আলোর ভীড়ে পর্ব ১৬

আলোর ভীড়ে পর্ব ১৬
ইশরাত জাহান অধরা

“আম্মু আসছে।বাস থেকে নেমে পরেছে অলরেডি।যেকোন সময় এসে পরবে”
প্রিয়তা বিরক্ত হয়ে বলল,
“তো?এর জন্য আপনি আমাকে সকাল সকাল ডেকেছেন?এত হইচই করার কি আছে?আসলে আসুক!”
কথাটা বলতেই হঠাত প্রিয়তার মনে হলো ওরা তো দুজন আলাদা রুমে থাকে।ইনামের মা এসে যদি দেখে তাহলে নিশ্চয়ই উনি পছন্দ করবেন না!কথাটা মাথায় আসতেই অবাক হয়ে বলল,

“এখন?এখন কি করব?আপনি আগে বলেন নি কেন?”
“তোমাকে আগে কিভাবে বলব।আমি তো এই মাত্রই জানলাম।আর জেনেই দৌড়ে এসে তোমাকে জানালাম।”
ইনাম একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো।প্রিয়তা কিছু বুঝে উঠতে পারছেনা দেখে ইনাম কাছে গিয়ে প্রিয়তার কাধ ধরে বলল,
“চিন্তা করো না।আমি সব ব্যবস্তা করছি।আমাদের এখন কাজ করতে হবে।তোমার ঘরে যা যা জিনিসপত্র আছে সব আমার রুমে নিয়ে এসো!আমিও হেল্প করছি তোমায়।”
ইনামের কথা শুনে প্রিয়তা কিছুটা শান্ত হলো।উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো ইনামের কথায়।ইনাম মুচক হেসে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কাজে লেগে পরো।আম্মু আসার আগে তোমার রুম পুরোটা ক্লিন করে ফেলতে হবে।”
প্রিয়তা নিজের রুমে গিয়ে আলমারি থেকে সব জামা কাপড় এনে ইনামের আলমারিতে রাখলো।সব প্রয়োজনীয় জিনিস এনে ইনামের রুমে রাখলো।টয়লেট থেকে নিজের ব্রাশ আর পেস্ট নিয়ে এসে ইনামের টয়লেটে এনে রাখলো।নিজের রুমটা মুহুর্তের মধ্যেই খালি হয়ে ফেলল ইনাম আর প্রিয়তা মিলে।কাজ শেষে ইনাম বলল,
“ঘরে তো মনে হয় কোন খাবার নেই।আমি বাজারে যাচ্ছি।”

ইনামের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে প্রিয়তা একটা শ্বাস নিলো।অনেক কাজ করেছে সে।সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই এত কাজ করতে হবে ভাবতেই পারেনি।মুখ ধুয়ার টাইম পর্যন্ত পায় নাই।বসা থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে নিজের বিছানায় বসতেই চোখ পরল সামনে থাকা আলমারির দিকে।আলমারির উপরে ওর ব্যাগ রাখা।প্রিয়তা কিছু না ভেবে একটা টুল এনে টুলের উপর উঠলো।দুই পা উচু করে হাত বারালো আলমারির দিকে।প্রথমে ব্যাগের নাগাল না পেলেও কিছুক্ষন চেষ্টা করতেই ব্যাগটাকে ছুতে পারলো সে।
“কি করছো চেয়ারে উঠে?”

প্রিয়তা কেবল ব্যাগ ধরে টান দিতেই যাচ্ছিলো আচমকা ইনামের কন্ঠ শুনে ভড়কে গেল প্রিয়তা।পিছু ফিরে তাকাতেই টুলটা নড়তে শুরু করলো।টুল থেকে পরেই যাবে এমন একটা অবস্তায় ইনাম সাথে সাথে প্রিয়তাকে ধরে ফেলল।এমন একটা পরিস্থিতি হবে কেওই ভাবতে পারেনি।ইনামকে এত কাছে দেখে প্রিয়তার শ্বাস প্রশ্বাস কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।চোখ বড় বড় করে ইনামের দিকে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা। ইনামও প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে ছিলো।
“বাহ! বাসায় এসে এমন সিন দেখব ভাবতেই পারিনি।কি লোমান্টিক সিন!”

