পূর্ণতা পর্ব ৩৩
নন্দিনী নীলা
বিষন্ন মনে পূর্ণতা বাসায় ফিরে এসেছে। মুখটা যথেষ্ট গম্ভীর হয়ে আছে। প্রভাতের প্রতি এবার আর অভিমান হয়নি রাগ হয়েছে। প্রভাত ইচ্ছে করে ওর অনুভূতি নিয়ে খেলছে। রাতে আসবে বলে আশা দেখাল আর এখন কি করল? আসলো না..!
এর মানে কি দাঁড়ায়? ও আমার সাথে ইচ্ছে করে খেলছে। আমাকে কি খেলনা পুতুল পেয়েছে?
পূর্ণতা কলেজ ড্রেস পরেই শক্ত হয়ে বসে আছে। রাগে ওর সব কিছু ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করছে। প্রভাত ওর সাথে কেন এমন করছে?
রাগে ওর চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। পূর্ণতা আওয়াজ পেল মা আসছে ও তাড়াতাড়ি উঠে দরজা আটকে বলল,” আম্মু আমার খুব মাথা ব্যথা করছে ঘুমাব।”
“ এখন কি ঘুমের টাইম? গোসল করে খেতে আয়
তোর বাবা বসে আছে।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ আব্বু আর তুমি খেয়ে নাও আমি পরে খাব।”
“ কি হয়েছে দেখি বের হ।”
“ আম্মু প্লিজ একটু একা থাকতে দাও না।”
রোজিনা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন। মাঝে মাঝে মেয়েটার যে কি হয় না।পূর্ণতা হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল।
রোজিনা বেগম নিচে নামতেই শাহিন আলম জিজ্ঞেস করল,“ পূর্ণ কই?”
“ পরে খাবে। তুমি খেয়ে নাও।”
শাহিন আলম মেয়েকে রেখে খেতে চাইছিল না। কিন্তু রোজিনা বেগম জোর করেই তাকে খেতে দিল।
পূর্ণতা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল ঘুম ভাঙল মায়ের ডাকে। ধরফরিয়ে উঠে নিজের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল। আম্মু এখনো এই অবস্থায় দেখলে সর্বনাশ হবে। পূর্ণতা তাড়াতাড়ি ওয়াশ রুমে ঢুকে গেল। কোনরকম ঝরনা ছেড়ে গোসল সেরে দরজা খুলতেই ওর মা বললেন,“ কি হয়েছে? এতো বেলা করে গোসল করলি কেন?”
“ আম্মু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।” আহ্লাদি কন্ঠে বলল পূর্ণতা।
“ টাইম মতো কি কিছু করেছিস কখনো?” চড়াও কন্ঠে বলল রোজিনা বেগম।
পূর্ণতা নিচে নেমে খেতে বসল। খেতে খেতে কলিংবেলের আওয়াজ আসলো। পূর্ণতা এদিক ওদিকে তাকিয়ে কাউকে না পেয়ে বিরক্ত হয়ে দরজা খুলতে গেল।
পূর্ণতা রেগে বিড়বিড় করে বলল,“ দুঃখ বিলাস করে সারাদিন কাটালাম এখন এই সন্ধ্যায় একটু খেতে বসেও শান্তি নেই। কোন আপদ এলো এখন? এই বাড়িতে তো আমি ছাড়া কেউ দরজা খুলতেও নেই। অসহ্য”
পূর্ণতা রাগে নাকমুখ লাল করে দরজা খুলতেই চমকে উঠল। ওর চোখ দুটো রসগোল্লার মতো বড়ো হয়ে উঠল। ওর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে হাস্যোজ্জ্বল মুখে প্রভাত। তার শ্যামবর্ণ মুখে সিগ্ধ হাসি। পূর্ণতা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। বিস্মিত ও কথা বলতে ভুলে গেছে। পূর্ণতার ধ্যান চূর্ণ করল প্রভাত।
“ প্রেম করতে বাসায় চলে এসেছি।” এক গাল হেঁসে বলল প্রভাত ।
থতমত খেয়ে পূর্ণতা সোজা হয়ে দাঁড়াল। চোখমুখ শক্ত করে নিল পূর্ণতা। দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে আছে প্রভাত এর দিকে তারপর চলে গেল ডাইনিং টেবিলের দিকে। প্রভাত বুঝল পূর্ণতা রাগে আগুন হয়ে আছে। ও দরজা আটকে ভেতরে এসে এদিক ওদিক তাকাল। আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
শাহিন আমলের সাথে প্রভাতের এখন অব্দি দেখা বা কথা হয়নি। এজন্য আজ এগারোটার দিকে হঠাৎ রোজিনা বেগমের কল পায়। ও কল দেখেই বুঝতে পারে এটা পূর্ণতার কল নয়। কারণ তখন পূর্ণতার কলেজে থাকার কথা। ও রিসিভ করে সালাম দেয়।
“ আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
“ ওয়ালাইকুমুস সালাম।”
“ আন্টি ভালো আছেন?”
