বিয়ে থা পর্ব ৩৬
তাহিনা নিভৃত প্রাণ
একটানা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে এসে কাউন্সিলিং করেছেন রমজান শেখ। আজ শেষ দিন। মিথিলা ও রমজান শেখ ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছেন। সাইকিয়াট্রিস্টের নাম রুহুল আমিন। চোখের চশমা ঠিক করে রমজান শেখের দিকে তাকালেন। কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে বললেন,
‘ কেমন আছো ইয়াং ম্যান? ‘
রমজান শেখ এই একমাস যাবত অনেক বার মধ্যবয়সী এই লোকের ভুলটা ধরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি মানতে নারাজ হয়তো। সেজন্য বার-বার ইয়াং ম্যান বলেই ডাকেন। রমজানের মুখে হাসি। তার ভেতর এখন পানির মতো সহজ সরল। বললেন,
‘ আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? ‘
রুহুল আমিন উত্তর দিলেন। তারপর ঔষধ পত্র নাড়াচাড়া করলেন কিছুক্ষণ। ফের প্রশ্ন করলেন,
‘ আজকাল কেমন ফিল করো? ‘
‘ ভালো, আমি নিজের মধ্যে সেই পুরনো আমিকে খুঁজে পাই। ‘
‘ ভেরি গুড। আজকের পর থেকে তোমাকে আর আসতে হবে না। এবং এসব ঔষধপত্র ও খেতে হবে না।শুধু কয়েকটা ঔষধের নাম বলে দিবো। ওগুলো মস্তিষ্ক ঠান্ডা রাখবে তোমার। আর তোমার ডায়বেটিসের ঔষধ গুলো তো আর সারাজীবনই খেতে হবে। হা হা। ‘
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রমজান শেখ মাথা নাড়ালেন। ডক্টর আবার বললেন,
‘ তুমি অনেক জটিল পেশেন্ট ছিলে। বাট আ’ম সাকসেস না-ও। একটু বাহিরে অপেক্ষা করবে? তোমার স্ত্রীর সাথে আমি একটু কথা বলবো। ‘
রমজান শেখ বের হয়ে গেলেন। মিথিলা হেসে বললেন,
‘ বলুন ডক্টর, কি বলবেন? ‘
‘দেখুন মিসেস শেখ আমি আপনাকে পার্সোনাল কিছু প্রশ্ন করবো। আপনার হাসবেন্ড স্বামী স্ত্রীর বিশেষ মুহুর্তে কি আগের মতো হিংস্রতা প্রকাশ করেন? বা আগের মতো কোনো কর্মকাণ্ড করেন? যেটা করলে আপনার মনে হতো সে নিজের রাগ মেটাচ্ছে। ‘
‘ না। সে আর এরকম করে না। আমাকে ছুলেও এমন ভাবে ছুয় যেনো আমি একটি নরম পুতুল, সে একটু জুড়ে চাপ দিয়ে ধরলেই ব্যথা পেয়ে কেঁদে ফেলবো। মানুষটার অনেক উন্নতি হয়েছে। অনেকবার কেঁদে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। নিজের মেয়ের কথা আজকাল বেশি বলে। মেয়েকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইবে। ‘
