আলোর ভীড়ে পর্ব ১৩

আলোর ভীড়ে পর্ব ১৩
ইশরাত জাহান অধরা

অফিস শেষে প্রিয়তা বাসায় ফিরছিলো।রাস্তাতে হেঁটে যাচ্ছে সে।বাম হাতের ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো রাত ৮টা বাজে।হঠাত পাশের একটা রেস্টুরেন্টে চোখ পরলো।রেস্টুরেন্টের গ্লাসে দেখা ইনামকে দেখে থমকে গেলো প্রিয়তার পা।

দেখে মনে হচ্ছে কারোর জন্য অপেক্ষা করছে।টেবিলের উপরে থাকা কফির মগে চুমুক দিচ্ছে আর কিছুক্ষন পর পর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে টাইম দেখছে বলেই এই ধারনা প্রিয়তার।ইনামের উপর থেকে চোখ সরিয়ে হাঁটতেই যাবে এমন সময় এশাকে রেস্টুরেন্টের ভিতর ঢুকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো প্রিয়তার।এশা এখানে কি করছে?তাড়াহুড়োয় প্রিয়তাকে নজরে পরেনি এশার।প্রিয়তা দেখতে পেলো এশা সরাসরি গিয়ে ইনামের টেবিলে ওর সামনে বসলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হাতে থাকা ব্যাগ সাইডে রেখে কি একটা যেনো বলছে।বাইরে থেকে শুনতে পারছেনা সে।কি বলছে ইনামকে?ইনামও মনযোগ দিয়ে সবটা শুনছে।তারমানে এতক্ষন এশার জন্যই অপেক্ষা করছিলো?ইনাম এশার কথা শুনে হেসে লুটিয়ে পরছে চেয়ারের উপর।বিরক্ত লাগছে প্রিয়তার।এখানে সে দাঁড়িয়ে আছে কেন আজব!ওদের রং তামাশা দেখতে?এখন নিজের উপর নিজেরই রাগ হচ্ছে প্রিয়তার।এতোটা বেহায়া কবে থেকে হলো সে?

কই আগে তো এত বেহায়া ছিলো না।যেখানে কেও কোন শব্দ করে কথা বললে নিজ থেকে কোনদিন কথা বলতো না যতক্ষন না অই ব্যক্তি ওর কাছে ক্ষমা চাইছে সেখানে ইনাম ওকে বিয়ের পর থেকে এত এত অপমান করে যাচ্ছে সে কেন মুখ বুজে সহ্য করছে সব?আশ্চর্য! ও কি অন্যান্য মেয়েদের মতো দিন দিন হয়ে যাচ্ছে?যাদের স্বামী চিট করার পরও সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে নেয়!

ওদের না হয় যাওয়ার জায়গা নেই কিন্তু ওর তো যাওয়ার জায়গা আছে।ও যদি সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে ওর বাবা মার কাছে চলে যায় তাহলে ওর বাবা মা সিউর ওকে আদর যত্নে গ্রহন করবে!তাহলে কিসের জন্য এখানে পরে আছে?হঠাত ইনামের কল আসায় ইনাম ফোন নিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো।প্রিয়তা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে এগিয়ে গেলো।বাস স্ট্যন্ডে এসে বেঞ্চে বসে আছে সে।এরমধ্যেই অনেকগুলা বাস ওর সামনে চলে গেলো।প্রিয়তার কেন যেন বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না।সে এক দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে।

“আরে!প্রিয়তা তুই এখানে একা বসে কি করছিস?”
হঠাত এমন কথায় চমকে সামনে তাকালো প্রিয়তা।সামনেই ইরাকে দেখে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরল সে।অবাক হয়ে বলল,
“তুই?তুই বাংলাদেশে আসলি কবে?”
“গতকালই কানাডা থেকে ফিরলাম।এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি।”
প্রিয়তা হেসে বলল,

“সেইম।”
“চল আমার বাসায় চল।বাসায় গিয়ে আড্ডা দেই।”
“নারে!আমাকে বাসায় ফিরতে হবে।তুই এক কাজ কর তুই আমার সাথে আয়!”
“যাওয়া যায়।”
প্রিয়তা হেসে ইরাকে নিয়ে বাসে উঠে পরলো।সিটে বসেই ইরা জিজ্ঞেস করলো,
“শুনলাম বিয়ে করেছিস!”

