সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৪

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৪
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

প্রকৃতি এখন নিশ্চুপ। মুষলধারার বৃষ্টিটাও আস্তেধীরে কমেছে। এক পাল মৃদূ বাতাস এসে খোঁচা দিচ্ছে শরীরে। একটু আগের বেদনায় ডুবন্ত হালকা বর্ষার আঁচে এখন শুধুই মন ভোলানো সুর। আড়াআড়ি অন্ধকার হাত-পা মেলে বসেছে অদূরের ওই
গহীন ঝোপে। ঝোড়ো বাতাসের স্পর্শ পেতেই নিভে গেছে রাস্তার সোনালী আলো। ডুবন্ত এক তমসা ভরা রাতে
নিথরের মতো যে সুপুরুষ দাঁড়িয়ে? তার চওড়া বুকের ভাঁজে আরেক রূপসী মিশে। তীব্র তো নিজের মাঝে নেই। চোখেমুখে অবিশ্বাস, রুদ্ধ মস্তক,নিশ্চল চাউনীতে একটা শক্ত পিলার সে। ভীতু মেয়ে কি সত্যিই ফিরে এসেছে? সত্যিই এভাবে জড়িয়ে ধরেছে ওকে? ভালোবাসি বলেছে? তীব্র ভুল শোনেনি তো!

সকালের মতো আরেকবার তীব্রর প্রাণ ওষ্ঠাগত হলো। তবে তফাৎ শুধু,তখন ভয়ে-মানবিকতায়, এবার ভালোবাসায়!
অনিন্দ্যসুন্দর এই মুহুর্তে হঠাৎ তীর্যক সাদা আলো ঠিকড়ে পড়ল ওদের ওপর। তীব্রর ঘোর ভাঙল অমনি। সঙ্গে সঙ্গে কতগুলো তেড়ে আসা হাত তালির আওয়াজে চটক কাটার ন্যায় নড়ে ওঠে পুষ্পিতা।
প্রিয় পুরুষের বুক হতে চকিতে মাথা তুলে ঘুরে চায় পেছনে।।
তীব্রর বন্ধুরা! সহসা ছিটকে সরে এলো মেয়েটা। মিরাজ, আরমান,মুশফিক নাহিদ,সব কটা হাজির। আরমানের হাতে টর্চ। একটা ছাতা মেলে চারজন ঠেসেঠুসে দাঁড়িয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তীব্রর এত দেরি,আবার ভারি বর্ষণ, সব মিলিয়ে কেউ আর ঘরে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারেনি। তারপর নিচে নামতেই ফাঁকা রাস্তায় বন্ধুর এই দৃশ্যে চমকের পর আনন্দে ফেটে পড়ছে তারা।
কিন্তু পুষ্পিতা কুণ্ঠায় নিঃশেষ। কী করবে,কোথায় তাকাবে সব কিছু প্যাঁচ বেঁধে গেল।
মিরাজ থেমে নেই। দু আঙুল মুখে দিয়ে সমানে সিটি বাজাচ্ছে সে। নাহিদের পুরূ ঠোঁটে হাসির তুফান। ফাঁকে আনচানে মনে ওপরে দেখল। ইস! মিস নূহা এমন সুন্দর দৃশ্যটা মিস করে গেলেন।

বিট্টু আর পুষ্পিতা এক হয়েছে! মেয়েটা এখানে থাকলে সব থেকে বেশি খুশি হোতো। ওর উতলা মন চাইল ছুট্টে গিয়ে নূহাকে এখানে টেনে নিয়ে আসতে। এতো রাত,সাথে আয়েশা ঘরেই ওসব ভেবে গেল না। আবার, মেয়েটা যে রাগ করে আছে। ভাবতেই নাহিদের হাসি মিলিয়ে মুখ কালো হলো। নূহা আজ গোটা একটা দিন তার সাথে কথা বলেনি। ছাদেও দেখা হলো! তাকায়নি ওর দিকে। নাহিদের কত খারাপ লেগেছে জানে মেয়েটা?
তার ধ্যান ছোটে বন্ধুদের হল্লাহল্লি শুনে।
সব ঝেড়ে ফেলে নিজেও সামিল হলো তারপর।

ওরা এক ছুটে গেট পেরিয়ে বাইরে চলে এলো। চারজন চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে কুণ্ডলীর মধ্যে আটকে নিলো তীব্র-পুষ্পিতাকে। চোখমুখে বাধ ভাঙা উল্লাস! হাত তালি দিতে দিতে গান ধরল,
“ বন্ধু যায়নাই হারাইয়া, রাস্তায় সে দাঁড়াইয়া,
এতক্ষণ প্রেম কইরাছে।
বৃষ্টিতে ভিজিয়া,রিত্তিক রওশান সাজিয়া,
তলে তলে ট্যাম্পু ছাইড়াছে।
হোয় হোয়!”

