দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২৪
অবন্তিকা তৃপ্তি
ভোর রাতে আকাশের বড্ড মন খারাপ হলো! আকাশ চিঁড়ে ঝরঝর করে ঝরতে লাগল বৃষ্টির ফোঁটা! ঠান্ডায় ঘুমন্ত আশা নড়তে নড়তে একদম সেটিয়ে গেলো অনিরূপের নগ্ন গায়ের সঙ্গে। অনিরূপ তখনও ঘুমায় নি! আশা ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতেই, ও তৃপ্তির হাসি হেসে, আহ্লাদ নিয়ে দুহাতে আগলে বুকে টেনে নিলো স্ত্রীকে। আশা ঘুমের ঘোরেই অনিরূপের বুকের নাক ঘষল! অনিরূপ হাসে, বৌর এলোমেলো চুল গুছিয়ে দিয়ে লম্বা সময় নিয়ে চুমু খেলো বৌর কপালে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলতে লাগল নিজের মতো করে; নীরবে-
‘আমি শেষ অব্দি পেয়েই গেলাম তোমায় আশাবরী। অভিনয়ে আমি হরে গেলাম, না চাইতেই তোমাকে ভালোবেসে ফেললাম। না, তুমি কখনোই জানবে না এগুলো। আমি আজকের পর তোমার চোখের সামনে একটা কালো পর্দা টেনে রাখবো; সবসময়। পর্দাটা যে উঠাতে চাইবে, পরদিন তার লা-শ পাবে এই পৃথিবী! তোমাকে হাজার তপস্যা করে পেয়েছি আমি, এত সহজে কেউ তোমার মন উস্কাতে পারবে না। ই্যয়ু আর মাইন, ই্যয়ু আর মেইড টু বি মাইন!’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সকাল তখন ৯টা বাজে। সারারাত না ঘুমিয়ে, ভোর রাতের দিকেই চোখ বুজেছিল অনিরূপ। তবে বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারেনি! ইতিমধ্যেই অনিরূপের দরজায় টোকা পরে। অনিরূপ ঘুমে তখন দিশেহারা। আশা তখন শুনেও নিই আওয়াজ! মেয়েটা শরীর খারাপের দরুণ হুশ হারিয়ে ঘুমাচ্ছে! দরজায় টোকা শুনে, অনিরূপ আশাকে আরও একটু টেনে নিলো নিজের মধ্যে! তারপর ঘুমঘুম স্বরে বললো-
‘কে?’
ওপাশ থেকে কাজের মেয়ে বললো-
‘ভাইজান, খালাম্মা ভাবিরে আইতে কইসে।’
অনিরূপ চোখ খুলল, একবার বুকের মধ্যে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত আশাকে দেখে জবাব দিল-
‘মাকে বল, আশা একটু অসুস্থ।’
‘জে, আইচ্ছা।’
কাজের মেয়ে চলে যায়। অনিরূপ আবারো আশার দিকে চায়। আশা চোখ-মুখ কুচকে ঘুমিয়ে আছে। শরীরে শুধু অনিরূপের গতরাতে পরা টিশার্ট গায়ে। অনিরূপ হালকা হাসলো, কম্বল টেনে আশার কাঁধ অব্দি ঢেকে দিয়ে ডাকলো নরম গলায়-
‘আশা? বউ, উঠো। সকাল হয়েছে। গেট অ্যাপ! আশা।’
আশা অনিরূপের ডাকডাকিতে বড্ড বিরক্ত। বেশ রাত করে ঘুমানোতে তাকাতে অব্দি পারছে না। ও নিভু-নিভু ভাবে চোখ খুললো। অনিরূপ আশার ঠোঁটের কোণ আঙুল নাড়িয়ে ছুয়ে বললো-
‘গেট অ্যাপ, সোনা।’
আশা অনিরূপের এমন আদুরে ডাকে অভ্যস্ত নয়! আচমকা এমন ডাকে ও চটজলদি চোখ খুলে অনিরূপকে দেখে। অনিরূপ তাকিয়ে আছে। অনিরূপের ঠোঁটে মুচকি হাসি। ওই হাসির দিকে চেয়ে- আশার ধীরে ধীরে মনে পড়তে লাগল গতরাতের কাহিনি। মুহূর্তেই ও লজ্জায় শেষ হয়ে গেলো। শ্বাস আটকে দ্রুত কম্বল দিয়ে মুখ ঢেকে নিয়ে বললো-‘আপনি আগে বের হোন, প্লিজ।’
অনিরূপ আশার এমন অবুঝপোনা দেখে হো হো করে হেসে উঠল। আশার কম্বল মুখ থেকে সরাতে চাইলে আশা আরও শক্ত করে চেপে ধরলো। অনিরূপ চেষ্টা করলো কয়েকবার, একপর্যায়ে জোর করে কম্বল সরিয়ে দিয়ে উকি মেরে বৌর লাজুক মুখটা দেখে চোখ টিপলো-‘হ্যাই, কী হাল-চাল?’
