বিয়ে থা পর্ব ৩৫
তাহিনা নিভৃত প্রাণ
বিয়ের অনুষ্ঠানের পর ছোট করে একটি বৌভাতের অনুষ্ঠান করা হলো। রমজান শেখ ও মিথিলা আসলেন না। ডাক্টারের কাছে যেতে হবে তাদের। তারপরই সব আত্মীয় স্বজন বিধায় নিলেন। ধারার ভাইয়েরাও বিদেশে চলে গেলেন। সুমিত্রাও ফিরে গেছে ইন্ডিয়ায়।
সময় দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে নিনীকার। তার পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ হয়েছে। আগামীকাল তাকে ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। এদিকে ধ্রুবর ও ছুটি শেষ। ফারিনের এসএসসি পরীক্ষা চলছে।
সময়টা রাত দশটা। খেয়ে ধ্রুব একটু বেরিয়ে গেছে। ঘরে নিনীকা একা। এই কয়েকটা দিন তার স্বপ্নের মতো কেটেছে। ধ্রুবের হাতে হাত রেখে কতো জায়গায় ঘুরেছে। রাতের আঁধারে নির্জন রাস্তায় হেঁটেছে। লং ড্রাইভে গিয়েছে। দিনশেষে একে অপরের উষ্ণতায় ডুবে থেকেছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এবার তাদের সাময়িক সময়ের জন্যে আলাদা হতে হবে। নিনীকা ভাবলো, সে না-হয় কয়েকদিন পর পরীক্ষার পাঠ চুকিয়ে নেবে, কিন্তু ধ্রুব! তার যে চাকরিটাই এমন, সারাজীবনই কি সে পরিবার ছেড়ে ওখানে এখানে ঘুরবে?
ধ্রুব ফিরলো এগারোটা নাগাদ। হাতে প্যাকেট করে আনা ফুচকা। ছোট্ট টেবিলে রেখে বউকে জড়িয়ে ধরলো।
‘ ফুচকা এনেছি। ‘
নিনীকা নিজেকে ছাড়িয়ে নিচে চলে গেলো। প্লেট নিয়ে আসার সময় ডেকে এলো ফারিনকে। ফারিন এলো। চোখের নিচে কালো দাগ। বেচারি রাত জেগে পড়ে। নিনীকা টেনে বিছানায় বসালো। ফুচকা সামনে দিয়ে বলল,
‘ খেতে শুরু করো। কি অবস্থা করেছো নিজের বলো তো? সুস্থ না থাকলে কিভাবে হবে? ‘
ফারিন হেসে খেতে শুরু করলো। ধ্রুব গালে হাত দিয়ে বউ ও বোনকে দেখছে। নিনীকা ঠেসে একটি ফুচকা ঢুকিয়ে দিয়েছে তার মুখে। বহু কষ্টে সে সেটা গিললো। বলল,
‘ অনেক টক। ‘
ফারিন চোখ বন্ধ করে গপাগপ খাচ্ছে।
‘ তুমি এর স্বাদ কি বুঝবে? মেয়েদের ইমোশন এটা। ‘
‘ খেয়ে বের হো। ‘
ফারিন ঠোঁট বাকালো,
‘ যাবো না, ভাবি আমার বই খাতা নিয়ে আসো তো। এখানেই পড়বো আজ। এখানেই ঘুমাবো। তোমার হাসবেন্ডকে বলো আমার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়তে। ‘
ধ্রুবর মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। নিনীকা সত্যি সত্যি উঠে দাড়িয়েছে। ধ্রুব টেনে ধরলো হাত।
‘ খাওয়া শেষ করো তাড়াতাড়ি, তারপর এই শয়তানকে বের করো রুম থেকে। ‘
ফারিন নিনীকার আরেক হাত টেনে ধরলো।
‘ ভাবি তুমি প্লিজ বই খাতাগুলো নিয়ে এসো। ‘
ধ্রুব ফারিনের হাত থেকে বউকে ছাড়িয়ে প্রায় জড়িয়েই ধরেছে।
