মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ১৬
মুশফিকা রহমান মৈথি
“যদি এক বছরের মাথায় আমাকে তুমি প্রমাণ করতে পারো তোমাদের বিয়ের ভিত্তি আছে, তাহলেই আমি আমাদের চুত্তি অনুযায়ী তোমাকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দিব”
দাদার শর্ত অচিরেই ভালোবাসার নাটক ফুরে শীতল যুদ্ধের আবহ তৈরি করলো দাদা-পৌত্রের মাঝে। অভ্রের চোয়াল শক্ত হল। ক্রোধ গিলে বললো,
“আপনি আপনার কথা পাল্টাতে পারেন না দাদাজান। টাকাটা আমার জন্য কতটা জরুরি আপনি জানেন। সব জেনে শুনে আপনি আমাকে ঠকাবেন?”
আউওয়াল সাহেবের পৌড় ঠোঁটে কৌতুকমিশ্রিত হাসি উন্মোচিত হলো। খুব শীতল স্বরে বললেন,
“ঠকিয়েছো তুমি আমাকে। কি বলেছিলে, এই মেয়েটা তোমার পছন্দের। কে অপরকে খুব ভালোবাসো তোমরা। আমিও সেটা ভেবেছি। তোমাদের একে অপরের প্রতি আচারণ দেখে আমি ভেবেছি যাক আমার নাতী শুধু শর্তের জন্য বিয়ে করছে না। নাতীর খুশিতে খুশি হয়েছি। কিন্তু তুমি আমার চোখে ধুলো দিয়েছো। মেয়েটা তোমাকে ভালোবাসেই না। যার ফলাফল ছিলো আজকের ঘটনা। সে তো তোমাকে পছন্দ অবধি করে না। আর তুমি তাকে টাকার জন্য বিয়ে করেছো সেটার গ্যারেন্টি। তুমি আমার টাকা পাওয়ার জন্য এমন নাটক করতেই পারো। তোমাদের বিয়ের কোনো ভবিষ্যত অন্তত আমি দেখছি না। দেখা যাবে আমি টাকা দিবো তুমি দু মাসের মধ্যে এই বিয়ে ভেঙ্গে নিবে। তোমার কি ভরসা? শোনো অভ্র, আমার টাকা আমার পরিশ্রম, ঘামের ফসল। তোমার নাটকের জন্য সেটা আমি তোমাকে দিব না।“
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আউওয়াল সাহেব একটু থামলেন। তারপর গম্ভীর স্বরে বললেন,
“এতো নাটকের প্রয়োজনও ছিলো না অভ্র। তোমার নিজস্ব পছন্দ ছিলো না যখন, আমাকে বলতে। আমি তোমার জন্য ভালো মেয়ে খুজতাম। অত্যন্ত নাটকের বিয়ে তোমাকে করতে হতো না”
“দাদাজান আপনি ভুল ভাবছেন। ঐন্দ্রিলাকে আমি টাকার জন্য বিয়ে করি নি। হ্যা এটা ঠিক আমি এখন বিয়ে করার পক্ষপাতী ছিলাম না। আমার ব্যাবসাটা স্টার্টিং পয়েন্টে। আমি সময় নিতে চেয়েছিলাম। তবে আমি যখন ই বিয়ে করতাম ঐন্দ্রিলাকেই করতাম। কারণ আমার জীবনে আমি অন্য কাউকে ভাবতেই পারি না। হ্যা, মানছি আমার টাকা দরকার ছিলো। তাই তো আমি আপনার থেকে চেয়েছি। আপনি আমাকে বিয়ের শর্ত দিয়েছিলেন। আপনি বলেছিলেন, আমি যদি বিয়ে করি তাহলে আপনি আমার ব্যাবসায় ইনভেস্ট করতে টাকা দিবেন। বিয়ে হয়েছে এখন আপনি শর্ত বদলাতে পারেন না। আর প্রমাণ করার প্রশ্ন কোথা থেকে আসছে, যেখানে আমি আমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করেছি। এখানে দ্বিতীয় কথা আসবে কেন?”
