দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২১
অবন্তিকা তৃপ্তি
সুন্দর, শুনশান একটি রাত! শহরে অনেক নিয়ন বাতির ঝলমলানি দেখা যাচ্ছে। গাড়িতে একটা সফ্ট মিউজিক বাজছে। আশা এখনও মুখটা ফুলিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। অনিরূপ বার কয়েক চেষ্টা করছে আশার সঙ্গে কথা এগুনোর। অথচ জেদি মেয়েটা মুখই খুলছে না। অসম্ভব একটা মেয়ে! অনিরূপ বিড়বিড় করে বলে বসে-‘শরীরে ২০ কেজির মাংস নেই, অথচ জেদ শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, উফ!’
আশা এখনও জানালার দিকে চেয়ে আছে। অনিরূপ এবার মিনমিন করে কথা বলার ট্রাই করে-‘আশা, শুনো আশা! ‘
আশা তাকাল না। অনিরূপ আবারো গলা কেশে বলে-‘আল্লাহর ওয়াস্তে কথা তো বলো, আশা। ঘুরতে এসে মুখটা বেজার করে রেখেছ, আর আমার মুডটাও খারাপ করছো!’
আশা এবার অনিরুপের দিলে তাকাল। কিছুটা রেগেই বললো-‘আপাকে এভাবে ফেলে এলাম এটা কী ঠিক হয়েছে? অরূপকে বারবার ভোগান্তি দিচ্ছেন আপনি।’
অনিরূপ কিছু একটা ভেবে তির্যক হেসে বললো-‘হয়তো অরূপের জন্যে এটা ভোগান্তি নয়, হয়তো তার থেকেও বেশি কিছু।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আশা অনিরূপের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, এই লোক শুধরানোর নয়। সারাক্ষণ নিজের মর্জি মতো চলা লোক জীবনেও কী আশাকে শুনবে? উহু!
আশা আবারও চুপ হয়ে যায়। অনিরূপ বললো-‘কোথায় যাবে এখন বলো? চাইনিজ রেস্টুরেন্ট? নাকি আমার পছন্দের ইতালিয়ান খাবে?’
আশা আশেপাশে চায়। আজকের রাতটা ভীষণ শীতল, আরামদায়ক! শীতল বাতাস বইছে চারদিকে। বাতাসে আশার খোপা করা চুলও এলোমেলো হচ্ছে। আশা মুখটা ভরে শ্বাস টানল! তারপর চোখ বন্ধ করে লম্বা লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে আপনা আপনি অস্ফুট স্বরে বলে বসলো-‘কোন কৃতিমতা নেই, এমন জায়গায় যাব।’
অনিরূপ রাস্তায় ফোকাস করে ছিল। আশার কথা শুনে বলে উঠল-‘হোয়াট?’
আশা এবার সরাসরি তাকায় অনিরূপের দিকে। সুন্দর করে হেসে আবদার করে বসে- ‘গাড়িটা ঘুরিয়ে একটা নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে যান না।’
অনিরূপ ভ্রু কুঁচকে আশার দিকে তাকিয়ে বললো-‘আর ইউ ম্যাড? এত রাতে নিরিবিলি জায়গা মানে বুঝো? রিস্ক আছে।’
আশা অবুঝের মতো বলে বসে-‘কীসের রিস্ক?’
অনিরূপ এবার ক্রূর হাসে। আশার চুলের খোপাটা আচমকা খুলে দিয়ে ঝরঝরে হেসে বলল-‘ সুন্দরীদের রাক্ষসরা কেড়ে নিতে চায় একা পেলে, জানো না?’
আশা ভ্রূ বাঁকায়, বলে-‘তাতে কী? স্ত্রী রক্ষার দায়িত্ব নিবেন!’
অনিরূপ কিছু না বলে শুধু হাসে। অথচ মনেমনে সে বলে একের পর এক কথা-‘তোমার জীবনে সত্যিকারের রাক্ষস তো আমি, সুন্দরী আশা! আমি এলাম, তোমাকে কেড়ে নিলাম, আর এখন? তোমার মন কাড়ার জন্যে আমার জান হাজির করে দিলাম।আমার সুন্দরীটা আসলে, বড্ড পোউর!! আহা!’
