প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৫৬

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৫৬
তানিশা সুলতানা

দুই চার দশ গ্রামের প্রভাবশালী জমিদার। যার দাপটে গোটা এলাকায় হাহাকার শুরু হয়েছে। শত শত নিরীহ মেয়েদের চড়া দামে বিদেশে পাচার করেছে। তার বিনিময়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। গড়েছেন টাকার পাহাড়। সেই জমিদারের আজকে টাকার অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না। র ক্ত কেনার টাকাও জোগাড় হচ্ছে না। জমিদারের ছোট পুত্র দুনিয়াতে নেই। তারপর জন্য আজ ওবদি কেউ আহাজারি করে নি।

এমনকি মৃ ত্যুর রহস্য জানতেও কেউ ইচ্ছুক নয়৷ আর দুই পুত্র নির্বাক। তারা বাবার অসুস্থতায় একটুও বিচলিত নয়। বাবার সম্পদের ভাগ তারা অনেক আগেই বুঝে নিয়েছে। মোটা টাকা তাদেরও রয়েছে। কিন্তু এক টাকাও দিবে না তারা। হাসপাতালে দেখতেও আসে নি বাবাকে। মনোয়ার যেনো স্বাধীনতা পেয়েছে। জমিদার হাসপাতালে ভর্তির পরমুহূর্তেই বাড়ি ছেড়ে পগারপার। কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না। অবশ্য খোঁজও নেয় নি। মামুন বউকে নিয়ে শশুর বাড়ি গিয়েছে। ভেবে ফেলেছে এখন থেকে শশুর বাড়িতেই থাকে সন্তান এবং বউ নিয়ে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শিউলি জমিদারের সব থেকে বিশ্বস্ত মানুষ। কেশাগার থেকে শুরু করে সকল বিষয়ের তথ্য রয়েছে তার। জমিদারের অগোচরে সরিয়েছে অনেক অর্থ। এমনকি জমিদার খুশি হয়েও দিয়েছেন অনেক। তবুও তিনি টাকা দিতে নারাজ।
মমতা বেগম হাসপাতালে দেখতে আসেন নি জমিদারকে। জমিদার বাড়ি তার নামে লিখে নিয়েছে কিছু দিন আগেই। এই বাড়িটা এখন তার। এখন জমিদার বেঁচে না থাকলে রাজত্ব করবে সে। অযথা টাকা খরচ করে বাঁচিয়ে রাখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

ইব্রাহিম এসেছিলো জমিদারকে দেখছে। হাসপাতালের রিসিপশনে বসে আছে তিনি। তার পাশে ইমন এবং ইশান বসে আছে। ইফাদ ছিলো। কিছুক্ষণ আগেই চলে গিয়েছে। ফিনাইলের গন্ধ মোটেও তার পছন্দ না।
ইব্রাহিম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে
“এতো প্রভাবশালী জমিদার চিকিৎসা বিনে ম র বে? শেষ সময়ে তার পাশে নিজের সন্তানরাও রইলো না।
ইমন উদাস স্বরে বলে

” এটাই কি ওনার প্রাপ্য নয়?
“হয়ত প্রাপ্য। কিন্তু উনি এতোসব করেছেন কার জন্য? তার সন্তানদের জন্য। তার টাকার পাহাড় সন্তানরা ভোগ করবে। তাদের উচিত ছিলো ওনার পাশে থাকা।
একটু থামে ইব্রাহিম। তারপর বলে
“তোমরা কেনো টাকা দিচ্ছো? আর কোথায় পাচ্ছো?
ইশান জবাব দেয়।

” ওনার টাকাই। আমাদের হাত খরচের জন্য টাকা দিতো সেই টাকা জমিয়েছিলাম। সেটাই দিয়েছি।
আর সে যেমনই হোক আমাদের দাদাভাই। তার জন্যই তো আমরা দুনিয়াতে আসতে পেরেছি। বিলাশ বহুল জীবনযাপন করতে পেরেছি। এটা আমাদের দায়িত্ব।
মুগ্ধ হয় ইব্রাহিম। একজন নার্সকে ডাকে। এবং জিজ্ঞেস করে কেমন আছেন জমিদার সাহেব। নার্স জবাব দেয়
“ওনার অবস্থা খুবই খারাপ। ইমিডিয়েটলি তাকে ঢাকার কোনো বঠ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু ওনার ছেলেমেয়েরা তো আসছেনই না দেখতে। কাকে বলবো এসব?
ইব্রাহিম নার্সকে বলে।

