দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬২

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬২
তাসফিয়া হাসান তুরফা

ভোর তখন ৫টা বেজে ২০ মিনিট পেরিয়েছে। নিশীথ দোলা একে-অপরের সান্নিধ্যে গভীর ঘুমে মগ্ন! হঠাৎ বালিশের নিচ থেকে আসা দ্রিবদ্রিব শব্দে নিশীথের ঘুম ভেঙে যায়। চোখ কচলে বালিশের নিচ হাতড়ে ফোন বের করে সামনে ধরতেই পরিচিত নাম্বার দেখে নিশীথের শান্তির ঘুম উড়ে যায়! তড়িঘড়ি করে শোয়া থেকে উঠে বসে বিছানায়। পাশে ঘুমন্ত দোলনচাঁপার হাত ধীরে সরিয়ে দেয় নিজের উপর থেকে। দোলা ঘুমের মাঝেই ভ্রু কুচকে অন্য পাশে ফিরে আবার ঘুমিয়ে যায়! এদিকে আবারো সাইলেন্ট করা ফোনের ভাইব্রেশন বাজতেই নিশীথের টনক নড়ে, ফোনের কথা মনে পড়ে! মুখ ফুটে আওড়ায়,

“ওহ শি*ট”
কল রিসিভ করে কানে ধরতেই নিশীথের চোখমুখের বিস্ময়ভাব রুপ নেয় অস্বাভাবিকতায়! স্তব্ধ, বিমূঢ় সে চিৎকার দিয়ে উঠে,
“হোয়াট??”
নিশীথের বিকট চিৎকারে পাশে থাকা দোলার ঘুম ভেঙে যায়। ও হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসে। পাশে বসে বিস্মিত নিশীথের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
“কি হয়েছে? চিল্লিয়ে উঠলেন কেন?”
নিশীথ দোলার দিকে তাকালো একই রকম অবাক চাহনিতে। দোলা সে চাহনির অর্থ বুঝলোনা। পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
“কি হলো? কিছু বলছেন না কেন? কোনো ব্যাড নিউজ কি? প্লিজ বলুন আমার টেনশন হচ্ছে!”
নিশীথ কিছু বলবে তার আগেই ওপাশ থেকে ফোনে আওয়াজ আসে। তা শুনে নিশীথ দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলে,
“আমি এক্ষুনি আসছি!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শাহজালাল আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট। যেখানে দিন-রাত সমান। ঘড়ির কাটায় এখন ভোর সাড়ে ছয়টা বাজলেও এয়ারপোর্টে মানুষ দেখে মনে হবে যেন এটা ভরদুপুর! কেউ বা প্রস্থানরত সজনকে বিদায় জানাতে ব্যস্ত, তো কেউ আগমনী প্রিয়জনকে বুকে টেনে নিচ্ছে সযত্নে! এয়ারপোর্টের বাইরে উপস্থিত নিশীথের অবস্থাও ঠিক তাই। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আজ নিশান দেশে ফিরছে! ওর বড় ভাই। পরিবারে মা ও দাদুর পর নিশীথের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি। এ ক’বছর ভিডিও কলে ভাইকে দেখলেও সরাসরি দেখার তুলনা আর কিছুতে হয়না! নিশীথও যেন বিষয়টা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে আজ। যেই না নিশানের দেশীয় নাম্বার থেকে ফোন এসেছে নিশীথ এর শ্বাসরুদ্ধ হয়েছে। যেইনা নিশান জানিয়েছে ও ল্যান্ড করেছে নিশীথ একছুটে চলে এসেছে ভাইকে নিতে! এখন শুধু ওর বেরোনোর অপেক্ষা!