“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোমার কি অবস্থা?”
“ এইতো আন্টি ভালোই।”
“ পূর্ণতার আব্বু বাসায় এসেছে। পূর্ণতার এসএসসি তে এতো ভালো রেজাল্ট করেছে তোমার জন্য। সেই থেকেই বলছে তোমার সাথে দেখা করবে। আজ তুমি ফ্রী থাকলে লাঞ্চে আসো একবার বাসায়।”
প্রভাত জানায়,“ আন্টি আমি আসব কিন্তু সন্ধ্যায়। আমার বিকেলে টিউশনি আছে ওটা শেষ করে আসব।”
দুপুরে ইচ্ছে করেই প্রভাত কলেজে যায়নি। আজ দেখা করার কথা ছিল সেটা কলেজে না হয়ে বাসায় হবে। এজন্য পূর্ণতার কথা রাখতে পারেনি। এরমধ্যে মহারানী রেগে আগুন। বাসায় এসে রাগ ভাঙাবে সেই আশাতেই ছিল।
প্রভাত পূর্ণতার রাগ দেখে কিছু বলার সুযোগ পেল না ও এগিয়ে এসে বলল,“ পূর্ণতা আই এ্যাম সরি। রাগ করছো কেন?”
পূর্ণতা দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,“ দয়া করে তুমি আমার সাথে আহ্লাদ করতে এসো না প্রভাত। তুমি কি ভেবেছ আমি ছোটো বাচ্চা? তুমি যতোই অপরাধ করো না কেন? দেখা হলে দুটো মিষ্টি কথা বললেই আমি সব ভুলে যাব? আমার কষ্টের কোন দাম কি তোমার কাছে আছে? কত সময় আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম তুমি আবার আমার মন ভেঙে দিলে।”
“ আমি আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার আম্মু হঠাৎ ফোন দিয়ে জানাল আঙ্কেল আমার সাথে দেখা করতে চায়। এজন্য সন্ধ্যায় পর যে টিউশনি ছিল ওটা আমি বিকেলে শেষ করেছি। যাতে এখানে এসে একটু বেশি সময় কাটাতে পারি।”
“ একবার ও ভাবলে না। একজন তোমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে? এতো পাষাণ তুমি?” চোখ টলমল করে উঠল পূর্ণতার। কান্না চলে এলো ফের। পূর্ণতা ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের কান্না আটকালো।
প্রভাত আশেপাশে আড়চোখে চেয়ে চট করেই কান ধরে বসে পড়ল পূর্ণতার সামনে।
পূর্ণতা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল প্রভাত কে এই অবস্থায় বসতে দেখে।
প্রভাত ফ্লোরে বসেই বলল,“ প্লিজ ক্ষমা করে দাও। আর কখনোই তোমায় কষ্ট দেব। এই লাস্ট বার ক্ষমা করে দাও না।”
পূর্ণতার রাগ পরে গেল। প্রভাত কে এভাবে কান ধরে বসে কাকুতি মিনতি করতে দেখে ওর রাগ কমে হাঁসি চলে এলো। ও খিলখিলিয়ে হেঁসে উঠল। ওর হাঁসি দেখে প্রভাতের দম আসলো। ছেলেমানুষী হলেও পূর্ণতার রাগ খুব ভয়ংকর। রাগ কে খুব ভয় পায় প্রভাত। পূর্ণতাকে কতটা ভালোবাসে সেটা বুঝাতে পারবে না কখনোই। কিন্তু পূর্ণতা রাগ করলে ওর অভিমানে টকটকে মুখ দেখলে প্রভাত এর দম আটকে আসে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
পূর্ণতা হাসতেই প্রভাত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,“ তোমার রাগ আমি কতটা ভয় পাই জানো? এতো রাগ করো কেন? রাগে জন্য দিনদিন আরো শুঁটকি হচ্ছ। চোখগুলো ও গর্তে চলে যাচ্ছে। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো না?”
“ আব্বুর মতো বলছো। আমি কি আসলেই শুকিয়ে যাচ্ছি?” ঠোঁট উল্টে বলল পূর্ণতা।
প্রভাত পূর্ণতার গালে হাত বুলিয়ে বলল,“ বেশি দুশ্চিন্তা করছো? আমি কি তোমার জীবনে দুশ্চিন্তা হয়ে প্রবেশের করেছি পূর্ণতা?”