” আপনাদের যতটুকু সধ্য করুন। হাসপাতালের যাবতীয় বিল আমি মিটিয়ে দিবো।
“এখানে থাকলে উনি আর বেশিক্ষণ বা
পুরোটুকু শেষ করার আগেই সাহেব এর কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে আরেকজন নার্স। তিনি মাথা নিচু করে বলে
” হি ইজ নো মোর।
জমিদার সাহেবই বোধহয় প্রথম ব্যক্তি তার মৃত্যুর মুহুর্তে কোনো চিৎকার চেঁচামেচি হয় না। কেউ ডুকরে কেঁদে ওঠে না। কারো হৃদয় বিচলিত হয় না। প্রিয় জনরা মুখে পানি দেয় না। ইমন দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। ইশান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। যেনো পৃথিবী থেকে এই একটি মানুষ চলে যাওয়াতে দুনিয়াটা শান্ত হয়ে গেলো। প্রশান্তির নিঃশ্বাস বয়ে গেলো গোটা ধরণী জুড়ে।

মুহুর্তেই জমিদারের মৃ ত্যুর বার্তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা মধুপুর গ্রাম জুড়ে। সকলের চোখে মুখে ফুটে ওঠে প্রশান্তির হাসি। আলহামদুলিল্লাহ বলে ওঠে এক বাক্যে।
জমিদারের ছেলে মেয়ে কিংবা বউ কেউ ই হাসপাতালে দেখতে আসে না শেষ বারের মতো। ইমন ইশান এবং ইব্রাহিম হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করে এম্বুলেন্সে নিয়ে যায় জমিদার বাড়ির গেইটে। কিন্তু দারোয়ান গেইট খুলে না। জানায় মমতা বেগমের কড়া নির্দেশ এই লা শ জমিদার বাড়িতে ঢুকবে না। জমিদার বাড়ির একটু মাটিও পাবে না সাহেব।

কয়েকশো বিঘা জমির মালিক জমিদার সাহেব শেষ বেলায় নিজের জন্য সাড়ে তিন হাত জমি পাচ্ছে না চিরতরে ঘুমনোর জন্য। নিজের বাড়ির এক মুঠো মাটি জোটে না তার কপালে। ইব্রাহিমের হুকুমে মধুপুর গ্রামের ছোট একটা গোরস্থানে জমিদারকে কবর দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
আসমান হতে সেলিম বোধহয় হেসে বলছে
“জমিদার সাহেব আমার সোনার পরিবার ধ্বংস করে দিয়েছিলেন আপনি। অথচ দেখুন আমি আমার পরিবারের সাথেই শুয়ে আছি নিজ বাসভবনে। আর আপনি?
আপনার কপালে তো এক মুঠো মাটি জুটলো না স্বজনদের আশেপাশে। এটাই হচ্ছে নিয়তি। এটাকেই বলে ভাগ্য।

আলু সিদ্ধ দিয়ে ভাত মেখে পূর্ণতার মুখের সামনে ধরে অভি। পূর্ণতা মুচকি হেসে অভির হাত সরিয়ে দেয়। চোখে চোখ রেখে বলে
” আপনার পাপের টাকায় কেনা চাল আমার গলা দিয়ে নামবে না এমপি সাহেব।
অভি শান্ত গলায় বলে
“আজকের মতো খেয়ে নাও। কাল থেকে সৎ উপার্জনের টাকায় খাওয়াবো তোমায়।
” উহু
কাল থেকে নয়। আজকেই খাবো না আমি। আর আপনার এই রাজপ্রাসাদে থাকবোও না।
পাপের টাকায় গড়া এই প্রাসাদে আমি শান্তি পাচ্ছি না। হৃদয় পুরছে।

অভি ভাতের থালা রেখে দেয়। পকেট থেকে মোবাইল এবং ওয়ালেট বের করে টি-টেবিলে রাখে। পায়ের জুতো জোড়াও খুলে ফেলে। তারপর পূর্ণতার ছোট হাতটা মুঠো করে ধরে। এবং বলে
“চলো পূর্ণতা। আজকে থেকে আমাদের নতুন জীবন শুরু। এই জীবনে থাকবে না কোনো পাপের ছোঁয়া।
পূর্ণতা খুশি হয়ে এক গাল হেসে অভির হাত খানা মুঠো করে ধরে। খিধেয় পেট চু চু করছে। সেসব পাত্তা না দিয়ে স্বামীর সাথে বেরিয়ে পড়ে অজানা উদ্দেশ্যে। প্রাসাদের বাইরে এসে একবার পেছন ফিরে তাকায় অভি। এতোদিনে তিলতিল করে গড়ে তোলা এই রাজপ্রাসাদ। অনেক শ্রম এবং অর্থ রয়েছে এতে।
মেইন দরজায় তালা দেয় না অভি। থাকুক এমন। প্রতিজ্ঞা করে মনে মনে বলে

