মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ৩০
মুশফিকা রহমান মৈথি
ঐন্দ্রিলা কোনো কথা বললো না। হাতজোড়া এগিয়ে দিয়ে তড়িৎ গতিতে জড়িয়ে ধরলো সে অভ্রকে। গলাটা এতটাই জোরে ধরেছে নিঃশ্বাস আটকে যাবার যোগাড়, কিন্তু ঐন্দ্রিলার সমস্ত শরীর কাঁপছে। ঘামে চুলের গোড়া থেকে নোনা জলের রেখা গড়িয়ে পড়ছে। সারা শরীর ভেজা। ঘাড়ের উপর বিন্দু বিন্দু ঘামকনার দিকে নজর যেতেই চোখ সরিয়ে নিলো অভ্র। সকাল সকাল কোনো অভদ্র চিন্তা করতে চায় না।
একেই দিনের পর দিন বউয়ের পাশে মরা ভেটকি মাছের মত শুয়ে থাকা খুব দূর্বিষহ। যতই হোক সে পুরুষমানুষ। না চাইতেও কিছু চিন্তা মস্তিষ্কে চেপেই বসে। উপর থেকে পাশে শায়িত মানুষটি ঐন্দ্রিলা। এরমধ্যে সেই মানুষটি বিনা নোটিশে এভাবে জড়িয়ে ধরলে মেকি মুখোশ ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। অভ্র তো এত ভালো মানুষ নয়। নিজের একটি সহ্য ক্ষমতাও আছে। ফলে অতিকষ্টে বলে উঠলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ঐন্দ্রিলা আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছে। ছাড়”
অভ্রের কথাটা কানে আসতেই সম্বিৎ ফিরলো তার। চোখ খুলে আশপাশ দেখলো। নিজেকে দেখলো। সে অভ্রকে জড়িয়ে আছে। ফলে তড়িৎ গতিতে তাকে ছেড়ে পেছনে সরে বসলো ঐন্দ্রিলা। তার চোখ মুখ বিভ্রান্ত। অভ্র অবাক স্বর শুধালো,
“সকাল সকাল আমার গলা চেপে ধরার কি মানে?”
ঐন্দ্রিলার মস্তিষ্ক থেকে এখনো স্বপ্নের আবছা স্মৃতিগুলো মলিন হয় নি। বারংবার কানে বাজছে “তুই আমার বউ তো হতে পারছিস না। আমার দমবন্ধ লাগছে”। অভ্র এখনো চেয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়। ফলে আমতা আমতা স্বরে বললো,
“আমি ভয় পেয়েছিলাম”
“কেনো?”
অভ্রের পালটা প্রশ্নে ঐন্দ্রিলা নিজেকে সামলে নিয়ে খুব সাবধানে বললো,
“খারাপ স্বপ্ন দেখেছি”
“কি! চোর তোর গলা কেটে দিয়েছে?”
ঐন্দ্রিলা মাথা নাড়ালো। সে সত্যটা বলতে পারছে না। বলবেও না। কি বলবে, “স্বপ্নে দেখেছি তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিস, তাই ভয়ে মাথা হ্যাঙ হয়ে গেছে”
একেই দুম করে জড়িয়ে ধরার জন্য সে বেশ বিব্রত। লজ্জায় মুখ লাল হয়ে আছে। অভ্র কিছুসময় তার দিকে চেয়ে রইলো। ফিঁচেল হাসি হেসে বললো,
“গলা কাটা অবস্থায় তোকে দেখতে কেমন লাগছিল? এমনেই তোকে শাকচুন্নীর মত লাগে, গলা কাটা অবস্থায় নিশ্চয়ই আরোও বিশ্রী লাগছিলো!”
অভ্রর কথা শুনে দুম করে জমাট অনুভূতিগুলো পলায়ন করলো। লালচে আভায় রাঙ্গা ঐন্দ্রিলার চোখ ধিক ধিক করে জ্বলে উঠলো রাগে। রাগী স্বরে বললো,
“তোর গলা কেটে দিয়ে দেখাবো কেমন লাগছি?”
