমান উঠোনে চেয়ার পাতলেন তিনটা। অনিরূপের ওই দুপুরটা পুরোটাই গেলো রোগী দেখায়।এদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, অনিরূপ হয়তো পুরো গ্রামের মেয়েদেরই জামাই বনে গেছে! ফ্রিতে দেখে দিচ্ছে, কেউ গ্রামের জামাই বলে টাকাও আনেনি। শ্বশুরের সামনে কিছু বলতে পারছে না আর নাইবা পারছে এদের একের পর এক ক্যাচক্যাচানি অনিরূপ সহ্য করতে। দাঁতে দাঁত চেপে অনিরূপ শেষ অব্দি রোগী দেখে গেলো।

আশা ঘরের জানলা দিয়ে অনিরূপের রোগী দেখা দেখছিল। মনেমনে আত্মিক শান্তি অচ্ছে আশা। বুঝুক আরও!
অনিরূপ যখন রুমে আসলো, তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। আশা রুমেই ছিল। নিধির সঙ্গে আমের ভর্তা খাচ্ছে। অনিরুপ রুমে আসতেই নিধি চুপচাপ বেরিয়ে গেল। আশা কোনদিকে নজর নাই, ও ভর্তা খেতে মশগুল।মহা ক্লান্ত অনিরুপ এসে সোজা জুতো নিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিছুটা কাদা লেগে গেলো বিছানায়। আশা সেটা দেখে হইহই করে উঠল-

‘নতুন বিছানা নষ্ট করছেন কেন?জুতো খুলে ঘুমানো যায়না?’
অনিরুপ আশার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। চূড়ান্ত হতাশ হয়ে বলল-
‘আশা, আমার দিকে একটু নজর দাও। তুমি এখনও বিছানা নিয়ে পড়ে আছো। আমি বেচারা হাত-পা নাড়াতে পারছি না ব্যথায়। নিজেদের হাসপাতালে আমি হায়েস্ট একদিনে ১৫ জন পেশেন্ট দেখেছি। অথচ আজ শ্বশুরবাড়ি ঘুরতে এসে আমাকে দিয়ে তোমরা প্রায় ৩০ জন পেশেন্ট দেখিয়ে ফেললে। তাও কিনা ফ্রি! ভাবো, আমি অনিরূপ ফ্রিতে রোগী দেখছি। আমি তো চিন্তাও করতে পারছি না, ড্যাম!’

আশা অনিরূপের কথার ধরন শুনে মনেমনে হাসি পেলেও, অনিরূপ লাই পাবে দেখে হাসল না। বরং টিটকারি করে বললো-
‘আমাকে কন্ট্রাক্ট করে বিয়ে করার আগে মাথায় রাখা উচিত ছিল, আমি সাধারণ গ্রামের মেয়ে। আর গ্রামে এসব হয়।’
অনিরূপ আশার কোল থেকে বালিশ টেনে নিয়ে সেটা মাথার নিচে দিয়ে বললো-‘যে ফাঁসার সে সবদিকেই ফাঁসে রে বউ! সবই কপাল!’

তারপর সেদিন রাতটুকু কোনরকমে পাড় করে অনিরূপ পরদিন সকালেই ফিরে আসে শহরে। এবং তওবা করে, ইহজনমে সে আর শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে না। আশাকে সহ্য করেই অনিরুপ ইহজনমের চূড়ান্ত সাধনার পরিচয় দিয়ে দিয়েছে, বাকি ষোল আনা শ্বশুরবাড়ি পা রেখে পূরণ করার কোন প্রয়োজন নেই!

অনিরূপ আজ বেশ দেরি করেই হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। দুপরের খাবার যখন খেলো, তখন প্রায় সন্ধ্যা! আশা রুমে বসে কুরআন পড়ছিল। অনিরূপ রুমে এসে আশাকে জায়নামাজ দেখে আর বিরক্ত করল না। সোজা ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় শুলো। আশা কুরআন জায়গায় রেখে জায়নামাজ ভাঁজ করতে করতে বললো-
‘আপনার নামাজ-কালাম লাগে না?’

