দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২০
অবন্তিকা তৃপ্তি
সদর দরজার সামনে পা রাখতেই সিঁড়িতে পা ভেজে আচমকাই নিধি পড়ে যেতে নিল। অরূপের গায়ের উপর পড়তেই অরূপ টাল সামলাতে, নিধিকে বাঁচাতে নিধির কোমর ছুয়ে আটকালো পড়ে যাওয়া থেকে। নিধি থরথর করে কেঁপে উঠে অরূপের বুকের কাছের শার্ট খাঁমচে ধরলো। অরূপ নিধির দিকে কেমন অন্যরকম দৃষ্টিতে এই প্রথম তাকাল, নিধির মুখের আদল আচমকাই অরূপের ভীষন ভালো লেগে গেলো। অরূপ তাকিয়ে ছিলো, নিধি লজ্জা-সঙ্কোচ নিয়ে উঠে দাড়াবে সোজা হয়ে- তার পূর্বেই সদর দরজাটা খুলে বড়বড় চোখে ওদের দুজনকে দেখে ফেলল আশা! নিধি আশাকে দেখে দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, অরূপ বোকাবোকা চোখে দু বোনের দিকে চেয়ে হঠাৎই কেশে উঠল, নিচু স্বরে আশাকে বলল-‘উনাকে ভেতরে আনুন ভাবি।’
কথাটা বলে বিড়াল ছানার ন্যায় গুটিয়ে পালিয়ে ঘরে ঢুকে গেলো অরূপ। আশা নিধির দিকে তাকাল, নিধি গলা পরিষ্কার করে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললো-‘শরীর ব্লেলেন্স করতে পারিনাই। তাই ওভাবে-‘
আশা সঙ্গেসঙ্গে নিধিকে এসে জড়িয়ে ধরল, আবেগে আপ্লুত হয়ে বললো-‘আপা, আসতে কষ্ট হয়নি তো?’
নিধি হালকা হাসল, আশার পিঠে হাত বুলিয়ে বললো-‘তোর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আসলেই অদ্ভুত ভীষণ।তুইও তাদের কাছে থেকে নিজেও অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছিস।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আশা হেসে ফেলল, আবেগমাখা গলায় আরও কটা কথা বলবে, তার আগেই পেছন থেকে ওয়াহিদা বললেন-‘ওকে নিয়ে ভেতরে আসছো না কেন, আশা? গরমে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখলে, আক্কেল নেই?’
আশা ওয়াহিদার কথা শুনে জিহ্বা কাটল দাঁত দিয়ে, নিধিকে ধরে ধরে ভেতরে ঢুকলো। আশা এমনভাবে নিধিকে ধরে রাখছে, যেন আসলেই নিধি ভীষন অসুস্থ, হাঁটতেই অক্ষম। নিধি বোনের এমন পাগলামি দেখে হেসে উঠে মনেমনে।আশা নিধিকে সোফায় বসাল, ওয়াহিদাও মুখোমুখি সোফায় বসলেন। আশাকে বললেন-‘যাও শরবত বানিয়ে আনো আশা।’
আশা শরবত বানাতে চলে গেলো। ওয়াহিদা আর যাই হোক, বাড়ির মেহমানদের সঙ্গে কড়া আচরণ করেন না সাধারণত। তাই হাসিহাসি মুখে বললেন-‘কেমন আছো নিধি? অনি বলল, তোমার শরীর নাকি ভীষণ অসুস্থ।’
নিধি হালকা হাসার চেষ্টা করে বললো-‘তেমন নয় আন্টি। ওই একটু-‘
আশা শরবত নিয়ে এসেছে। নিধি শরবত খেতে খেতে উপরের সিঁড়ির দিকে এমনি তাকালো, অবাক হল নিধি। অরূপ নিধি তাকানোর সঙ্গেসঙ্গে মুখ চোরের মতো লুকিয়ে আবার ঘরে চলে যাচ্ছে দ্রুত। নিধি আশ্চর্য হলো ভীষন! ছেলেটা এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন?
