মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ১৮
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাঁধে ভারী আচলটা রেখে কুচিগুলো সুন্দর করে সাজাচ্ছিলোই অমনি ধরাম করে দরজা খুলে ফেললো কেউ। আৎকে উঠতে কুঁচিগুলো সব হাত থেকে ছুটে গেলো। কুঁচি সামলাতে যেয়ে আঁচলটাও বেসামাল হলো। চোখ তুলে তাকাতেই দেখলো বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র। তার শান্ত দৃষ্টি ঐন্দ্রিলার হতভম্ব মুখখানার দিকে। ঐন্দ্রিলা তন্মধ্যে তড়িঘড়ি করে আঁচলটা আকড়ে ধরলো। আকস্মিক ঘটনায় মস্তিষ্ক শুন্য হয়ে গেলো। হাতপা কেমন ঠান্ডা হতে লাগলো। সোজা হয়ে ড্রেসিং টেবিল গেসে দাঁড়ালো সে। হাত থেকে কুঁচি ছুটে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অপ্রস্তুত স্বরে বললো,
“তুই এখানে কি করছিস? আমি তো লক করেছিলাম”
অভ্রের ঘরের লকটা নষ্ট। নষ্ট করেছে অভ্র নিজেই। এটা নতুন নয়। রগচটা মানুষটির রাগের স্বীকার প্রায় দরজা, জানালা, দেওয়ালকে ভোগ করতে হয়। এটা খুবই স্বাভাবিক এই বাড়িতে। ইদ্রিশ সাহেব পাত্তা দেন না। অভ্রের ঘরের দিকে তিনি ভুল ক্রমেও নজর দিবেন না, এবং ঘোষণা করেছেন অভ্রের এমন কাজের জন্য তিনি একটা পয়সা খরচ করবেন না। থাকুক লক ছাড়া। কোনোদিন যদি অভ্রের জন্য এই ঘরের দেওয়াল ভেঙ্গে পড়ে বা ছাঁদ খসে যায় তবুও ইদ্রিস সাহেবের ভ্রুক্ষেপ হবে না। বরং তিনি গদগদ স্বরে বলবেন,
“এই চোটে আমার ঘর ছাড়ো”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিন্তু ঐন্দ্রিলা এই কাহিনী জানে না। তাই সে লক তো দিয়েছে কিন্তু লক হয় নি দরজা। অভ্র তার বিব্রত কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে একেবারেই উপেক্ষা করে দরজার ছিটকিনি আটকে দিল। তারপর নির্বিকার চিত্তে নিজের গায়ের টিশার্টটি খুলে উদাম গায়ে খাটের উপর টানটান হয়ে শুলো। পরণে শুধু ঘিয়া রঙ্গের একটা প্যান্ট তার। তার এহেন কার্যে তাজ্জব হল ঐন্দ্রিলা। চোয়াল ঝুলে গেলো। একটা পুরুষ এতোটা অসহ্য কেন হবে? তার টিশার্টটা অবহেলায় পড়ে আছে চেয়ারের উপর। তার অনাবৃত ঘর্মাক্ত, ক্ষীণ লোমশ বুকখানা দেখতে পাচ্ছে ঐন্দ্রিলা। সেই সাথে উন্মুক্ত হয়ে আছে পেটের ধারে আছে কিছু পুরাতন, ক্ষীণ মিলিয়ে যাওইয়া দাগ। ঐন্দ্রিলার মনে হলো তার শরীরের সব রক্ত আলোর বেগে মাথায় উঠে গেছে। নাক, মুখ লাল হয়ে গেলো অসহনীয় রাগে। ফলে কুপিত স্বরে বললো,
“নির্লজ্জের মতো শুয়ে আছিস কেনো? বের হ ঘর থেকে। দেখছিস না আমি শাড়ি পড়ছি।”
