মন রাঙানোর পালা পর্ব ২৩
ইয়াসমিন খন্দকার
অভিক আজ আরাফাতের পরামর্শ অনুযায়ী আনিসাকে নিয়ে একজন সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে এসেছে তাকে দেখানোর জন্য। বর্তমানে তারা অপেক্ষা করছে কখন সাইক্রিয়াটিস্ট হাসপাতালে এসে পৌঁছাবেন। দুজনেই তার কেবিনের বাইরে বসে অপেক্ষা করছে।
কিছু সময় পর, ডাক্তার চলে আসেন। ডাক্তারকে আসতে দেখে অভিক দাঁড়িয়ে পড়ে। সামান্য হেসে বলে,”আপনিই ডাঃ রহমান?”
ডাঃ রহমানও প্রাণোচ্ছল হেসে জবাব দেন,”জ্বি, আপনি নিশ্চয়ই মেজর অভিক, রাইট?”
“হুম।”
“আরাফাত আমাকে বলেছিল আপনার কথা। আপনার পেশেন্ট কোথায়?”
অভিক আনিসাকে সামনে এনে তার দিকে ইশারা করে বলে,”ও হলো আনিসা৷ ওকেই আপনার কাছে দেখানোর জন্য এনেছি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ঠিক আছে, আপনি ওনাকে ভেতরে পাঠিয়ে দিন। আমার একা ওনার সাথে কথা বলে ওনার মানসিক অবস্থাটা বুঝতে হবে। তারপর আমি বলতে পারব ওনার কি ধরনের ট্রিটমেন্ট বা থেরাপি প্রয়োজন।”
বলেই ডাঃরহমান নিজের কেবিনে প্রবেশ করেন। অভিক আনিসাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”তুই এখানে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? যা ওনার পেছন পেছন।”
আনিসা খানিক ভীতু স্বরে বলল,”তুইও আয় না আমার সাথে। আমার একা যেতে ভীষণ করছে।”
অভিক খানিক বিরক্ত হয়ে বলল,”এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি এখানেই আছি। তুই ডাক্তার রহমানকে বিশ্বাস করতে পারিস। উনি অনেক নামকরা একজন সাইক্রিয়াটিস্ট। তোর যা সমস্যা হচ্ছে নির্দ্বিধায় ওনাকে বলবি।”
অভিক এত করে বলার ফলে আনিসা কিছুটা সাহস পেল। ধীর পায়ে ডাক্তার রহমানের কেবিনে প্রবেশ করল। অভিক বাইরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল।
আনিসাকে কেবিনে প্রবেশ করতে দেখে ডাক্তার রহমান নম্র সুরে বললেন,”হ্যাভ আ সিট।”
আনিসা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে চুপচাপ বসে পড়ে। ডাক্তার রহমান জিজ্ঞেস করেন,”আপনার নাম?”
“আনিসা আঞ্জুম।”
“বয়স?”
“২৯”
“ওহ। তো বলুন আপনার কি সমস্যা?”
আনিসা চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে,”আপনি জীবনে কখনো কোন ভুল করেছেন ডাক্তার সাহেব? যার জন্য আপনাকে এখনো অব্দি পস্তাতে হচ্ছে?”
