মন রাঙানোর পালা পর্ব ২৫
ইয়াসমিন খন্দকার
আনিসার জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনা শুনে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অভিক এবং সুনীতি। আনিসা সব কথা বলে মলিন হেসে বললো,”দোষটা আমারই ছিল…আমি ভুল মানুষকে ভালোবেসে নিজের জীবন বিপদে ঠেলে দিয়েছি।”
অভিক হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে,”তুই একদম চিন্তা করিস না আনিসা। শিহাব এবং তার সাথে যারা জড়িত তাদের সবাইকে আমি তাদের কৃতকর্মের জন্য উচিৎ শিক্ষা দিব। তোর এবং তোর বাবার প্রতি করা অন্যায়ের জবাব তাদের দিতেই হবে। তুই শুধু আমাকে সেই স্থানে নিয়ে চল যেখানে তোকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। সেখানে গেলে আমরা কোন ক্লু পেতে পারি।”
আনিসা বলে,”সেখানে যাওয়া বিপদজনক হতে পারে। তাছাড়া আমার মনে হয় না, আমি পালিয়ে যাবার পর শিহাবরা ওখানে কোন প্রমাণ আস্ত রেখেছে।”
“তুই আমাকে ঠিকানাটা শুধু দে। আমি আরো কিছু আর্মি নিয়ে সেখানে যাব। শিহাব এখানকার মোস্ট ওয়ান্টেড আসামী। ওকে আমাদের যে করেই হোক ধরতে হবে। ও দেশে ভয়ংকর মাদকদ্রব্য এবং অস্ত্রের চোরাচালান করে যা আমাদের দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাছাড়া তোর সাথে ও যা অন্যায় করেছে সেটারও কোন ক্ষমা নেই। তাই তুই শুধু আমাকে ঐ স্থান অব্দি নিয়ে চল। বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আনিসা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”আচ্ছা। চল তাহলে।”
অভিক সুনীতির উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তুমি এখানেই থাকো। আমি আনিসার সাথে যাচ্ছি। সাবধানে থাকো।”
সুনীতি কিছুটা ভীত স্বরে বলে,”ওখানে একা যাওয়াটা বিপদজনক হতে পারে।”
“আমি তো বললাম আরো কয়েকজনকে নিজের সাথে নিব। তুমি চিন্তা করো না।”
“ঠিক আছে, আপনিও সাবধানে যাবেন।”
অভিক মাথা নাড়িয়ে আনিসাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে৷ সুনীতি তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
গায়ে গোলাপী রঙের সালোয়ার সাথে মেচিং পাজামা পরিহিত একটা মেয়ে সেনাক্যাম্পের চারিদিকে ঘোরাফেরা করছে। ব্যাপারটা আরাফাতের নজর এড়ায় না। তাই তো সে ক্যাম্পের বাইরে এসে গলা খাকারি দিয়ে বলে,”হেই মিস, কে আপনি? কাকে চাই?”
গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠ কানে বেজে উঠতেই পেছনে ফিরে তাকায় অহনা। পেছনে তাকাতেই কিছুক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতে থাকে তার সামনে দাঁড়ানো আর্মির পোশাক পরিহিত উজ্জ্বল শ্যামলা সুদর্শন পুরুষটিকে। আরাফাত মেয়েটিকে এভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিব্রতবোধ করে। সামান্য কেশে বলে,”আপনি নিশ্চয়ই এখানে আমাকে দেখার জন্য আসেন নি৷ যেই কাজে এসেছেন সেটা বলুন।”
আরাফাতের কথায় অহনার ধ্যানভঙ্গ হয়। অচেনা পুরুষটির প্রতি খানিক ভালো লাগা তৈরি হলেও এমন ত্যাড়া কথায় মুহুর্তেই অনুভূতি বদলে যায়। সেও বেশ তেজ নিয়ে বলে,”আমার কি খেয়েদেয়ে আর কোন কাজ নেই যে আপনাকে দেখার জন্য ঢাকা থেকে এতদূর সিলেটে চলে আসব!”
