প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৬
Writer Mahfuza Akter
ড. আরমান মুখে কুটিল হাসি বজায় রেখেই সৌহার্দ্যের কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন। লোকটা যে একটা মানসিক রোগী, এতে সৌহার্দ্যের কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মানসিক রোগীরাও যে এত চতুর হতে পারে, সে ব্যাপারে সৌহার্দ্যের কোন ধারণা ছিল না। সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন হাতে নিলো। এই মুহূর্তে কাজ ফেলে বাসায় যাওয়া সম্ভব না। প্রহরের সাহায্য তাই অতি প্রয়োজন।
প্রহর ক্লাস শেষ করে বেরিয়েছে মাত্র। আজ তার একটাই ক্লাস ছিল। তাই এখন বাসায় গিয়ে খেয়ে-দেয়ে একটা লম্বা ঘুম দেওয়ার পরিকল্পনা তার। গাড়িতে উঠে গাড়ির চাবি ঘুরাতেই সৌহার্দ্যের কল দেখে কপালে গভীর ভাজ পড়লো প্রহরের। ফোন কানে লাগিয়ে সে চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করলো,
“এই অসময়ে ফোন করলি যে! কোন সমস্যা হয়নি তো?”
সৌহার্দ্য ত্যক্ত গলায় বললো, “সমস্যার তো শেষই নেই জীবনে! তবে তোকে একটা জরুরি প্রয়োজনে ফোন দিয়েছি।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“কী রকম প্রয়োজন?”
“এইচএসসির রেজাল্ট দিয়েছে আজ। মধু আর তরীও হয়তো এতক্ষণে নিজেদের রেজাল্ট জেনে গিয়েছে।”
“হ্যাঁ, ওদের তো জানারই কথা! দুপুর দুটোয় রেজাল্ট প্রকাশ পেয়েছে দেখলাম। আর এখন বাজে বেলা সাড়ে তিনটা। তুই দেখেছিস ওদের রেজাল্ট?”
সৌহার্দ্য ক্লান্ত বদনে হেসে বললো, “অনেক আগেই! তরীর তো এজ এক্সপেক্টেড সব সাবজেক্টেই এ-প্লাস এসেছে। তবে মধুর রেজাল্ট দেখে আমি বেশ অবাক হয়েছি। এতো ভালো করবে, আশা করিনি।”
মধুর রেজাল্টের কথা শুনে প্রহরও অবাক হলো, “কিরকম ভালো রেজাল্ট করেছে?”
“এ-প্লাস না পেলেও জিপিএ ভালো এসেছে। ফোর পয়েন্ট সিক্স ফাইভ।”
প্রহর কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলো। পরমুহূর্তেই সশব্দে হেসে উঠে বললো, “এইটা কোনো রেজাল্ট হলো? এটাকে তুই ভালো রেজাল্ট বলছিস? তুই নিজে এইচএসসিতে বোর্ডে ফার্স্ট হয়েছিলি, আর তোর বোন এতো নিকম্মা কেন? ওকে দেখলে কোনো এঙ্গেলেই তোর বোন মনে হয় না আমার। হা হা!”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে বললো, “মধুর সামনে আবার এসব বলিস না গিয়ে। এমনিতেই ও তোকে দেখতে পারে না।”
“তোর বোনের সামনে তো কখনো যাবই না আমি। আমায় দেখলেই এরকম ভাবে তাকায়, যেন চোখ দিয়েই ভস্ম করে দেবে আমায়। বাপ রে বাপ!” বলেই প্রহর লম্বা একটা শ্বাস ফেললো।
সৌহার্দ্য চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো, “কিন্তু তোকে যে আজ একটু আমার বাসায় যেতে হবে! বিকেল পাঁচটার আগে আমার বাসায় পৌঁছাবি, আর হাত বোঝাই করে মিষ্টি নিয়ে যাবি। আমি মাঝরাতের আগে বাসায় ফিরতে পারবো না।”
প্রহর কিছু বলার আগেই সৌহার্দ্য কল কেটে দিলো। যেন প্রহরের জবাব শোনার কোনো প্রয়োজন নেই! প্রহরের মুখ বিতৃষ্ণায় ভরে উঠলো। বিরক্ত হয়ে সে গাড়ি ঘুরালো, “জনাব অর্ডার দিয়েছেন! আমি তো তার হুকুমের গোলাম! কি দিনকাল চলে এলো!”
অনবরত কলিং বেলের শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে মধু বিরক্ত মুখে দরজা খুলতে খুলতে বললো, “খুশির দিনে একটু শান্তিতে নাচানাচিও করতে দেয় না! বেল বাজিয়ে কানের বারোটা বা…..”
প্রহরকে দেখেই মধুর অনবরত চলতে থাকা মুখ বন্ধ হয়ে গেল। মধু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো। প্রহর হাত ভর্তি মিষ্টির প্যাকেট দেখিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললো, “পরীক্ষায় পাশ করার জন্য কনগ্রেটস্!”