চোখের উপর বাম হাতটা রেখে নির্বিকার চিত্তে শুয়ে আছে অভ্র। হেলদোল নেই। ঐন্দ্রিলার অগ্নিবানী তার কানে আসছে না। ঐন্দ্রিলা আবার শুধালো,
“কথা কানে যাচ্ছে না? আমি বললাম তো আমি শাড়ি পড়ছি, বের হ ঘর থেকে”
এবার হাত সরিয়ে চোখ মেললো অভ্র। মোটা কন্ঠে শান্ত স্বরে বলল,
“প্রথমত তুই শাড়ি পড়ছিস না, এক থান কাপড়ের সাথে কোদাকোদি করছিস। দ্বিতীয়ত ঘরটা আমার, এই ঘরের সবকিছু আমার। তাই আমি মোটেই বাহিরে যাবো না। এখন আমি ঘুমাবো। তোর ইচ্ছে হলে তুই যা”
অভ্রের কথা ছ্যাত করে উঠলো ঐন্দ্রিলা। প্রেসার কি বেড়ে যাচ্ছে ঐন্দ্রিলার। কে জানে? তবে তার মাথা এতোটা গরম যে নিঃসন্দেহে ডিম সেদ্ধ হয়ে যাবে। রাগে গজরাতে গজরাতে বললো,
“এই ঘর আমারও, এখানের সব কিছু আমারও”
“তাহলে আমিও কি তোর?”
মাথাটা কাত করে গাঢ় স্বরে শুধালো অভ্র। ঐন্দ্রিলা থমকে গেলো। শব্দ হারিয়ে ফেললো কি বলবে। অনেকক্ষণ হাতরালো ঝগড়া করার অস্ত্র, আফসোস পেলো না। ফলে চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে সে ঘুরে গেলো। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“এদিকে তাকাবি না”
অভ্র শব্দ করে হেসে উঠলো। সেই হাসির শব্দ দেওয়ালে আন্দোলিত হলো। সহাস্য কন্ঠে বললো,
“আমার দেখার জন্য তাকাতে হয় না”
ঐন্দ্রিলা আয়না থেকে তাকে দেখলো। নির্লজ্জের মতো হাসছে। ফলে রাগে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা ক্রিমের ডিব্বা ছুড়ে মারলো অভ্রকে উদ্দেশ্য করে। কিন্তু অভ্র সরে যাওয়ায় সেই ডিব্বা লাগলো খাটের পাশের ফুলদানিটার গায়ে। ফলে মুহূর্তেই চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে গেলো। অভ্র ঘাড় করে সেই ভাঙ্গা অংশগুলো দেখলো। হাসি থামার বদলে যেনো আরোও বেড়ে গেলো। টিটকারীর স্বরে বললো,
“বাহ, প্রথম দিনেই রুপ দেখিয়ে দিলি”
ঐন্দ্রিলার ইচ্ছে হলো তার বর নামক বর্বর পুরুষটার মাথা ভেঙ্গে চার ভাগ করে ফেলতে। তারপর এই ঘর লন্ডফন্ড করে দিতে। কিন্তু নববধু হয়ে বিয়ের প্রথম দিন এমন তান্ডব করলে নিশ্চিত আউওয়াল সাহেব তাকে বের করে দিবে। তখন যেয়ে উঠতে হবে মায়ের বাড়িতে। কিন্তু আগের রাতেই বড়গলায় বলেছিলো, সে ওখানে ফিরবে না। রাগ কমাতে হবে ফলে ধপ করে বসে পড়লো সে। মাথাখানা চেপে রাখলো। ঠিক তখনই দেখলো বিশালকায় দুটো তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখ তুলতেই বললো,
“উঠ, কোদাকোদি করতে করতে ঘেমে গেছিস”
বলেই বাহু টেনে দাঁড় করালো ঐন্দ্রিলাকে। ঐন্দ্রিলা রাগী স্বরে শুধালো,
“কি করছিস?”