“কি সাংঘাতিক! একেবারে খু’ন? অবশ্য তোর নরম হাতে আমি হাজারবার খু’ন হতে পারবো”
বিনা সতর্কতায় এমন নির্লজ্জ কথা বলা অভ্রর স্বভাব। অন্য সময় হলে মুখ ভেঙ্গচি কেটে উঠে পড়তো ঐন্দ্রিলা। কিন্তু এখন তা হলো না। উলটো বিষন্ন গলায় বললো,
“এগুলো শুধু মুখে কথা”
অভ্র মুখখানা আরোও কাছে এনে বললো,
“তুই কি চাস আমি স্বেচ্ছায় তোকে গলা পেতে দেই যেন তুই কাঁটতে পারিস?”
তার অনড় দৃষ্টি স্থির ঐন্দ্রিলার দিকে। বড্ড বেপোরয়া এই দৃষ্টি। হুট করে বুকে লাগে। সকাল সকাল এমন নেশাতুর দৃষ্টি হৃদয়ের জন্য একেবারেই ভালো নয়। স্বচ্ছ দিঘীর মতো গভীর দৃষ্টিতে হুট করে হৃদয় ফসকে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। ঐন্দ্রিলার হৃদয় এমনিতেই দূর্বল হয়ে আছে কিছুদিন যাবৎ। এই দূর্বলতা নিয়ে এমন দৃষ্টির সম্মুখীন হওয়া মোটেই ভালো কিছু নয়। ঐন্দ্রিলা শুকনো ঢোক গিলে বললো,
“সেটা কখন বলেছি?”
“আমার মৃত্যু সইতে পারবি না বুঝি?”
“সকাল সকাল অলুক্ষণে কথা বলিস কেনো?”
“সকাল সকাল আমার গলা চেপে ধরছিস আর বলতে দোষ? জানিস আমার কত দেরি হয়ে যাচ্ছে। আজ দোকানে ব্যাংকের লোক আসার কথা। তৃষা সকাল থেকে ফোন দিতে দিতে কানের পোকা বের করে দিয়েছে। জানিস কত দেরি হয়ে গিয়েছে?”
“তুই এখন তৃষার সাথে দেখা করতে যাচ্ছিস?”
কথাটা যেন একটু জোরেই বললো ঐন্দ্রিলা। অভ্র তার কান সাথে সাথে হাত দিয়ে চেপে। হতভম্বের মত উত্তর দিল,
“হ্যা”
“কেনো?”
অভ্র আবারো হতভম্বের মত উত্তর দিল,
“ভিজিটিং এ আসছে ব্যাংকের ম্যানেজার তাই”
ঐন্দ্রিলার মুখখানা শক্ত হয়ে গেলো। নাকের পাটা ফুলিয়ে বললো,
“তৃষার কি কাজ সেখানে?”
অভ্র ঐন্দ্রিলার প্রশ্ন শুনে নিঃশব্দে হাসলো। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
“কেনো তুই কি চাস আমি যাব না? কিছুদিন আগে তো বলছিলি তোর কিছু যায় আসে না। আমি দশ জন নিয়ে ঘুরলেও তোর কিছু যায় আসে না”
ঐন্দ্রিলা উত্তর দিতে পারল না। ঠোঁট কামড়ে হজম করল কথাটা। অভ্রের হাসি বিস্তৃত হলো। কোথাও না কোথাও রাগী মেয়েটি তার জন্য জ্বলছে। একটু একটু করে তার হৃদয়ে নিজের নাম খোদাই করতে সে সক্ষম। পৈশাচিক এক হাসি উন্মোচিত হলো তার ঠোঁটে। খুব দেরি নয় যখন নাক উঁচু, রাগী মেয়েটি আত্মসমর্পন করবে তার কাছে। সেদিনটা অভ্রের জীবনের সবথেকে সুখময় দিন হবে। একটু সবুর, একটু সবুর।
খাবার টেবিলে তীব্র তাড়া দিলো অভ্র। তার বের হতে হবে। কাননের উদ্দেশ্যে বললো,
“মা আমাকে এককাপ চা দাও, আমার বের হতে হবে”
“তোমার মা কেনো দিবে? তোমার বউকে বলো”
আউওয়াল সাহেব সংবাদপত্রে মুখ গুজে রাশভারী স্বরে বললেন। এই বাড়ির অদ্ভুত নিয়ম। স্বামী স্ত্রীর হাতে ছাড়া চা খায় না। দাদী মারা যাবার পর থেকে দাদাজান চা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। এই নিয়মের মর্মার্থ হলো স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার প্রেম বাড়ানো। এক কাপে দুজন চা খাবে। যদিও বেশ রোমাঞ্চকর ব্যাপার। কিন্তু ঐন্দ্রিলার বিশ্বাস নেই। গতবারের মত মরিচ গুলিয়ে খাইয়ে দিতে পারে। কি ভরসা? আজ কোনো চান্স নিতে রাজী নয় অভ্র। তাই সে উঠে গেলো চেয়ার থেকে। আউওয়াল সাহেব তার চশমাটা সাদা পাঞ্জাবীতে মুছতে মুছতে বললেন,
“শুনলাম, তুমি নাকি লোনের জন্য এপ্লাই করছো?”