ইস! আশা লজ্জায় দুহাতে চোখ ঢেকে আইঢাই করে উঠে বললো-‘উফ, আপনি বেশি বেশি করছেন কিন্তু। এভাবে কেন করছেন?’
অনিরূপ হাত সরাতে সরাতে বলল-‘আরে তাকাও, এত লজ্জা কোথায় রাখো বলো তো? কালকে রাত থেকেই চোখে চোখ মেলাতে পারছো না।’
আশা হাত সরালো না। অনিরূপও আর চেষ্টা করলো না। মুখ ঢেকে থাকা আশার দিকে চেয়ে, এভাবেই বলতে লাগলো-
‘আশা, একটা বিষয় ভাবছিলাম আমি! আমার জীবনে গতকালের মতো রাত আরেকবার এসেছিল। কিন্তু ট্রাস্ট মি- আমি সেদিন গতরাতের মতো এতো আনন্দ, এতো সুখ পাইনি। গতরাতে তোমার চোখের দিকে আমি নিজের জন্যে, যে ভালোবাসা দেখেছিলাম, সেটা আমার বহু কষ্টের ফল ছিল আশা!’
আশা অনিরূপের কথা গুলো ভীষণ মনোযোগ দিয়ে শুনে!অনিরুপ আরো বলবে, সেই আশায় আস্তে আস্তে হাত সরালো মুখের উপর থেকে। ওর টলমলে দুই চোখে ভাসলো, স্বামীর মুখায়ব; স্বামীর দু নীলাভ চোখ, যা এখন আশাকে খুব আবেগ, ভীষণ আকাঙক্ষা নিয়ে দেখছে। অনিরূপ একসময় আশার গাল আগলে নিলো দুহাতে! নরম, আদুরে গলায় বললো-
‘আমি তোমাকে শেষ অব্দি পেয়ে গিয়েছি আশা! তুমি আমার বহু তপস্যার ফল, সোনা! অনিরূপ শ্যুড থ্যাঙ্ক ইউ, ফর লাস্ট নাইট, ফর ইউর লাভ, ফর ইউর এভরিথিং!’
আশা মায়া মায়া দৃষ্টিতে অনিরুপের দিকে চেয়ে থাকে। অনিরূপ কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে আশার গোলগাল, লালাভ মুখের দিকে চায়। চোখ যায়, আশার চোখে, তারপর নাকে,, তারপর গ্লোসি ঠোঁটে।
অনিরূপ নিজেকে আটকালো না, নিজের নেশাকে দমালো না! বরং ধীরে ধীরে মুখ এগিয়ে আনলো ঠোটের দিকে! আশাও চেয়ে আছে অনিরুপের মুখের দিকে! ওর মধ্যেও কিছু একটা কাজ করছে! দুজনের ঠোঁট যখন ছুঁইছুঁই,অনুভূতির জোয়ার বইছে দুজনের হৃদয়ে- ঠিক সেসময় অনিরূপের অ্যালার্ম বেজে উঠলো!চোখ খুলে চমকে উঠলো ওরা দুজন!
আশা অনিরূপের দিকে তাকাল, অনিরুপ বিরক্তিতে সেভাবেই আবার চোখ কুচকে ফেলেছে! আশা লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিলো। অনিরূপ চোখ খুলে ঘাড় কাত করে ফোনের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে উঠে-‘শালা, এত ভালো মুহূর্তটা…’
আশা শোনে অনিরূপের বিড়বিড় করে বলা কথা। ও খিলখিল করে হেসে উঠে! অনিরূপ বিরক্ত হয়ে আশার দিকে চেয়ে ভ্রু বাকায়,
‘এখানে হাসার কী ছিল?’