দূরের দারোয়ান ছাতা নিয়ে আর আসেননি। ওখানে দাঁড়িয়েই হাসছেন তিনি। ভাগ্যিস, এই বিল্ডিংয়ের বাড়িওয়ালা এখানে থাকেন না। নাহলে ছেলেপেলে গুলোর আনন্দ মাটি হোতো! আবার এমন আশ্চর্য কাণ্ডকারখানাও মিস করতেন তিনি। আহা,এক জীবনে চারটে বিয়ে করা ছাড়া আর কোনও সাধই তার বাকি নেই।
বন্ধুদের এমন হৈ-হুল্লোড়েও তীব্রর হাসি ফিরল না। এতো শব্দেও নিজের বক্ষঃস্থলের ভূমিকম্প সে স্পষ্ট শুনছে। বিলাতি নয়নজোড়া এখনও আটকে পুষ্পিতার ওপর।
মেয়েটা তখন লজ্জায় কাঠ। মিরাজদের গানের লাইন শুনে শুনে চোখ খিচে নিচ্ছে বারবার। চিবুক তার গলবিলে। অস্বস্তিতে হাবুডুবু খেয়ে হাতের আঙুল কচলাচ্ছে কখনও।
চোরা দৃষ্টি তুলে সে একটু জায়গা খুঁজল পালানোর। ওরা এতো হযবরল হয়ে ঘুরছে, একটা ফাঁক গলে দৌড়ানোরও উপায় নেই।

পুষ্পিতা তক্কে তক্কে রইল। যেই একটু জায়গা পেয়েছে, ছুটতে চাইল ঘরে।
তুরন্ত হাতটা টেনে ধরল তীব্র।
মেয়েটা চমকে যায়! চাউনীতে হতভম্ব ভাব।
কিছু বোঝার আগেই সে পুরুষ তাকে টেনে আবার বুকে নিয়ে গেল। প্রথমবার, প্রথমবার নিজের সবটুকু জোর দিয়ে পুষ্পিতার ক্ষুদ্র-কোমল দেহটা সবার সামনেই আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল তীব্র। পুরুষালি কণ্ঠস্বর,
কেমন হাঁসফাস করে বলল,
“ তুমি কোথাও যাবে না ভীতু মেয়ে! আমার বুকে এইভাবে সারাজীবন আটকে রাখব তোমাকে। তুমি কোথাও গেলে আমি মরে যাব,সত্যিই মরে যাব।”

রাত তখন অনেক! দুটো পার হবে নিশ্চিত। তীব্র ধমকে-ধামকে পাঁজিগুলোকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে।
ব্রীড়ার তোপে পুষ্পিতা তখনও আত্মস্থ হতে পারছে না। একটু আগের সব ঘটনা পরপর সাজালে পৃথিবীটাই দুলছে তার। এতো সাহসী কবে হলো ও? কবেই বা এমন নির্লজ্জ হলো? ইস,
এই ১৯ বছর বয়সে এত লজ্জা মেয়েটা কোনওদিন পায়নি।
তীব্রর চোখের দিকেও আজ তাকানো দুঃসাধ্য যেন।
পুষ্পিতা সিঁড়ি বেয়ে আগে আগে উঠছে। পেছনে ছায়ার মতো তীব্র। ঠিক এই কারণেই পুষ্পিতার পা এগোতে চাইছে না। মোজাইকের খাঁজে কেউ আঠা লাগিয়েছে না কি!

দুজনেই কাকভেজা। সারা সিঁড়িঘর তলিয়ে গেল পোশাক চুইয়ে পড়া টুপটাপ জলে। পুষ্পিতা আনত মাথায় নিজেদের দরজা অবধি এলো। থামল, ভেতরে না ঢুকে পিছু ঘুরল আবার।
কুণ্ঠায় নিভন্ত চোখের তারা, অমনি থতমত খায়। তীব্র দাঁড়িয়ে আছে। ঘরে যায়নি। চোখে চোখ পড়তেই ডান ভ্রুটা তুলল সে।
পুষ্পিতা থতমত ভাব ঢাকতে নিজেই বলল,
“ না মানে.. এমনি দাঁড়িয়েছি!”
তীব্র ঠোঁট কামড়ে হাসল। কপাল কুঁচকে বলল
“ আমি তো বলিনি,তুমি আমার জন্যে দাঁড়িয়েছ!”