প্রিয়তা উপর নিচ মাথা নাড়লো।ইরা অবাক হয়ে বলল,
“বিয়ের কথা শুনে মুখ কালো করে ফেললি কেন?”
“আরে তেমন কিছু না।সারাদিন অফিস করে টায়ার্ড হয়ে আছি।”
ইরা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“কিন্তু তোর চোখ মুখ তো অন্য কথা বলছে!কিছু লুকাচ্ছিস আমার থেকে?”
প্রিয়তা থতমত খেয়ে গেলো।ইরা যে মেয়ে ওকে সব কিছু বললে নির্ঘাত বাবা মার কাছে বলে দিবে।তাই কথাটা ঘুরানোর জন্য বলল,

“তো দিনকাল কেমন যায়?”
“এইতো!”
“কানাডার লাইফটাকে মিস করছিস?”
ইরা হেসে বলল,
“কালকেই তো আসলাম।”
“অহ তাই তো!আংকেল আন্টির কি অবস্তা?”
ইরা একটা শ্বাস ফেলে বলল,

“ভালো না।আম্মুর পেটে পাথর হয়েছে।কিছুতেই অপারেশন করাতে চাইছে না।আমি জোর করে আজকে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসছি।কালকে অপারেশন।”
“কি বলিস?কয়টার দিকে অপারেশন?”
“সন্ধ্যার দিকে।”
“তাহলে তো ভালোই হলো।আন্টিকে গিয়ে দেখে আসতে পারব!”
“তুই যাবি?”
“হুম।হাসপাতালের ঠিকানাটা দে।”

লিফট থেকে নেমে বাসার সামনে এসেই ব্যাগ থেকে চাবির রিং বের করে দরজার আনলক করে দুজনে বাসার ভিতর ঢুকলো।ইরা আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
“এই তোদের বাসাটা তো সেই!কি সুন্দর করে সাজানো!”
বলতে বলতেই সোফায় বসলো।প্রিয়তা ও পাশে এসে বসে বলল,
“কি খাবি বল?রাতের ডিনারটা এখান থেকে করে যা।”

“আমি ডিনার করে ফেলেছি।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বলল,
“করে ফেলেছিস মানে?কখন?”
“আরে আসার সময়ই!”
“তাহলে তুই বস আমি কফি বানিয়ে আনছি।কফি খাস তো!”
ইরা বাধা দিয়ে বলল,
“আরে আমি কিচ্ছু খাবো না!তুই বস এখানে।”
“কিছুতো খা!পানি হলেও খা।”
ইরা প্রিয়তার হাত ধরে টেনে পাশে বসালো।ব্যাগ থেকে কয়েকটা ক্যান বের করল।প্রিয়তা অইগুলার দিকে তাকিয়ে বলল,

“এগুলা কি?”
ইরা হেসে বলল,
“বিয়ার আর ওয়াইন।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বলল,
“তুই এগুলা খাস?”
“আরে বিদেশে থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে গেছে।”

সামনের টেবিল থেকে দুইটা গ্লাস নিয়ে একটা ওয়াইনের ক্যাপ খুলে দুই গ্লাসে ঢাললো।মুহুর্তেই দুই কাঁচের গ্লাস ওয়াইনে ভরে গেলো।মনে হচ্ছে গ্লাসে কেও রক্ত রেখে দিয়েছে।ইরা প্রিয়তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“নে টেস্ট করে দেখ!”
প্রিয়তা নাক মুখ কুচকে বলল,

“ছিহ ছিহ!আমি এসব খাই না।”
“আরে একটু খেয়ে দেখ!”
“বললাম তো খাবো না।”
“বুঝেছি এখন তুই আর আমাকে বন্ধু ভাবিস না।”
“আরে অইরকম কিছুই না।”
“তাহলে খা!জাস্ট এক গ্লাস!”
“শুধু এক গ্লাস কিন্তু!”
“হ্যা হ্যা।আমি আর তোকে জোর করব না।”

প্রিয়তা কিছুক্ষন গ্লাসের দিকে তাকিয়ে রইল।ইরা হাতে একটা গ্লাস ধরিয়ে দিতেই প্রিয়তা নাক দিয়ে শুকেই মুখ সরিয়ে ফেলল।কি গন্ধ!ইয়াক!
“কি হলো?গন্ধ শুকছিস কেন?খা!”
প্রিয়তা গ্লাসটা সামনে নিয়ে এক হাত দিয়ে নিজের নাক চেপে ধরল। এক ঢোকে পুরো গ্লাস শেষ করেই কাশতে লাগলো।ইরাও নিজের গ্লাসেরটা শেষ করে টেবিলের উপর রাখতেই দেখল প্রিয়তা এর মধ্যেই একটা বিয়ারের ক্যান খাওয়া শুরু করেছে।পুরো ক্যানটা শেষটা করে আরেকটা ক্যান হাতে নিতেই ইরা বাধা দিয়ে বলল,
“আর খাইস না বইন।এতগুলা একসাথে কেও খায় না।মারা যাবি!”
প্রিয়িতা ইরার হাত ঝেড়ে ফেলে বলল,