ডাক্তার রহমান মুচকি হেসে বলে,”সকল মানুষের জীবনই ভুল-ভ্রান্তি রয়েছে। কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। আমার জীবনেও এমন অনেক ভুল আছে। যা নিয়ে আমায় আফসোস করতে হয়।”
আনিসা কাঁদো কাঁদো সুরে বলে,”জানেন, ডাক্তার সাহেব। আমার ভুল আমাকে শান্তি দেয় না একমুহূর্তের জন্যেও। প্রতি মুহুর্তে আমাকে তড়পায়। যখনই সেই ভয়ানক স্মৃতি গুলো মনে পড়ে..আমি..আমার ইচ্ছা করে নিজেকে শেষ করে দেই।”
ডাক্তার রহসান শান্ত ও বিনম্র স্বরে বলেন,”কাম ডাউন। এত হাইপার হবেন না। ঠান্ডা মাথায় কথা বলুন। আমি বুঝতে পারছি আপনার অতীতে আপনার সাথে এমন কিছু ইন্সিডেন্ট ঘটেছে যা আপনাকে ট্রমাটাইজ করে রেখেছে। তবে আপনাকে এই ট্রমাকে ওভারকাম করতে হবে। দুচোখ বন্ধ করে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিন। তিক্ত স্মৃতিকে দূরে ঠেলে নিজের জীবনের সুন্দর মুহুর্তগুলো মনে করার চেষ্টা করুন। তাহলেই দেখবেন, আপনি অনেকটা শান্তি পাবেন।”
আনিসা, ডাক্তার রহমানের কথা মতোই কাজ করে। চোখ বন্ধ করে ভালো স্মৃতিগুলো মনে করে। যেই স্মৃতির সবটা ঘিরেই ছিল অভিক!
ডাক্তার রহমান আনিসাকে জিজ্ঞেস করে,”আপনি চোখ বন্ধ করে কি দেখতে পারছেন?”
ডাক্তার রহমানের প্রশ্নের জবাবে আনিসা বলে,”অভি!”
ডাক্তার রহমানের যা বোঝার বোঝা হয়ে যায়। তিনি আনিসার উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”আপনি এখন বাইরে যান এবং আপনার বন্ধু মেজর অভিককে ভেতরে আসতে বলুন।”
আনিসা মাথা নাড়িয়ে বিদায় নেয়। আনিসা চলে যাবার কিছু সময় পর অভিক ডাক্তার রহমানের কেবিনে প্রবেশ করে। ডাক্তার রহমানের সামনে বসে সে জিজ্ঞেস করে,”কি বুঝলেন ডাক্তার?”
“ওনার অতীতে বোধহয় খুব খারাপ কিছু হয়েছিল। যা ওনাকে ট্রমাটাইজ করে দিয়েছে।”
“ওকে এই ট্রমা থেকে বের করার কি কোন উপায় নেই?”
“উপায় আছে।”
“কি উপায়?”
“উপায়টা হলেন আপনি।”
“আমি?”
“হ্যাঁ, আপনি। আপনাকে ঘিরে ওনার অনেক সুন্দর স্মৃতি রয়েছে। যেই স্মৃতিগুলো ওনার ভালো থাকার কারণ। হয়তো ওনার অন্ধকারময় অতীতকে কাটানোর জন্য ওনার আপনার সঙ্গের প্রয়োজন।”
“আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন?”
“আপনি একটা কাজ করুন, মেজর অভিক। যতটা পারেন মিস আনিসার সাথে সময় কাটান। আপনার সাথে থাকলে হয়তো উনি ওনার ট্রমা অনেকটা কাটিয়ে উঠবেন। মোদ্দাকথা ওনার আপনার কোম্পানির প্রয়োজন।”
“জ্বি, বুঝতে পেরেছি। আপনাকে ধন্যবাদ।”
সুনীতি অস্থির হয়ে সারা ঘরময় পায়চারি করে চলেছে। ঘড়ির কাঁটায় সময় বর্তমানে বিকেল ৪ টা। অভিকরা ১২ টার সময় বের হয়েছে। এতক্ষণে তো ওদের চলে আসার কথা। সুনীতির ভাবনার মাঝেই কলিং বেল বেজে ওঠে। সুনীতি একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। দরজা খুলতেই সে দেখতে পায় অভিক ও আনিসা একসাথে দাঁড়িয়ে। সুনীতি ভালো করে খেয়াল করে দেখে আনিসার সাথে অনেকগুলো শপিং ব্যাগ। সাথে খাবারের প্যাকেটও আছে। অভিক সুনীতিকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খানিক বিরক্তির সুরে বলে,”এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমাদের ভেতরে তো প্রবেশ করতে দাও।”
সুনীতি দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়। আনিসা সবগুলো শপিং ব্যাগ নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। অতঃপর কয়েকটা ব্যাগ সুনীতির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”এগুলো নাও নীতি।”
“কি আছে এখানে?”
