রাগে অনুরাগে পর্ব ১৮

রাগে অনুরাগে পর্ব ১৮
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি

ব‍্যালকনির সামনের মেহগনি গাছটার ফাঁকফোকরে উঁকিঝুকি দিচ্ছে বিকেলের তেজহীন রোদ। সোনালী আভায় ছেয়ে আছে গোধূলির আগ মুহুর্তের পৃথিবী। প্রকৃতি জানান দিচ্ছে, এই তো আর কিছুক্ষণ। তারপরেই রোদেরা সব আধারিতে লুকিয়ে পড়বে।

মালিহা মনটা খারাপ করে ব‍্যালকনিতে এসে দাড়িয়েছে। অনেকটা আগ্রহ নিয়ে শাশুড়ি মা, জা এবং শশুর বাবার সঙ্গে কথা বলেছিল মেয়েটি। কিন্তু বরাবরের মতোই নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে তাকে। নাহ! জাওয়াদের কোন আশানুরূপ খবর তারা দেননি। সবার এক কথা,হয়তো নেটওয়ার্কের সমস্যা। নতুবা ব‍্যাস্ততায় ফোন দিতে পারছে না। নিশ্চিত করে কেউই কিছু বলছেন না। সবাই সম্ভাব‍্য বা মনগড়া কাহিনী বলে যাচ্ছেন। তাতে স্বামীর চিন্তায় ব‍্যাকুল মালিহার অন্তর জুড়াচ্ছে না। জুড়ানোর কথাও নয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দুটো হলদে পাখি মেহগনি গাছের একদম শীর্ষ ডালটিতে আসন পেতেছে। পুরুষ পাখিটি বারংবার মেয়ে পাখিটির দিকে মুখ ঘুরাচ্ছে। এতে বারবার মুখ অন‍্যদিকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মেয়ে পাখিটি। পাখি জোড়ার মান অভিমানে মালিহার মন খারাপেও ঠোঁট কোলে মৃদু হাসির রেখা ফুটে ওঠে। মেয়েটি মনে মনে আসা করে জাওয়াদ একদিন ঠিক তার সামনে আসবে। সেও মেয়ে পাখিটির মতো অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে রাখবে। পরক্ষণেই মনে শঙ্কা জাগে জাওয়াদ আদর করে তার অভিযোগ গুলো শুনে মান ভাঙাবে তো?

আজকাল মেয়েটির মনে নানান রকম খারাপ চিন্তা এসে হানা দেয়। আনমনে কত কি ভেবে চলে। জাওয়াদের চিন্তায় ক্রমশই অস্থির হয়ে পড়ে সন্তান সম্ভাবা মালিহা। মায়া বেগম মেয়েকে কাছ ছাড়া করেন না। ইতিমধ্যে বাড়ির সকলে সবটা সম্পর্কে অবগত হয়েছেন। মালিহার দাদু জামিলা বেগমও ফিরে এসেছেন। পরিবারের রাগ অভিমান দূর হলেও সকলের মনে ভয় দানা বাধছে দিনকে দিন। কি থেকে কি হয়!

পরিক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছে। এরপরও একটি সপ্তাহ বাবার বাড়িতে কাটিয়েছে মালিহা। বিকেলে দাদুর সঙ্গে বসে গল্প করছিল। এরমধ্যেই বাড়ির ফোনে কল এলো। বাড়ির ফোন সাধারণত মায়া বেগমের কাছেই থাকে। বরাবরের মতো তিনিই কল রিসিভ করলেন। ওপাশ থেকে কুশল বিনিময় শেষে জানালেন, মালিহাকে তার শশুর বাবা নিতে আসবেন। অর্থাৎ মেয়ের ফিরে যাবার দিন। মায়া বেগম এবার আর খুশি হতে পারলেন না। মেয়ে তার গর্ভবতী। খুব একটা সুস্থও না। জামাইটার এ পর্যন্ত কোন খোঁজ খবর পেলেন না। সে চিন্তায় মেয়ে যেমন অস্থির তেমনই তারাও চিন্তিত। এখানে থাকলে তিনি বুঝিয়ে শুনিয়ে অন্তত ঠিক করে খাওয়াতে পারবেন। এসময় পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খাওয়া খুবই জরুরি। এতে গর্ভের সন্তান এবং মায়ের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে অনেক বড় ভুমিকা রাখে। শশুর বাড়ি যতই ভালো হোক। সেখানে কে তার মেয়েকে বুঝিয়ে শুনিয়ে খাইয়ে দিবে? মেয়ের চিন্তায় অস্থির লাগে মায়া বেগমের।

