আলোর ভীড়ে পর্ব ১২
ইশরাত জাহান অধরা
প্রিয়তা সোফায় বসে আছে।কিছুক্ষন আগেই বাসায় এসে জামা পালটে নিয়েছে সে।একটু পরেই ইনাম কিচেন রুম থেকে এক কাপ গরম আদা চা নিয়ে আসলো।প্রিয়তার দিকে বারিয়ে দিয়ে বলল খেয়ে নিতে।প্রিয়তা কোন কথা না বলে চুপচাপ কাপটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো।এক চুমুক দিতেই চোখ মুখ কুচকে ফেলল সে।প্রিয়তাকে চোখ মুখ কুচকাতে দেখে ইনাম জিজ্ঞেস করলো।
“কি হয়েছে?”
প্রিয়তা ইনামের দিকে তাকিয়ে বলল,
“চা তিতা হয়ে গেছে।”
“আদা চা!একটুতো তিতা হবেই!খেয়ে নাও।যেভাবে ঠান্ডা পানিতে গোসল আসছো জ্বর না যাতে উঠে সেজন্য চা দিয়েছি।এমনি এমনি দেইনি!”
ইনামের কথা শুনে প্রিয়তা চুপচাপ লক্ষী মেয়ের মতো পুরো টা শেষ করল।এমনেই মনে হয় ইনাম রেগে আছে ওর উপর।যে কাজ করেছে উনার জায়গায় যেকেও থাকলেই রেগে যেতো।ইনাম চায়ের কাপটা নিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আমি একটা কথা বুঝলাম না তুমি একা একা অইখানে গেলে কিভাবে?আমি তো ভাবছিলাম তুমি এখানে সেখানে ঘুরাঘুরি করে এসে পরবে।পরে গিয়ে দেখি তুমি রাস্তাই হারাই ফেলছো!আর গেছো তো গেছো এমন জায়গায় গেছো যেখানে মানুষের ছায়া অব্দি নেই!কিভাবে?”
“জানি না।আমি তো হাঁটছিলাম। হঠাত চারপাশে নিরিবিলি, কোন শব্দ শুনতে না পেয়ে আমার হুশ আসে।আর হুশ আসতেই দেখি আমি রাস্তার মাঝে চলে এসেছি।”
ইনাম ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কিভাবে হাঁটছিলে যে তোমার কোন হুশই থাকে না?”
“আমি তো আপনাকে গালি দিতে দিতে…”
নিজের ঠোট চেপে নিলো প্রিয়তা।কি বলতে যাচ্ছিলো সে?
ইনাম ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুমি আমাকে গালি দিচ্ছিলে?”
প্রিয়তা নিজেকে সামলে বলল,
“আমার জায়গায় যেকেও থাকলেই আপনাকে গালি দিতো!আপনি হাজবেন্ড হয়ে আপনার স্ত্রীকে বলছেন অন্য একজন ছেলে খুঁজে নিতে?আপনার স্ত্রীকে আপনি কি করে এই কথা বলতে পারেন?একবারও আপনার বুক কাঁপলো না?”
“তো?আমার বলাটা কি ভুল?আমি তোমাকে আমার স্ত্রী হিসেবে মানি না!”
প্রিয়তা মুখ ফুলিয়ে সোফা থেকে উঠে রুমের দিকে যেতে যেতে বলল,
“আপনি আমাকে স্ত্রী হিসেবে না মানলে আমাদের বিয়েটা অসত্যি হয়ে যাবে না!আপনার আমার বিয়ে কবুল পড়ে হয়েছে!কেও আপনাকে জোর করেনি কবুল বলার জন্য। আমিও আপনার পায়ে ধরিনি আমাকে বিয়ে করার জন্য।আপনি নিজ ইচ্ছায় কবুল বলেছেন।আপনি আমাকে স্ত্রী হিসেবে মানুন আর না মানুন বিয়েটাকে আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না!”