অনিরূপ নিয়ে যাবে না দেখে আশা আর কথা বাড়ায় না। চুপ করে বসে থাকে বাকীটাসময়। কিন্তু একটাপর্যায়ে দেখে অনিরূপ সত্যি সত্যি আশাকে নিয়ে যায় একটা নদীর পাড়ে। নদীর পাড়ে রাত নটায়ও একটা-দুটো কাপল দেখা যাচ্ছে, ওরা নিজেদের মতো করে সময়টা উপভোগ করছে।
অনিরূপ ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে আশার দিকের দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দিল, পারফেক্ট ম্যানলি ভঙ্গিতে বললো-‘ইওর হ্যান্ড, হানি?’
আশা অনিরূপের নাটক দেখে হেসে ফেলল কেন যেন। ‘বড্ড নাটক করছেন’ বলে হাসতে হাসতে হাত দিল অনিরূপের হাতে!
প্রথমবারের মতো অনিরূপের দিকে বাড়িয়ে দেওয়া আশার হাতটা অনিরূপ বেশ সফ্টলি আগলে চেপে ধরলো। আশা নামল গাড়ি থেকে। অনিরূপ আশা কে নিয়ে এগিয়ে গেলো সামনে। আশা হাঁটতে হাঁটতে চারিদিক দেখে বললো-‘ভেবেছিলাম অন্ধকার থাকবে সব। এখন তো দেখছি আলো আর আলো।’
অনিরূপ আশার হাতটা এখনো ধরে আছে। অনিরূপ ওদের দুজনের ধরে রাখা হাতটা এখনো অদ্ভুত ভাবে দেখেই যাচ্ছে। বিষয়টা ভালো লাগছে দেখতে ওর। আবেগে, আবেশে অনিরূপ হঠাৎ আশার হাতটা চেপে ধরলো শক্ত করে, আশা অনিরূপের দিকে তাকাল তখন। অনিরূপও তাকাল। দুজনের চোখে চোখ পড়ল। আশা নিজের হাতের দিকে তাকাল, তারপর আস্তে করে হাতটা নিয়ে নিলো অনিরূপের হাত থেকে। অনিরূপ এখন আর হাতে গরম কিছু অনুভব করছে না, হাতে আরাম লাগছে না একদম আর। হাতটা কেন যেন বড্ড অসম্পূর্ণ দেখাচ্ছে। অনিরূপ ব্যর্থ ভঙ্গিতে আশার দিকে তাকাল।
আশা ইতি-ওতি চেয়ে সঙ্কোচ নিয়ে বললো-‘জায়গাটা ঘুরে দেখি?’
অনিরূপ আশার দিকে তাকাল, মাথা নেড়ে অস্ফুট স্বরে বললো-‘হু-হ্যাঁ, চলো।’
আশা হাঁটছে। অনিরূপ পাশে পাহ হাঁটছে ওর। পাশেই একটা ছোটখাটো ধাবা দেখা যাচ্ছে। অনিরূপ সেটা দেখে বললো-‘ক্ষুধা পেয়েছে তোমার? ধাবা আছে এখানে একটা।’
আশা উচ্ছল ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে বললো-‘না, আরেকটু পরে খাই?’
অনিরূপও আর জোর করলো না। ওরা হাঁটতে হাঁটতে বেশ দূর এসে গেছে। এবার অনিরুপ একটা গান ছাড়ল ওর ফোনে। আশা হঠাৎ গান শুনে বললো-‘আপনি গানও শুনেন?’
অনিরূপ মাথার পেছন চুলকে হাসার চেষ্টা করে বললো-‘ওই মাঝেসাঝে।’
আশা হেসে বললো-‘আপনি দেখায়; আচার আচরণে খারুস পুরুষমানুষ হলেও আপনার মধ্যে এখনও একটা দুরন্তপনা আছে। কিন্ত আমার মনে হয়, আপনি আপনার এই দিকটা লুকিয়ে রাখতেই বেশি পছমদ করেন! আই গট ইট!’