“আর একটু খাই।খেলে কিছুই হবে না।”
বলেই ক্যানটা মুখে নিলো।ইরা নিরুপায় হয়ে প্রিয়তার খাওয়া দেখছে।এখন নিজেকে নিজের চড়াইতে মন চাচ্ছে।কোন দুঃখে সে প্রিয়তাকে খেতে বলল?এরমধ্যেই ইরা অনেকবার থামানোর চেষ্টা করেছে।কিন্তু প্রিয়তা কোন কথা শুনেনি।ও ওর মতোই খেয়েই যাচ্ছে।টেবিলের উপরের সব বোতল শেষ করে সে এখন সোফায় বসে ঝিমাচ্ছে।ইরা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত ১০ টা বাজে।এখন তো ওর বাসায় যাওয়া লাগবে।কিন্তু এই অবস্তায় কিভাবে বাসায় যাবে সে?প্রিয়তাকে এভাবে রেখে যাওয়াটা ঠিক হবে না।কিছু একটা ভেবে ইরা প্রিয়তাকে বলল,

“ঘুম পাচ্ছে তোর?”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে বলল,
“হুম।”
“তাহলে রুমে গিয়ে ঘুমা।”
প্রিয়তা বসা থেকে ঢুলতে ঢুলতে উঠে দাঁড়ালো।কিছুদুর এগিয়ে সামনে দুইটা রুম দেখে বলল,
“আমার রুম কোনটা?আমি তো চিনতেই পারছিনা।”
প্রিয়তার কথা শুনে ইরা অবাক হয়ে বলল,
“তোর রুম মানে?”

কিছু একটা মাথায় আসতেই বলল,
‘তোরা দুজন আলাদা রুমে ঘুমাস?”
প্রিয়তা চোখদুটো খোলার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছেনা।তাই দুই হাত দিয়ে চোখ দুটো টানটান করে ধরে হেসে বলল,
“পেয়ে গেছি।”
ঢুলতে ঢুলতে রুমের ভিতর গিয়ে সোজা বিছানায় শুয়ে পরল হাত পা ছড়িয়ে।ইরা রুমে এসে প্রিয়তাকে বলল,
“কিরে বল?তোরা আলাদা রুমে থাকিস?”
কিন্তু প্রিয়তা কোন উত্তর দিলো না।সে এখন ঘুমে বিভোর হয়ে আছে।ইরার কোন কথাই তার কানে যাচ্ছে না।

ইনাম বাসায় ঢুকেই পুরো রুম অন্ধকার দেখে ভ্রু কুচকালো।রুম এমন অন্ধকার হয়ে আছে কেন?প্রিয়তা কি আসে নাই এখনো?কিন্তু না আসলে দরজার লক কে খুললো?দরজা তো খুলাই ছিলো!লাইট জ্বালিয়ে নিজের রুমে গিয়ে হাতের ঘড়ি খুলে টেবিলের উপর রাখলো।গায়ে থাকা ব্লেজারটা খুলে চেয়ারের উপর রেখে টাই খুলতে খুলতে প্রিয়তার রুমে গিয়ে লাইট জ্বালাতেই দেখল প্রিয়তা ঘুমাচ্ছে।ইনাম অবাক হলো।

এত তাড়াতাড়ি তো প্রিয়তা ঘুমায় না।তাহলে আজ এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরার কারণ কি?টায়ার্ডে জন্য?হ্যা এটাই হবে।আর কি কারন থাকবে?লাইটের সুইচ আবার অফ করে নিজের রুমে চলে আসলো।টাই খুলে শার্টের হাতার বোতাম খুলতে খুলতে কাবার্ড থেকে একটা টিশার্ট আর টাউজার বের করলো।পকেটে থেকে মোবাইল আর মানিব্যাগ বের করে টেবিলের উপর রেখে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আজকে অনেক গরম পরেছে।শাওয়ার নেওয়া দরকার!
প্রিয়তার ঘুমের মধ্যে অনেক পানির পিপাসা পেয়েছে।ও চোখ দুটোকে খুলতে চাইছে কিন্তু পারছে না।চোখ বন্ধ রেখেই শুয়া থেকে উঠে বসল।ধীরে ধীরে ডাইনিং ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।ফ্রিজ থেকে একটা বোতল বের করে পানি খেয়ে আবার ফ্রিজে রেখে হাঁটতে হাঁটতে নিজের রুমে এসে শুয়ে পরল।

আলোর ভীড়ে পর্ব ১২

ইনাম শাওয়ার শেষে তোয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বারন্দায় গিয়ে ভিজে তাওয়াল ছড়িয়ে দিয়ে এসে ডাইনিং রুমে এসে এক গ্লাস পানি খাওয়ার জন্য গ্লাসে পানি ঢেলে খেতে খেতে ড্রয়িংরুমের দিকে চোখ গেলো ইনামের আবছা আলোয় সোফার মধ্যে এক গাছা চুল দেখে ভয়ে কেঁপে উঠল ইনাম।প্রিয়তা তো রুমে ঘুমাচ্ছে।তাহলে সোফায় কে শুয়ে আছে?গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে ড্রয়িং রুমে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে সোফার কাছে আসতেই দেখলো….

আলোর ভীড়ে পর্ব ১৪