প্রিয়তা নিজের রুমে গিয়ে দরজা দিয়ে বিছানায় শুয়ে পরল।আর এদিকে ইনাম সোফায় বসে আছে।প্রিয়তা তো সত্যিই বলেছে ও যতোই মুখে বলুক অই মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে মানে না কিন্তু বিয়েটাকে তো ও অস্বীকার করতে পারবে না।সবার সামনে ওর মতামত নিয়েই বিয়েটা হয়েছে।কি করে অস্বীকার করবে সে?দুই হাত দিয়ে মাথার চুল খামচে নিচু হয়ে বসে রইলো ইনাম।ও কি ভুল করে ফেলেছে?ওর কি উচিত প্রিয়তাকে সব কথা খুলে বলার?সব কথা শুনে নিশ্চয়ই সে তার সাথে সংসার করতে চাইবে না!মানুষ সবসময় নিজের ভালোটা আগে বুঝে।তারপর বাকিদের বিষয় নিয়ে ভেবে দেখে।প্রিয়তাও নিশ্চয়ই নিজের কথাই আগে ভাববে!তার সাথে থাকতে চাইবে না!এমনও হতে পারে যে প্রিয়তা নিজ থেকেই ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিলো।অস্বাভাবিক কিছু তো আর না!হুম এটাই করা লাগবে।মেয়েটা ওর প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছে।আসক্তটা ভালোবাসায় রূপ নেওয়ার আগেই ওকে নিজের থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।যদ দ্রুত সম্ভব এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করা লাগবে ওর সাথে!ভেবেই নিজের মনকে শান্ত করলো সে।
প্রিয়তা রুম থেকে বেরুতেই আশেপাশে চোখ বুলালো।কোথাও ইনামকে দেখলো না।একটু এগিয়ে গিয়ে ইনামের রুমে উকি দিতেই দেখল পুরো রুম খালি!ওয়াশরুমে গিয়েছে বোধ হয় ভেবেই টেবিলের উপর থেকে গ্লাস নিয়ে জগ থেকে পানি ঢেলে পুরো পানি খেয়ে গ্লাসটা টেবিলের উপর রাখতে যেতেই সামনে খাবারের প্লেট দেখে থমকে গেলো।টেবিলে খাবার ঢাকনা দিয়ে ঢাকা কিন্তু ইনাম কোথায়?একটু ভালো করে খেয়াল করতেই দেখল নিচে একটা কাগজের মতো কিছু একটা রাখা।কি এটা?চিরকুট?কিন্তু কিসের?এগিয়ে গিয় কাগজটা হাতে নিয়ে মেলে চোখ বুলালো।
“আমি অফিসে চলে যাচ্ছি। তুমি ঘুম থেকে উঠে খাবার খেয়ে অফিসে চলে এসো।আমার জন্য অপেক্ষা করো না!আর আমি গাড়ির ড্রাইভার পেয়েছি।তাই আমার সাথে তোমার আর আশা যাওয়া লাগবে না।আমরা আগের মতো যে যেভাবে আসতাম যেতাম ঠিক সেভাবে আসব যাবো!”
চিঠিটা পড়েই প্রিয়তা ঠমকে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষন।লোকটা ড্রাইভার জোগাড় করলো কখন?একটা শ্বাস ফেলল।মাত্র কয়েকদিন ওরা একসাথে যাওয়া আসা করেছে।আগে তো যে যার মতোই যেতো তাহলে এরকম অনুভূতি হওয়ার মানে কি?ওর কষ্ট হচ্ছে কেন?অপমানবোধ থেকে নাকি ইনামের সাথে একসাথে একসাথে যেতে পারবে না বলে?কোনটা?কাগজটা রেখে টেবিলে খেতে বসে গেলো।খাবার শেষ করেই রেডি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
অফিসে প্রবেশ করতেই প্রিয়তার নজর গেলো ইনামের কেবিনের দিকে।পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিজের চেয়ারে বসে পরলো।কি করতে যাচ্ছিলো সে?যে লোকটা ওর কোন কেয়ার করে না, স্ত্রী হিসেবে মানে না সে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করছিলো?কেন?সকাল থেকে দেখেনি বলে?ও কেন লুকিয়ে দেখবে?কই ইনাম কি একবারও ওর সাথে বলেছে?নাকি দেখতে চেয়েছে তাহলে ও ই কেন?লোকটা ওকে কি ভাববে ছ্যাচড়া?উনি তো বিয়ের পরেই বলে দিয়েছিলো সবকিছু। সব জানার পরও এরকম ছ্যাচড়ামি করার মানে কি?দিন দিন তার এত অধঃপতন হয়ে গেছে?কবে হলো এতো অধঃপতন?কি করে হলো?সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে কাজে মনযোগ দিলো প্রিয়তা।
দুপুরে,
প্রিয়তা খাবার খেয়ে হাত ওয়াশরুম থেকে হাত ধুয়ে আসছিলো হঠাত ইনামকে দেখলো।ইনাম অন্যদিকে ফিরে আছে।অফিসের এক কলিগের সাথে কথা বলছে সে।কথা বলা শেষ হয়ে হাঁটতে যেতেই হঠাত মাথা ঝিম করে উঠলো।বাম হাত দিয়ে দেয়াল ধরার জন্য হাত বারাতেই হঠাত প্রিয়তা দৌড়ে এসে বলল,
“ঠিক আছেন আপনি?আবার মাথা ব্যথা করছে?”
