মন রাঙানোর পালা পর্ব ২৮
ইয়াসমিন খন্দকার
চোখ বন্ধ করে বসেছিল অন্ধকার ঘরটায়। হঠাৎ সেখানে কারো প্রবেশের শব্দে অভিক চোখ মেলে তাকায়৷ চোখ মেলতেই দেখতে পায় শিহাবকে। ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,”তুই!”
শিহাব শয়তানি হেসে বলে,”হ্যাঁ, আমি। তোর সাথে বোঝাপড়া করতে এলাম।”
“কিসের বোঝাপড়া?”
শিহাব অভিকের সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে। অভিকের মাথায় একটা বন্দুক তাক করে বলে,”আমাদের অনেক জ্বালিয়েছিস তুই,,,তোর জন্য আমার ব্যবসায় অনেক লস গেছে। কতবার সীমান্তের পারে আমাদের কত মাল আটকে দিয়েছিস। আমার কত লোককে ধরে নিয়ে গেছিস। তোর জন্য যা ক্ষতি হয়েছে তার সব কিছুর হিসাব আজ নেব।”
বলেই বন্দুকের ট্রিগারে চেপে ধরে। অভিক হঠাৎ করে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিয়ে বলে,”আজকে যেন কয় তারিখ?”
হঠাৎ অভিকের এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় শিহাব। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”হঠাৎ এসব কেন জিজ্ঞেস করছিস?!”
অভিকের হাসি চওড়া হয়। সে বলে,”তোর বুঝি আজকের দিন তারিখ মনে নেই৷ কোন ব্যাপার না, আমি তোকে মনে করিয়ে দিচ্ছি। আজ ২৮ শে সেপ্টেম্বর, বুধবার। আজকে তোর সাথে তোর ইন্ডিয়ান পার্টনার চতুষ্পদ ত্রিবেদীর মিটিং হবার কথা। একদম পার্ফেক্ট টাইমিং, তাইনা? দুজনকেই একসাথে ধরতে পারা যাবে।”
“এসব কি বলছিস তুই?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কি ভেবেছিস তুই? বুদ্ধি কি তোর একার মাথাতেই আছে? আমাদের মাথায় কি বুদ্ধি নেই? বাংলাদেশ আর্মিকে এতটা বোকা ভাবিস না। তোরা অপরাধীরা যদি চলিস ডালে ডালে তাহলে আমরা চলি পাতায় পাতায়।”
“তোকে আমি শেষ করে দেব! একদম চালাকি না।”
“তুই কি করবি? তোর সবকিছু করার সুযোগ শেষ।”
অভিকের কথা শেষ হতে না হতেই হুড়মুড় করে ঐ বদ্ধ ঘর টাতে ঢুকে পড়ে আর্মির কয়েক জন সদস্য। তাদের ঢুকতে দেখে অভিক বলে,”এই যে..তোদের খেলা শেষ।”
শিহাব চিৎকার করে বলে,”এটা কোনমতেই হতে পারে না। আমার এত দিনের সাজানো সাম্রাজ্য এভাবে নষ্ট হতে পারে না। আমি এটা হতে দেব না।”
আরাফাত এসে শিহাবের হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিয়ে তাকে গান পয়েন্ট করে বলে,”ঐ মামা না প্লিজ! তোর খেলা শেষ!”
শিহাব রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,”তোরা আমার সাথে ডবল গ্লেইম খেলেছিস। ছাড়বো না কাউকে আমি!”