পুষ্পিতা আইঢাই ভাবে গাল চুলকাল। ভীষণ দোটানায় থুবড় পড়েছে বেচারি।
এক,তার এক্ষুনি, এই মুহুর্তে তীব্রর সামনে থেকে পালাতে ইচ্ছে করছে। মানুষটার এই যে প্রেমিক সুলভ বাঁকা নজর,এই যে তাকে মেপে দেখা এসব তো কাঁটার মতোন দাগ কাটছে বুকে।
পরপর যেতে ইচ্ছে করছে না। এভাবেই অন্ততকাল তীব্রর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যায় যদি! এতেও পুষ্পিতার অনেক সুখ!
মেয়েটা কী করবে ভেবে পেলো না। দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে গলার শ্লেষা কাটাল। বলল মিনমিনিয়ে,

“ অনেক ভিজেছেন আজ! বুকে গরম তেল মালিশ করে নিলে জ্বর-টর আসবে না। ঘুমও ভালো হবে।”
পুরোটা সে ওর দিকে না চেয়েই বলল।
তীব্রর জবাব এলো বিলম্বহীন,
“ ঘুম আসবে আমার? প্রথম বার যখন কলেজের বাইরে বসে হাত ধরেছিলে? তিন রাত ঘুমোতে পারিনি। আজ তো দুবার জড়িয়ে ধরেছ,কদিন ঘুম হবে না কে জানে!”
পুষ্পিতার শীর্ণ বুক ছলকে উঠল এতো! এরপর আর দাঁড়িয়ে থাকা হয় না। অন্ততকালের সুখখানা সে নিমিষেই বিসর্জন দিয়ে দিলো।
হাওয়ায় দুলতে থাকা পলাশের মতোন ফেঁপে ওঠা গাল, উচাটনে ভরতি হৃদয় নিয়ে চপল পায়ে ঘরে ঢুকেই খিল টেনে দিলো মেয়েটা।

তীব্র বুক ফুলিয়ে মুক্ত শ্বাস টানল। এতো সহজে অনুভূতির দোলাচল থেকে নিস্তার মিলবে বোঝেনি! ভীতু মেয়ে সব ভুলে ওকে ক্ষমা করেছে। ঠকিয়েছে জেনেও ভালোবেসে কাছে টেনেছে! এমন মিষ্টি ভবিষ্যৎ যদি আগে জানতো তীব্র, শুরুতেই সবটা বলে দিতো তাহলে।
তীব্র ঘরে ঢুকল আস্তেধীরে। দরজা লাগিয়ে ফিরতেই ভড়কে উঠল একটু! বিচ্ছুগুলো
সব ক-টা একদম মুখের ওপর দাঁড়িয়েছে এসে।
ও পুরূ কণ্ঠে বলল,

“ কী চাই?”
মিরাজ বলে,
“ দেখাতে চাই!”
তীব্র ভ্রু বাঁকায়,
“ কী?”
পাশে মুশফিক ছিল। মিরাজ আচমকা জাপটে ধরল ওকে। কাঁদোকাঁদো ভাব করে বলল,
“ তুই কোথাও যাস না মুশফিক। তুই আমার বুকের মধ্যে থাক। তুই গেলে আমি মরে যাব।”
সবাই হুহা করে হেসে উঠল
এতে।
তীব্র চোখ রাঙিয়ে বলল,
“ বেশি সাহস বেড়েছে তোর তাই না? দাঁড়া!”
পায়ের জুতোতে হাত দিতে গেলেই, মিরাজ ছুট লাগায়।

বাকীরাও দুরন্ত কদমে পিছু নেয় তার। তীব্র তেড়ে যেতে নিয়েও দাঁড়িয়ে গেল। মনের প্রশান্তি কিংবা প্রেমের শুরু? কোনও এক সুখে হাজার হাজার প্রহর পর ঝরঝর করে হেসে ফেলল সে৷
পুষ্পিতা চোরের মতো পা টিপেটিপে ঘরে এসেছে। আয়েশার দরজার হুক আগেই খুলে দিয়েছে নূহা। মেয়েটা নরম বিছানায় লেপ্টে গেছে একদম। পাতলা কাঁথায় পা থেকে মাথা অবধি ঢাকা। ঘরের
আলো জ্বলছে তখনও।
পুষ্পিতা ভেজা জামাকাপড় ছাড়ল। সেসব ধুয়ে-নিঙড়ে মেলল বারান্দায় ।
চুল মুছে,গামছায় প্যাঁচিয়ে আস্তেধীরে পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল নূহার। গায়ের কাঁথাটা টেনে ওপাশ ফিরতেই বলল কেউ একজন,