অভ্র বিনা সময় নষ্ট করে বললো,
“জি, আমি অহেতুক সময় নষ্ট করতে অপছন্দ করি”
“আমি কিন্তু কোনো পেপারে সাইন দিবো না”
আউওয়াল সাহেবের কথায় একটু থমকালো অভ্র। কঠিন হলো কন্ঠস্বর,
“মানে?”
“মানে আমি থার্ড পার্টি হয়ে মর্টগেজ দিবো না। জানো তো কোনো সম্পত্তি ছাড়া লোন হয় না”
“সেটা নিয়ে আপনার চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা নেই”
খুব রুক্ষ্ণ গলায় গলায় উত্তর দিল। আউওয়াল সাহেবের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। তার মুখ দেখে যে কেউ আন্দাজ করবে কেউ যেনো তার বুকে সুঁচের গুতো দিয়েছে। অভ্র অপেক্ষা না করেই প্রস্থান করলো। বাইকে স্টার্ট দিতেই মুখে একটা অর্ধেক রুটির অংশ গুজে জুতো পড়তে পড়তে বেরিয়ে এলো ঐন্দ্রিলা। এসে দাঁড়ালো তার বাইকের সামনে। অভ্র বিরক্ত গলায় বললো,
“কি?”
কোনোমতে রুটি গিলে বললো,
“আমাকে কলেজে দিয়ে আয়”
“আমার দেরি হচ্ছে”
“অন্য মেয়ের জন্য সেজে বের হতে পারিস আর নিজের বউকে কলেজে দিতে পারবি না? কেমন পুরুষ তুই?”
“হ্যা?”
অভ্রের প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই সে পেছনে চেপে বসলো। হুকুম দিয়ে বললো,
“কলেজ যাব”
অভ্র সাইড মিররে ঐন্দ্রিলাকে দেখলো কিছু সময়। তারপর বাধ্য হয়ে কলেজের দিকে গেলো।
কলেজে পৌছেই ঐন্দ্রিলা চলে যেতে নিলে অভ্র পেছন থেকে তার হাত টেনে ধরলো। আকস্মিক টানে ঘাবড়ে গেলো ঐন্দ্রিলা। তার বিস্ময়কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বলে উঠলো,
“ম্যাডাম ভাড়াটা?”
“কিসের ভাড়া?”
“এই যে আমার তেল পুড়ালেন সেই ভাড়া”
ঐন্দ্রিলা নাক মুখ কুচকে ফেললো। অভ্রও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। ঐন্দ্রিলার হাত আরোও শক্ত করে ধরে বললো,
“এখনি একশ টাকা বের কর”
“একশ কেনো, বাসা থেকে বিশ টাকা ভাড়া”
“তাহলে রিক্সা দিয়ে আসতি। আমার বাইকে চুল উড়িয়ে আসতে কে বলেছে?”
“আমার কাছে টাকা নেই”
“মানে?”
“ওয়ালেট বাড়ি রেখে এসেছি”
“বাহানা দিলে হবে না”
“সত্যি বলছি”
“উহু, হবে না। টাকা বের কর”
মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ২৯
ঐন্দ্রিলা ঠোঁট উলটে ফেললো। সে আসলেই তাড়াহুড়োতে ব্যাগ আনে নি। সে জানে অভ্র তাকে নিয়ে আসবে। যাবার সময় পিউ তো আছেই। অভ্র তার হাতে হালকা টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলো। গাঢ় স্বরে বললো,
“ছেড়ে দিতে পারি এক শর্তে?”
“কি?”
“চুমু খা গালে”…………