এত চিৎকার চেচামেচির শব্দ শুনে আনিসাও এগিয়ে আসে। আনিসা আসতে দেখে অভিক বলে,”ওখানেই দাঁড়িয়ে যা৷ তুইও এই অপরাধীদেরব সাথে ছিলি৷ তাই বাকিদের সাথে তোকেও বন্দি করার আদেশ আছে।”
আনিসা অভিকের কথা মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে যায়। কয়েকজন আর্মি এগিয়ে এসে অভিকের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দেয়। অভিক উঠে দাঁড়িয়ে শিহাবের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”নিজেকে বেশি চালাক ভেবেছিস, হ্যাঁ? কি ভেবেছিলিস তুই না? কি ভেবেছিলি আনিসাকে কাজে লাগিয়ে আমাকে বোকা বানিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করবি। অথচ শুরু থেকেই যা আমরা তোর সাথে গেইম খেলছি সেটা বুঝলিও না।”
আনিসা হতবাক হয়ে অভিকের দিকে তাকায়৷ অভিক আনিসার দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,”মীরজাফর চিনিস শিহাব? তোর দলেও এমন একজন মীরজাফর লুকিয়ে ছিল। যে গোপনে তোর সব তথ্য আমার হাতে তুলে দিত। যাইহোক, জানতে চাস না সেই মীরজাফর কে? দাঁড়া,পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। কালিয়া,সামনে আসো।”
অভিক একবার ডাক দিতেই দৌঁড়ে সামনে চলে আসে কালিয়া। কালিয়াকে দেখে শিহাব অবাক হয়ে যায়। কারণ এ যে তার সবথেকে বিশ্বস্ত লোক। সেই কিনা এমন ধোকাবাজি করল! শিহাব রাগী চোখে কালিয়ার দিকে তাকালো। কালিয়া ৩২ পাঁটি দাঁত বের করে হেসে বললো,”আজ থেকে কয়েক মাস আগে আমি আর্মিদের হাতে আটক হইছিলাম। তখন ওরা আমাকে কিছু না করে ছেড়ে দেয়। তখন থেকেই আমি ওদের কেনা গোলাম হয়ে যাই। এখান থেকে সব তথ্য আমিই ওদের পাচার করি।”
এবার অভিক বলে,”কালিয়াই আমাকে জানিয়েছিল তুই আনিসাকে ব্যবহার করে আমার বিরুদ্ধে কি পরিকল্পনা করছিস। আমি সব জেনেশুনেই তোর পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করি। আমি যখন আনিসাকে নিজের সাথে করে নিয়ে যাই এবং তার সাহায্য করি তখন তুই মনে করিস আমি তোর ফাঁদে পা দিয়েছি। কিন্তু তুই বুঝতে পারিস নি সবটাই ছিল আমার প্ল্যান। আমি খুব সুন্দর ভাবে নাটক চালিয়ে যাই। তোকে বা আনিসাকে ঘুনাক্ষরেও এটা সন্দেহ করতে দেই না যে,,আসলে আমার পরিকল্পনা কি ছিল। আমি তোকে আর আনিসাকে সমাল তালে বোকা বানাই৷ তুই ভেবেছিলি সবটা তোর প্লানমতো চলছে কিন্তু আসলে সবকিছু চলছিল আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী।”
অভিক একটু থেমে বলে,”আমরা চাইলে অনেক আগেই তোকে বন্দি করতে পারতাম। কিন্তু আমাদের উদ্দ্যেশ্য ছিল তোর ইন্ডিয়ান পার্টনারের সাথে তোকে গ্রেফতার করা। এইজন্যই এত নাটক করতে হয়েছিল।”