আশা নিধিকে ওয়াহিদার কথায় একটা ঘর দেখিয়ে দিল। আশ্চর্যজনক ভাবে ঘরটা অরূপের পাশের গেস্টরুম। নিধি ঘরে ঢুকেই ফ্রেশ হতে গেলো। আশা নিধির ঘরের বিছানায় বসে থাকলো। নিধি বাথরুম থেকে বের হলে আসা হাসিহাসি মুখে বললো-‘আব্বা তোমাকে কী কিছু বলেছেন আপা?’
নিধি তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে বললো-‘কী বলবে?’
আশা কিছুটা দোনামোনা করে বললো-‘তোমার বিয়ের কথা। পাত্র নাকি সদ্য স্ত্রী হারিয়েছে। ওদের তোমাকে বেশ পছন্দ হয়েছে। আব্বা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে, তোমার সঙ্গে কথা বলতে। ওদের সঙ্গে কথা আগাবে কী না।’
নিধি হাসলো, বললো-‘ভালো মানুষকেই দায়িত্ব দিয়েছে আব্বা। তোকে এত পাকনামি করতে হবে না।আমি এখন বিয়ে করছি না। লোকটা কয়েকদিন হল না বৌ হারাল, এক্ষুনি বিয়ের জন্যে লাফাচ্ছে। ভালো নাকি লোকটা?’
‘তাহলে তুমি কী কোনোদিন বিয়েই করবে না আপা?- আশা গোমরা মুখে বলল।
নিধি আশার পাশে বসলো। হালকা হেসে বললো-‘করব না কেন? সারাজীবন আব্বার ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকব নাকি? তবে এবার ভেবেচিন্তে। আগের ভুলটা আমি আবার করতে চাইনা।’
আশা নিধিকে বসিয়ে রেখে রিসিপশনিস্টের কাছে এগিয়ে যায়-
‘এক্সকিউজ মি? আমি অনিরূপ শেখ জয়ের ওয়াইফ বলছি।’
আশা অনিরূপের শিখিয়ে দেওয়া কথাগুলো তোতাপাখির ন্যায় গড়গড় করে বলে ফেলে। ‘ওয়াইফ’ কথাটা বলার সময় আশা গলার স্বর অস্বাভাবিক ভাবে কেপেছিল। কিছুদিন আগেও এই কথাটা বলার সময় আশার রাগ হতো, ঘেন্নায় শরীর ঘিনঘিন করে উঠত। এখন সেটা আর হচ্ছে না, ঘেন্না না হলেও কোন একটা অস্বস্তির ফলা এসে বিধেছে বুকে। আশা কথাটা বলার সাথেসাথে রেসিপশনের মেয়েটা হন্তদন্ত হয়ে বলল-‘সিউর ম্যাম, স্যার আমাদের বলে রেখেছেন। আসুন আমার সঙ্গে।’
রিসিপশনের মেয়েটার এমন হম্বিতম্বি দেখে আশা কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে বলল-‘এত তাড়াহুড়ো করবেন না, প্লিজ। আমরা অপেক্ষা করছি , আপনি কাজ শেষ করুন।’
মেয়েটা আশার দিকে কিছুটা অবাক হয়ে তাকায়! স্যার এত রাগী, বদমেজাজি একজন, অথচ উনার স্ত্রী! পানির ন্যায় শান্ত, গলার আওয়াজ কী মিষ্টি! মেয়েটা হালকা হাসল, বলল-‘জী, আসুন।’
আশা নিধিকে নিয়ে মেয়েটার পিছু পিছু এগিয়ে গেলো। অনিরূপ প্যাশেন্ট দেখছে। রিসিপশনের মেয়েটা দরজায় টোকা দিল-‘স্যার আসব?’
অনিরূপ বুঝল আশা এসেছে। ও প্যাশেন্ট দেখে প্রেসক্রিপশন লিখে দিল। গরিব মানুষ এবার অনিরূপের হাতটা ধরে বলে উঠল-‘স্যার, ৫০০ টাকা কমায় রাখেন স্যার। অনেক কষ্টে আসছি আপনার কাছে। পিলিজ স্যার!’
