যাতনা আমার পর্ব ৪

যাতনা আমার পর্ব ৪
সানজিদা ইসলাম সূচনা

শহরতলী থেকে অনেকটা দূরেই মির্জা বাড়ির স্থান। নির্জন শান্ত পরিবেশ চারিদিকে। নেই কোনো গাড়ির হর্ণ, কোলাহল পরিবেশ। সচারাচর শুনা যায় সেটা। আয়েশা মির্জার স্বামী খুব সখ করেই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। বাড়ির ব্যবসা বাণিজ্য শহরমুখী, যাতায়াতে সমস্যা হলেও তারা মির্জা বাড়ি ছাড়া আলাদা থাকার কথা বলেনা। কাজ শেষে সবাই ফিরে আসে শান্তি নীড়ে। এই শান্তি নীড় যেন একটা অশান্তিতে পরিনত হয়েছে।

এমনটাই মনে করেন আয়েশা। গত নয়টা মাস বাড়িটা যেন পাতালপুরীতে ডুবে গেছে। কেউ কারও সাথে কথা বলে না। হয় না এক সাথে খাওয়া দাওয়া। সবাই যেন সেই নয় মাস আগেই পরে আছে। সবকিছুরই মূল যেন ইনায়া। এটাই মনে হয় আয়েশা মির্জার। সোহানার আদিখ্যেতার জন্য চুপ করে যান। মাঝেমধ্যে ইনায়ার জন্য মায়াও হয় তার। আঠারো বছর বয়সেই বাবা-মা হারানো তারপর বিয়ে? সবকিছু ভাবলে ভিষন মন খারাপ হয় ইনায়ার জন্য তারপরও একটা কথা আছে না, মানুষ স্বার্থের কাঙাল। ঘুরেফিরে সেই স্বার্থের পিছনেই ছুটে সব।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চার একর জায়গায় বিশাল বড়ো মির্জা বাড়িটিকে, চারদিকে ঘিরে রয়েছে বড়ো প্রাচীর। বাড়ির বড় মূল দরজা হতে রাস্তা কিছুটা এঁকেবেঁকে গিয়েছে সদর দরজা অবধি। তন্মধ্যে বাড়ির সামনে থামে কালো একটা গাড়ি। বেড়িয়ে আসে ইনায়া আর নিধি দুজন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় আয়েশা মির্জা বসে বসে পান চিবুচ্ছে। নিধি সিড়ি বেয়ে তার রুমে চলে গেল এক্ষুনি গোসল করতে হবে। বিশ্রী কান্ড করছে সে রাস্তায়। ইনায়া সামনে এগুতেই খেঁকিয়ে উঠলেন আয়েশা,

-” এই, এদিকে আয় তুই। ”
ইনায়া মাথার ঘোমটা ভালো করে টেনে আয়েশার সামনে আসে। কেনো জানি দাদিকে তার ভিষন ভয় করে। দাদি যে তাকে বাঁকা চোখে দেখে তা ভালো বুঝতে পারে ইনায়া। তবুও সে চুপচাপ থাকে।
-” কেমন গেলো তোর আজকের দিন? ”
-” জ্বি দাদি ভালো।”
-” আয়, আমার পাশে বোস। ”

পান খাওয়া দাতে হেসে বলে উঠেলেন আয়েশা মির্জা। ইনায়া আশ্চর্য হয় ক্ষানিকটা দাদির ব্যবহারে। এমন করে আয়েশা তার সাথে কোনোদিন কথা বলেছে বলে মনে হয় না। ইনায়া মাথা নিচু করে বসে পরে তার পাশে। আয়েশা মির্জা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে ওঠে,
-” এমন করে কি তোর জীবন যাইবে? দেখ, আমি বাবা সাধাসিধে কথার মানুষ। এই বাড়িতে কিসের আশায় আছিস তুই? বলতো? স্বামী দিয়েইতো স্বামীর সংসার। যেখানে সেটাই নেই, তাহলে এই বাড়িতে কেনো পরে থাকবি বলতো? কিসের আশায়? যেখানে নাভান তোকে না দেখেই বাড়ি ছেড়েছে। মধ্যযুগের নারীরা একটা কথা বলতো জানিস সেটা কি?”
ইনায়া দুপাশে মাথা নাড়ায়। অতএব জানে না সে। আয়েশা মির্জা ভালো করে তাকায় ইনায়ার পানে।
বলত,

