পূর্ণতা পর্ব ৩৪
নন্দিনী নীলা
পূর্ণতা ড্রয়িংরুমে শুধু ঘুরঘুর করছে। আব্বু নিচে আসার পর প্রভাতের সাথে কয়েকটা কথা বলেছে। তারপর দুজনেই নিশ্চুপ বসে টিভি দেখছে। পূর্ণতা একবার যাচ্ছে তো আসছে। প্রভাত এখানে বসে থাকবে আর ওর কি মন টিকবে রুমে? প্রভাত ওয়াশরুমে যাবার বাহানা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। পূর্ণতা জানে এই মিথ্যাচার করার কারণ। ও খুশিতে তাড়াতাড়ি কিচেনের সামনে থেকে উপরে উঠে এলো। এতোক্ষণ কিচেনে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারছিল।
প্রভাত উপরে এসে দাঁড়াল পূর্ণতার রুমের সামনে। পূর্ণতার মা কিচেনে আছেন। পূর্ণতা ছুটে এসে ওর সামনে দাঁড়াল উচ্ছ্বাস নিয়ে।
“ এতো উঁকিঝুঁকি মারছিলে কেন? একটু ও ভয়ডর নেই তাই না। তোমার আব্বুর সামনেও এমন পাগলামী করতে ভয় করছে না? ”
“ তুমি কি প্রতিদিন আসো? কতদিন পর এসেছ একটু মন ভরে দেখব না?”
“ এখন দেখো। এক মিনিট টাইম।”
“ আমার এক মিনিট এ হবে না।” আহ্লাদি কন্ঠে বলল পূর্ণতা।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
প্রভাত বলল,“ সারাদিন কথা বলে কি আর ভালোবাসা প্রকাশ করা যায় পূর্ণতা? দিনে এক বার এক মিনিট কথা বলেও শান্তি অনুভব করার নামই তো ভালোবাসা। সারাদিন চেয়ে থেকে ও তুমি ভালোবাসা বুঝবে না। কিন্তু সপ্তাহে একবার দেখেও পুরো সপ্তাহ স্বস্তি নিয়ে অপেক্ষায় থাকাটাই তো ভালোবাসা।”
“ হয়েছে তোমার কাব্যিক ভাব বাদ দাও।” প্রভাত ওর নাক টেনে বলল,“ ঝাসিকী রাণী। আর নিচে নামবে না আমি এখন চলে যাব।”
“ এখনি?”
“ নয়টা বেজে গেছে। হোস্টেলে ফিরতে হবে।”
পূর্ণতা মুখ কালো করে ফেলল। প্রভাত চলে যাবে শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। পূর্ণতা মলিন মুখে তাকিয়ে আছে প্রভাতের দিকে। প্রভাত ওর দিকে চেয়ে বলল,“ হাঁসি মুখে বিদায় দাও এভাবে মুখ গোমড়া করে রাখলে কি আমার ভালো লাগে?”
“ প্রভাত চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি। তাহলে আর আমার মন খারাপ হবে, তোমার বিদায়ে আমার মন বিষন্ন হয়ে উঠবে না,কোন দুশ্চিন্তা হবে না,তোমায় নিয়ে। তুমি আমি আমরা একসাথে থাকব সবসময়। খুব ভালো হবে। ইশ ভেবে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে দেখো। চলো না সবাইকে সব বলে দেই।” লাফিয়ে উঠে বলল পূর্ণতা।
প্রভাত ওর মাথায় গাট্টা মেরে বলল,” কমপক্ষে আরো তিন বছর পর আমাদের বিয়ে হবে ইনশাআল্লাহ।”
“ এতো দিন আমি কীভাবে থাকব?”
“ এই তোমার মধ্যে লাজুক ভাব নেই?”
” না আমি তোমার ব্যাপারে একটুও লাজুক না। আমি খুব করে তোমাকে চাই। কবে আমাদের বিয়ে হবে, আমরা এক ছাদের নিচে থাকব সেইদিন আমি সবচেয়ে খুশি থাকব জানো?”
“ কোনদিন?”
“ যেদিন কবুল বলে আমরা এক হয়ে যাব। চলো না আমরা বিয়ে করে ফেলি প্লিজ।” প্রভাতের হাত ধরে বলল ষ পূর্ণতা।
প্রভাত বলল,“ তোমার বাড়িতে এসে এইযে এতো আদর যত্ন পাচ্ছি। এই খবর তারা জানতে পারলে আমাকে কি করবে জানো?”