আরাফাত হালকা হেসে বলে,”সেটাই তো জানতে চাইছি যে আপনি এখানে ঠিক কি করতে এসেছেন।”
অহনা এবার খানিক নরম গলায় বলে,”আমি আমার বান্ধবীর সাথে দেখা করতে এসেছি।”
“আপনার বান্ধবী?”
“আমার বান্ধবী সুনীতি। এই ক্যাম্পেই থাকে ” মেজর অভিক” ওনাকে চেনেন নিশ্চয়ই? মেজর অভিকের স্ত্রী সুনীতির বান্ধবী আমি৷ আমার নাম অহনা।”
আরাফাত বলে ওঠে,”ওহ,আপনিই তাহলে সেদিনের সেই ঝগড়ুটে মহিলাটা!”
অহনার কাছে আরাফাতের কন্ঠস্বরটা অল্প অল্প পরিচিত ঠেকছিল। এই কথার পরে সে সম্পূর্ণ বিষয়টা বুঝতে পারে। তেতে উঠে বলে,”ও আপনিই তাহলে সেই অসভ্য লোকটা যে আমায় স্টুপিড বলে অপমান করেছিলেন।”
“মুখ সামলে কথা বলুন। আমি একজন ডিউটিরত আর্মি অফিসার৷ আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারেন না।”
“আরে রাখুন আপনার ডিউটি। আমার বান্ধবীর সাথে শুধু আমার দেখাটা হতে দিন। তারপর আমি আমার দুলাভাইকে বলে আপনার শাস্তির ব্যবস্থা করছি।”
অহনার কথায় আরাফাত গগণবিদারী হাসিতে মগ্ন হয়। হাসতে হাসতেই বলে,”আপনি আমার শাস্তির ব্যবস্থা করছেন? রিয়্যালি? ওকে করুন দেখি। আগে নিজের বান্ধবীকে তো খুঁজে বের করুন।”
“ওয়েট, আমি আমার বান্ধবীকে এক্ষুনি কল করছি।”
বলেই সে সুনীতিকে ফোন লাগায়। কিছুক্ষণ ফোন রিং হবার পর সুনীতি ফোনটা রিসিভ করতেই অহনা বলে,”ঐ সুনীতি? কোথায় তুই?”
“আমি তো কোয়ার্টারে। কেন?”
“ভেবেছিলাম তোকে সারপ্রাইজ দিব কিন্তু সেটা আর হলো না৷ যাইহোক, আমি তোর এখানে এসেছি। বর্তমানে আর্মি ক্যাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু তোর কোয়ার্টার খুঁজে পাচ্ছি না। এখানে একজন অসভ্য লোক আমায় দাঁড় করিয়ে রেখে অপমান করছে। তুই এর একটা বিহিত কর।”
সুনীতি বলে,”ওহ, তুই আসবি আমায় আগে বলবি না? যাইহোক, যে তোকে বিরক্ত করছে তাকে ফোনটা দে তো।”
অহনা বিশ্বজয়ের হাসি হেসে আরাফাতের দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”এই নেন। আমার বান্ধবী আপনার সাথে কথা বলবে। আমাকে অপমান করার ফল এবার আপনি বুঝবেন।”
আরাফাত হাসিমুখে ফোনটা হাতে নিয়ে বলে,”হ্যালো, ভাবি। আসসালামু আলাইকুম। কিছু বলবেন?”