প্রিয়তার কথা শেষ হতে হতে ইনামের মাথার ঝিম কিছুটা কমেছে।
“কি হলো?কিছু বলছেন না কেন?চলুন আপনাকে কেবিনে দিয়ে আসি!আপনি একা হেঁটে যেতে পারবেন না।”
বলেই ইনামের হাত ধরতেই ইনাম প্রিয়তার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আমাকে নিয়ে তোমার ওতো চিন্তা করতে হবে না!নিজেকে নিয়ে ভাবো।অন্যের বিষয়ে নাক গলাতে আসবে না।আর তুমি জানলে কিভাবে আমি একা হাঁটতে পারব না?আমার নিজের শক্তি আছে হাঁটার!নিজের সিটে যাও!”
বলেই কেবিনে চলে গেলো ইনাম।ইনামের কথাগুলা শুনে প্রিয়তা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।কথাগুলা এখনো কানে বাজছে প্রিয়তার।লোকটার হুট করে কি হলো?এমন ব্যবহার করছে কেন?গতকালকের ঘটনা নিয়ে কি রেগে আছে?নাকি অন্য কোন কিছুর জন্য?এশা দুর থেকে সবকিছু দেখে হাসলো।এগিয়ে গিয়ে বলল,
“কান্না করছো না কি?”
এশার কথা শুনেই প্রিয়তা তাকালো এশার দিকে।এশা হেসে বলল,
“আসলে ইনাম কোন মেয়েকে সহ্য করতে পারে না।তোমার মতো মেয়েকে তো দুই চোখে দেখতেই পারে না!তাই শুধু আদিখ্যেতা দেখাতে যেও না!ইনামের থেকে দুরে থাকবা!ও শুধু একটাই বন্ধু আর সেটা আমি।অইদিন মনে হয় রেগে ছিল তাই আমাকে বকেছিলো।আমি ওর কাছে অনেক স্পেশাল বুঝলে!তুমি আবার স্পেশাল হতে যেও না।স্টাফ স্টাফের মতোই থাকবা।”
আলোর ভীড়ে পর্ব ১১
প্রিয়তা আজ কোন উত্তর দেয়নি এশার। কি উত্তর দিবে ও তো একধরনের শকের মধ্যে আছে ইনামের ব্যাপারটা নিয়ে।বারবার ওকে চিন্তিত করে তুলছে।মস্তিষ্কের প্রায় সম্পূর্ণ জায়গায় এই বিষয়টা নিয়েই ঘুরপাক খাচ্ছে।চিন্তা করতে করতেই নিজের সিটে এসে বসলো প্রিয়তা।বসে একবার সামনে তাকালো। ইনামের কেবিনের দিকে।লোকটা ঠিক আছে তো?মাথা ব্যথা করছিলো উনার?উনি তো কোন উত্তরই দিলেন না।ইশ যদি গিয়ে দেখে আসতে পারতো তাহলে হয়তবা কিছুটা নিশ্চিন্তমুক্ত হতো।মনে এরকম হাজারও প্রশ্নের ভান্ডার নিয়ে সারাটাদিন কাটিয়ে দিলো প্রিয়তা।