আশা হাসতে হাসতে বললো-‘আপনার কপাল খারাপ আসলেই। যা আবেগ গলায় এতগুলো কথা বললেন, শেষ অব্দি চুমু খেতে যাচ্ছিলেন, তখনই অ্যালার্ম!’
আশা হাসছিল ভীষণ! অনিরূপ ভ্রু কুচকে আশার হাসি দেখল নিশ্চুপভাবে! তারপর আচমকা আশার ঘাড়ে চট করে একটা চুমু খেয়ে নিলো। আশা চমকে উঠল আবার। ঘাড়ে উষ্ণ অনুভব করছে, হাত বাড়িয়ে ও ঘাড় চেপে ধরল, অনিরূপ ভ্রূ বাঁকিয়ে বললো-‘দেখলে, কার ভাগ্য খারাপ! চুমু তো খেয়েই ফেললাম। ঠোঁটে না হোক, অন্য কোথাও।’
আশা আবারো লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। অনিরূপ আর মেয়েটাকে লজ্জা দিলো না। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বললো-‘গোসল করে ফেলো,আমার একটা কল দিতে হবে।’
আশা হালকা মাথা দুলিয়ে বেড থেকে উঠে শাড়ি নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। আশা চলে গেলে, অনিরূপ কাউকে কল লাগাল-
‘একজন অ্যাকসিডেন্টের প্যাশেন্ট রাতে কেবিনে ভর্তি হয়েছিল! হোয়াট’স হিস কন্ডিশন রাইট নাও?’
‘আমি আজ বাড়ি যাচ্ছি।’
শেখ মহলে, ডাইনিং টেবিলে সবার মুখ নিধির দিকে গেলো। নিধি মুখ-চোখ শক্ত করে বসে আছে। অরূপ নাস্তা খাওয়া বাদ দিয়ে তীক্ষ চোখে চেয়ে দেখলো নিধিকে। ওয়াহিদা আশার দিকে তাকালেন, আশা নিজেও অবাক হয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। ওয়াহিদা আবার নিধির দিকে চেয়ে বললেন-
‘কিন্তু তোমার চিকিৎসা চলছে। বাড়িতে গেলে এসব কন্টিনিউ করবে কিভাবে?’
নিধি ওয়াহিদার দিকে তাকালো, নম্র গলায় বললো-‘আমি মেডিসিন নিয়ে নিবো আন্টি, ইউনিয়ন হাসপাতালে বাকি চিকিৎসা করিয়ে নিব। বাড়িতে আব্বা একা, উনার কষ্ট হচ্ছে ওখানে একা একা।’
আশা এবার বিরক্ত হয়ে বললো-‘আমার তো আব্বার সঙ্গে কালকেই কথা হয়েছিল। আব্বা আরও চাইছেন, তুমি চিকিৎসা শেষ করে তারপর যেন বাড়ি যাও।আব্বা যেখানে চাইছে, সেখানে তুমি এত কেন তাড়া দেখাচ্ছো, বলো তো?’