-” জামাইরা হলো সাত ভাই, জামাই বিনে কেহ নাই।
স্বামী যদি ভালো হয় তার মুখের দিকে তাকিয়ে সারা জনম মানুষের কটু কথা শুনেও পার করা যাবে। স্বামী হলো স্ত্রীয়ের রক্ষক। স্বামীর বাড়িতে যতই বিলাসিতা, মানুষজন ভালো থাকুক না কেন। স্বামী যদি ভালো না হয় বউয়ের কোনো মর্ম থাকে না। জীবন টা তো সামনে পুরোটাই পরে আছে ইনায়া। নাভানের আশায় না থেকে জীবন টা নতুন কর শুরু কর। এই বাড়িতে ঘুরেফিরে তোর একটাই পরিচয় নাভানের বউ। সোহানা যতই তোর নিজের পরিচয় দেক সেটা তো মুছে যাবে না। আজ না কাল তোদের সম্পর্ক ভেঙেই যাবে। সোহানা ঠিক তোকে পড়াশোনা করিয়ে অন্যথায় বিয়ে দিবে। তখন লোক জানাজানি বেশি হবে। এরচেয়ে ভালো এখনই একটা ব্যবস্থা কর, আমরা তোর পাশে থাকব। শক্ত কর নিজেকে।

কথাগুলো বলে থামলেন আয়েশা। ইনায়া অনুভূতি শুন্য হয়ে বসে আছে তার সামনে। মুখে কোনো কথা নেই। কথাগুলো তার অজানা নয়। আজ না কাল ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবেই। তখন কোথায় ঠাই হবে তার। এর চেয়ে ভালো না আত্মসম্মান নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া। কিন্তু কই যাবে সে? পৃথিবীতে সে বড্ড একা। আয়েশা মির্জা ইনায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। রান্নাঘরের দিকে চোখ রাখেন। নিপা রান্না করায় ব্যস্ত। সতর্ক হয়ে ব’লে ওঠে,
-” আমি যে এসব বলেছি, সোহানা যেন না জানে। পাছে বলবে আমি তোর কানে বিষ ঢেলেছি। এমনিতেই সি আই ডি নিপা সারাদিন কুটনামি করতে থাকে আমার নামে।

-” কে কার নামে কুটনামি করে গিন্নি? ”
কথাটা শুনে চকিতে সামনে তাকায় আয়েশা মির্জা। ইশান দুষ্টু হেসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকালেন তিনি। ইশান তাকে বড্ড জালায়।
-” তোকে বলব কেন? তুই আমাদের কথার মাঝে বা’ হাত ঢুকাচ্ছিস কেনো?”
-” বারে! আমি তোমার কর্তা না।

কথাটা বলে বসতে বসতে রান্না ঘরে থাকা নিপাকে হাঁক ছেড়ে ডাকে ইশান। এক গ্লাস পানি আনার জন্য। সামনে তাকায় ইনায়ার দিকে, মেয়েটির মায়াবী মুখটা বড্ড করুন হয়ে আছে। একসাথে ইনায়ার জীবনে এতকিছু ঘটে গেছে। তার ধাক্কাটা সহজেই কাটিয়ে তোলার মতো নয় আঠারো বয়সি মেয়ের। ইশান তাকানো অবস্থায় ইনায়া চোখ তুলে, মিলিত হয় দুই জোড়া চোখের দৃষ্টি। তড়িৎ গতিতে চোখের দৃষ্টি নামায় ইনায়া।
ছেলের ডাক শুনে তারাতাড়ি করে পানি নিয়ে এলেন নিপা। ইশান একটানে পুরো গ্লাস শেষ করে নিপার হাতে গ্লাস দিয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বলে,

-” বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে মা। তোমার স্বামী, ভাসুর আর জা মিলে আমাকে প্রচুর খাটিয়েছে। সকাল থেকে অফিসে এক কাপ কফিও খেতে পারিনি।
-” আহারে,, তুই ফ্রেশ হয়ে আয় আমি এক্ষুনি ভাত বেড়ে দিচ্ছি। আর ইনায়া, তুমি বসে আছো কেন? নিধি কে নিয়ে খেতে আসো। ”

বলেই রান্নাঘরে দৌড় লাগায় নিপা। বাকি সবাই আসার আগে দুপুরের রান্না শেষ করতে হবে। ইয়ানা বরাবরই অবাক হয় ইশানের প্রতি। সবার সাথের গম্ভীর রগচটা মানুষটা মা আর দাদির কাছে এলেই বাচ্চা হয়ে যায়। নিপাও ছেলেকে পাঁচ বছরের বাচ্চা ভাবে যেন।
-” এহ্, আসছে নবাব। তাকে সবাই খাটায়। শোন, আমার দুইছেলে সোনার টুকরো তাদের নিয়ে যা তা বলবি না। আজকে আসতে দে তোর বাবা জেঠা কে। ”
-” তুমি কেমন গিন্নি হে? কর্তার দুঃখ বুঝনা। বয়স তো কম হলো না গিন্নি, কুটনামি কমাও। বাকি জীবন তো আমার, তোমার কুটনীতিতেই পার হয়ে যাবে। ”