“ স্যার হলেন বাবার মতো! সম্মানীয় মানুষ!”
পুষ্পিতা লাফিয়ে উঠল ত্রাসে। প্রকট চোখে বলল,
“ তুতুই ঘুমোসনি?”
নূহা এপাশ থেকে ওপাশ ফিরে শোয়। কর্কশ কণ্ঠে বলে,
“ লাইট অফ কর। তোর আর তোর স্যারের জ্বালায় এতক্ষণ আলো জ্বালিয়ে ঘুমোতে হয়েছে। আর পারব না,সরি!”
পুষ্পিতা ঠোঁট ওল্টাল। চুপচাপ উঠে সুইচ টিপল দেয়ালের। শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই তীব্রর শক্ত চিবুক ভেসে ওঠে সামনে। মুচকি হাসল মেয়েটা। মাথার বালিশ টেনে বুকে নিয়ে এলো। আজকের রাত শেষ হবে! কিন্তু এই যে প্রণয়লীলা শুরু হলো দুজনের? এর শেষ আছে কোথাও?

নূহার আজ রেজাল্ট বেরিয়েছে। ভীষণ আশ্চর্যের কথা হলো, ডিপার্টমেন্ট টপার হয়েছে মেয়েটা।
খবরটা রাতারাতি পৌঁছে গেল নাহিদের কানেও। দুপুর বেলা আয়েশা দুটো বড়ো বাটিতে পোলাও-কোরমা রেঁধে তাদের ঘরে দিয়ে গেছেন। সাথে গদগদ হেসে জানিয়ে গেছেন এসব।
সেই থেকে ব্যকুল চিত্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে নাহিদ। এতো ভালো ভালো খাবার মুখে রুচছে না তার। মাথার মধ্যে এক পৃথিবী চিন্তা নিয়ে কোনওরকম এক ঘন্টা পার করল সে।

নূহা ওর ওপর চরম ক্ষেপে আছে। এই রাগ তো ভাঙাতে হবে তাই না! সাথে মেয়েটা এমন চমৎকার রেজাল্ট করল! ডিপার্টমেন্ট টপার হওয়া কি মুখের কথা না কি! একটা উইশ না করতে পারলে নাহিদ মরেও শান্তি পাবে না এখন।
কিন্তু কীভাবে কী করবে সে? নূহা রেগে তাকালেই তো ওর দম ফুরিয়ে যায়। সেখানে চটে কিছু বললে যে নাহিদকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
নাহিদ অনেক ভেবে ভেবে একটা বুদ্ধি আঁটল মনে। আর এক মুহুর্ত দেরি না করেই,গায়ে শার্ট চাপিয়ে রকেট বেগে ছুটে গেল কোথাও।

ফুলের দোকান থেকে একটা ইয়া বড়ো বুকে কিনেছে সে। দোকানি বুকেটা দেয়ার সময় বলেছেন,এই ফুল দিলে যে মেয়ে তাকে দুচোক্ষেও দেখতে পারে না? সেও খুশিতে প্রেমে পড়ে যাবে।
নাহিদ ফুরফুরে মেজাজে রিকশায় উঠে বসল। যদি কোনও মেয়ে বুকেটা দেখে প্রেমে পড়তে পারে, সেখানে রাগ ভাঙা তো মামুলি ব্যাপার।
ছেলেটা উজ্জ্বল চোখমুখে ফুলের গায়ে হাত বোলাল। দরজায় এসে শার্টের কলারটা টেনেটুনে গোছাল দুবার।
বুয়া মাত্র ঘর মুছেছেন। মেঝে চটচটে ভেজা। বালতির জল পাল্টাতে যাওয়ার আগে বলে গেলেন,