অনিরূপ ভ্রু বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে-‘এমন মনে হওয়ার কারণ?’
আশা জবাব দিলো-‘কারণ আপনি ভয় পান, না জানি আপনার মেইল ইগো ছোট হয়ে যায় মানুষের সামনে।’
অনিরূপ হেসে ফেলল। ভ্রূ নাচিয়ে বললো-‘ আমার উপর আজকাল পিএইচডি করছো নাকি?’
আশা বললো-‘এমন নয়। আপনার সঙ্গে এতটা মাস থাকতে থাকতে কিছুটা হলেও আপনাকে বুঝে ফেলেছি।’
অনিরূপ কিছু বললো না। অনিরূপকে জানতে চাইলে, জানুক! সে আশাকে ততটাই জানতে দিবে, যতটা সে চায়!
আশা হাঁটতে হাঁটতে বললো-‘গানটা ভালো মানিয়েছে এখনের আবহাওয়া আর সিনারিও এর সঙ্গ।’
‘আর আমাদের জুটির সঙ্গেও-‘ -অনিরূপ কথার উপরে বলে ফেলল।
আশা চমকে অনিরুপের দিকে তাকাল, পরপরই লজ্জা অথবা সঙ্কোচে আবারও গুটিয়ে গেল।আশা আগে আগে আরো কয়েক কদম এগোতেই, অনিরূপ এবার পেছন থেকে ডেকে উঠল-‘
‘এই যে সুন্দরীতমা স্ত্রী আমার!’
আশা এত জোরে ডাক শুনে চমকে পেছনে তাকাল। অনিরূপ আশার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। হাত পাতিয়ে আশার দিকে চেয়ে বড্ড রোমান্টিক ভঙ্গিতে চেয়ে আছে আশার দিকে। আশার চোখে বিস্ময়. চমক!
অনিরূপ হাতটা ওভাবেই বাড়িয়ে রেখে রোমান্টিক ভঙ্গিতে অনুমতি চাইল-‘উইল ইউ ওয়ানা ড্যান্স উইদ মি, মিসেস অনিরূপ শেখ জয়?’
আশা আশেপাশে চায়। সব কাপলরাই এই নিরিবিলি মোমেন্ট উপভোগ করছে। আশা আবারো অনিরূপের দিকে চায়।ফিসফিস করে শাসায়-‘পাগল? এখানে ড্যান্স করবেন আপনি?’
অনিরুপ আবারও বলল-‘কেন নয়? পাশে এমন সুন্দরী স্ত্রী থাকলে স্বামীরা একটু আকটু ডান্স করতেই চায়। সো মে আই?’
এমন কথার ধরনে, আশা কেন যেন ঠোঁট টিপে হেসে উঠল। পরপরও আবারও মুখটা স্বাভাবিক করে ফেলল। অনিরূপের দিকে চেয়ে রেগে কিছু বলতে গিয়েও কেন যেন বলতে পারল না। হয়তো চারদিকের পরিবেশটাই এমন রোমান্টিক, আবেগে ভেসে বেড়ানোর মতো।
তাই কোমলমতি আশা স্বামীর আবদারে গলে, আবেগে গা ভাসিয়েই দিল। হাত বাড়িয়ে ছুলো অনিরূপের হাতখানা। অনিরূপ আলতো করে ওই হাতটা ছুলো। মাথা নিচু করও একটু হেসে আবারও আশার দিকে তাকাল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আশার কোমরে হাত রাখল। আশা অনিরূপের কাঁধে হাত রেখে লজ্জা নিয়ে বললো-‘আমি ডান্স পারি না।’
অনিরূপ আশার হাতটা একটু উঁচু করে হেসে বলল-‘আপনার স্বামী আপনাকে শিখিয়ে দিতে চাইছে, মিসেস অনিরূপ! শিখতে চাইবেন তার কাছে?’
আশা অনিরূপের এমন নাটক দেখে হেসে ফেলল! অনিরূপের ফোনে গান বাজছে-
Ladies and gentlemen, will you please stand?