অভ্র উত্তর দিল না। শাড়িটা হাতে নিলো। তারপর ইউটিউবের সেই টিউটোরিয়াল দেখে আস্তে আস্তে শাড়িটা পড়াতে শুধু করলো। ঐন্দ্রিলা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ছেলেটার দিকে। একরোখা, একগুঁয়ে ছেলেটার এমন যত্নশীলও হতে পারে এ যেন আকাশ কুসুম ঘটনা। কি দৃঢ় প্রযত্ন। যখন তার রুক্ষ্ণ হাতের ছোঁয়া ঐন্দ্রিলার অনাবৃত উদরে লাগছিলো, কেঁপে উঠছিলো সমস্ত দেহ। ঐন্দ্রিলা কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে রইলো। অভ্র আঁচলটা ছেড়ে দিল। তার ভেজা চুলগুলো টেনে সামনের একপাশে রাখলো। লম্বা চুল থেকে পানি পড়ছে। ঘামে ভেজা, রাগে লালচে হওয়া একটা মুখ, লম্বা অবিন্যস্ত ভেজা চুল আর মিষ্টি রঙ্গা শাড়ি। অভ্র নিলীন চোখে তাকিয়ে রইলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমনীর দিকে। গাঢ় সেই দৃষ্টিতে কি যেন ছিলো যা মুহূর্তেই অস্বতি ঘিরে ধরলো ঐন্দ্রিলাকে। সে ব্যস্ততা দেখিয়ে বললো,
“সর, এখনই তোর পাগলা খালার দল আমাকে ডাকবে”
বলেই ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুলগুলো আঁচড়াতে লাগলো। ঐন্দ্রিলা চুলগুলো বাঁধতে নিলেই অভ্র গাঢ় স্বরে বলল,
“বাঁধিস না, তোকে খোলা চুলে বেশী ভালো লাগে”
মুগ্ধ সম্বোহনী কন্ঠ অভ্রের। ঐন্দ্রিলা আয়নার মধ্যে তাকালো অভ্রের চোখে। কতটা সময় তাদের দৃষ্টি বিনিময় হলো নিজেরাও জানে। এর মাঝেই খালার কন্ঠ শোনা গেলো,
“বউ, তুই কি শাড়ি পড়তেছিস নাকি বানাচ্ছিস? এত সময় লাগে?”
সম্বিৎ ফিরলো দুজনের। অভ্র দাঁড়িয়ে থাকলো না। টেবিলের উপর রাখা সিগারেটের প্যাকেটটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে সে হনহন করে চলে গেলো বারান্দায়। ঐন্দ্রিলা এখনো দাঁড়িয়ে রইলো। তার হৃদস্পন্দন তীব্র হয়ে আছে। শান্ত হচ্ছে না কিছুতেই। এমন কেনো হচ্ছে?
ঐন্দ্রিলা নেমে আসতেই খালাদের উৎসাহের কমতি নেই। তারা যাবে আজ একটি পার্কে। একটু আগেও বিনা শব্দে ঝুম বৃষ্টি হয়েছে। এই কাঁদা পানিতে কি করে কারোর পার্কে যেতে ইচ্ছে হয়। এক খালা বললো,
“পার্ক যাব, ঘুরবো, ফিরবো, আইস্ক্রিম খাবো”
এর মধ্যেই অভ্র নেমে এলো। পরণে একটা নীল পাঞ্জাবি। হাতা কনুই অবধি গুটিয়ে রাখা। ঘড়িটা পড়তে পড়তে বললো,
“চলো”
“তুই যাচ্ছিস?”