“ আপা সাবধানে হাঁইটেন। ফ্লোর কিন্তু ভিজা । কারেন্টও নাই যে ফ্যান চালামু! পইড়া টইরা গ্যালে আমি কিছু জানি না।”
ফোন টিপতে টিপতে ঘাড় নাড়ল নূহা। কলিংবেলটা তক্ষুনি বাজল। ও উঠে এলো তড়িৎ। পুষ্পিতা কলেজে। আয়েশা সবে যোহরের নামাজে দাড়িয়েছেন। শরীর ভালো নেই! তাই অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন আজ।
দরজাটা নূহাই খুলল। অমনি ওপাশ হতে চ্যাঁচিয়ে উঠল নাহিদ,
“ অভিনন্দন!”
কিন্তু হঠাৎ কাণ্ডে মেয়েটা হকচকাল খুব! ভ্যাবাচেকায় পেছাতে গেলেই ভেজা মেঝেয় হড়কে গেল পা-টা। সাথে সাথে ধপাস করে পড়ে গেল নিচে।

নাহিদের কথা শেষ। বুকেইর আড়াল থেকে চোখদুটো ছিটকে বাইরে চলে এলো। নুহা মেঝেতে পড়ে সাপের মতো করছে। চোখমুখ ব্যথায় গোটানো।
নাহিদ ওকে কীভাবে তুলবে বুঝল না। হতভম্বতায় হাত না পেতে বুকেইটা বাড়িয়ে ধরল।
অমনি জ্বলন্ত চোখে চাইল নূহা। চটে বলল,
‘ আপনি দেখতে পাচ্ছেন না আমি পড়ে গেছি? আমাকে না তুলে ফুল সাধছেন কেন? ফুল নিয়ে কি শুয়ে থাকব এখানে?”
জ্বিভ কাটল সে,
“ সরি সরি আসুন।”
ডান হাতটা বাড়াল নাহিদ। নূহা প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে। সরু কোমরের হাড়গোড়ও নড়ছে বোধ হয়। কিন্তু তেজ দেখাতে ভুলল না। ঠেলে নাহিদের পেতে রাখা হাতটা সরিয়ে দিলো সে। নিজেই দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়াল তারপর। বলল মুখ ঝামটা মেরে,

“ আমি অশ্লীল ছেলেদের হাত ধরি না।”
নাহিদের আনন জুড়ে হুড়হুড় করে অন্ধকার মেখে আসে। পরপর ভীষণ রাগে তেতে গেল মাথাটা! সব দোষ মিরাজের। ওর চুলগুলো বাউন্ডুলেদের মতো। নাহিদের ইচ্ছে করল টেনে সেসব উপড়ে ফেলে আসতে।
বদমাশ ছেলেটা যদি সেদিন মেশিন নিয়ে না বলতো, আজ এরকম কিচ্ছু হোতো না।
নাহিদ ফুস করে দম ঝাড়ে। চট করে দুই কানে হাত দিয়ে বলে,
“ ভুল হয়ে গেছে! এমন আর হবে না।”

কান ধরতে গিয়ে বুকেইটা দুম করে নিচে পড়ে গেল। কিন্তু নাহিদের সেদিকে খেয়াল নেই। সে নিজের মতোন বলছে,
“ আমি আর কোনওদিন,কোনও মেশিনের কথা জিজ্ঞেস করব না আপনাকে। আজ থেকে দুনিয়ার সব মেশিন বাদ। আমি আর মেশিন কথাটা উচ্চারণই করব না।”
“ করবেন না, করবেন না করেও তিনবার করে ফেললেন।”
নাহিদ আবার জ্বিভ কাটে। আবার বলে, “ সরি!”
নূহার রাগ-ক্ষোভ সত্যিই নেই৷ পড়ে থাকা বুকেইটা নিজেই ওঠাল সে। শুধাল সংকোচহীন,
“ এটা কি আমার জন্য?”
নাহিদের কণ্ঠ প্রফুল্ল,

“ জি। আপনি এতো ভালো রেজাল্ট করেছেন। সেজন্য…”
“ এখনও কান ধরে আছেন কেন? হাত নামান।”
ও সাথে সাথে হাত নামাল। হেসে বলল,
“ থ্যাংক ইউ!”
“ দাঁত ক্যালাচ্ছেন কেন? আমি কি আপনাকে মাফ করেছি না কি?”
ফের হাসিটা ধপ করে নিভে গেল নাহিদের।
“ করেননি?!
“ না।”
নাহিদ উতলা হয়।
“ কী করলে মাফ করবেন বলুন,আমি তাই করব।”