” একদিন সৎ উপার্জনে ঠিক এমনই একটা প্রাসাদ বানাবো আমি। সেখানে আমি পূর্ণতা এবং আমাদের সন্তান থাকবো। ইনশাআল্লাহ।
পূর্ণতার পায়ে ইফতিয়ারে কিনে দেওয়া জুতো। অভি পায়ের পানে তাকাতেই পূর্ণতা খুলে ফেলে জুতো। ছুঁড়ে ফেলে দূর অজানায়।
সন্ধ্যা ছয়টা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। কক্সবাজারের মুন্সি নগর শহরটি ইতোমধ্যেই অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছে। রাস্তা ঘাটের জনমানব কমেছে। অভি এবং পূর্ণতা পিচ ঢালা রাস্তায় হাত ধরে হাঁটছে। আশেপাশে বাড়ি ঘর নেই। শুধু বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা রাস্তা। দুজনের পেটেই খুধা, পকেট খালি, পায়ে জুতো নেই।
এমন রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটতে বেশ কষ্টই হচ্ছে দুজনের। তবুও কেউ টু শব্দও করছে না। অনেকটা পেছনে ফেলে এসেছে তাদের প্রাসাদ। বিলাসবহুল জীবন।

কিছুক্ষণ হাঁটার পরেই উঁচু উঁচু বিল্ডিং এবং জনমানবের এর দেখা মেলে। মনে হচ্ছে এটা বাজার। অভির ঠোঁটে একটু হাসির দেখা মেলে। পূর্ণতার পানে তাকিয়ে বলে
“হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তাই না? ওই তো বাজার দেখা যাচ্ছে। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
পূর্ণতা মৃদু হাসে। অভির হাত জড়িয়ে ধরে।
অভি এক বুক আশা নিয়ে এগিয়ে যায় বাজারের নিকট।
ভাতের হোটেল দেখা যাচ্ছে। জামাকাপড়ের দোকান। বিভিন্ন শাকসবজি এবং প্রয়োজনীয় সকল জিনিস পত্র দেখা যাচ্ছে বাজারে। উঁচু উঁচু বিল্ডিং। চাকচিক্য দোকান। মানুষের সোরগোল।
অভির প্রথমে ভাতের হোটেলের দিকে যায়। একটা দোকানে প্রচুর ভিড়। দোকানের সামনেই মেনেজার বসে আছে। অভি মেনেজারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নরম গলায় বলে

“আমার বউয়ের জন্য কিছু খাবার দেওয়া যাবে? আমার কাছে টাকা নেই।
মেনেজার অভিকে পর্যবেক্ষণ করে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে। তারপর পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে বলে
” টাকা নেই তো খাইতে মন চায় কেন? ফকিন্নি
কোথা থেকে আসেন আপনারা?
সরুন এখান থেকে।
অপমানে চোখ ভিজে ওঠে পূর্ণতার। অভি মাথা নিচু করে পূর্ণতার হাত ধরে চলে যায়।
“আমার খিধে পায় নি। খাবো না আমি।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৫৫

অভি জবাব দেয় না। সে তো জানে পূর্ণতার খিধে পেয়েছে। এখন খাওয়া প্রয়োজন। একা নয় তো পূর্ণতা। সে না খেলে বাবু খাবার পাবে কোথায়?
অন্য একটা হোটেলে যায় অভি। পূর্ণতাকে এবার সাথে নেয় না। একটু দূরে দাঁড় করিয়ে রাখে।
এবারেও হোটেলের মেনেজারকে বলে
” আমি কাজ করে দিবো। কোনো কাজ আছে বলুন? বিনিময়ে আমার বউকে এক মুঠো ভাত দিন৷
মেনেজার হাতের ইশারায় অভিকে কাছে ডাকে। পাশে বসতে বলে।
অভি ওনার কথা মনো বসে।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৫৭