পূর্ণতা কথা বলল না। প্রভাত ওর জীবনে রঙিন বসন্ত নিয়ে এসেছে। প্রেমে পড়লে মানুষের চেহারা উজ্জ্বল হয়, রূপচর্চা করে কিন্তু পূর্ণতার ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টো। ও দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছে, চোখ গর্তে চলে যাচ্ছে, গায়ের রং ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে।
পূর্ণতা জানে এই সমস্যার কারণ,
প্রভাত পড়াশোনায় ভালো, তার গার্লফ্রেন্ড ভবিষ্যতে বউ হবে পূর্ণতা। ওকেও প্রভাত এর মতো ভালো স্টুডেন্ট হতে হবে। পরে যদি প্রভাত এর পরিবার ওকে অযোগ্য মনে করে সেই নিয়ে দিনরাত দুশ্চিন্তায় থাকে। রাত জেগে পড়াশোনা করে। ঘুম কম হয় এজন্য চোখের পার কালো হচ্ছে।
ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে না পূর্ণতা প্রভাত এর থেকে একটু অবহেলা পেলেই খাওয়ার সাথে রাগ দেখাচ্ছে। প্রভাত কে দেখাতে পারছে না। অদ্ভুত পাগলামী করছে পূর্ণতা।
প্রভাত যেদিন প্রথম ওকে জড়িয়ে ধরেছিল সেদিন ছিল সবচেয়ে কষ্টের ও আনন্দের দিন। এরপর ওদের ঝামেলা পোহাতে হয়নি। টেস্টে ফেইল করার জন্য ওর মতো গাধী স্টুডেন্ট কে এসএসসি পরীক্ষায় বসতে দিবে না জানায় প্রিন্সিপাল স্যার। সেই বিপদে গার্ড হয় প্রভাত। স্যার ম্যাম দের সাথে কথা বলে তাদের রাজি করায়। সাবজেক্ট প্রতি আলাদা টাকা দিয়ে ফরম ফিলাপ করা হয়। তিনমাস মনদিয়ে পড়াশোনা করে পূর্ণতা এসএসসি তে 4.74 পেয়ে পাশ করে। ওর মতো টেনেটুনে পাশ কথা স্টুডেন্ট এর জন্য এই রেজাল্ট টাই অনেক। সবাই ভেবেছিল ও কোনরকম পাশ করবে।
অনেকে তো ভেবেছিল ও ফেইল করবে। সবার আশায় জল ঠেলে দিয়ে ও ভালোই নাম্বার পেয়েছে।
পূর্ণতা একটা হাসি দিয়ে বলল,“ এমনিতেই, আমি তোমায় নিয়ে সব সময় সংকায় থাকি।”
প্রভাত ভ্রু কুঁচকে বলল,“ আমি তো আছি। আর থাকব সবসময় আমায় নিয়ে কিসের ভয়?”
” জানি না।”
“ মাইর খাবে।” শাসনের সুরে বলল প্রভাত।
পূর্ণতা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,“ হুম সেটাই তো পারবে। শুধু মারতে আর শাসন করতে পারো তুমি। আদর, আহ্লাদ করতে পারবে না।”
“ এক মাসের মধ্যে তোমার সেই আগের লাবন্যময় চেহারা ফিরে না আসলে খবর আছে। ফালতু দুশ্চিন্তা করে নিজেকে কাহিল করবে না।”
“ তুমি আমার সাথে ঠিকমতো দেখা সাক্ষাৎ করলেই আমি একদম ফিট হয়ে যাব। তুমি আমার সব রোগের ঔষধ।” আহ্লাদি কন্ঠে বলল পূর্ণতা।
প্রভাত দেখল সিঁড়ি বেয়ে নামছে রোজিনা বেগম তাকে দেখেই প্রভাত ঝড়ের বেগে উঠে আরেক সোফায় গিয়ে বসল।
পূর্ণতা আধখাওয়া করেই হাত ধুয়ে এসে বসেছিল রাগ অভিমানের পাল্লা কমাতে। মায়ের উপস্থিতিতে উঠে আবার ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল।
রোজিনা বেগম এসেই বলল,“ আরে প্রভাত যে কখন এলে?”
“ এইতো আন্টি একটু আগেই এসেছি।”
“ আমাকে ডাকবে।” বলতে বলতে তাকাল পূর্ণতার দিকে তারপর বলল,“ এই পূর্ণ প্রভাত এসেছে আমাকে ডাকিস নাই কেন?”
পূর্ণতা পর্ব ৩২
“ আমি ডাকতে পারব না।”
“মেয়েটা এখনো সেই আগের মতোই ঘাড়ত্যারা আছে।”মেয়েকে চোখ রাঙানি দিয়ে বলল প্রভাত কে।
প্রভাত মৃদু হাসলো তার কথায়।