মালিহার মাথায় তেল দিয়ে বেনি করে দিচ্ছিলেন জামিলা বেগম। মায়া বেগম কথা বলা শেষে ফোন রেখে এসে মেয়ে এবং শাশুড়িকে সবটা জানালেন। সাথে এও বললেন, “জামাইয়ের না ফেরা অব্দি এখানেই রাখার ইচ্ছে আমার। মেয়েকে আমি আর কখনও জোরজবরদস্তি করবো না। ও যা ভালো বুঝবে সেটাই করবে। আপনি কি বলেন আম্মা?”

শাশুড়ি মায়ের দিকে প্রশ্নবাক‍্য ছুড়ে দিলেও জামিলা বেগম চুপ রইলেন। নাতনির চিন্তায় ছুটে এসেছেন ঠিকই কিন্তু পূর্বের অপমান এখনো ভুলতে পারেননি তিনি। ফলে নিজ থেকে তাকে আর কিছু বলতে শোনা গেল না।
মায়া বেগম শাশুড়ি মায়ের চুপ থাকায় আর কিছু বলার আগ্রহ পেলেন না। কিন্তু মুখ খুললো মালিহা। মাকে অবাক করে দিয়ে বললো, “আমি ও বাড়িতে ফিরে যেতে চাই। আমার মনে হয় আমার এখন সেখানে থাকাটাই ভালো হবে। অনেকদিন তো হলো। এবার চলেই যায়।”
মেয়ের কথায় মায়া বেগমের মনের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। নাড়ি ছেড়া ধনকে দিয়েছেন তিনি কষ্ট। এ কষ্ট যেন বারবার তাকেই আঘাতে জর্জরিত করে। কষ্ট পেলেও প্রকাশ করলেন না। বিরস গালায় বললেন, “যেমনটা তোমার ইচ্ছে।”

সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে মেয়ের জন্য তার পছন্দের রসগোল্লা নিয়ে এলেন মালিহার বাবা । মালিহা খেতে খুব পছন্দ করে। ইদানিং তার আবার মিষ্টির প্রতি দারুণ রকম ক্রেবিং হচ্ছে।
ভদ্রলোক হাতমুখ ধুয়ে মাঝারি সাইজের একটি বাটিতে আট দশটা রসগোল্লা বেড়ে নিজেই মেয়ের রুমে নিয়ে এলেন। উদ্দেশ্য মেয়ে খাবে আর তিনি মন ভরে দেখবেন।

মালিহা তখন মাগরিবের নামাজ আদায় করে জায়নামাজ গুটিয়ে রাখছিলো। বাবাকে ট্রেতে করে কিছু আনতে দেখে কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেল কাছাকাছি। সচরাচর বাবা তার রুমে আসেন না।
মেয়ের উদ্দেশ্য ভদ্রলোক বললেন, “আম্মু, তোমার জন্য রসগোল্লা এনেছি। সবটা খাবে কিন্তু।”
মালিহা হাসে। দেরি না করে বাটি থেকে একটি রসগোল্লা মুখে তুলে নেয়। রসে ভরা নরম তুলতুলে মিষ্টান্ন। নাম তার রসগোল্লা। চিনির পরিমাণ একটু কম থাকায় বেশ খেতে লাগে।

মেয়েকে শুধান, “কেমন আম্মু?”
প্রতিত্তোরে মালিহা বলে, “মাশা আল্লাহ খুব ভালো আব্বু।”
“তাহলে আরও খাও।”
মালিহা পরপর আরও দুটো রসগোল্লা খায়। তারপর বাবার উদ্দেশ্য বলে, “ওবাড়ি থেকে ফোন এসেছিল। আগামীকাল নিতে আসবেন আমাকে। এবার তাহলে ফিরতে হবে আব্বু।”
“জাওয়াদ আসলে পরে গেলে হয় না আম্মু?”