নিশীথের অপেক্ষার অবসান ঘটে যখন সামনে তাকিয়ে ও দেখে, গায়ে সোয়েটার চাপিয়ে দুই হাতে লাগেজ নিয়ে হেলেদুলে হেটে আসছে নিশান। মুহুর্তেই নিশীথের চোখে পাঁচ বছর আগের দৃশ্য ভেসে উঠে! যখন নিশানকে বিদায় দিতে ওরা সবাই এয়ারপোর্টে এসেছিলো। সেদিনের নিশান আর আজকের নিশানের মাঝে বাহ্যিক দিক দিয়ে বেশ পরিবর্তন এসেছে! আগের তুলনায় স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে, চেহারায় আরও ম্যাচুরিটি এসেছে। এতদিন পর ভাইকে দেখে নিশীথ খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে যায়। নিশান কাছে আসতেই একপ্রকার ঝাপিয়ে পড়ে ওর উপর! এদিকে ছোটভাইয়ের আকস্মিক হাম’লায় নিশান হতভম্ব হয়ে যায়। লাগেজ ছেড়ে নিশীথের ভার ও নিজেকে সামলিয়ে নেয়! ওকে জড়িয়ে ধরে নিশীথ উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে,

—এতদিন পর এলে, ভাইয়া! আহ পুরো পাঁচ বছর পর তোমায় ধরতে পারলাম! আই মিসড ইউ!
নিশান এক হাতে ভাইয়ের চুল এলোমেলো করে দিয়ে হেসে বলে,
—মিস করবি কেন? আমি না থাকায় তো ডাবল আদর পাচ্ছিলি সবার থেকে। তোর তো আরও দুঃখী হওয়ার কথা!
ভাইয়ের রসিকতায় নিশীথও যোগ দিয়ে বলে,
—তা একটু হয়েছি বটেই! কিন্তু এত বছর পর এলে, একটু তো খুশি হওয়ার অভিনয় করতেই হবে নাকি?
নিশীথের কথায় নিশান ওর কান চেপে ধরে শক্ত করে। নিশীথ কান ছাড়াতে ছাড়াতে বলে,
—উফ ভাই, ছাড়ো তো! লোকে দেখছে!
—দেখুক। এত বছর পর তোর কান মলার সুযোগ পেয়েছি এভাবেই ছেড়ে দেবো নাকি?
আশেপাশে লোক তাকিয়ে থাকায় কিছুক্ষণ পর অবশ্য নিশান ওর কান ছেড়ে দেয়। নিশীথ বাম হাতে কান ডলতে ডলতে নিশানকে আগা থেকে গোড়া লক্ষ্য করে বলে,

—এই গরমের দিনে সোয়েটার পড়ে এসেছো। গরম লাগছেনা তোমার?
—এখানে আবহাওয়া নরমাল থাকলেও আমার ওখানে ঠান্ডা ছিলো রাতের বেলা তাই সোয়েটার পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম ফ্লাইটে উঠে খুলে ফেলবো কিন্তু পরে আর করা হয়নি।
সোয়েটার খুলতে খুলতে বলে নিশান। খোলা শেষে ওর সোয়েটার নিশীথের হাতে দেয়। নিশীথ একহাতে ভাইয়ের সোয়েটার, অপরহাতে লাগেজ নিয়ে হাটা শুরু করে। হাটতে হাটতেই শুধায়,
—হুট করে যে চলে এলে, বাসায় জানিয়েছো? মা জানে তুমি আসছো?
—না, ইচ্ছে করেই জানাইনি। সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম সবাইকে।
—জানতাম এটাই করবে! তবে আমায় অন্তত ফ্লাইটে উঠার আগে জানাতে পারতে। এভাবে হুট করে ভোরবেলা জানাবে আমি ঘুম ভেঙে উঠে বেশ চমকে গিয়েছিলাম!
নিশীথের কথায় নিশান হাসতে হাসতে বলে,

—তুই যাতে এভাবে অবাক হোস এজন্যই তো তখন ফোন দিলাম! আচ্ছা, এখন বাসায় কিভাবে যাবো? বাসায় তো জানানো হয়নি সো ড্রাইভার নিতে আসবেনা।
—উবার কল করছি দাঁড়াও!
নিশীথ উবার ডাকে। মিনিট দশেকের মাঝে একটা পেয়েও যায়। দুই ভাই গাড়িতে চেপে বসে রওনা হয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে দুজনের এতদিনের জমানো বহু হাসিঠাট্টা হয়।
বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই দুজন নেমে পড়ে। দারোয়ানও এত বছর পর নিশানকে দেখে অবাক হয়ে সালাম দেয়! নিশীথ ওর লাগেজ দুটো দারোয়ানের হাতে তুলে বলে,