অনিরূপ ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে হাত সরিয়ে ফেলে বললো-‘টাকা এটেন্ডেন্সের কাছে দিয়ে যান।’
রোগী বুঝে গেল, অনিরূপ টাকা কমাবে না। দুহাতে চোখের জল মুছে উনি উঠে দাড়ালেন। এটেন্ডেন্সের কাছে টাকা জমা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আশাকে দেখে। আশেপাশে কথা শুনে বুঝতে পারল, এটা স্যারের বউ! গরিব লোকটা আশার দিকে ঘৃণিত নজরে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ, আশা লোকটাকে দেখে ভ্রু কুঁচকায়। লোকটা আশাকে আগাগোড়া ঘৃণার নজরে দেখে মেয়েকে নিয়ে চলে গেলো। আশা তখনও ভ্রু কুচকে চেয়ে আছে লোকটার পিঠের দিকে। উনি এমন অদ্ভুত ভাবে আশাকে দেখছিল কেন? আশা বুঝে উঠে না। অনিরূপ ডাকছে। তাই আশা নিধিকে নিয়ে রুমে ঢুকে।
ওদের দেখে অনিরূপ হালকা হেসে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল, হাত সিয়ে সামনের চেয়ার দুটো দেখিয়ে বললো-‘বসো, বসো নিধি।’
নিধি আড়ষ্টতায় জড়িয়ে বসল। আশা বললো-‘আপনার কথামতো টেস্ট করিয়েছে ওরা।’
অনিরূপ নিধির আগের রিপোর্টগুলো ঘাটাতে ঘটাতে বলল-‘কালকের মধ্যে রিপোর্ট দিয়ে দিবে।’
ওদের কোথার মধ্যে অনিরুপ কলিং বেল বাজাল, এটেন্ডেন্স দ্রুত রুমে ঢুকলো। অনিরূপ জিজ্ঞেস করল-‘অরূপ স্যারের প্যাশেন্ট দেখা শেষ?’
‘জি স্যার।’
‘ওকে আমার রুমে পাঠিয়ে দাও।’
মেয়েটা চলে গেলো। অনিরুপ আশাদের দিকে ফিরে বলল-‘চা না কফি? নিধি?’
নিধি সঙ্গেসঙ্গে বললো-‘লাগবে না, আমরা চা খেয়েই এসেছি।’
অনিরূপ আর জোড়াজোড়ি করলো না। অরূপ এসেছে। হাতে এপ্রোন ঝুলিয়ে, বুকের কাছের শার্টের দুটো বোতাম খোলা।লোমশ বুক দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। নিধিকে একবার দেখেই অরূপ আরেকটা চেয়ারে বসল।অনিরূপ আশাকে একবার আড়চোখে দেখে, ফ্রান্স ভাষায় অরূপকে কিছু বললো। অরূপ অনিরুপের কথা শুনে আশার দিকে চেয়ে আবার অনিরুপের দিকে চাইল। অনিরুপ চোখের ইশারায় অনুরোধ করল অরূপকে। অরূপ হেসে ফেলল, বললো-‘ওকে।’
অরূপ তারপর আশার দিকে তাকাল। আশা-নিধি ওদের দুজনের দিকে
ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে। আশা বললো-‘এটা কী কোন কোড ল্যাংগুয়েজ?’
অনিরূপ কিছু না বললো, শুধু দাঁত বের করে হাসলো। অরূপ উত্তর করল-‘এটাকে ব্রো কোড বলে ভাবী। তুমি বুঝবে না।’
আশা এখনও গোল গোল চোখে ওদের কথা বোঝার চেষ্টা করছে। অনিরূপ উঠে দাঁড়াল। এপ্রোন খুলে হাতে ঝুলিয়ে আশার দিকে চেয়ে বললো-‘চলো, বেরোই আমরা। নিধির কিছু ওষুধ নিতে হবে। নিধি অরূপের সাথে আসবে ওগুলো নিয়ে। কাম অন!’
আশা হতভম্ব হয়ে বললো-‘আমি আপাকে নিয়ে এলাম, এখন আপার সাথে যাবো না?’