“হ্যা, তোমাদের চার রমনীকে ছেড়ে দেওয়া মানে পরদিন নিউজপেপারের হেডলাইন হওয়া। সেই চান্স নিচ্ছি না। আর আমার এতো সুন্দর বউ। তোমাদের আইসক্রিম পেলে তো হুশ থাকে না। দেখা যাবে আমার বউকে হারিয়ে এসেছো, তখন বউয়ের শোকে আমি দেবদাস হয়ে যাব। নো নো, চান্স নিবো না। চলো”
ঐন্দ্রিলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অভ্রের দিকে। অভ্রও সবার সামনের ঐন্দ্রিলার হাতটা ধরলো। সে ছাড়াতে চাইলেও পারলো না। কারণ অভ্রের বাঁধন শুধু শক্ত নয় খুব শক্ত।
রাস্তার ধার দিয়ে হেটে যাচ্ছে পিউ। এই বৃষ্টি, বাদল, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, কাঁদা একদম ভালো লাগে না পিউ এর। বৃষ্টি কেবল নিজের ঘরের জানালা দিয়েই সুন্দর। বাহিরে বের হলেই কাঁদা পানি, গর্ত আর পিছলা খাওয়া। দুবার পিচ্ছিল কাঁদায় পা পিছলেছেও পিউয়ের। দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। ঠিক তখনই কারোর স্বর কারে এলো,
“এই পিউ? এই পিউ”
পিউ তাকালো আকাশের দিকে। আকাশ ডাকছে? নীলাদ্রি ভাইয়ের স্বরে। বুদ্ধিমতী পিউয়ের এমন বোকা চিন্তা করা অন্যায়। তাই সে আশপাশ দেখলো তখন নীলাদ্রি বললো,
“আশেপাশে তাকাচ্ছো কেনো? আমি তো গাছে”
পিউ বাম দিকে তাকাতেই দেখলো গাছের ঘরের জানালা থেকে মুখ বের করে নীলাদ্রি তাকে ডাকছে। বটবৃক্ষটা ঐন্দ্রিলাদের বাড়ির একেবারে পেছনে, বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে। তাই এই রাস্তাটা খুব ভালো করে দেখা যায়। পিউ যাচ্ছিলো তার খালা বাসায়। তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিলো। মেঘের গর্জন একটু পর পরই শোনা যাচ্ছে। একটু পর ই ঝুম করে নামবে জলদের কান্না। ছাতা নেই পিউয়ের কাছে। তার মুখখানা ভিজে গেছে। নীলাদ্রি বলল,
“কোথায় যাচ্ছো?”
“খালাবাড়ি”
“বৃষ্টি হচ্ছে তো। আরো জোরে হবে। এখন যেও না। তুমি বরং বাসায় এসো। ছাতা নিয়ে যাও”
নীলাদ্রির কথা শুনে পিউ ঠোঁট উলটে বললো,
“অসম্ভব নীলাদ্রি ভাই, আন্টি যে পরিমান রেগে আছে আমার উপর। আপনার মনে নেই আমি আপনার বোনকে পালাতে সাহায্য করেছি। ছাতা চাইলে আন্টি আমার পিছনে ছাতা ভাঙ্গবে”
সাবেরা সেদিন পিউকে বেশ বকেছিলো। ছোটবেলার বান্ধবী হয়ে এমন অকাজে বান্ধবীকে সাহায্য করার অপরাধে তাকে যে জেলে দেওয়া হয় নি এটা অনেক। তাই এখন তার সামনে যেতে চায় না পিউ। নীলাদ্রি তখন বললো,
“তাহলে উঠে এসো, আমার ঘরে তোমাকে কেউ কিছু বলবে না”
“আপনার ঘর?”