পূর্ণতা দাঁত কেলিয়ে বলল,“ জানব না কেন? সবাই তোমাকে তখন মাথায় তুলে রাখব বাড়ির একমাত্র মেয়ের জামাই বলে কথা। তুমি জামাই আদর খেয়ে মোটা হয়ে যাবে। তোমার পেটে এত্ত বড়ো একটা ভুঁড়ি হবে।” বলেই খিলখিলিয়ে হেঁসে উঠল পূর্ণতা।
প্রভাত বিদ্রুপ করে বলল,“ জামাই আদর তো দূরে থাক,আমায় তখন ঝাড়ু পিঠা করে তাড়াবে তোমার আব্বু আম্মু। না বাবা আমি ঝাড়ুর বাড়ি খেতে চাইনা।”
পূর্ণতা মুখ বেঁকিয়ে বলল,“ যাও ভীতুর ডিম। প্রথম দিনই বুঝেছিলাম তুমি একটা হাবাগোবা ছেলে। ওতো সাহস তোমার নেই। থাক আর ভয়ে আত্মা শুকিয়ে ফেলার দরকার নেই। আমি এখনি কাউকে কিছুই বলব না।”
প্রভাত পূর্ণতার কপালে চুমু খেয়ে চলে গেল।
সময়টা আরো কিছুদিন পরের কথা,
দিনটা খুবই স্পেশাল। আজ প্রথম পূর্ণতা শাড়ি পরেছে। ইচ্ছে করেই পরেছে। গত সপ্তাহে ওদের ক্লাসের এক মেয়ে এক ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়েছে। পূর্ণতা সেই ঘটনা শোনার পর থেকে উৎফুল্ল হয়ে আছে। পূর্ণতা সুন্দর করে সেজে লাল টুকটুকে বউ হয়ে বাসা থেকে বের হয়েছে। বাসায় আজ কেউ নেই। আব্বু আম্মু দুজনেই গ্রামে গিয়েছে। চাচার সাথে আব্বুর কোন জরুরী কথা সেটাই বলে গিয়েছে। সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরে আসবে বলল। পূর্ণতা এই সুযোগ টাই কাজে লাগিয়েছে। ও বড়ো একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হলো। ওর গায়ে বোরকা এজন্য আশেপাশের কেউ ওকে চিনতে পারল না। পূর্ণতা শাড়ির উপরে কালো বোরকা পরেছে। ফাঁকা অটোতে উঠেছে রিজার্ভ করে। পূর্ণতা নিজের কালো বোরকা খুলে ফেলল। সামনে থেকে আধবয়স্ক লোকটা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে।
পূর্ণতা আয়না বের করে নিজের চুল ও সাজগোজ ঠিক আছে নাকি চেক করে সুন্দর করে বসল। পূর্ণতা মনে লাড্ডু ফুটছে। প্রথমবার শাড়ি পরেছে নিজে নিজে কিন্তু ভালোই পেরেছে। নিজেকে নিয়ে ওর খুব প্রাউড ফিল হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এসে পূর্ণতা ভাড়া মিটিয়ে নামল ব্যাগ হাতে। পূর্ণতা এক পলক ভেতরে থাকা বিল্ডিং গুলোর দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। প্রভাত ওকে এই অবস্থায় দেখে কেমন রিয়েক্ট আল্লাহ মালুম জানেন। ভয় ভয় লাগছে কিন্তু ভয়কে ময়লার মতো ঝেড়ে ফেলে বলল,’ ভয় পাওয়ার কি আছে? আমি কি চোর? আমি ভয় পাব কেন? আমি ভালোবাসি। যারা ভালোবাসে তারা কখনোই ভয় পায় না। ভালোবাসার চেয়ে বড়ো সাহস আর কিছুতে নেই।”
পূর্ণতা ব্যস্ত রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। একজন সাহায্য পাওয়ার মতো মানুষ খুঁজছে ওর দুচোখ। যার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে প্রভাত কে কল দিতে পারবে। কিন্তু কেউ কি ওকে ফোন দিবে? পূর্ণতা লাল শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। তাই সবাই ওকে ঘুরে ঘুরে দেখছে। পূর্ণতার হালকা অস্বস্তি লাগছে। সবার নজর দেখে ওর বিরক্ত ও লাগছে। বিড়বিড় করে বলে উঠল,’জীবনে লাল শাড়ি পরা মেয়ে দেখে নাই?’ বিড়বিড় করলেও কথাটা জোরেই বলেছে পূর্ণতা।
কেউ একজন পাশ থেকে রাগান্বিত স্বরে বলে উঠল,“ দেখেছে কিন্তু সেটা বিয়ের আসরে। কিন্তু এভাবে ভার্সিটির গেইটের সামনে কোন লাল বেনারসী পরিহিত নারী। কেউ আগে কখনোই দেখেনি।”
পূর্ণতা চকিতে তাকাল। প্রভাত চোখমুখ লাল করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। পূর্ণতা ওর রাগী চোখ দেখে শুকনো ঢোক গিলল।
পূর্ণতা নিজেকে সামলে বলল,“ আমার টানে তুমি ফোন দেওয়ার আগেই চলে এসেছ? আমাকে কেমন লাগছে দেখো তো?”