এই বলে অভিক সামনে তাকায়। কয়েকজন আর্মি চতুষ্পদ ত্রিবেদীকে ধরে নিয়ে সামনে আসছে। অভিক বাকা হেসে বললো,”অবশেষে আমার পরিকল্পনা সফল। তোকে বোকা বানিয়ে তোদের দুজন পার্টনারকেই একসাথে গ্রেফতার করতে পেরেছি৷ এজন্যই তো এত কিছু! এবার তোদের এই অন্যায় সাম্রাজ্যের ধ্বংস হবে চিরতরে।”
শিহাব আর কিছু বলতে পারে না। সে বুঝতে পারে তাকে কিভাবে ঠকানো হয়েছে। অভিক এবার শিহাবের কাছে এসে বলে,”তোর সব খেলা শেষ। এবার নিজের বাকি দিনগুলো অন্ধকার চার দেয়ালে কাঁটানোর জন্য প্রস্তুতি নে।”
অতঃপর অভিক এগিয়ে যায় আনিসার দিকে। আনিসা মাথা নিচু করে তাকিয়ে ছিল৷ অভিক একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”তুই এত গুলো দিন যা যা অন্যায়, অত্যাচার সহ্য করেছিস তাতে তোর প্রতি একটু হলেও আমার মায়া হচ্ছে। কিন্তু অন্যায় তো অন্যায়ই হয়,,,তবে আমি চেষ্টা করব তোর শাস্তি যতটা সম্ভব কম যেন হয়।”
আনিসা কৃতজ্ঞের দৃষ্টিতে তাকায়। অভিক বলে,”তুই চিন্তা করিস না, শাস্তি ভোগের পর তোকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। তোর বাবার খুনের জন্যেও এই শিহাব উপযুক্ত শাস্তি পাবে। তোর প্রতি করা প্রত্যেকটা অন্যায়ের শাস্তি পাবে ও।”
আনিসা এবার আবেগতাড়িত হয়ে কেদে দেয়।
আরাফাত এগিয়ে আসে অভিকের দিকে। অভিক আরাফাতকে জিজ্ঞেস করে,”সুনীতির কি অবস্থা?”
“ভাবির অবস্থা একদম ভালো না৷ এই গোপন মিশনের জন্য আমি তাকে কিছু জানাতেও পারিনি। কাল থেকে কিছু না খেয়ে আছে,,”
অভিক বিরক্তিতে মুখ দিয়ে “চ” জাতীয় শব্দ উচ্চারণ করে বলে,”আমি জানতাম। এমন কিছুই হবে। আমাকে এখান থেকে জলদি কোয়ার্টারে পৌঁছে সুনীতির সাথে দেখা করতে হবে। জানি না, ও একা কেমন আছে।”
আরাফাত বলে,”ভাবির বান্ধবী এসেছে৷ উনি বর্তমানে ভাবির দেখাশোনায় আছেন।”
“তাহলে তো একটু নিশ্চিত হওয়া যায়। যাইহোক, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।”
সবাই যখন যে যার মতো ব্যস্ত ছিল তখন শিহাব রাগে ফুসছে৷ এত সহজে সে কিছুতেই নিজের হার মেনে নিবে না। সবকিছুর শেষ দেখে ছাড়বে।
শিহাবের রাগ মূলত জমা হয় অভিকের উপর। এই অভিকের পরিকল্পনাতেই তার এত ক্ষতি হয়ে গেল। তাই শিহাব ঠিক করে নেয় এই অভিককে একটা শিক্ষা দেবেই। তাকে তো আজ এমনিতেই বন্দি করা হবে। তার ভবিষ্যৎ এমনিতেই অন্ধকার। এই অভিককেও সে কোনমতে সুখী হতে দেবে না।
এদিকে অভিক আরাফাতকে বলে,”তোর ফোনটা দে। সুনীতিকে একটা ফোন দেই।”
আরাফাত নিজের ফোনটা অভিককে দেয়৷ অভিক সুনীতিকে কল দেয়। সুনীতি শুয়ে ছিল৷ সুনীতি ফোন রিসিভ করে অভিকের কন্ঠস্বর শুনে শান্তির নিঃশ্বাস নেয়। বলে,”তুমি ঠিক আছ?”
মন রাঙানোর পালা পর্ব ২৭
“হ্যাঁ, আমি একদম ঠিক আছি। ফিরে এসে দেখা বলছি। তুমি খেয়ে নাও।”
“তুমি খেয়েছ কিছু?”
“আমি খেয়ে নেব। তুমিও খেয়ে নেও।”
এভাবেই কথা চলতে থাকে তাদের।