মন রাঙানোর পালা পর্ব ৪১
ইয়াসমিন খন্দকার
অহনা একটু স্বাভাবিক হতেই সবাই তার দিকে প্রশ্নের বাণ ছুঁড়তে থাকে। শফিক ইসলাম বলেন,”আমরা তো সবাই সিসিটিভিতে দেখলাম, তোমাকে কে বা কারা তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। তুমি কি জানো কারা তারা?”
অহনা একটু ভেবে বলে,”আমার তেমন কিছু মনে নেই। যতদূর মনে পড়ে, আমি ঘরে বসে বিয়ের জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। সেসময় রুমে আমি ছাড়া কেউ ছিল না। এমন সময় আমি একটা আওয়াজ শুনতে পাই,আমার রুমের জানালা থেকে। ওদিকে তাকাতেই দেখি জানালা বেয়ে কে বা কারা নেমে আসছে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা আমার মুখে কিছু একটা স্প্রে করে। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই।”
“তুমি কি তাদের মুখ দেখতে পাওনি?”
“না, তাদের সকলের মুখে মাস্ক ছিল। তাই তাদের চিনতে পারিনি।”
অভিক বলে ওঠে,”ড্যাম ইট। এরা সব পরিকল্পনা করেই এসেছিল। যেই গাড়িটা সাথে নিয়ে এসেছিল তার নাম্বারপ্লেটও ঢেকে রাখা ছিল৷ তাই ক্যামেরায় সেটা ধরা পড়েনি।”
সুনীতি সকলের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”এসব নিয়ে এখন আর ভেবে কি হবে? সবথেকে বড় কথা হলো যে, অহনার কিছু হয়নি। ও একদম সেইফ আছে। আমাদের কাছে এটাই তো জরুরি, তাইনা?”
অভিক বলে,”তবুও তো আমাদের জানা উচিৎ যে কে বা কারা অহনাকে তুলে নিয়ে গেছিল।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরাফাত বলে,”সুনীতি ভাবি ঠিক বলছেন। অহনা যে ঠিক আছে এটাই আমাদের কাছে অনেক। ওকে কে বা কারা তুলে নিয়ে গেছিল সেটা নাহয় পরে তদন্ত করে বের করা যাবে। যাইহোক, এখন যেহেতু অহনা ঠিক আছে তাই আমাদের এখন উচিৎ বিয়েতে ফোকাস করা। অভিক তুই কাজিকে ডেকে পাঠা।”
আরাফাতের এহেন কথা শুনে তার মা আনোয়ারা বেগম বলে ওঠেন,”তুই কি পাগল হয়ে গেলি আরাফাত? এই মেয়েকে তুই বিয়ে করবি?”
নিজের মায়ের এমন কথা শুনে আরাফাত হতবাক স্বরে বলে,”মা,,তুমি এমন কথা বলছ?”
“হ্যাঁ, বলছি। আর আমি একদম ঠিক বলছি। যেই মেয়েকে এভাবে তার বিয়ের দিন তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার চারিত্রিক শুদ্ধতা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।”
“মা!”
শফিক ইসলাম নিজের স্ত্রীর উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তুমি চুপ করো আনোয়ারা। যা বলছ ভেবে বলছ তো?”
“আমি সবকিছু ভেবেই কথা বলছি। আমি বোকা নই যে, এটা বিশ্বাস করব ওকে কয়েকটা ছেলে তুলে নিয়ে গিয়ে এমনি এমনি ছেড়ে দিয়েছে, কিছু করেনি। ঐ মেয়ের চরিত্রে কলংক লেগে গেছে। এমন মেয়েকে আমি কিছুতেই নিজের ঘরের বউ করে তুলতে পারি না।”
এসব কথা শুনে অহনার চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে। সুনীতি অহনার কাঁধে হাত রাখে। অহনার মা কান্না করতে করতে বলেন,”আপনারা বিশ্বাস করুন, আমার মেয়ের চরিত্র খারাপ নয়। গোটা এলাকায় ওর মতো ভালো মেয়ে আর একটাও নেই। ও কখনো একটা প্রেম অব্দি করেনি, ছেলে বন্ধু পর্যন্ত নেই ওর। দয়া করে ওর নামে এমন কলংক ছেটাবেন না।”
এবার আনোয়ারা বেগমের সুরে সুর মিলিয়ে আনোয়ারা বেগমের ভাইয়ের বউও বলে ওঠেন,”আপু তো ঠিকই বলছে। আপনাদের মেয়ের চরিত্র যদি এতই ভালো হয় তাহলে তাকে কেন বিয়ের দিন এভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো?”
সুনীতি এগিয়ে এসে বলে,”অহনা আমার বান্ধবী। আমি ওকে বিশ্বাস করি। আমি জানি, ও কেমন মেয়ে। আপনারা সবাই ভুল ভাবছেন ওকে নিয়ে।”
আনোয়ারা বেগম বলেন,”আমরা কোন ভুল ভাবছি না। যা ঠিক তাই ভাবছি।”
আরাফাতের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সে এগিয়ে এসে নিজের মাকে বলে,”আল্লাহর দোহাই লাগে মা, তুমি চুপ করো। অহনার নামে আর একটা বাজে কথা আমি সহ্য করবো না।”
আনোয়ারা বেগম বলেন,”আরাফাত! তুই এই মেয়েটার জন্য আমাকে এভাবে বলছিস?”