অনিরূপ বললো-‘না, কারণ তুমি এখন তোমার হাসবেন্ডের সাথে ডেটে যাবে। মা কে বলা আছে।’
আশা বিরক্ত হলো ভীষণ, বললো—‘পাগল আপনি? বেহুদা কথা বলছেন কেন?’
নিধি এবার নিজেই খুশি হয়ে বললো-‘আশা? যা, ঘুরে আয়। আমি যেতে পারব।’
আশা নিধির দিকে চেয়ে বললো-‘আপা, তুমিও এই লোকের পাগলামিকে সায় দিচ্ছো। উফ!’
নিধি হালকা হেসে বললো-‘কারণ এই পাগলামি গুলো একজন মেয়ের স্বপ্ন থাকে। তুই পাচ্ছিস দেখে আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। যা ঘুরে আয়।’
আশা আর কিছু বলবো, তার আগেই অনিরূপ বলে উঠে-‘বেরোবে? নাকি…’
নিধি এবার নিজেই আশাকে জোর করে চেয়ার থেকে উঠিয়ে অনিরূপের দিকে ঠেলে দিল। অনিরূপও হেসে আশার কাঁধ আগলে নিলো। তারপর আশাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যেতে লাগল সামনে।
ওরা যেতেই, নিধি কেমন আবেগপ্রবন হয়ে গেলো। হালকা হেসে চোখের কোনার জল লুকিয়ে ফেলল। বোনকে দেখে নিধির আফসোস হচ্ছে! এমন একটা পাগলাটে সংসার তো ওরও হতে পারতো!
অরূপ নিধিকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখে, একটু পর বলে উঠে- ‘বাসায় যাবেন না? চলুন।’
নিধি মৃদু হেসে ব্যাগ কাঁধে তুলে নিলো। অরূপ বাইরে এসে বাইকের চাবি বের করল, নিধি বাইক দেখে সঙ্গেসঙ্গে বললো-‘বাইক?’
অরুপ চাবি দিয়ে বাইক চালু করছিল, নিধির কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে বললো-‘কেন? সমস্যা ভাই গাড়ি নিয়ে গেছে।’’
নিধি এদিক ওদিক তাকিয়ে অশ্বস্তি ঢাকবার চেষ্টা করে বললো-‘আপনাদের বাসার ঠিকানা দিন, আমি পৌঁছে যেতে পারবো।’
অরু নিধিকে একবার দেখে আবার নিজের বাইকের দিকে তাকাল। পরপর কিছু এইটা মনে পরে ‘শীট!’ বলে বাইক থেকে নেমে গেল। নিধির দিকে চেয়ে বললো-‘চলুন, সিএনজি দেখি। সিএনজিতে তো আপত্তি নেই?’
নিধি এবার বিড়ম্বনায় পরে গেলো। বোনের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এত ভোগান্তি পোহাচ্ছে ওকে নিয়ে। লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছে নিধি। নিধি তাই বললো-‘আপনি যান।আমি যেতে পারব। প্লিজ ঠিকানাটা দিয়ে দিন।’
অরূপ হাসল। মেয়েটা লজ্জায়ই শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই ও এবার নিধিকে কিছু আর জিজ্ঞেস করল না, এগিয়ে গিয়ে সিএনজি দেখল। সিএনজি একটা পেয়ে হগিয়ে নিধিকে হাত বাড়িয়ে ডাকল। নিধি আবারও বললো-‘খামোকা কষ্ট করছেন আপনারা।’
দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১৯
অরূপ কিছুটা থমকলো। সত্যি তো! মেয়েটার জন্যে অরূপ এতো কেন বেগ পোহাচ্ছে? কীসের এত টান! মেয়েটাকে ভালো রাখার, উনাকে অস্বস্তিতে না ফেলার? অরূপ নিজের উপরই আশ্চর্য হচ্ছে।
অরূপ নিজের ভাবনা গুলো এখনকার মতো ঝেড়ে ফেলে নিধিকে জোরপূর্বক সিএনজি তে উঠে বসলো। নিজে ড্রাইভারের পাশে বসল। নাহলে দেখা যাবে, মেয়েটার পাশে বসলে এখানেও মেয়েটা অস্বস্তিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে।হাসে অরূপ! অস্বস্তি রানীটা!