ইশানের কথায় তেতে উঠেন আয়েশা মির্জা। ইনায়া আস্তে করে ব্যাগ নিয়ে তার রুমে চলে যায়। সে সোহানা মির্জার সাথে কথা বলবে। দাদির কথাগুলো আসলেই সত্যি। এইভাবে জীবন চলবে না। শোক কাটিয়ে উঠতে হবে তাকে।
ইনায়া যেতেই ইশানের উপর তেড়ে আসেন আয়েশা।
কানমলা দিয়ে রুষ্ট কন্ঠে বলেন,

-” তা আমি যখন এতই খারাপ। নিয়ে আয় নতুন গিন্নি। দেখি তার স্বামী ভক্তি আমার থেকে বেশী কি না। ”
ইশান মুচকি হেসে বলে ওঠে,
-” আনবো তো,, তাকে নিজ হাতে বানাবো আমি। লোহার চেয়েও শক্ত ইস্পাত ধৃর। যার প্রতিঘাতে তুমি দশ টুকরো হবে আশু। তাই বলছি কুটনৈতিক বুদ্ধি এখন কমাও। ”

নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে আছে ইনায়া। বিকাল হতে চললো। দুপুরে খেতে যায়নি নিচে। নিধি এসে অনেকবার বলে গেছে। ইচ্ছা হয়নি তার। জীবনটাই হাঁপিয়ে উঠছে প্রায়। সবইতো ঠিকঠাক ছিল ইনায়ার জীবনে। বাবা-মা কে নিয়ে তার সুন্দর হাসি খুশি একটা পরিবার ছিল। শুধু সুখ আর শান্তিতে ভরপুর তাদের ছোট্ট মধ্যবিত্ত সংসার। তাদের সুখে গ্রহণ হয়ে এলো একটা অ্যাকসিডেন্ট। তারপর নিমিষেই সবকিছুই উলোটপালোট হয়ে গেল। বাবা-মা হাড়িয়ে সদ্য আঠারোয় পা দেওয়া বাচ্চা মেয়েটির কাছে তখন সব কিছুই দুঃস্বপ্ন মনে হয়েছিল। যেন ঘুম ভাঙ্গতেই ঠিক হয়ে যাবে সব। কিছুতেই সম্মুখের ঘটনা গুলো তার মানতে ইচ্ছে হয়না। বরাবরই মতই ইনায়া নিশ্চুপ থাকে। মাঝে মধ্যে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে তার। কিন্তু, তারপরও গলার মধ্যে কান্না গিলে নেওয়ার অসীম ক্ষমতা হয়ে গেছে এতদিনে। শোয়া থেকে উঠে বসে আলমারির কাছে যায় ইনায়া। সেখান থেকে বের করে তিন জনের হাস্যজ্বল একটা ছবি। হাত বুলায় ছবিটির উপর। মনে পরে একবছর আগের কথা।

নাভানের সাথে ইনায়ার বিয়ের ঠিক হয়েছে তখন দু’ মাস। সোহানা মির্জা বলেছিলেন নাভান ফিরতেই ইনায়াকে বউ করে ঘরে তুলবেন। তখন থেকেই তার ছোট্ট কিশোরী মনে নাভানের জন্য সুপ্ত ভালবাসা পুষেছিল। বিয়ে, সংসার নিয়ে কতশত স্বপ্ন সে ভাজ করে রেখেছিল মনের গহীনে। হঠাৎ বাবা মায়ের মৃত্যু তারপর সোহানার সাথে এই বাড়িতে আসে পরিশেষে নাভানের সাথে বিয়ে। সবকিছু ভাবলে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে ইনায়ার।
-” মা এসেছে ভাবি! তোমাকে যেতে বলেছে তার ঘরে। ”
আচমকা নিধির কথায় ঘোর ভাঙে তার। চটজলদি উঠে দাঁড়ায় ইনায়া। মাথায় কাপড় টেনে, নিধির সামনে এসে জিজ্ঞেস করে,

যাতনা আমার পর্ব ৩

-” লাঞ্চ করেছে তারা? ”
-” হুম, তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল। বলেছি খেয়ে শুয়ে আছে। খাওনি বললে সবাইকে বকবে। ”
ঠোঁট উলটে বলল নিধি। ইনায়া নিধির সাথে কথা বলতে বলতে সোহানার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়।
নিধি তার থেকে বিদায় নিয়ে নিজের রুমে চলে যায় মা ভাবির কথার মধ্যে থাকতে চায়না সে।

যাতনা আমার পর্ব ৫