“আমি তোমার জন্য কিছু সালোয়ার কামিজ আর শাড়ি পছন্দ করে এনেছি।”
“আপনারা কি শপিং মলে গেছিলেন?”
“হ্যাঁ, শুধু শপিং মল না সেখান থেকে একটা রেস্টুরেন্টেও গিয়েছিলাম। ইশ,সেই কলেজ লাইফের স্মৃতিগুলো মনে পড়ে গেল। জানো তো নীতি, কলেজ লাইফেও আমরা এভাবে একসাথে শপিং করতাম,রেস্টুরেন্টে খেতাম আরো কত কি করতাম। অনেকবার তো এমন হয়েছে ক্লাস বাম্প করে সিনেমাও দেখতে যেতাম।”
কথাগুলো শুনে সুনীতির একদম ভালো লাগে না। তবুও সে মেকি হেসে বলে,”আপনারা তো বাইরে থেকে এলেন। যান ফ্রেশ হয়ে আসুন।”
বলেই সে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। অভিকও যায় তার পেছন পেছন। আনিসা নিজের জন্য শপিং করে আনা জিনিসপত্র গুলো দেখতে থাকে।
সুনীতি ঘরে এসে মন খারাপ করে বিছানায় বসে পড়ে। অভিক এসে তার পাশে বসে। সুনীতির হাত শক্ত করে ধরে হাতের উলটো পিঠে চুমু খেয়ে বলে,”রাগ করেছ নীতি?”
সুনীতির রাগটা আজ একটু বেশিই। তাই সে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে বলে,”আমি কেন রাগ করব? আমি কি রাগ করতে পারি? রাগ করা তো আমার জন্য নাজায়েজ!”
“ম্যাডাম আজ একটু বেশিই রেগে গেছে মনে হচ্ছে!”
সুনীতি বলে,”তুমি জানেন, তোমরা গেছ থেকে আমি কত দুশ্চিন্তায় ছিলাম জানো?”
“ভুল হয়ে গেছে নীতি। এমন ভুল আর হবে না।”
এবার সুনীতি একটু গলে গিয়ে বলে,”আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। তা ডাক্তার কি বলল?”
“ডাক্তার বলল যে, আনিসা কিছুটা মানসিক ট্রমায় আছে। আমার সাথে কাটানো সুন্দর মুহুর্তগুলোর জন্য নাকি ও আনন্দ পায়। এজন্য আমাকে বলল, ওর সাথে বেশি বেশি করে সময় কাটানোর জন্য।”
সুনীতি এটা একদম ভালো লাগল না। তবে সে নিজের খারাপ লাগা প্রকাশ না করে বলল,”এটা আবার কেমন সমাধান?”
“কি জানি! ডাক্তারই বললো, ওর সাথে বেশি বেশি সময় কাটাতে। যাতে ও ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসে। এজন্যই তো ওকে নিয়ে শপিং মলে ঘুরতে গেলাম।”
“ও..”
অভিক এবার সুনীতিকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে,”তুমি আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারো। আনিসাকে আমি শুধু বন্ধু ভেবে ওকে সাহায্য করছি এর থেকে বেশি কিছু নয়।”
মন রাঙানোর পালা পর্ব ২২
“আমি তো নিজের থেকেও তোমাকে বেশি বিশ্বাস করি। শুধু একটাই অনুরোধ, এই বিশ্বাসের অমর্যাদা করো না। নাহলে বিশ্বাস শব্দটার উপর থেকেই আমার বিশ্বাস উঠে যাবে।”