কথাটা কানে আসতেই ইনাম আর প্রিয়তা চমকে দরজার দিকে তাকালো।দেখলো ইনামের মা আর বোন দাঁড়িয়ে আছে।ইনামের মা শ্রেয়াকে থাপ্পড় দেখাচ্ছে কথাটা বলার জন্য।প্রিয়তা ইনামের থেকে সরে এলো।ইনামও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল নিজেকে সামলিয়ে বলল,
“তোমরা কখন আসলে?”
শ্রেয়া দাঁত কেলিয়ে বলল,

“যখন তুমি ভাবিকে পরে যাওয়া থেকে ধরলে তখন!”
ইনামের মা চোখ রাংগাতেই শ্রেয়া চুপ হয়ে গেলো।ইনামের মা হেসে বলল,
“কিছুক্ষন আগেই এলাম।দরজা খোলা ছিল দেখে ভেতরে এসে গেলাম।”
ইনাম একটা চেয়ার টেনে দিয়ে বলল,
“বসো!”
ইনামের মা বসে বললেন,
“ভালো আছিস তোরা?”
“হ্যা।এখনো কিছু রান্না হয়নি।আসার সময় বলে আসতে।ছুটির দিন দেখে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে।”
“সমস্যা নেই।আমরা খেয়েই এসেছি।ক্ষিধা নেই আমাদের।”
প্রিয়তা বলল,
“আপনারা বসুন।আমি খাবার রেডি করে নিয়ে আসছি।”

প্রিয়তা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে।মসলা পাতি কোথায় আছে কিছুই জানে না সে।সবসময় তো ইনামই রান্না করে।কোথায় রাখছে কে জানে!সারা রান্নাঘর খুঁজেও একটা মসলা পেলো না!
“মসলাপাতি সবকিছু সামনের বক্সগুলাতে আছে।”
কথাটা শুনেই প্রিয়তা পিছন ফিরে দেখলো ইনাম দাঁড়িয়ে আছে।ইনামের কথামতো প্রিয়তা সামজে তাকাতেই দেখল কাঠের মতো অনেকগুলা বক্স। কয়েক কদম হেঁটে বক্সগুলা খুলতেই যাবে ইনাম বাধা দিলো।বক্সের দরজা খুলতে খুলতে বলল,

“খাটো মানুষ!নাগাল পাবে না!আমি নামিয়ে দিচ্ছি।কি কি লাগবে বলো!”
প্রিয়তা চুপ করে রইলো।ও তো কোনদিন রান্নাই করেনি।কি করে জানবে কি কি মসলা লাগে?তাও শুনা থেকে বলল,
“মরিচ গুড়া,হলুদ গুড়া,ধনিয়া গুড়া,আদা গুড়া,রসুন গুড়া,জিরা গুড়া।”
ইনাম ভ্রু উচিয়ে পিছনে ফিরে বলল,
“এই আদা গুড়া, রসুন গুড়াটা কি জিনিস?”
“মসলা!”

“মসলা তো বুঝলাম। বাট আদা, রসুন গুড়া হয় কেমনে?এগুলা তো বাটা হয়!”
প্রিয়তা চোখ মুখ কুচকে ফেললো।নিজের উপর নিজের দাগ হচ্ছে।সামান্য মসলা পাতির নাম জানে না সে?
“তুমি রান্না জানো তো?”
“জানি।অইগুলা ভুলে বলে ফেলেছি।”

“দেখো না জানলে আমাকে বলো।আমি সাহায্য করব।”
“আমি জানি।অনেকদিন রান্না করি নি দেখে ভুলে গেছি।”
ইনাম ফ্রিজ থেকে আদা,রসুন বাটার বক্স বের করে বলপ,
“তাহলে তো ভালোই!রান্না করো।আমি গেলাম।গুড লাক!”
বলেই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।প্রায় কয়েক কদম পা ফেলার সাথে সাথেই পিছন থেকে প্রিয়তা ইনামকে ডাক দিলো।ইনাম প্রিয়তার দিকে ফিরে বলল,

“ডাক দিলে কেন?”
প্রিয়তা এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
“ইয়ে মানে….আমি রান্না পারি না।আম্মু কোনদিন আমাকে রান্নাঘরে যেতে দেয় নি।”
ইনাম অবাক হয়ে বলল,
“কোন কিছুই রান্না করতে পারো না?”