‘ আমার বৌ থেকে দূরে থাক। খেয়ে বিদেয় হো, তোর না পরীক্ষা? ‘
‘ তো? আগামীকাল ভাবি চলে যাবে, তার সাথে সেজন্য আজ আমি থাকতে চাই। ‘
ধ্রুবের মুখ দেখার মতো হলো। বোনের সামনে এর বেশি নির্লজ্জ হওয়া সম্ভব না। এখন শেষ ভরসা নিনীকা। যাকে সে শক্ত করে ধরে রেখেছে। একদম বের হতে দিবে না।
ফারিন ঠোঁট চিপে হাসছে,
‘ তুমি ভাবিকে ছাড়ছো না কেন? ‘
নিনীকা এই দুজনের টানাটানিতে বিরক্ত হলো। নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো, কিন্তু ধ্রুব আরও শক্ত করলো বন্ধন। নিনীকা আস্তে করে বলল,
‘ বোনের সামনে এমন নির্লজ্জ আচরণ করছেন কেন? কি ভাববে সে? ‘
ধ্রুব ও আস্তে করে উত্তর দিলো,
‘ বউয়ের সাথে এবারের মতো আজই আমার শেষরাত, তোমার বোঝা উচিত মিসেস। ‘
নিনীকা শরীরে অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করলো। কয়েকদিন তার মেয়েলি প্রব্লেমের কারণে ধ্রুব তার কাছাকাছি আসেনি। বুকে জড়িয়ে রেখে ঘুমাতো আর বলতো,
‘ তোমার এই প্রব্লেমটা আসার আর সময় পায়নি? ‘
নিনীকা হেসে ফেলতো। মানুষটা এতো পাগল।
ফারিন ফুচকা খেয়ে শেষ করে বলল,
‘ যা-ও এইবার চলে যাচ্ছি, নেক্সট টাইম থেকে আর ছাড়বো না ভাবিকে। ‘
ধ্রুব শব্দ করে দরজা বন্ধ করেছে। নিনীকা মুখে হাত রেখে হাসছে। ধ্রুব ঠেলে ছুঁড়ে ফেললো বিছানায়। নিজের সমস্ত ভর ছেড়ে দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলো গাল,
‘ খুব মজা নেওয়া হচ্ছিল? ‘
নিনীকা ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়িয়ে না করলো। ধ্রুব কাত হয়ে সরে গেলো। মিছিমিছি চোখ বন্ধ করে ঘুমের অভিনয় করছে। নিনীকা বুঝতে পেরে ঠেলে সোজা করলো। বুকে কনুই ঠেকিয়ে রেখে বলল,
‘ ওতো রাগ করছো কেন? আমি তো জানতাম ও মজা করছে। ‘
ধ্রুব সাড়া দিলো না। নিনীকা আবার বলল,
‘ তুমি কতোদিনের জন্য চলে যাচ্ছো বলো তো, আমি থাকবো কিভাবে? ‘
‘ কথা বলবে না? আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে? ‘
ধ্রুব ফট করে চোখ মেলে তাকালো। তাদের সংসারের একমাস পূর্ণ হয়েছে। একমাস! আগামীকাল নিনীকাকেও হোস্টেলে দিয়ে তাকে রওনা হতে হবে কাজে। তবে সে অনেক কিছু গুছিয়ে নিয়েছে। নিনীকাকেও বলা হয়নি।
‘ এর পরের বার থেকে ঢাকাতেই সব হবে। পোস্টিং যেখানেই হোক তুমি সাথে যাবে। ‘
নিনীকার মুখ উজ্জ্বল হলো। ফট করে চুমু খেলো ঠোঁটে।
‘ আগে বলো-নি কেন গো? ‘
ধ্রুবের মুখ থেকে অভিমানের চাপ সরে গেলো। হাতের বন্ধন শক্ত করলো।
‘ তুমি কাছে থাকলে আমার এতকিছু মনে থাকে না। ‘
নিনীকা গাল টেনে দিলো,
‘ অভিমান ও করতে জানেন আপনি? ‘
ধ্রুব হাসছে,
‘ কেন ওটা কি শুধু মেয়েরা করে নাকি? ছেলেরা করতে পারে না? ‘