—আচ্ছা ভাই, তুমি তাহলে উপরে যাও। সবার সাথে দেখা করে ফ্রেশ হয়ে ঘুম দাও। জেট ল্যাগ হবে তোমার!
নিশান প্রশ্ন করে,
—তুই এখনি চলে যাচ্ছিস? আমার সাথে চল উপরে। আমার পাশে তোকে দেখলে মা আরও বেশি খুশি হবে! আয়।
নিশীথ মাথা নেড়ে বলে,
—না, ভাইয়া। আজ আর উঠবোনা। দোলনচাঁপা বাসায় একা আছে। ওকে আসার আগে ঠিকমতো বলেও আসিনি কোনোকিছু। টেনশন করছে বেচারি।
—ওরে বাবা! বউয়ের প্রতি কি ভালোবাসা!
নিশান ইয়ার্কি মেরে বলে। নিশীথ হেসে বলে,
—তোমার বিয়ে হলে তুমিও ভালোবাসতে! অবশ্য দেশে থাকলে আমার আগে তোমারই বিয়ে হতো। এবার তোমার পালা, দাড়াও শুধু!

বিয়ের কথা শুনে নিশানের মুখ শিথিল হয়। নিশীথ তা লক্ষ্য করে প্রশ্ন করতে যাবে এমন সময় ওর ফোনের রিংটোন বেজে উঠে। ও দেখে দোলা কল দিয়েছে। তা খেয়াল করে নিশান বলে,
—দোলা ফোন দিয়েছে না? আচ্ছা তুই যা তবে। কিন্তু জলদি বাসায় আসিস। আর অবশ্যই দোলাকে নিয়েই আসিস!
—ভাইয়া, তুমি সব জানোই তারপরেও…
—নিশীথ! যা বলেছি তা করবি। পাল্টা জবাব দিবিনা বড়ভাইকে!

নিশান বলে দেয়। নিশীথ আর কিছু বলেনা। ফোস করে এক শ্বাস ছেড়ে প্রস্থান করে। দারোয়ান লাগেজ উপরে উঠিয়ে দিয়ে আসে নিশানের সাথে। নিশান মুচকি হেসে কলিংবেলে চাপ দেয়। এত ভোরে ওর মা ও দাদু বাদে কারও উঠার কথা না! ওরা ওকে দেখে কতটা খুশি হবে তা ভেবেই ও মনে মনে উচ্ছাসিত হয়! পরপর দুইবার কলিংবেল দেওয়ার পর দরজা খুলে দেয় কাজের মেয়ে। তবে ও নতুন আসায় নিশানকে দেখে চিনতে পারেনা। আসমা বেগম ভেতর থেকে চিল্লিয়ে বলেন,

—কে এসেছে রে, নিপা?
—চিনতেসিনা তো, খালাম্মা। আপনি আইস্যা দেখে যান।
নিপার কথায় আসমা বেগম নিজেই চলে আসেন গেটের কাছে। তবে গেটের বাইরে দাড়িয়ে থাকা স্বয়ং তার বড়পুত্রকে দেখে উত্তেজনায় তার শরীরে কাটা দেয়! অক্ষিদুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়ে আসে। নিশান হেসে এগিয়ে আসার আগেই তিনি এক গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠেন!