নূহা মনে মনে বলল,
“ আমাকে ভালোবাসলে।”
চুপ দেখে তাগিদ দিলো ছেলেটা।
“ বলুন প্লিজ!”
কথার মধ্যে আয়েশা এসে দাঁড়ালেন। ওকে দেখেই বললেন,
“ ওমা নাহিদ! তুমি কখন এলে?”
তারপর চোখ পড়ল নূহার হাতের দিকে।
“ এতো বড়ো বুকেই? তুমি বুঝি ওকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছ!”
নাহিস জোরসে মাথা ঝাঁকায়।
“ বেশ বেশ। আচ্ছা তোমরা গল্প করো তাহলে। আমি চা দিচ্ছি।”
এবারেও মাথা ঝাঁকাল নাহিদ।
আয়েশা যেতেই নূহা বলল,
“ সব কথায় এত মাথা ঝাঁকাবেন না তো। মুখে বলবেন।”
“ কী বলব?”
“ ভালোবাসার কথা।!
বেখেয়ালে ‘ও’ বলে আবার সতর্ক চোখে চাইল নাহিদ।
“ হ্যাঁ?”
নূহার কণ্ঠে দাপট,

“ হ্যাঁ হ্যাঁ কী? ভালো ভালো কথা বলবেন। নাহলে আপনার সাথে মিশব কেন?”
ছেলেটা বোকা বোকা ভাবে আবার মাথা নাড়ল। নূহা ভালো ভালো কথা বলেছেন? কিন্তু সে যে অন্য কিছু শুনলো!
পরপরই শিরদাঁড়া সোজা করল নাহিদ। সর্বনাশ! ও কি মিরাজের সাথে থেকে থেকে সত্যিই অশ্লীল হয়ে যাচ্ছে?
নূহার নিষ্পলক চাউনি তখন বুকেইতেই। নাহিদ প্রথম কিছু দিয়েছে! এটা ও কোথায় তুলে রাখবে? মাথায়,না বুকে! নূহার খুব করে মন চাইল বুকেইটাতে চুমু খেয়ে ভরিয়ে ফেলতে। নাহিদ সামনে বলে পারল না।
ওপর থেকে একটা গোলাপ বের করল শুধু। চোটপাটের কণ্ঠটা হঠাৎ মিহি করে বলল,
“ এই ফুলটা আমার চুলে গুঁজলে কেমন লাগবে মিস্টার ঢেঁড়স?
নাহিদ সানন্দে জানায়,

“ দারুণ!”
নিষ্পাপের মতো বায়না করল মেয়েটা,
“ তাহলে আপনিই গুঁজে দিন না!”
অবাক চোখে চাইল সে,
“ আমি?”
নূহার মাঝে ভণিতা নেই। অমন জড়োতাহীন জানাল,
“ আমি তো তেমন সাজগোজ করি না। জানি না কীভাবে গুঁজতে হয়! দেবেন আপনি?”
নাহিদের মুখায়বে অস্বস্তির ছাপ। কিন্তু মুখের ওপর মানা করতে পারল না। এগিয়ে এলো। হাত থেকে ফুলটা নিতেই,
পাঞ্চক্লিপে আটকে রাখা চুলগুলো খুলে দিলো নূহা। বলল,
“ আপনি আমার কানে গুঁজে দিন! তাতেই হবে।”
নাহিদের হাত কাঁপছে। কাঁপছে বুকটাও। কী যে অস্থির ঢিপঢিপে শব্দ! কানের খাঁজে ফুল গেঁথে দেয়ার পুরোটা সময় তার দিকে একযোগে চেয়ে রইল নূহা। নাহিদ ফুল এঁটে সরে আসে। খোলা কেশের এক কোণে টকটকে লাল গোলাপ রাখা তরুণী তখন শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হয়ত!
নাহিদ ওসব বুঝল না। হিসেবে সে বড্ড কাঁচা। একটুখানি শুকনো ঢোক গিলল কেবল।
নূহা ঠোঁটে নেড়ে শুধাল,

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৩

“ আমাকে কেমন লাগছে?”
নাহিদ কথা বলতে গিয়ে টের পেলো কণ্ঠনালিতে শব্দ নেই।
জানাল কোনওরকম,
“ সসুন্দর!”
“ এখন আমায় দেখলে কেউ প্রেমে পড়বে?”
নূহার আচরণ কেমন অন্যরকম আজ। এমনটা নাহিদ কখনও দেখেনি। কীসব উদ্ভট উদ্ভট প্রশ্ন!
উত্তরে মাথা নাড়ল শুধু। বোঝাল
“ হ্যাঁ।”
ফটাফট প্রশ্ন ছুড়ল মেয়েটা,
“ তাহলে আপনি? আপনিও পড়বেন?”

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৫