অধৈর্য্য হয়ে বললো অর্ক। আউওয়াল সাহেবের স্বর আরোও গম্ভীর হলো,
“আমি কি বাচ্চা মানুষ? তোমার মত মানুষ চড়াই আমি। আমার চুল এভাবে পাকে নি। তুমি চিৎকার করে বললে তো সত্য বদলাবে না অভ্র। আসল কথা, ঐন্দ্রিলা তোমাকে পছন্দ করে না। তোমাদের বিয়ে একটা তাশের ঘর। যা ভেঙ্গে যেতে একটা দমকা হাওয়াই যথেষ্ট। আর যদি আমার নজর, অভিজ্ঞতা ভুল হয় তাহলে আমাকে ভুল প্রমাণ করো। এক বছরের মাঝে দেখিয়ে দাও তোমরা সুখী দম্পতি। তোমাদের একটা সংসার হওয়া সম্ভব। যেখানে ভালোবাসা থাকবে, ভবিষ্যত থাকবে। বড় পৃথিবীতে তোমাদের নিজস্ব পৃথিবী। যেখানে তোমরা একে অপরকে বুঝবে, একে অপরের হাল ধরবে, ভুল করবে, শিখবে। তারপর হাতে হাত রেখে জীবন পার করবে। আফসোস, এমন কিছুই হবে না। আরে যে মেয়ে তোমাকে ভালোই বাসে না তাকে নিয়ে তুমি ভবিষ্যৎ কি করে কাটাবে। তাই আমার শর্ত আমি পাল্টাবো। তুমি রাজী না হলে আমার জন্য ভালো, আমি টাকাগুলো বেঁচে যাবে”
অভ্রের মুখখানা রাগে রক্তিম হয়ে যাচ্ছে। দাদার এমন আচারণ তার অসহ্য লাগছে। প্রবীন মানুষটির গিটে গিটে বদ বুদ্ধি। ইচ্ছেকৃত ভাবে তাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরানোর ফন্দি। সে আসলে মেনেই নিতে পারছে না অভ্র তার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করেছে। তার পছন্দের মেয়েদের ছেড়ে অভ্র নিজের মর্জি চালিয়েছে। আউওয়াল সাহেব স্বভাবগত কারণে অতিরিক্ত দম্ভে পরিপূর্ণ, আত্মজেদি এবং কন্ট্রোল ফ্রিক।
তিনি অস্বাভাবিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চান সবার জীবন। বড় ছেলে এবং ছেলের বউ তার ইশারায় চলে। ইদ্রিস সাহেব এতটাই তার আদেশ মেনে চলে যে, অভ্রের মনে হয় মানুষটা বাথরুমে গেলেও বাবার অনুমতি নিবে। কিন্তু অভ্র ব্যতিক্রম। আউওয়াল সাহেবের সকল স্বভাব তার মাঝে আছে, অতিরিক্ত জেদি, দাম্ভিক এবং কন্ট্রোল ফ্রিক। নিজের স্বার্থের ব্যাপারে সে সতেচন। ফলে নিজের জীবনে অন্য কারোর ছড়ি ঘুরানো অতীব অপছন্দ অভ্রের। তাই তো সে চলে নিজের মর্জিতে। বেপরোয়া সে জীবনের প্রতি। এইকারণে পাশ করার পরও সে চাকরি না করার সিদ্ধান্ত নেয়। নিজের ব্যাবসা শুরু করে। এখন সেই ব্যবসাকে বাড়াতে চায় সে। তাই তো দাদার নিকট টাকা চাওয়া। আর এই চতুর খেঁকশেয়ালের মতো মানুষটি তাকে টোপের পর টোপ দিয়ে যাচ্ছে। রাগে গা রিরি করছে অভ্রের, চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। শানিত স্বরে বললো,
“আপনি আসলে মানতেই পারছেন না আমি আমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করেছি। আজও আমি আপনার অবাধ্য হয়েছি। এতটা সহজে আপনার শর্তও পূরণ করে ফেলেছি। আপনার আত্নসম্মানের দেওয়ালে আঘাত লেগেছে। দম্ভ সত্ত্বার এমন আঘাত আপনি সইতে পারছেন না”