অনিরুপ মোবাইল দেখতে দেখতে বলল-‘নামাজ? ওহ! না, আমি পড়ি না।’
আশা ভ্রূ কুঁচকে ফেলল-‘কেন? কোনি ভ্যালিড রিজন আছে?’
‘ভ্যালিড রিজন নেই, এমনিই।’ -অনিরূপের অবহেলার উত্তর!
আশা আর কথা বাড়ায় না। যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে শয়তানি তাকে আর নামাজের কথা কি-বা বলবে আশা! আশা চুপচাপ একটা বই নিয়ে বিছানায় বসে।দুজনের মধ্যে অনেকখানি দূরত্ব! অনিরুপ হঠাৎ একটা ভিডিও দেখে বাঁকা হেসে আশার দিকে তাকাল। সহসা আশারও তখন চোখ গেলো অনিরুপের মোবাইলের দিকে।
ভিডিওতে দেখাচ্ছে- ‘গার্লফ্রেন্ড এর গায়ে শুধুমাত্র বয়ফ্রেন্ডের একটা সাদা শার্ট, দুজন একে ওপরের সঙ্গে আনন্দ নিয়ে জড়াজড়ি করছে।’

ভিডিওটা পুরোপুরি দেখার আগেই আশা ছিটকে সরে গিয়ে রাগান্বিত গলায় বললো-‘এগুলা কী দেখেন আপনি? অশ্লীল লোক! ছিঃ! এগুলো দেখেই আপনার মাথা ভর্তি অশ্লীল ভাবনা ঢুকে গেছে।’
অনিরুপ ডান ভ্রু উঁচু করে বললো-‘তুমি আমার বউ। গার্লফ্রেন্ড নও, না। তোমার কাছে আশা করতেই পারি এরকম।’
অনিরূপের ঠোঁটকাটা কথা শুনে আশা চট করে বইটা বন্ধ করে উঠে পড়ল বিছানা থেকে। চরম অস্বস্তি নিয়ে বললো-‘খবরদার আমাকে নিয়ে এমন চিন্তা করবেন তো। আমি ওরকম আপডেটেড মেয়ে নই। আর তাছাড়া আপনার-আমার সর্ম্পক এরকম লুতুপুতুও নয়।সাবধান!’

আশা কথাটা বলে দ্রুত পায়ে বই নিয়ে নিচে চলে গেলো। বলা যায় না, কখন আবার অনিরূপ ঝাঁপিয়ে পরে ওর উপর! বলেছে, আর ছুবে না। কিন্ত বলা যায়না, অনিরূপ তো আবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে মাহির।
আশা চলে যেতেই, অনিরূপ মৃদু হেসে ভিডিওটা আবার ওপেন করল। ভালোই লাগছে দেখতে। আশাকে নিশ্চয় অনিরূপের শার্টে দারুণ মানাবে। অনিরূপ আশাকে ওই অবস্থায় কল্পনা করে মনেমনে দারুন মজা পেল। মনেমনে চিন্তাও করে ফেলল কিভাবে কাজ হাসিল করা যায়। কাজের মেয়েকে ডেকে কিছু একটা শিখিয়ে রাখলো! কাজের মেয়েও ভয়েভয়ে অনিরূপ যা বলল, তাই শিখলো! এখন বাকিটা কাজ করলেই চলে!