With every guitar string scar on my hand
I take this magnetic force of a man to be my lover
My heart’s been borrowed and yours has been blue
All’s well that ends well to end up with you
Swear to be overdramatic and true to my lover
And you’ll save all your dirtiest jokes for me
And at every table, I’ll save you a seat, lover
অনিরূপ আশাকে ঘুরিয়ে গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলালো,আশা যতটুকু পারছে অনিরূপের সঙ্গে তাল মেলানোর চেষ্টা করছে।গ্রামের মেয়ে, টিভি দেখে যতটুকু শিখেছি আরকী!
গানের একপর্যায়ে অনিরূপ বিড়বিড় করে আশার কানের কাছে এনে শেষেরটুকু বলল-‘লাভারর’
আশার স্যুরসূরি লাগলো ভীষণ! ও হেসে উঠে ও কান সরিয়ে কাঁধ সংকুচিত করে ফেলল। অনিরুপ আশার কোমর ধরে একটার পর একটা স্টেপ দিতে দিতে গান গাইলো-
Can I go where you go?
Can we always be this close forever and ever?
And ah, take me out, and take me home (forever and ever)
You’re my, my, my, my
Oh, you’re my, my, my, my
Darling, you’re my, my, my, my
Lover
তারপর আবারও আশার ওপর কানে বিড়বিড় করল আগের মতো-‘লাভারর!’
আশা এবার অতিরিক্ত সুড়সুড়িতে হেসেই ফেলল! অনিরূপের কাঁধে থাকা হাতটা অনিরূপের পরনের নেভি ব্লু শার্টটা খামচে ধরে হাসতে হাসতে বলে উঠল-‘সুড়সুড়ি লাগে, এমন করবেন না প্লিজ!’
অনিরূপ বোকা বোকা চোখে আশার দিকে চেয়ে বলে উঠল-‘এটা একটা রোমান্টিক স্টেপ, আশা!’
আশা থমকে গেলো! সঙ্গেসঙ্গে লজ্জায় অনিরূপের কাঁধ ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। অনিরূপও আশার কোমর ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
আশা অনেকক্ষণ হলো এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে! আশা কাঁপছে, ওর নরম হৃদয়টা আজকাল বড্ড অচেনা ঠেকে ওর কাছে। অনিরূপের বদলে যাওয়া শুরুতে খটকা লাগলেও, এখন আশার ভালোবাসা লোভী মনটা ক্ষয়ে গেছে স্বামীর প্রেমে। হ্যাঁ, স্বীকার করে আশা এখন সেটা! কিন্তু সেটা মনেমনে। মুখে আশা মরে গেলেও বলবে না অনিরূপকে ভালোবাসে, অসভ্য স্বামীর প্রেমে আশা শেষ অব্দি পিছলালোই!
স্বীকার করতে যে আশার বড্ড ভয়! যদি অনিরূপ বদলে যায়, ধোঁকার ব্যথাটা আবার পেতে হয়? স্বামীর কাছে নিজের অনুভূতি নিয়ে অপমানিত হলে আশা যে মরে যাবে লজ্জায়! প্রবল আত্মসম্মান খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে আশা! বড্ড ভয় আশার কোমল মনে!
অনিরূপ এখনও সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে আশার পাশে।অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর একটা সময় আশা টলমল চোখে চেয়ে- অস্ফুট স্বরে প্রশ্ন করে বসে-
দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২০
‘আপনি কী সত্যি বদলে গেছেন? সত্যিই?’
অনিরূপ আশার দিকে মাথা তুলে চায়! তার চোখে কিছু একটা আজকে দেখা যাচ্ছে! আজকে অনিরুপের বুকে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে! আশার টলমলে কণ্ঠের প্রতুত্তরে মিথ্যা বলতে কেন যেন আজ অনিরূপের একটুও মন চাইল না! অনিরূপ বুকের ঢিপঢিপ শব্দকে এড়িয়ে, শুধু এটুকু বললো-‘ধাবা বন্ধ হয়ে যাবে, ডিনারটা এখুনি করে ফেলবে?’