আউওয়াল সাহেব হাসলেন। মৃদু কাঁপলো প্রবীন দেহ। লাঠিটা শক্ত করে ধরে বললেন,
“আমার আত্মসম্মান এতো নগন্য নয়। হ্যা, এখন ঐন্দ্রিলাকে আমার পছন্দ নয়। কিন্তু আমি তাকে মেনে নিয়েছি। যেহেতু সে আমার নাতবউ। কিন্তু কতদিন সে আমার পরিবারে থাকে সেটাও তো আমার দেখার বিষয়। আমার বয়স হয়েছে, আমি চাই আমার পরিবারটি যেন শক্তপোক্ত থাকে। ছেলে, বউ, নাতী, নাতবউ, পোপৌত্র—এগুলো এই বয়সের সবার কাম্য। আমিও ব্যতিক্রম নই। এজন্যই তোমার বিয়ের জেদ করেছি। কিন্তু সেই বিয়ের যদি মূল্য না থাকে তাহলে আমার জেদের কি মূল্য? তাই বলছি তুমি সংসার কর, এক বছরের মাথায় একটা পোপৌত্রের মুখ দেখাও। আমি টাকা দিয়ে দিবো তোমাকে। টাকা নিয়ে তো কবরে যাব না”
“বেশ, চেক রেডি রাখেন। এক বছর পর কথা হবে। আমার বউ শুধু আমাকে ভালোইবাসবে না। আমাদের বাচ্চাও হবে”
দাঁতে দাঁত পিষে কথাগুলো বললো সে। এক মুহূর্ত দাঁড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ফলে গটগট করে বেরিয়ে গেলো সে। আউওয়াল সাহেবের ঠোঁটের হাসি প্রশস্থ হলো। তার পরিকল্পনার প্রথম ধাপ সফল।
নিজের ঘরের খাটের উপর বসে আছে ঐন্দ্রিলা। সামনে একটা খোলা ট্রলি ব্যাগ। জামাকাপড় গুছিয়ে নিচ্ছে সে। আজ থেকে অন্য বাড়ি, অন্য ঘরে তাকে থাকতে হবে। নিজের ঘরে চোখ বুলালো ঐন্দ্রিলা। কত শত স্মৃতি, কত শত মুহূর্ত। কান্না, হাসির, রাগের। আজ থেকে সেই স্মৃতিগুলো থাকবে তবে ঐন্দ্রিলা থাকবে না। মানুষ বলে বিয়ের পর নাকি নিজের ঘর, বাড়ি আর নিজের থাকে না। মেয়েদের জীবনের নিয়তি এমন। বিয়ের পর তাদের সব কিছু শ্বশুরবাড়ি। ঐন্দ্রিলা জানালা দিয়ে তাকালো অভ্রের ঘরের দিকে। আচ্ছা, ঐ ঘরটা কি কখনো নিজের হবে? ঐবাড়িতেও সে নিজের মর্জি দেখাতে পারবে? তার মন খারাপ হলে বাবা আইসক্রিম নিয়ে আসতো, ঘরে ভাংচুর করলে মা কিছু বলতো না। প্রতি মাসে সে ভাংগন তহবিলে টাকা রাখতো। চামচটাও তার ধুয়ে খেতে হয় নি কখনো। ছোটবেলা থেকে নীলাদ্রি এবং ঐন্দ্রিলার মাঝে ভালোবাসার দাড়িপাল্লাটা ঐন্দ্রিলার ভারী ছিলো। মাঝে মাঝে তো সে নীলাদ্রিকে বলতো,
“ভাইয়া আমার মনে হয় তোকে ময়লার ডাস্টবিন থেকে তুলে আনা হয়েছে। সিনেমায় দেখায় না স্বামী-স্ত্রীর বাচ্চা হয় না বলে বাচ্চা রাস্তা থেকে নিয়ে আসে। তারপর তাদের কোল আলো করে রাজপুত্র আসে। আমার মনে হয় রাস্তার ছেলেটা তুই”
আর নীলাদ্রি কেঁদে ভাসাতো। ছবি এনে মুখের সামনে এনে বলতো,
“আমি মোটেই রাস্তার ছেলে নই, এইযে প্রমাণ আমি হসপিটালে হয়েছি”
ঐন্দ্রিলা তখন নির্লিপ্ত ভাবে বলতো,
“তাহলে মনে হয় তোকে হাসপাতাল থেকে তুলে এনেছে”
তারপর নীলাদ্রির কান্না আরোও বাড়তো। কথাগুলো ভাবতেই হেসে উঠলো ঐন্দ্রিলা। এর মাঝেই কড়া পড়লো দরজায়,
“কে?”