চলে জেল এক সপ্তাহ। আশা ওদিনের কথা প্রায় ভুলেই বসেছে। হয়তো পোউর আশা বুঝতে পারেনি, তার ভাগ্যে একজন চূড়ান্ত চালাক-বদবুদ্ধির স্বামী জুটেছে। যে এত সহজে আশার সামান্য ‘না’ তেই হাল ছেড়ে দিবে না অবশ্যই!
হঠাৎ সেদিন আশা দুপুরে গোসল করার জন্যে কাপড় নিবে, দেখে আলমারিতে কোনো শাড়িই নেই ওর। আশা অবাক হয়ে গেল একদম, এতগুলো শাড়ি কোথায় উধাও হয়ে গেল? আশা রুমের অন্যান্য ড্রয়ার খুঁজলো, কোথাও নেই কোন জামা বা শাড়ি। হতবম্ব আশা এবার পারুলকে ডাকল।
পারুল রুমে এসে দেখে আসা তন্নতন্ন করে ওর শাড়ি খুঁজছে। পারুলকে দেখে আশা আলমারি খুঁজতে খুঁজতে জিজ্ঞেস করল-

‘পারুল, আমার শাড়িগুলো দেখেছো?’
পারুল অনিরূপের এক সপ্তাহ আগে শিখিয়ে দেওয়া বুলি আউড়ে ভয়েভয়ে মাথা নাড়ল-‘ভাবী, আমি এগুলা মেশিনে দিয়া দিসি।’
আশার হাত থেমে গেল, অবাক হয়ে পারুলের দিকে চেয়ে বললো-‘সব শাড়ি?’
‘হা ভাবী। ময়লা লাগতেসিল সবগুলা, তাই।’
আশা মনেমনে বিরক্ত হলো। কিন্তু পারুলকে বিরক্তি না দেখিয়ে শান্ত গলায় বললো-‘পারুল, আমি প্রতিদিন আমার শাড়ি নিজে ধুয়ে দে। ময়লা কোথা থেকে আসবে? তাও সবগুলো? মেশিনে দেওয়ার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করবে না একবার?’

পারুল এবার কাঁদোকাঁদো গলায় বললো-‘মাফ করেন ভাবী। আমি বুঝি নাই।’
আশা থামে। পারুলের কান্না দেখে ও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তাই হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে-‘কাঁদছো কেন?আচ্ছা, তুমি যাও। আমি দেখছি কী করা যায়।
নিজের এত ভালো অভিনয় দেখে মনেমনে হেসে পারুল বেরিয়ে গেলো।
পারুল যেতেই আশা হতাশ হয়ে বসে থাকলো বিছানায়। এই শাড়িতে আজ মাছ রান্না করছে। গা থেকে মাছের আঁশটে গন্ধ আসছে, ছিঃ! গুলিয়ে আসছে গা আশার। কী করবে?

চিন্তায় আশা ভুলেই গেছে একপ্রকার, এসব কার পরিকল্পনা হতে পারে ভুলেই গেছে, এক সপ্তাহ আগে অনিরূপের সঙ্গে ওর কী বিষয়ে কথা হয়েছিল। আশা মনে করে, অনিরুপ বলে গেছে ও আজ রাতে আসবে। ততক্ষণে আশার কাপড়ও শুকিয়ে যাবে। এতক্ষণ এভাবে ময়লা শাড়িতে বসে না থেকে অনিরুপের কিছু পরে থাকা যাবে।
আশা তাই কিছু চিন্তা না করেই ভেজা শাড়িগুলো মেশিন থেকে বের করে বারান্দায় মেলে দিয়ে আসে। তারপর আলমারি থেকে অনিরূপের একটা ব্লু শার্ট, ট্রাউজার বের করে বাথরুমে চলে গেলো! গোসল করে বেরিয়ে বারান্দায় ভেজা টাওয়াল মেলতে গেলো! ব্যাস, কাজটা তখনই ঘটে গেলো। অনিরূপের মাত্রই রুমে এসে ঢুকল তখন।