“হ্যা, আমার বৃক্ষপ্রাসাদ। তুমি চাইলে এখানে সারাদিন থাকতেও পারবে”
বলেই নির্মল হাসলো নীলাদ্রি। মানুষটি এতটা সুন্দর করে কি করে হাসতে পারে জানা নেই পিউয়ের। পিউ বললো,
“আসবো কি করে? আপনার প্রাসাদে আসতে হলে তো আন্টির সীমানা পার হতে হবে”
“তুমি চিন্তা করো না, মা কন্যা শোকে একটু মুর্ছিত। কে আসলো গেলো তার খোঁজ নেই”
পিউ হাসলো। গেটে দারোয়ান নেই। তাই ফুরুত করে ঢুকে পড়লো সে। বৃক্ষগৃহে উঠতে হলে সিড়ির সহায়তা নিতে হয়। কাঠের সিড়ি পিচ্ছিল হয়ে আছে বৃষ্টিতে ভিজে। পিউ বলল,
“উঠবো কি করে? আমি তো পড়ে যাব। আমি তো শুকনোতেই পিছলা খাই। এটা তো পিছলাই আছে”
“তুমি তো বুদ্ধিমতী পিউ। এই সামান্য সিড়িতে উঠতে পারবে না?”
“আপনি হাত দিন। আমি হাত ধরে উঠবো”
নীলাদ্রি একটু ভাবলো। কিছুক্ষণ বাদে দরজা থেকে দু সিড়ি নেমে হাত বাড়ালো। পিউ জুতো খুলে উঠলো সিড়ি বেয়ে। তারপর খপ করে ধরলো নীলাদ্রির হাত। ইশ! হাতটা সারাজীবনের জন্য ধরা গেলে মন্দ হতো না।
নীলাদ্রির চোখে মুখে লজ্জা। প্রথম কোনো পরনারীর হাত ধরেছে সে। পিউ তার হাত ধরেই প্রবেশ করলো তার বৃক্ষপ্রাসাদে। ছোট একটা ঘর। যেখানে হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। একটা তোশক, একটা কম্বল, আর নীলাদ্রির স্তুপকৃত জামাকাপড় আর বই। একটা টিপট আছে। সেখানে গরম পানির ব্যাবস্থা করা হয়। ছোট্ট একটা চুল্লি দিয়ে। পিউ নিপুন চোখে দেখলো নীলাদ্রির ঘর। অবাক চোখে বললো,
“আপনার কষ্ট হয় না নীলাদ্রি ভাই। বৃষ্টির দিন এখানে থাকেন কি করে?”
“ডাবল মাস্টার্স কি খালি খালি করা?”
বলেই একটা সুতো টান দিল। সাথে সাথেই প্লাস্টিকের পর্দা ঘিরে দিলও কাঠের বাড়ি। পিউ বলল,
“আপনার তো অনেক বুদ্ধি নীলাদ্রি ভাই”
“তা আর কি, শুধু বাবাই কদর করে না। আচ্ছা কফি খাবে”
“খাবো”
নীলাদ্রির মিনিট দশেকের মধ্যেই কফি বানিয়ে আনলো। পিউ কফিতে চুমুক দিয়ে বললো,
“আপনি এভাবে আর কতদিন থাকবেন? এখন তো আংকেলের সাথে সন্ধি করতে পারেন”
“নাহ, আমি সন্ধি করবো না। আর আমি তো বেশি দিন নেই। ঐন্দ্রিলার বৌভাতের পর দিন ই আমি চলে যাব। অহেতুক কেনো কম্প্রোমাইজ করবো?”
নীলাদ্রি চলে যাবে শুনতেই মনটা বসে গেলো পিউয়ের। তীব্র বিষাদ ঘিরে ধরলো কোমল মন। বিষন্ন স্বরে শুধালো,
“আপনি চলে যাবেন নীলাদ্রি ভাই?”
“হ্যা, পিউ আমার এখানে ভালো লাগে না। আমার প্রকৃতি ভালো লাগে, পাহাড়ে টেন্ট লাগিয়ে ঘুমানো বা সমুদ্রের অতল ঢেউ এ নৌকার পাল তোলা যেগুলোই যে আমার প্রিয়। এভাবে ইট পাথরের জীবন আমাকে খুব কুঁড়ে খায়”
পিউ খেতে পারলো না কফিটা। গলায় আটকে আছে। নীলাদ্রি তাকে দেখলো। অবাক স্বরে শুধালো,
“কফিটা ভালো খেতে না?”