“নুডলস পারি শুধু।তাও এটা ইউটিউব থেকে শিখেছি।বাস্তবে প্রয়োগ করে দেখিনি!”
“দেখছি কি করা যায়!আম্মু শুনলে হার্ট অ্যাটাক করে বসবে।”
প্রিয়তা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।ইনাম যেতে যেতে বলল,
“ফোনটা নিজের কাছে এনে রাখো।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বলল,
“ফোন কেন রান্নাঘরে রাখব?”

ইনাম প্রিয়তার কোন কথার জবাব না দিয়েই চলে গেলো।প্রিয়তা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে রুম থেকে মোবাইল ফোন এনে কাছে রাখলো।কিছুক্ষনের মধ্যেই ফোনে কল আসলো।ফোনের স্ক্রিনের ইনাম নামটা ভেসে উঠতেই অবাক হলো প্রিয়তা।ভ্রু কুচকে এলো।কিছুক্ষন আগেই না লোকটা কথা বললো?তাছাড়া বাসায় থেকে ফোন দেওয়ার মানে কি?ভেবে পেলো না সে।ফোন রিসিভ করে কানে নিতেই ওপর পাশ থেকে ইনাম বলল,
“আমি যেভাব্ব যেভাবে যা কিছু করতে বলব তুমি ঠিক সেভাবে সেভাবে সবকিছু করবা।একটাও এদিক সেদিক করবা না!”

“আপনি কোথায়?আর সামনে না বলে ফোনে কেন বলছেন?”
“এতকিছু তোমার না জানলেও চলবে।যা বলছি তা করো!”
প্রিয়তা বুঝতে পারলো ইনাম এখন ওকে কোনকিছুই বলবে না।তাই চুপ থেকে বলল,
“হুম বলুন।”
“ভাত রাধতে পারো?নাকি সেটাও পারো না?”
“নাহ,ভাত রান্না করতে পারি।”
“তাহল চুলায় ভাত বসিয়ে দাও।আর আমার রুম থেকে ইয়ারফোন নিয়ে আসো।খাটের উপর বালিশের পাশেই রাখা আছে।”

‘ইয়ারফোন কেন লাগবে?”
“তুমি এক হাতে ফোন নিয়ে আরেক হাতে কাজ করবা?করতে পারবা?”
“আচ্ছা আমি আনছি।”
ইয়ার ফোন এনে কানে গুজে বলল,
“ভাত চুলায় বসিয়ে দিয়েছি।”
“পেয়াজ,কাচামরিচ এগুলা কাটো!মুরগী,মাছ এগুলা কাটাই আছে জাস্ট ফ্রিজ থেকে বের করে পানিতে ভিজাও তাহলেই হবে!”
ইনামের কথামতো সব কাজ করে শেষ করলো।

“চুলায় কড়াই বসিয়ে তেল ঢেলে পেয়াজ গুলাকে দিয়ে দাও।পেয়াজ হালকা ব্রাউন রঙ এলে তার উপর মরিচ, হলুদ গুড়া,আদা,রসুন বাটা, লবন দিয়ে ভালো করে কসাও।যখন মসলা গুলাতে তেল ভেসে উঠবে তখম চিকেনের পিসগুলা দিয়ে ভালো করে কসাতে থাকবা।কসানো হয়ে গেলে তার উপর পানি দিয়ে ঢাকনা দিয়ে রেখে দাও।অহ গরম মসলাও দেওয়া লাগবে।”
“আলু দিব না?”
“নাহ,আম্মু আলু খায় না।ঝোল ঘন হয়ে আসলে নামিয়ে ফেলবা।আর লবন চেক করে দেখো ঠিক আছে কিনা।লবন লাগলে দিয়ে দিও।”
“শেষ।”

“এবার মাছের পিসগুলাকে লবন,হলুদ আর মরিচ দিয়ে মাখো।মাখা হয়ে গেলে কড়াইয়ে তেল ঢেলে মাছগুলাকে ছেড়ে দাও।পিসগুলাকে জোরে ফেলবা না। তেল উপচে পরবে।আস্তে ধীরে তেলে ছাড়বে।বুঝতে পেরেছো?”
‘হুম।”
“তাহলে মাছগুলাকে ভাজো।লাল হয়ে উঠলে তুলে ফেলবা।”
“এরপর?”