“ তুমি এই বেশে এইখানে কি করছো?” রাগান্বিত স্বরে বলল প্রভাত।
পূর্ণতার প্রভাত বাহু জড়িয়ে বলল,” আম্মুর বিয়ের শাড়ি আমি চুরি করে পরে এসেছি কেন জানো?”
প্রভাত কপাল কুঁচকে নিল। পূর্ণতা কে এইখানে এই বেশে দেখে ওর চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল।
ওর ফ্রেন্ড একটু আগেই ওকে কল দিয়ে জানিয়েছে,“ প্রভাত তোর গার্লফ্রেন্ড তো একেবারে নববধু সেজে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তুই কোথায়?”
“ কি বলছিস তোরা মাথা খারাপ হয়েছে? ও এখানে আসবে কেন?”
“ মাথা আমার না তোর খারাপ হবে। হাতে ইয়া বড়ো একটা ব্যাগ। মনে হচ্ছে একেবারে চলে এসেছে তোর কাছে। আচ্ছা তোর গার্লফ্রেন্ড কে আবার জোর জবরদস্তি করে বিয়ে দেওয়া চেষ্টা করছিল নাকি বাসা থেকে এমন বউ সেজে এসেছে কেন?”
“ কাকে না কাকে দেখেছিস? ফোন রাখ তো। ফালতু পেছাল শোনার টাইম নেই আমার কাছে।”
“ আরে ও আসবে তুই কি জানিস না? আচ্ছা আমি ছবি পাঠাচ্ছি তুই দেখ।”
প্রভাত চমকে উঠল।
“ ছবি দেওয়ার দরকার নেই আমি বাইরে আসছি।”
“ ওকে কিন্তু প্রভাত তোর তো মনে আর হোস্টেলে থাকার হবে না রে।”
“ মানে কি যাতা বলছিস? আমি হোস্টেলে থাকব না কেন?”
“ কিভাবে থাকবি? বউ নিয়ে কি আর হোস্টেলে থাকতে পারবি অতি শীঘ্রই তোকে নতুন বাসা নিতে হবে।”
বন্ধুকে ধমক দিয়ে কল কেটে বাইরে আসে দৌড়ে।এসেই লাল বেনারসী শাড়ি পরা পূর্ণতা কে দেখতেই ওর হৃদস্পন্দন থেমে যায়। পূর্ণতার শুভ্র গায়ে লাল টুকটুকে শাড়িটা দারুন ভাবে ফুটে উঠেছে। যেকোনো পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া জন্য এই শাড়ি পরা মেয়েটি যথেষ্ট। প্রভাত ঢোক গিলে নিজের দৃষ্টি সংযত করে এগিয়ে দাঁড়ায় পূর্ণতার পাশে। তারপর ওর হাতে বড়ো ব্যাগ থেকে চমকে উঠল। পূর্ণতা কি ভেবে এভাবে এসেছে বুঝতে পারতেই থমকে গেল।
পূর্ণতা পর্ব ৩৩
প্রভাত দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“ কেন এসেছ?”
পূর্ণতা এক গাল হেসে লাজুক কন্ঠে বলল,“ তোমায় নিয়ে পালিয়ে যাবার জন্য।”
লজ্জায় পূর্ণতার শুভ্র গাল রক্তিম হয়ে উঠছে। পূর্ণতা আর প্রভাতের দিকে আশেপাশের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
প্রভাত রাগে চোখমুখ আঁধার করে ফেলল। ঝামটা দিয়ে পূর্ণতার ধরা হাত নিজের বাহু থেকে ছাড়িয়ে নিল।