নিশীথ বাসায় ঢুকতেই দোলা অস্থিরভাবে শুধায়,
—কোথায় গিয়েছিলেন? কিছু বলে গেলেন না যে। এভাবে কেউ যায়? আমি কতটা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম আপনার আইডিয়া আছে?
এক নিঃশ্বাসে বলা ওর কথাগুলো নিশীথ বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনে। তবে জবাব না দিয়ে খাবার টেবিলের কাছে এগিয়ে যায়। গ্লাস নিয়ে জগ থেকে পানি ঢালতে শুরু করে তাতে। দোলা ভ্রু কুচকে ওর কার্যক্রম দেখে। ওর ধৈর্যের বাধ ভেঙে যাবে যাবে ভাব এবার! নিশীথ এগিয়ে এসে ওর হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বলে,

—রিল্যাক্স, পানি খাও। সব খুলে বলছি।
দোলা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে খাওয়া শুরু করে। পুরো গ্লাস শেষ করছে এমন সময় নিশীথ বলতে আরম্ভ করে,
—আজ আমার জীবনে এক প্রিয়জন ফিরে এসেছে, দোলনচাঁপা। যাকে আমি তোমার মতোই ভালোবাসি। কত্তদিন পর ওকে দেখলাম, ধরলাম..
নিশীথ কথা শেষ করতে পারেনা তার আগেই দোলার গলায় পানি আটকে যায়! নিশীথ দ্রুত ওর পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে যায়। দোলা নিজেকে সামলে ওর হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলে,
—প্রিয়জন মানে? কে ফিরে এসেছে আপনার জীবনে? আর কোন মেয়ের জন্য ওভাবে ছুটে গিয়েছিলেন আপনি?
দোলার ক্ষি’প্ত চাহনি ও প্রশ্নে নিশীথ বুকে হাত দিয়ে হাসে! দোলা বিরক্তিতে সেদিক চেয়ে রয়। নিশীথ হাসির মাঝেই বলে,

—হোয়াট? কোন মেয়ের জন্য? ভাই তোমাদের মেয়েমানুষের মাথায় কি স্বামীকে সন্দেহ করা ছাড়া আর কিছু কাজ করেনা নাকি?
—মানে? কি বলবেন সরাসরি বলুন
দোলা শুধায়। নিশীথ হাসি থামিয়ে বলে,
—আরে বাবা, আমার বড়ভাই এসেছে দেশে। নিশান ভাই। কানাডায় থাকে যে? ওকে রিসিভ করতেই ছুটে গিয়েছিলাম এয়ারপোর্ট।
এবার নিশীথের কথা দোলার বোধগম্য হয়। ও ক্ষেপে নিশীথের বাহুতে মেরে বলে,
—তো এই কথা সরাসরি বললেই পারতেন? অত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওভাবে বললে মানুষ উল্টাপাল্টাই বুঝবে স্বাভাবিক!

—ভুল বুঝে অবশ্য ভালোই হয়েছে। তুমি যে আমায় নিয়ে এত জেলাস তা তো জানা ছিলোনা, দোলনচাঁপা!
নিশীথ ওকে কাছে টেনে ঠোঁট বাকিয়ে হাসে। দোলা লজ্জায় এদিক-ওদিক চায়। প্রসঙ্গ পাল্টে শুধায়,
—ভাইয়া যে আসছেন সবাই জানতো? নাকি শুধু আপনি?
—ল্যান্ড করে আমায় জানিয়েছে শুধু। আর কেউ জানেনা। আমি ওকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে এলাম। নির্ঘাত সবাই বড়সড় সারপ্রাইজড হবে ওকে দেখে। সিনটা ভাবতেই মজা লাগছে!
নিশীথ খুশি হয়ে বলে। দোলা বলে,

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬১

—তবে আপনিও বাসায় গেলেই পারতেন ভাইয়ার সাথে। মোমেন্টটা মিস করলেন তো!
এবার নিশীথ কিছুটা গম্ভীর হয়। শান্ত কণ্ঠে বলে,
—আমি যদি ও বাসায় যাই, তোমায় নিয়েই যাবো।
—কিন্তু, নিশীথ..
—কোনো কিন্তু নয়। একা ফিরে যাওয়ার জন্য তো ও বাসা ছেড়ে আসিনি, দোলনচাঁপা। এসেছি তোমার সঙ্গে, ফিরবোও তোমারই সঙ্গে!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৩