‘ইউ আর লুকিং অ্যাট্রাকটিভ ইন ম্যাই শার্ট।’
অনিরূপের কণ্ঠস্বর শোনে, আশা চমকে পেছনে তাকালো। বারান্দার দেয়ালের মধ্যে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনিরূপ। ঠোঁটে অভদ্র একটা হাসি ঝুলিয়ে রাখা। শকুনি নজরে পরখ করছে আশার পুরো গা। লম্বা শার্টের হাতা ঝুলছে দুপাশে, আশা সেটাকে কোনরকমে ফোল্ড করলেই লাভ কিছু একটা হয়নু। ট্রাউজারটাও ফোল্ড করে রাখা। হাসলো অনিরূপ, পোউর-শর্ট আশার ট্রাউজার অনেকখানিই ফোল্ড করা লেগেছে।

আশা চূড়ান্ত অবাক, দুপুরে আজ আসার কথা ছিলো না অনিরূপের? বাইরে মিটিংয়ে খাওয়ার কথা ছিলো। এখন তাহলে এই সময়ে কেন?আশা থতমত খেয়ে শার্ট এর উপরের দুটো বোতাম লাগাতে লাগাতে অস্বস্তি নিয়ে বললো-
‘শা-শার্টটা- আমার শাড়িগুলো কে ভিজিয়ে ফেলেছে বাথরুমে। গরমে ভারী শাড়ি পড়ব, আপনি অপেক্ষা করুন। আমি শাড়ি রোদে দিয়েছি। শুকিয়ে গেলেই আমি শার্ট দিয়ে দিব আপনাকে।’

আশা তোতলাচ্ছে। মূলত অনিরূপের চোখ দেখে আশা ভয় পাচ্ছে। ওই দু চোখে আশা আবারো সেই রাতের নেশা দেখছে। আশা ভয় পায় ভীষণ এই নেশা, আশার মনে হচ্ছে তার মাথাটা ঘুরছে আবার। অনিরূপ ভ্রু বাঁকালো। এক পা-এক পা করে আশার দিকে এগিয়ে আসতে থাকল। আশা পেছালো সবসময়ের মতো। পিছিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকাতেই, অনিরুপ আশাকে দুহাতে নিজের মধ্যে বন্দি করে ফেললো। আশা ভ্রূ কুঁচকে অনিরূপের নেশালো চোখের দিকে চাইল। মনেমনে ভয়ে সেটিয়ে গেলেও, মুখে রাগ নিয়ে বললো- ‘দেখুন-আমি কিন্তু এসবের মুডে-‘
অনিরূপ হালকা হেসে আশার নাকে আঙুল ছুঁয়ে বললো-‘মুড বানানো লাগে না, মুড এসে যায়, অটো-আপনা আপনি।’

আশার বুক কাপছে! সুখে নয়, ভয়ে! ও অস্থির হাতে জোর করে নাকের উপর থেকে অনিরূপের আঙুল সরিয়ে দিতেই অনিরূপ তার ডানহাতে আশার দুহাত চেপে দেয়ালে ঠেসে ধরলো। অপরহাতে অনিরূপ আশার শার্টের বোতাম হাত ছুঁয়ে বরাবরের মতো অভদ্র সে হাসিখানা ছুঁড়ে ফিসফিস করে বললো-‘তোমার শাড়ি ভিজে নি। আমি-আমি অনিরুপ ইচ্ছে করে সব ভিজিয়ে ফেলেছি।’

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১৩

আশা ছুটাছুটি করছিল, অনিরূপের কথায় ওর ছটফটানি বন্ধ হয়ে গেলো, জিজ্ঞেস করল হতবম্ব হয়ে -‘কেন?’
অনিরূপের মুখ আশার মুখের সঙ্গে ছুঁইছুঁই! আশার দুহাত অনিরূপের শক্ত হাতে বন্দি। না পারছে নড়তে, না পারছে বাধা দিতে। আশার তেজ আবারো হারিয়ে যাচ্ছে। টলটলে হয়ে গেছে চোখ দু খানা। অনিরুপ শেষবারের ন্যায় ফিসফিসাল-‘আমি তোমাকে আমার শার্টে দেখতে চেয়েছিলাম। জেদ করেছিলে-জেদের ফলও পেলে।’

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১৫