সাবেরা থমথমে স্বরে বললো,
“আমি”
মায়ের স্বর শুনতেই জড়োসড়ো হয়ে বসলো ঐন্দ্রিলা। বাসায় ফিরে আসার পর থেকে মায়ের সাথে কোনো কথা হয় নি সে। এখন বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। একটুপর অভ্রের সাথে ও বাড়ি চলে যেতে হবে তাদের। সাবেরা ভেতরে প্রবেশ করলেন। বসলেন মেয়ের পাশে। নিস্তব্ধতা ভর করলো ঘরে। ঐন্দ্রিলা তার মত গোছগাছ করছে। সাবেরা বসে রইলো। কোনো কথা বললো না। ঐন্দ্রিলা সব জামাকাপড় গুছিয়ে ফেললো। লাগেজ আটকে বলল,
“আমার গুছানো শেষ”
“হুম”
মায়ের এমন শান্ত আচারণে অভিমানের পরদ গাঢ় হলো। একটিবার জিজ্ঞেস করা যেত না “তুমি কেনো কাজটা করেছো?” একবার শুধানো যেত না “বিয়ের পর তোমার কেমন লাগছে? মন কি ভালো আছে?”—না তার মা কোনো কিছু শুধালো না। ঐন্দ্রিলা ভেবেছিলো মা হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পারবে। মেয়েকেও বকবে তার ভুলের জন্য। তারপর জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু এমন কিছু হলো না। ঐন্দ্রিলা যখন লাগেজটা টেনে বেরিয়ে যেতে নিলো তখন সাবেরা ধীর স্বরে বললো,
“এই বাড়িটা তোমার ছিলো, তোমার আছে। বিয়ে হয়ে গেছে বলে মেয়েদের বাড়িতে অধিকার থাকে এসব বুলশিট মনে রাখার দরকার নেই। কখনো কোনো সমস্যা হলে এই বাড়িতে চলে আসবে”
“এসে কি হবে? শুধু থাকার স্থান?”
খুব শান্ত স্বরে কথাটি বললো ঐন্দ্রিলা। সাবেরা কপাল কুচকাল। গম্ভীর স্বরে বলল,
“এটা তোমার বাড়ি, এসে কি হবে মানে?”
“বিয়ের আগেও তো আমার বাড়ি ছিলো। কতবার নিজের মনের কথা বলতে চেয়েছি। নিজের পছন্দ, অপছন্দ জাহির করতে চেয়েছি। কই তখন তো কেউ শুনে নি। এখন তো বিয়েই হয়ে গেছে। এখন কি তার শোনা হবে? চিন্তা কর না, আমার সমস্যা হবে না। আমি খুব গুছিয়ে সংসার করবো দেখো”
বলেই ম্লান হাসলো সে। সাবেরা অপরাধীচোখে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা কখনোই তার মাকে বুঝবে না।
রাত দুটোটা নাগাদ বধুর গৃহপ্রবেশ হলো। বধুবরণ করলেন কানন। অভ্রের পরিবার একান্নবর্তী পরিবার নয়। কিন্তু এখন তা একান্তবর্তী পরিবার থেকে কম নয়। বিয়ে উপলক্ষে অভ্রের তিন খালা, চাচারা সবাই এসেছে। শুধু অভ্রের আপন ছোট ভাই আসতে পারে নি। লাস্ট সময় তার ফ্লাইট ক্যান্সেল হয়েছে। ঐন্দ্রিলার বরণ পর্ব শেষ হতেই খালারা ঘিরে ধরলো। তারা অত্যন্ত আন্তরিক। না একটু বেশি আন্তরিক। যে বউ পালিয়ে গিয়েছিলো সেই বউকে নিয়ে এতোটা হুল্লোড় কে করে জানা নেই ঐন্দ্রিলার। এক খালা তো শুধিয়েই বসলো,
“আচ্ছা মা, তুই ভারি শাড়ি নিয়ে কি করে পালালি। জানালা থেকে নামতে কষ্ট হয় নি? উষ্টা খাইলে দাঁত ভাইঙ্গে যাইতো তো”
“আমি জানালা দিয়ে পালাই নি”
ঐন্দ্রিলার বিব্রত উত্তরের সাপেক্ষে তাদের কৌতুহল বাড়লো। আরেকজন অবাক নয়নে শুধালো,
“তাইলে পালাইলি কেমনে? মানে হগগলের সামনে দিয়া মেইন গেট দিয়া বাইর হইছোস”
ঐন্দ্রিলা কি উত্তর দিবে জানা নেই। এর মাঝে কানন সব খালাদের ধমক দিল। নিজ হাতে বউকে নিয়ে গেলেন অভ্রের ঘরে। মিষ্টি করে বললেন,
মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ১৫
“তোমার লাগেজ রাখা ভেতরে। তুমি রেস্ট কর কেমন। কত ধকল গেছে আজকে”
ঐন্দ্রিলা জোর করে হাসলো। মহিলা চলে যেতেই সে একবার ঘরের দিকে তাকালো। কি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে ঘরটা। খাটে লাল গোলাপ দিয়ে লাভ বানানো হয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো ঐন্দ্রিলা। জীবনটা খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ঠিক তখনই দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো অভ্র। ঐন্দ্রিলা তার দিকে তাকাতেই ফিচেল হেসে বলল,
“বাবু, বরের আদর খাওয়ার জন্য রেডি?”………………