“তারপর মুরগী যেভাবে রান্না করছো অইভাবেই রান্না করবা।জাস্ট গরম মসলাটা স্কিপ করবা।”
মাছ রান্না শেষে চুলা থেকে কড়াইটা যখন উঠাতে যাবে তখন তাড়াহুড়ার মাঝে ভুলে খালি হাতেই কড়াই ধরে ফেলতেই ব্যথায় চোখ মুখ কুচকে ফেলল প্রিয়তা।মুখ দিয়ে হালকা আওয়াজ নের হয়ে গেলো।ফোনের ওপাশ থেকে ইনাম বলল,

“কি হলো?হাত পুড়ে ফেলেছো?”
প্রিয়তা বেসিনে পানির নিচে হাত রেখে বলল,
‘নাহ!অই হাত থেকে কড়াইয়ের ঢাকনা পরে গেছিলো।”
“বউমা তোমার রান্না শেষ?”
কথাটা শুনতেই পিছন ফিরে বলল,
“প্রায় শেষের দিকে।আপনি না আসলেও পারতেন।ডাকলেই আমি আপনার কাছে চলে যেতাম।”
ইনামের মা হেসে বলল,
“তুমি এই গরমে ঘেমে রান্না করতে পারো।সামান্য এসে দেখতে পারব না তোমার কি প্রয়োজন?ইনামটা এমন সময় বাইরে গিয়ে বসে আছে। কই বউকে সাহায্য করবে!এই ছেলেকে নিয়ে আর পারি না।”
কথাটা শুনতেই চমকে গেলো প্রিয়তা।তারমানে ইনাম এতক্ষন বাইরে থেকে ওর সাথে কথা বলছিলো!

খাবার টেবিলে সবাই বসে আছে।প্রিয়তা তাকিয়ে আছে সবার দিকে। ইনামের মা এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে কিছুক্ষন বসে থেকে মুখ গম্ভীর করে বলল,
“এটা তুমি কি রান্না করেছো বউমা?”
প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে ইনামের দিকে তাকালো।ইনাম মাথা নিচু করে চুপচাপ খাচ্ছে।
“এত ভালো রান্না কেও করে?আমি তো তোমার রান্নার ফ্যান হয়ে গেলাম।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে গেলো।ইনামের দিকে তাকাতেই দেখল ইনাম হাসছে।

“তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন?আমাদের সাথে বসো!খাও!”
“আমি পরে খাবো।আমার এখন ক্ষিধে নেই।”
“আরে বসো তো!আমরাই তো!লজ্জা পাওয়ার কি আছে?”
বলেই প্রিয়তাকে বসিয়ে দিলেন।প্রিয়তাকে অনেকক্ষন ধরে কিছু খেতে না দেখে ভ্রু কুচকে এলো ইনামের।
“কি হলো?খাচ্ছো না কেন?”
“ইয়ে মানে….”

‘অহ আমি তো ভুলেই গেছিলাম প্রিয়তার মেডিসিন খাওয়া বাকি আছে।খালি পেটে টাইম টু টাইম খেতে হয়।এখনো ওর মেডিসিন খাওয়ার টাইম হয় নি।তোমরা খাও। ও একটু পর খাবে।”
ইনামের কথাটা শুনে প্রিয়তা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো।ভাগ্যিস উনি কথাটা বলেছিলেন!ওর তো এই কথা মাথাতেই আসে নাই।সবার খাওয়া শেষে প্রিয়তা ইনামের রুমে আসলো।এই প্রথম ও ইনামের রুমটাকে ভালো করে দেখলো।আশেপাশে তাকাতেই দেখল দেয়ালের রঙ সাদা হলেও ইনামের ঘরের প্রত্যেকটা জিনিস নীল রং করা।যেমন জানলার সামনের পর্দা গুলা,আলমারির রঙ, বিছানার চাদর আরও অনেককিছুই নীল রংয়ের।যার কারনে দেয়াল সাদা কালার হলেও পুরো রুমটা নীল রংয়ের দেখা যাচ্ছে।সাদা দেয়ালটা কমই চোখে পরছে।আজব!লোকটা কি নীল রঙ পছন্দ করে?তাই বলে পুরো রুম নীল রঙ দিয়ে ছড়িয়ে রাখবে?

আলোর ভীড়ে পর্ব ১৫

“খাবার টেবিলে খাবার খেলে না কেন?আনকম্ফোর্টেবল ফিল করছিলে?”
ইনামের কথাটা শুনে পিছনে ফিরে বলল,
“নাহ!আনকম্ফোর্টেবল ফিল করার কি আছে?”
“তাহলে খাবার খেলে না কেন?”

আলোর ভীড়ে পর্ব ১৭