“যেতে যেহেতু বলেছেন এখনই তাই আমার মনে হয় এখন যাওয়াটাই ভালো। এ ব‍্যাপারে তুমি কি বলো আব্বু?”
মালিহার বাবা সাথে সাথে জবাব দিলেন না। মেয়ের শুভ্র কোমল মুখখানার দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। মেয়ে তার বড় হয়ে গিয়েছে। স্বামীর সংসার করছে। আচরণে পরিপক্বতা এসেছে। চোখ সজল হয়ে ভদ্রলোকের। এখনো বেশ স্পষ্ট মনে আছে এক ক্লান্ত বিকেলে টাওয়েলে মুড়িয়ে মেয়েকে নিয়ে এই নীড়ে পদধূলি ফেলেছিলেন। সেই মেয়ে এখন দুদিন বাদেই সন্তানের মা হবে।

পুরুষ মানুষ তো। তাই আবেগটা সজতনে গিলে ফেললেন। চোখ সজল হলেও শুষে নিলেন পুরুষত্বের কাঠিন‍্যে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “তোমার যা ভালো মনে হয় সেটাই কর। আমি আসছি। রাতে খেতে চলে এসো। দেরি করো না।”
বাবার চলে যাওয়ার দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকে মালিহা। বাবা মানুষটা হয় বড্ড ভালো। এ ভালোর যেন শেষ হয় না। বাড়ন্ত পেটে হাত রাখে মালিহা। আনমনেই ভাবে, জাওয়াদ ঠিক এভাবেই তাদের সন্তানকে ভালোবাসবে।
পরদিন দুপুর নাগাদ মালিহার শশুর বাবা উপস্থিত হন। দুপুরের খাবার শেষে বউমাকে নিয়ে ফিরবেন। মালিহা এবার নিজ খেয়ালে শশুর বাবাকে আপ‍্যায়ন করলো।
মায়ের চোখের পানিতে কন‍্যা বিদায় হয়। দুপুরের কিছু পরেই মালিহাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন শশুর বাবা। এ অবস্থায় রাত বিরেতে বাহিরে না থাকাটায় ভালো বিবেচনা করে কড়া রোদে বাড়ি ফেরার পথ ধরতে হয়েছে।

পিত্রালয় থেকে শশুরালয়ে ফিরে সকলের হাসিখুশি মুখ দেখার পরিবর্তে মালিহার দেখতে হয়েছে শুষ্ক এক একখানা মুখশ্রী। সকলে যেন জোর করে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মালিহাও নিজেকে স্বাভাবিক রাখলো।
বাড়ির পরিবেশ থমথমে হলেও মালিহার যত্নের অভাব হলো না। শাশুড়ি মা যত্ন করে রাতে বেড়ে খাওয়ালেন। ভনিতা না করে বললেন, “মোটেও জাওয়াদের জন্য চিন্তা করবে না। দুশ্চিন্তা তোমার শরীরের জন্য খুব ক্ষতিকর। জাওয়াদ ঠিকই ফিরে আসবে। এসে যদি দেখে তার চিন্তায় নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে শরীরের বেহাল দশা করেছো। কতটা রাগ হবে ছেলেটা আমার। তাই আমি বলি কি আল্লাহর ওপর সবটা ছেড়ে দিয়ে মনখুলে বাঁচো। দুশ্চিন্তা নিয়ে বাঁচা যায় না মা।”

রাতের খাবার শেষে এ বাড়ির সকলে কিছুক্ষণ ড্রয়িং রুমে গা এলিয়ে দিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে। আজও তার ব‍্যাতিক্রম হয়নি। রাতের খাওয়া শেষে মালিহাও সকলের সাথে বসে ছিল। শাশুড়ি মায়ের কথার পিঠে মালিহা বলে উঠলো, “তাহলে আপনাদের সকলের মুখে হাসি নেই কেন আম্মা? বাড়ির পরিবেশ এমন থমথমে কেন?”

শাশুড়ি মা বলার পূর্বেই রিপ্তি মাঝখান থেকে বলে উঠলো, “তুমি এসেছো না! এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। কদিন বাদে আমাদের পুচকু সোনা আসবে তখন দেখবে সব কেমন আনন্দে ঝলমল করতে থাকবে।”
রাতে শুতে যাওয়ার আগে মায়ের দেওেয়া ব‍্যাগটা খুললো মালিহা। এক এক করে বেড়িয়ে এলো জলপাইয়ের আচার, কুলের আচার, চালতার আচার, আলু বুখারার আচার, রসুনের আচার। সাথে ছিল তিলের নাড়ু, নারিকেলের নাড়ু। এক একটি বয়ামে মায়ের যত্নে গড়া ভালোবাসা দিয়ে ভরপুর।