“নাহ, কফি ভালো। আসলে আমার মনটা ভালো নেই নীলাদ্রি ভাই। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আকাশে যেমন মেঘ জমেছে। আমার মনেও মেঘ করেছে। আমি একজন পঁচিশ বছরের নারী। এমনটা নিশ্চয়ই আমাকে শোভা পায় না তাই না নীলাদ্রি ভাই?”
নীলাদ্রি কিছুসময় নীরব চেয়ে রইলো পিউয়ের দিকে। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে এককোনায় স্তুপ করে রাখা কদম ফুলগুলোর থেকে পাঁচটি নিয়ে এগিয়ে দিলও পিউ এর দিকে। গাঢ় স্বরে বললো,
“মেয়েদের প্রকৃতির এই ফুল নামক জড়বস্তুর প্রতি খুব মমতা। তারা ফুল পেলেই দুঃখ ভুলে যায়। আমার কাছে এখন দামী ফুল নেই। আছে এই বৃষ্টিস্নাত কদম ফুল। হুমায়ুন আহমেদের মতে এটা খুব ফালতু ফুল। তোমার মন কি এতে ভালো হবে পিউ?”
পিউয়ের চোখ ঝাপসা হলো। ঝাঝা করে উঠলো হৃদয় অসহনীয় বেদনায়। মানুষটা কি সত্যি বুঝে না? নাকি বুঝেও ভান ধরে?
পার্কটা শহরের সর্বপূর্বে। বিশাল দুই একর জমিনের উপর একটা ইকোপার্ক। বৃক্ষরাজীতে ঘেরা এই পার্কে আছে অনেক ব্যাবস্তা। বসে নদী দেখা যায়, বিভিন্ন রাইড আছে। খাওয়ার ব্যাবস্থা। কিন্তু অভ্রের খালাদের মাথায় চাপলো তারা বোট চালাবে। একেই বৃষ্টিতে পানির স্তর বেড়ে গেছে। অভ্র বারণ করলো। কিন্ত তারা শুনলো না। ধরলো ঐন্দ্রিলাকেও। ঐন্দ্রিলা সাতার পারে না। উপরন্তু বৃষ্টির জন্য পানি থৈথৈ করছে। এই পানিতে পরলে আর বাঁচা লাগবে না। পানি খেয়েই ভেসে উঠবে। তারা যখন ঐন্দ্রিলাকে টেনে নিয়ে যেতে উদ্ধত হলো। ঠিক তখনই অভ্র ঐন্দ্রিলার হাত টেনে বলল,
“ও যাবে না”
“কেন রে, ও যাইবো না কেন? আমরা মজা করবো আর বউ কি চাইয়ে দেখবে”
“খালা, আমি তো বলেছি ও যাবে না। ঐন্দ্রি সাতার পারে না। আর তোমরা মজা করো না, কেউ তো বারণ করে নি। ও আমার সাথে মজা করবে”
অভ্রের এমন কথায় খালাদের একজন বাকি দুজনকে টেনে কিছু বললো। তারপর তারা নিজেরা হাসাহাসি করলো। ঐন্দ্রিলা তাকিয়ে রইল অভ্রের দিকে। বাবা-মা ছাড়া কেউ জানে না ঐন্দ্রিলা সাতার জানে না। অভ্র কি করে জানলো সেটা। খালারা মজা করে বলল,
মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ১৭
“ঠিক আছে ঠিক আছে। তোরা মজা কর। আমরা ডিসটার্ব করুম না”
তারা চলে যেতেই ঐন্দ্রিলা শুধালো,
“তুই কি করে জানিস আমি সাতার পারি না”
অভ্র হাসলো স্মিত। মৃদু স্বরে বলল,
“এটা তো শুধু সাঁতার বাবু, তোর সম্পর্কে এমন অনেককিছুই আমি জানি যা হয়তো তুই নিজেও জানিস না”…………………