“আরাফাত ভাইয়া আপনি! অহনার কথায় কিছু মনে করবেন না। ও আসলে একটু বেশিই পাকনামি করে সব জায়গায়। আপনি কাইন্ডলি ওকে একটু কোয়ার্টার পর্যন্ত নিয়ে আসুন। আমি রান্না বসিয়েছি তো। এই অবস্থায় যেতে পারব না।”
“ঠিক আছে, ভাবি। নিন, আপনার বান্ধবীর সাথে কথা বলুন।”
বলেই ফোনটা অহনার দিকে বাড়িয়ে দিল। অহনা ফোনটা হাতে নিতেই সুনীতি কড়া গলায় বলল,”তুই চুপচাপ ওনার সাথে কোয়ার্টার অব্দি চলে আয়। আর ওনার সাথে খারাপ ব্যবহার করার জন্য ক্ষমা চাইবি। উনি তোর দুলাভাইয়ের বন্ধু হয়। তোর দুলাভাই যদি জানতে পারে তুই ওনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিস তো খারাপ ভাববে।”
‘কিন্তু…’
“আমি কোন কথা শুনতে চাই না অহনা। যা বলছি তাই কর।”
অহনা বেরস মুখে ফোনটা রেখে দেয়। আরাফাত বলে,”চলুন তাহলে আপনাকে কোয়ার্টার অব্দি পৌঁছে দেই।”
অহনা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”তার কোন প্রয়োজন হবে না। আপনি আমাকে রাস্তাটা দেখিয়ে দিন আমি একাই চলে যাব।”
“আপনার কথা শুনতে আমি বাধ্য নই। ভাবি আমাকে বলেছে আপনাকে কোয়ার্টার অব্দি পৌঁছে দিতে। আমাকে তার কথাই শুনতে হবে। তাই আমার পেছন পেছন আসুন।”
বলেই আরাফাত হাঁটতে শুরু করে। অহনা আর কোন উপায় না পেয়ে তার পিছন পিছন যেতে থাকে।
অহনাকে কোয়ার্টারে পৌঁছে দিয়েই আরাফাত বিদায় নেয়। সুনীতি অহনাকে জিজ্ঞেস করে,”তুই ওনার কাছে ক্ষমা চেয়েছিস তো?”
“তোর আমাকে কি মনে হয়? আমি কখনো কারো কাছে মাথানত করার মেয়ে?”
সুনীতি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”এত ইগো ভালো নয় অহনা। একদিন তোর এই ইগোই দেখবি তোকে কোন বিপদে ফেলবে। যাইহোক, হঠাৎ এভাবে চলে এলি?”
অহনা বলে,”হঠাৎ মানে? তোর জন্য আমার কত চিন্তা হচ্ছিল জানিস। কাল যখন তুই আমায় ঐ আনিসা না কি জানি মেয়ের ব্যাপারে বললি তখন তো আরো চিন্তা হচ্ছিল।”
“আনিসা আপুকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। উনি একজন অসহায় নারী৷ ওনার থেকে কোন বিপদ নেই।”
“কাউকে এতটা অন্ধবিশ্বাস করা ঠিক নয়।”
“বাদ দে, এসব। তুই একটু বিশ্রাম কর, আমি খাবার নিয়ে আসছি৷ তুই যদি আগে জানাতি আমি ভালোমন্দ কিছু করতে পারতাম।”
“শোন, আমার সাথে এত ফর্মালিটি করতে হবে না। তোর সাথে আমার অনেক কথা আছে তুই বসে বসে শোন।”
“বল, শুনছি।”
অহনা নিজের ফোন বের করে সুনীতিকে দেখায়। একটা ছেলে তাকে ম্যাসেজ করে রোজ বিরক্ত করে। সুনীতি জিজ্ঞেস করে,”ছেলেটা কে জানিস?”
“সেটা তো জানিনা। কিন্তু ছেলেটা নাকি আমার থেকে জুনিয়র হবে। ও নিজেই বলেছে ও ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। এবার এইচএসসি দিবে।”
“এই ছেলে তোকে ম্যাসেজ দেয় কেন?”
“ছেলেটা নাকি আমায় ভালোবাসে। অন্তত মুখে সেটাই বলে।”
“ছেলেটার ব্যাপারে কিছু জানিস না?”
“আরে না। দেখিস না, আইডিটা তো ফেক। আসল নাম দেয়া নেই। আইডির নাম ” নীলাভ আকাশ” আমি কিভাবে বুঝব এটা কে?”
মন রাঙানোর পালা পর্ব ২৪
“জিজ্ঞেস করিস নি?”
“করেছিলাম উত্তর দেয়নি। প্রতিদিন আমায় কবিতা লিখে পাঠায়। খোঁজ-খবর নেয়। অনেক কেয়ারিং। কিন্তু আমার তো জুনিয়র পছন্দ না।”
“ট্রাই করে দেখতে পারিস।”
“দরকার নেই। আমি এসবে নেই। মা যাকে আমার জন্য পছন্দ করবে তাকেই বিয়ে করব।”