মালিহা এখন আর ঘুমাতে বেশি রাত করে না। রাত জাগা শরীরের জন্য ভালো না। ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘরে যেতে না যেতেই গায়ে কাথা টেনে শুয়ে পড়লো। মৃদু আলোয় রুমটা অদ্ভুত লাগছে তার কাছে। খাটের সামনে সেই দুই পাল্লার কাঠের আলমারিটা। মনে পড়ে গেল জাওয়াদের সাথে কাঁটানো মুহুর্তের কথা। মনের মধ্যে চলমান ঝড় নিয়ে শশুরালয়ে ফিরে এসেছিল সেদিন। দূরত্ব ছিল দুজনের। অথচ মানুষটি তখন তার খুবই নিকটে ছিল। বিছানায় পাশাপাশি শুয়েও আকাশসম দূরত্ব ছিল দুজনার মধ্যে। আর আজ কত আকাঙ্খা মানুষটার কন্ঠস্বর শোনার। এক পলক দেখার কত আগ্রহ। কতশত আবেগ জমে আছে।

রাত তখন বারোটার ঘরে। ড্রয়িং রুমের দেয়াল ঘড়িটা ঢঙঢঙ আওয়াজ করে জানান দিচ্ছে এখন মধ‍্যরাত। নতুন তারিখের সূচনা হলো। ঠিক তখনই মালিহার ফোন শব্দ করে বেজে উঠলো। জাওয়াদের জন্য মালিহা আজকাল ফোন রিংটোন ফুল ভলিউমে দিয়ে রাখে। ফোন দিলে যদি না শোনার কারণে ধরতে না পারে!
ঘুমের ঘোরে ফোন হাতরে কানে নেয় মালিহা। ঠিক তখনই হৃদয় শীতল করা কন্ঠস্বর কানে ভেসে আসে। তড়িৎ গতিতে উঠে বসে মেয়েটি। ওপাশ থেকে কেউ একজন শীতল গলায় বলে উঠলো, “আব্বু আম্মু ছাড়া তৃতীয় কেউ আমার চিন্তায় মুখ শুকাবে এতটা আমি ভেবেছিলাম কখনও? অথচ আমার ভাবনার থেকেও বেশি কিছু ঘটে গেল। কেউ একজন আমার চিন্তায় কাঁদে, আমার জন্য রোজ অপেক্ষার প্রহর গোনে। আমার অপেক্ষায় অধির আগ্রহে বসে থাকা মেয়েটিকে বলছি, তোমার অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে শীঘ্রই।”

ঘুমের ঘোরে নাম্বার না দেখেই কল রিসিভ করে ফেলেছিল মালিহা। ফলস্বরুপ মাঝরাতে কিছুটা অপ্রত্যাশিত কন্ঠস্বরে প্রথম দফায় ভয়ে সিটিয়ে যায় মেয়েটা। পরক্ষণে কান থেকে ফোন নামিয়ে চক্ষু দর্শন করতেই হৃদয়ে বয়ে শীতল হাওয়া। মুহুর্তেই চোখ থেকে ঘুম উড়ে যায়। যখনই মুখ ফুটে কিছু বলতে যাবে তখনই ওপাশ থেকে লাইন কেটে যায়। মালিহা বার কয়েক ‘হ‍্যালো, হ‍্যালো, হ‍্যালো’ বলেও ওপাশ থেকে কোনরকম সাড়াশব্দ পায় না। কথা আর হয় না। তবুও মনে শান্তি লাগে। জানালা দরজা বন্ধ রুমেও কোথাও থেকে যেন এক টুকরো সুখ হাওয়া বয়ে যায়। প্রিয়জনের অবর্তমানে মনের ব‍্যাথায় অসুখে আক্রান্ত মেয়েটিকে তার কন্ঠস্বর যেন সুখের ওষুধ হয়ে এসে নিরাময় দিয়ে গেল।

রাগে অনুরাগে পর্ব ১৭

এরপর বাকিরাত মালিহার আর ঘুম হয় না। আলমারি খুলে খুটিয়ে খুটিয়ে নিজের জিনিসপত্র দেখে। জাওয়াদের দেওেয়া উপহারসামগ্রীতে হাত সজতনে হাত বুলায়। সেগুলো আলাদা করে রাখে। তারপর জাওয়াদের জামাকাপড় গুলো ভাজ খুলে পুনরায় গোছাতে বসে। তখন মেয়েটির মন প্রাণ জুড়ে শুধু তার একান্ত প্রিয় মানুষটা। পেটে হাত বুলিয়ে বলে, “তিনি আসছেন সোনামনি।”

রাগে অনুরাগে পর্ব ১৯