আরাফাত বলে,”হ্যাঁ, বলছি। কারণ এখানে ভুলটা সম্পূর্ণ তোমার। তুমি কোন কারণ ছাড়াই শুধু শুধু অহনাকে দোষারোপ করছ।”
“এত কিছুর পরেও তোর এটা মনে হয়?”
“হ্যাঁ।”
আরাফাতের মামি আনোয়ারা বেগমের কান ভাঙানোর জন্য বলেন,”আপু,নিশ্চয়ই এই মেয়ে তোমার ছেলের উপর কোন যাদুটোনা করেছে। নাহলে কি কোন ছেলে তার মাকে এভাবে বলে?”
“মামি, তুমি আর দয়া করে আগুনে ঘি ঢেলো না। মেহমান হয়ে এসেছ তেমনই থাকো। নাহলে আমি সীমালঙ্ঘন করতে দুবার ভাবব না।”
বলেই সে অভিকের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তুই কাজিকে ডেকেছিস? কখন আসবেন উনি?”
“ঐ তো উনি এনে গেছেন।”
কাজি এসে উপস্থিত হন। আরাফাত অহনার হাত শক্ত করে ধরে বলে,”আমি বিশ্বাস করি, অহনা পবিত্র। ওর কোন ভুল নেই। তাই আমি ওকেই বিয়ে করব। এ ব্যাপারে কারো আপত্তি আমি মানবো না।”
আনোয়ারা বেগম বলে ওঠেন,”তাহলে এটাই তোর শেষ কথা?”
“হ্যাঁ।”
“বেশ, তবে আমার শেষ কথাও শুনে নে। এই মেয়েকে আমি মরে গেলেও নিজের ছেলের বউ হিসেবে মেনে নেবো না। তুই ওকে বিয়ে করবি ভালো কথা। কিন্তু ওর ছায়াও যেন আমার বাড়িতে না পড়ে।”
শফিক ইসলাম বলেন,”এসব তুমি কি বলছ আনোয়ারা? তুমি কি একদম পাগল হয়ে গেলে নাকি?”
“তোমার ছেলের কাণ্ডজ্ঞানহীনতা দেখে আমায় পাগল হতে হলো। আমি বলে দিচ্ছি,বিয়ে করো ঠিক আছে এটা আটকানোর সাধ্যি আমার নেই কিন্তু এই মেয়ে যদি আমার বাড়িতে পা রাখে তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব বলে দিলাম।”
আরাফাত বলে,”ঠিক আছে,তোমায় এ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি ওকে আমার সাথে নিয়ে যাব। বাড়িতে নিয়ে যাব না ওকে।”
আনোয়ারা বেগম দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। তার সাথে তার ভাই, ভাবি ও তার বাপের বাড়ির অন্য সদস্যরাও চলে যায়।
আরাফাত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অহনার কাছে এসে তার হাত শক্ত করে ধরে নম্রস্বরে বলে,”চলো আমার সাথে। আমরা বিয়ে করব।”
অহনা বলে,”আপনি যা করছেন ভেবে করছেন তো? আমার জন্য আপনার মায়ের সাথে আপনার সম্পর্কে প্রভাব পড়বে। আপনি চাইলে এই বিয়েটা ভেঙেও দিতে পারেন।”
“চুপ,,আর একবার এধরণের শব্দ উচ্চারণ করবে না। নাহলে কিন্তু ভালো হবে না।”
বলেই সে অহনার হাতটা আরো শক্ত করে ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। অহনা হতবাক হয়ে দেখতে থাকে। বিয়ের আসরে উপস্থিত হয়ে সে কাজি সাহেবকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”আপনি বিয়ে পড়ানো শুরু করুন। আজ আর এক্ষুনি বিয়েটা হবে। কেউ এই বিয়ে আটকাতে পারবে না।”
অভিক, সুনীতি, অহনার পরিবারের সবাই আরাফাতের অহনার প্রতি এত ভালোবাসা আর বিশ্বাস দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। অহনার চোখেও খুশির জল চলে আসে। কাজি কবুল বলতে বললে অহনা কিছু সময় নিয়ে কবুল বলে, আরাফাত অবশ্য তড়িঘড়ি করেই বলে দেয়। ব্যস, বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়ে যায়।
বিয়ে হতেই আরাফাত অহনার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”এখন থেকে তোমার স্বামী হিসেবে তোমার সম্মান রক্ষার দায়িত্ব আমার। কেউ যদি তোমার দিকে আঙুল তোলে, তার সেই আঙুল আমি বেকিয়ে দেব।”
অহনার চোখে সুখের অশ্রু তখনো শোভা পাচ্ছে। সে নিজেকে প্রচুর ভাগ্যবান মনে করছে এমন একজন জীবনসঙ্গী লাভ করে।
মন রাঙানোর পালা পর্ব ৪০
★রঙে ভড়া জীবন, ঘুণ ধরে শেষ
একপাশে শুরু, একপাশে শেষ!★
এই কথাটা যেন মিলে গেল সাগরের ক্ষেত্রে। একদিকে যখন অহনার জীবনে নতুন প্রভাত শুরু হলো অন্যদিকে সাগর তখন অন্ধকার ঘরে বসে চিৎকার করে কাঁদছিল। নিজের ভালোবাসাকে চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলার দুঃখ ভোগ করছিল!