মধু মুখ বাকিয়ে প্রহরের সামনে থেকে চলে গেল। বিড়বিড় করে বললো, “অসহ্যকর!”
প্রহরকে দেখে মালিহার খুশির সীমা রইলো না। মধু মালিহাকে দেখে অবাক হয়। এই লোক এলেই মালিহার আতিথেয়তা এতো বেড়ে যায় কেন?
তরী প্রহরের সামনে চা, স্ন্যাকস্ ও মিষ্টি রাখতে রাখতে বললো, “আপনাকে কি সৌহার্দ্য ভা…..”
তরীর কথা শেষ হওয়ার আগেই মধু রাগী চোখে তাকিয়ে বললো, “এখন জামাইকে ভাই বলবি তুই? কমনসেন্স নাই তোর?”
তরী হতভম্ব হয়ে বললো, “মুখ ফসকে বলতে যাচ্ছিলাম। তুই তো বলতেও দিলি না!”
মধু ঠোঁট বাকিয়ে ভেংচি কাটলো। প্রহর চোখ ছোট ছোট করে মধুর দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা এমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে নাক-মুখ বাঁকায় কীভাবে? আশ্চর্য!
তরীকে আশ্বস্ত করার জন্য প্রহর বললো, “তুমি ঠিকই অনুমান করেছো। আমায় সৌহার্দ্য-ই পাঠিয়েছে! আর এটাও বলেছে যে, ও মাঝরাতের আগে বাসায় ফিরতে পারবে না।”
তরী মনঃক্ষুণ্ন হলেও হাসিমুখে মাথা নাড়ালো।
প্রহরের কথা অনুযায়ী সৌহার্দ্য মাঝরাতেই বাড়ি ফিরলো। ঘড়িতে তখন রাত দুটো বেজে সতেরো মিনিট। রিসার্চ সেন্টার থেকে তার বাসার দূরত্ব গাড়িতে ত্রিশ মিনিটের পথ, তবে মাঝরাতে রাস্তা ফাঁকা থাকায় আজ ফিরতে দশ মিনিটের মতো লেগেছে। ঘরের দরজা খুলতেই বরাবরের মতোই শূন্যতা অনুভব করলো সৌহার্দ্য। খুব কমসময়ের জন্য হলেও তরীর সান্নিধ্য তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এখন নিজেকেই সেই অভ্যাসের বিপরীতে লড়তে হচ্ছে।
প্রতিদিনের মতোই সৌহার্দ্য মধ্যরাতে তরীর ঘরে প্রবেশ করলো। তরী তখন জড়োসড়ো হয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। লম্বা চুলগুলো বিছানায় ছড়িয়ে সে ঘুমাচ্ছে। সৌহার্দ্য তরীর সামনে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মন ভরে তার চাঁদকে দেখলো। একবার স্পর্শ করে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে জাগলো। কিন্তু এতে যদি তরীর ঘুম ভেঙে যায়? তখন একটা ঝামেলা হবে। হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে সৌহার্দ্য নিজের ঘরে চলে এলো।
টেবিলে বসে ল্যাপটপ খুলতে।গিয়ে সৌহার্দ্যের কপালে ভাঁজ পড়লো। ল্যাপটপের ফাঁকে এক টুকরো সাদা কাগজ রাখা। সৌহার্দ্য কাগজটা হাতে নিলো। কাগজের এক পাশে কালো কলমে লিখা,
“আমায় অবহেলা করছেন আপনি, ডাক্তার সাহেব। আজ আপনার মুখ না দেখার এক মাস পূর্ণ হলো আমার। হসপিটাল আর রিসার্চ নিয়ে আপনি এতোটাই ব্যস্ত যে, আমাকে ভুলে গেছেন। আমিও আপনার সামনে আর কখনো আসবো না! আপনি বড্ড খারাপ লোক।”
তরীর হাতের লেখা সৌহার্দ্যের বেশ ভালো করে চেনা। লেখা টুকু পড়ে সৌহার্দ্য হাসলো। ডাক্তার সাহেব? এইটা কেমন নাম দিয়েছে? পৃথিবীতে কি কোনো প্রেমময় নাম ছিল না দেওয়ার মতো? ‘ ‘ডাক্তার সাহেব’ শব্দ দু’টো সৌহার্দ্য কয়েকবার আওড়ালো। প্রতিবারই হাসলো। মেয়েটা কি জানে যে, ওকে না দেখলে সৌহার্দ্যের দিনটা অপূর্ণ রয়ে যায়? সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাগজটা অপর পাশে লিখলো,
প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৬
“চাঁদ,
তোমায় দেখতে দেখতে আমার চোখ দু’টো অন্ধ হয়ে যাক;
তবুও তোমায় দেখার তৃষ্ণা না ফুরাক!”