‘ দ্যাটস গুড। হি ইজ ফুল ফিট। বাট রিমেম্বার, সে যেনো এরকম আঘাত আর কখনো না পায়। সামান্যতম মনকষ্ট হলে তার ব্রেনে ইফেক্ট পড়বে মারাত্মক ভাবে। তাকে সর্বদা হাসিখুশি রাখতে চেষ্টা করবেন। তার সাথে কেউ যাতে কখনো রেগে বা আঘাত দিয়ে কথা না বলে সেটার খেয়াল রাখবেন। তাকে কোনোভাবেই উত্তেজিত যাতে করা না হয়। সবাইকে বলবেন তার সাথে সফট ও নরম স্বরে কথা বলতে। ‘
মিথিলা হাসিমুখে বেরিয়ে গেলেন। রমজান শেখ হাত ধরে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন,
‘ কি বললো? ‘
‘ শেখ বাবু ফুল ফিট। ‘
‘ সত্যি? ‘
মিথিলা বাহুতে মাথা রাখলেন,
‘ সত্যি গো, তুমি সুস্থ পুরোপুরি। ‘
বন্ধ চোখজোড়ায় জানালার ফাঁক গলিয়ে অল্প আলো পড়তেই নিনীকা পিটপিট করে তাকালো। চোখের নিচে কালো দাগ স্পষ্ট। মাথা ভারী হয়ে আছে। মুখে দুঃখের চাপ। নিনীকা দূর্বল শরীর টেনে উঠে বসলো। গতকাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে তার। রুমমেট দুজন গতকালই বাড়ি চলে গেছে।
নিনীকা মোবাইল হাতে নিলো। ধ্রুবর দুটো মিসকলড। কল দিতেই রিসিভ করলো। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
‘ ঘুম ভেঙেছে তোমার মিসেস? ‘
ধ্রুব ভোর থেকে সকাল দশটা পর্যন্ত পার্সোনাল মোবাইল অন করে রাখে। এ সময়ের মধ্যেই নিনীকা ও বাড়িতে কথা বলে নেয়। নিনীকা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ হু..। ‘
‘ তোমার কি মন খারাপ? ‘
‘ না ‘
ধ্রুবর চিন্তিত স্বর,
‘ তবে মুখ শুকনো যে? ‘
‘ অডিও কলে কিভাবে দেখলে?
‘ আমি গলার স্বর শুনে বুঝতে পারি। তাছাড়া তুমি কয়েকদিন ধরে ভিডিও কলে কথা বলতে রাজি হচ্ছো না, বললেও এড়িয়ে যাচ্ছো। কেন বলো তো? আমার কি তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না? ‘
‘ স্যরি। ‘
‘ তোমার কি হয়েছে বলবে? আমার দ্বারা কি কোনো ভুল হয়েছে? ‘
‘ না গো। ‘
‘ নিনীকা! প্লিজ বলো কি হয়েছে তোমার? ‘
নিনীকা ভেজা কন্ঠে বলল,
‘ তুমি কি আসবে? আমার তোমাকে প্রয়োজন। ‘
ওপাশ থেকে কিছু সময় ধ্রুব কোনো কথা বললো না। সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত? বা এমন কিছু যা মনে লুকিয়ে রেখেছো? ‘
নিনীকা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো,
‘ আমি..আমি তোমাকে ফোনে বলতে পারবো না। তুমি এসো, একবার এসো প্লিজ। ‘
নিনীকার কন্ঠে অসহায়ত্ব। ধ্রুবর বুক চিনচিন করে উঠলো। কি হয়েছে তার মিসেসের?