নিনীকা উন্মুক্ত বক্ষে ঠোঁট ছুইয়ে মুখ গুঁজলো।
‘ আমার অভিমান করা ধ্রুব, মেয়েদের অভিমানী বলা হয়। তোমাকে কি বলবো? অভিমানা? ‘
পরদিন সকালে নাস্তা করেই রেডি হতে হয় তাদের। নিনীকা সবার থেকে বিদায় নিলো। ধারা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলেন কিছুক্ষণ। একসময় যে মেয়েটির সাথে ঝগড়া করার জন্যে ছেলের বউয়ের অভাববোধ করছিলেন সেই মেয়েটিই তার ছেলের বউ আজ। এবং আজ তিনি মেয়েটিকে ভালোও বাসেন।
নিনীকা আহ্লাদী কন্ঠে ডাকলো,
‘ মা…’
ধারা কপালে আদর দিলেন,
‘ ভালো করে পরীক্ষা দিও, পরীক্ষা শেষ হলে তোমার তো কিছুদিন বন্ধ থাকবে তাই না? তোমার শ্বশুর মশাইকে পাঠিয়ে দিবো নিয়ে আসবে না-হয়। বাড়িটা ফাঁকা ফাকা লাগবে এখন। কেন এসেছিলে মায়া বাড়াতে? ‘
নিনীকার চোখ ছলছল করলো। সবাই এতো ভালো কেন?
ফাহিম মাহবুব তার দজ্জাল চেহারার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ আমার পুত্রবধূকে সহিসালামতে পৌঁছে দিবে। তার যেনো কোনো অসুবিধা না হয়। ‘
ধ্রুব মাথা নাড়ালো। ধারা ছেলেকে নিচু হতে বললেন। ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে মাথা নিচু করলো। কপালে ভেজা একটি আদর টের পেলো। বহুদিন পর মায়ের আদর পেয়ে তার মুখে হাসি ফুটলো। চাকরির পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে মাকে তেমন সময়ই দিতে পারেনি সে। কোথায় যে এই আদর গুলো চাপা পড়ে গেছিল কে জানে। ধ্রুব মাকে জড়িয়ে ধরেছে।
‘ এইবার সবকিছু চুকিয়ে আসবো বুঝলে। তোমাকে আর ছেলের প্রতিক্ষায় দিন গুনতে হবে না। ‘
ধারা আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিলেন।
‘ মিশনে গেলে সাবধানে থেকো বাবা, দেশের কাজ করার জন্যে অনেক মেজর আসবে যাবে। কিন্তু তোমার মায়ের একমাত্র ছেলে হারিয়ে গেলে আর ফিরে আসবে না। ‘
ধ্রুব অভয় দিলো।
‘ আমি সাবধানে থাকবো মা, চিন্তা করো না। ‘
ফারিনের পড়োনে স্কুল ড্রেস। ভাই ভাবিকে বিদায় দিয়ে বাবাকে নিয়ে পরীক্ষার হলের উদ্দেশ্যে বের হবে সে।
নিনীকা ফারিনকে জড়িয়ে ধরলো,
‘ ভালো করে পরীক্ষা দিও। নিজের ও মা বাবার খেয়াল রেখো। ‘
বিয়ে থা পর্ব ৩৪
সবশেষে ফাহিম মাহবুবের থেকে বিদায় নিয়ে দুজন জিপ গাড়িতে উঠে বসলো। নিনীকা ধ্রুবর চোখ থেকে গগলস নিয়ে নিজের চোখে পড়ে নিলো। পড়োনে তার সাদা শার্ট, গলায় ছোট্ট স্কার্ফ। লং একটি স্কার্ট ও পড়েছে। ধ্রব আড়চোখে তাকিয়ে বউ কথা কও অতিক্রম করতে করতে বলল,
‘ সেই প্রথম মুখোমুখি হবার দিনের মতোই তোমাকে সুন্দর লাগছে। আজ স্কার্ট উপরে তুলে দৌড় দিবে না? ‘
নিনীকা বাহুতে ঘুষি দিলো,
‘ বদমাইশ মেজর। ‘