নিধি কিছু বললো না। ওয়াহিদা বললেন-‘দেখো তোমার বোন,আব্বা কি বলে। আশা যদি তোমাকে যেতে বলে যেতে পারো, আমি আটকাবো না।’
আশা ডাইনিং টেবিলে আর কিছুই বললো না। অপেক্ষা করলো, নিধিকে একা পেলে কথা বলার। অনিরূপ এবার শান্ত গলায় বললো-‘দেখো নিধি, তোমার এখন একজনের ট্রিটমেন্টের উপর ফোকাস করা উচিত। বারবার ডক্টর বদলানো, হাসপাতাল বদলানো ইজ নট দ্যাট গুড ফর ইউর বডি।’
নিধি অনিরুপের দিকে তাকাল, হালকা গলায় বললো-‘আমি কথা বলেছি ইউনিয়ন হাসপাতালে। তারা আমাকে অ্যাশিউর করেছে, বাকি চিকিৎসা আমি নির্দ্ধিধায় ওদের হাসপাতালে করাতে পারব।বাড়ির কাছে হাসপাতালে চিকিৎসা করানো আমার কাছে বেটার অপশন মনে হচ্ছে।’
নিধি তার কথায় নাছোড়বান্দি! ও এই মুহূর্তে যা বলছে, এতে কথা বাড়ানোর দরকার নেই! তাই বাকিরা আর কথা বাড়ালো না। অনিরূপও চুপ থাকল। ওর যা বলার বলেছে, বাকিটা আশা বুঝে নিবে।
নিধি রুমে এসেছে। ব্যাগ গোছাচ্ছে ও। আশা ওর পিছু পিছু ছুটছে! অনেকবার জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে? নিধি এড়িয়ে যাচ্ছে বারবার। আশা একপর্যায়ে বিরক্ত হলো ভীষণ, নিধির হাত থেকে কাপড় কেড়ে নিয়ে চেচিয়ে বললো-‘থামো এবার। বড্ড বাচ্চামো করছো আপা। তুমি আদৌ জানো, এখন নিয়মিত ট্রিটমেন্ট নেওয়া কতটা জরুরি তোমার জন্যে? দয়া করে এসব থামাও, প্লিজ!’
আশা অসহায় চোখে নিধির দিকে তাকিয়ে বললো! নিধি কড়া চোখে বোনের দিকে তাকাল! কিন্তু বোনের চোখে কাতরতা দেখে ও নিশ্চুপ হয়ে হয়ে গেল! ধপ করে বিছানায় বসে রইলো কিছুক্ষণ! আশা একটু পর বোনের পাশে বসে বোনের মুখটা দেখতে লাগল! নিধি একটু পর নিরুদ্ধেগ গলায় বললো-‘আমার কারণে আমি তোর জীবনটা নষ্ট করতে পারবো না আশা! তুই প্লিজ আমাকে যেতে দে, আমি আমার লাইফ গুছিয়ে নিব! তুই আগে তোর নিজের সংসারে পা-টাকে শক্ত কর। আমার কথা ভাববি তো, সময় আসলে অবশ্যই ভাববি। তবে প্লিজ, এখন না।’
আশা কিছুই বুঝতে পারছে না নিধির কথা।ও শুধু চেয়ে আছে নিধির দিকে!
অরূপের রুম নিধির রুমের পাশপাশি থাকায় ও সবই শুনতে পেয়েছে দুই বোনের কথা। অরূপ রাগে চোখ বুজে , দুহাত মুষ্টিবিদ্ধ করে কিছুক্ষণ ডিভানে বসে থাকল! ও ঘর থেকে দুই বোনের কথা শোনা যাচ্ছে! নিধি যাচ্ছে না, বরং পালাচ্ছে! কার থেকে? অরূপের থেকে, অরূপের জেগে উঠা ফিলিংসের থেকে! অরূপ রাগে ফাটছে! ভালোবাসাটা অন্যায় কেন ভাবছেন নিধি? অরূপ নিজেও কখনো চাইবে না, ভাইয়ের সংসারে আগুন দিতে। নিধি ডিভোর্সি, ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে গেলে হয়তো ফ্যামিলিতে অনেক বেগ পোহাতে হবে! তবে অরূপ কখনোই চাইবে না, ভাবীর উপর ওদের ফ্যামিলি থেকে কোনো প্রভাব পড়ুক! অরূপ তো দায়িত্বশীল ছেলে! ও এসব সামলে নিতে পারবে! কিন্তু তাকে সে জন্যে সুযোগ তো দিতে হবে। সেটা দিতেই এত আপত্তি নিধির!
দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২৩
অরূপ ভাবছে! একপর্যায়ে ও হালকা হেসে মাথার নিচে এক হাত রেখে ডিভানে লম্বা করে শুয়ে পড়ল! সিলিংয়ের দিকে চেয়ে হালকা স্বরে বিড়বিড় করলো-‘নিধি, ওহ নিধি! আপনি আমাকে এড়িয়ে যাবার কথা ভাবলেন কী করে? আমি আপনাকে ভালোবাসি জেনে পালিয়ে যাবার মতো বোকা বুদ্ধি আপনার মাথায়ই আসা পসিবল শুধু !যান; যান, বাড়ি যান। আমিও আসছি! খুব শীঘ্রই!’