‘ আমি চেষ্টা করবো মিসেস। তুমি কেঁদো না তো, প্লিজ ভিডিও কলে আসবে? ‘
নিনীকা কল কেটে ভিডিও কল করলো। স্কিনে ভেসে উঠলো আর্মির ইউনিফর্ম পড়া ধ্রুবর মুখ। ক্লিন শেভ করা মুখটায় চিন্তিত ভাব। নিনীকাকে গভীর চোখে দেখলো ধ্রুব। কিছু মুহুর্ত পর বললো,
‘ চোখের নিচে কালো দাগ, চোখমুখ শুকনো। তুমি তো নিজের প্রতি যত্নবান মিসেস। তবে এগুলো কি? রাত জাগো? কিন্তু কেন? ‘
‘ওই পরীক্ষা ছিলো…’
‘ মিথ্যা বলো না, সত্যিটাই শুনতে চাই। ‘
নিনীকা মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললো।
‘ তুমি এসো প্লিজ, আমি পারছি না। ‘
ধ্রুবর চোখ টলমল করছে। আশ্চর্য সে কেঁদে ফেলবে নাকি? এমন তো আগে ছিল না, এতো নরম হলো কবে সে! শুধু বললো,
‘ অপেক্ষা করো মিসেস। ‘
ধ্রুব এরপর দু’দিন কোনো যোগাযোগ করলো না। নিনীকা ফোন দিয়ে ও বন্ধ পেলো। তার নিজের উপর রাগ হলো। মানুষটা অতদূরে নিশ্চয়ই তার হেয়ালিতে রেগে গেছিলো সেদিন।
নিনীকার ভাবনা মিথ্যা করে দিয়ে তিনদিনের মাথায় হোস্টেলের সামনে এসে থামলো একটি জিপ গাড়ি। ধ্রুব চোখের গগলস খুলে দারোয়ানকে বলল,
‘ নিনীকা নামে একজন ছাত্রী আছে, তাকে বলবেন ব্যাগপত্র গুছিয়ে একেবারে নিচে নেমে আসতে। যদি বলে কেন, তবে বলবেন কেউ তাকে নিতে এসেছে। ‘
দারোয়ান মাথা নাড়িয়ে চলে গেলেন। নিনীকাকে কথাটা বলতেই সে চমকে গেলো। তাকে কে নিতে আসতে পারে আন্দাজ করতে পারলো না। তবে ধারা বলেছিলেন তাকে নেওয়ার জন্যে ফাহিম মাহবুবকে পাঠাবেন। অভিমানে নিনীকার ঠোঁট বেঁকে গেলো। ফুপাতে ফুপাতে ব্যাগপত্র গুছালো। গায়ে চাপালো একটি ফতোয়া ও জিন্স। চুলগুলো কোনোরকমে জুটি করে বেঁধে ট্রলি নিয়ে ছুটলো নিচে।
নিচে এসে যখন আশেপাশে ফাহিম মাহবুব কে খুঁজলো তখন চোখের সামনে দেখা দিলো চিরপরিচিত জীপগাড়ি। নিনীকার মুখ থেকে ধীরে ধীরে অভিমান সরে গেলো। ধীর পায়ে এড়িয়ে এসে বসলো জীপে। পেছনে ব্যাগপত্র রাখলো। ধ্রুব এতোক্ষণ নিরবে তাকেই পর্যবেক্ষণ করেছে। নিনীকা কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চেষ্টা করলো। ধ্রুব তার আগেই টেনে নিলো। বুকে জড়িয়ে মুখ গুঁজলো নরম অঙ্গে। নিনীকার শরীর কেঁপে উঠছে মাঝে মধ্যে। ধ্রুব পিঠে হাত ভোলাচ্ছে।
‘ এতো কান্না কিসের? এসেছি তো। ‘
নিনীকা অনেক পর থামলো। মুখ তুলে তাকালো পিটপিট করে। ধ্রুব দু’হাতের ভাজে মুখ নিয়ে ঠোঁটে দীর্ঘ চুম্বন করলো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে হাসলো।
‘ আমাকে পাগল করে দিবে তুমি। ‘
নিনীকা ধ্রুবকে অবাক করে দিয়ে গলায় মুখ গুঁজে নিজের কাজে ব্যস্ত হলো। ধ্রুব অবাক হতে গিয়ে হেসে ফেললো। হাতের বন্ধন শক্ত করে বলল,
বিয়ে থা পর্ব ৩৫
‘ আমরা রাস্তায় মিসেস। একটু দূরে হোটেল বুক করেছি। বেশি সময় লাগবে না, চলো যাই? ‘
নিনীকা শুনলো। অভাবেই পড়ে রইলো ধ্রুবের কোলে বসে কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে। হাত দু’খানা গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ধ্রুব ওভাবেই জীপ টান দিলো। যেতে যেতে বউকে দেখতে গিয়ে মনের মধ্যে চিন্তারা বাসা বাঁধলো। তার মিসেসের কিছু তো একটা হয়েছেই!