রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ১১
সিমরান মিমি
নিস্তেজ হয়ে চৌদ্দ শিকের এক ছোট্ট কুঠুরির মধ্যে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে স্পর্শীয়া।সারা মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু চিন্তারা বিচরণ করছে।কি থেকে কি হয়ে গেল?এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না?তাহলে কেন হলো?কি করা উচিত এখন তার?নাহ,এভাবে বসে থাকলে তো হবে না।বাড়িতে আর্শি একা রয়ে গেছে।মাও তো পার্লারে।আদোও শুনেছে কি না কে জানে?স্বীয় শরীরে ভর দিয়ে অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালো। দুটো শিক শক্ত করে ধরে এক কনস্ট্রাবলের উদ্দেশ্যে বললো,
“পিয়াশ শিকদার কিভাবে মারা গেছে?”
মহিলা টি তীর্যক চাহনি তে স্পর্শীর দিকে চাইলো।পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে অবহেলার স্বরে বললো,
“গলায় ফাঁস দিয়েছে।”
স্পর্শী জোরে শ্বাস নিলো।এরপর চিৎকার করে বললো,
“একটা ছেলে তার নিজস্ব ইচ্ছায় তার নিজের রুমে বসে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।নাহ আমি তার কাছে ছিলাম, আর নাতো মৃত্যুর আগে তার ফোনে কোনোরকম কন্ট্রাক্ট করেছি।তাহলে কোন ভিত্তিতে আপনারা আমাকে এখানে ধরে এনেছেন?
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
সামনের রুমে ডেস্কে বসা ইনস্পেকটর এগিয়ে এলো সেলের দিকে।স্পর্শীর উদ্দেশ্যে ই ছিলো তার কাছ পর্যন্ত পৌছানো।তিনি কাছে আসতেই মৃদু স্বরে হাঁক ছেড়ে বললেন,
” এই মেয়ে,চেচাচ্ছো কেন?”
মুহুর্তেই পুনরায় চেচিয়ে স্পর্শী বললো,
“আমাকে এখানে কেন ধরে আনা হয়েছে?”
লোকটি সূচালো চোখে স্পর্শীর দিকে তাকালো।সেই দৃষ্টিগুলো সরাসরি স্পর্শীর আত্মসম্মানে বিঁধলো।কিন্তু তাও কোনো টু শব্দ করলো না।
“তোমার বোনের সাথে সম্পর্ক ছিলো মৃত পিয়াশ সিকদারের সাথে।হুট করে সে সম্পর্কে ঝামেলা বাধলে তুমি আর তোমার বোন পুরো ক্যাম্পাসের সবার সামনে ইচ্ছেমতো তাকে পেটাও।আবার সেটার ভিডিও ধারণ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপ্লোড দিয়েছো।যার কারনে লজ্জায় সে আত্মহত্যা করেছে।এর পরিপ্রেক্ষিতে তার বড় ভাই কেস করেছে।আর সাক্ষী ছিলো তার তিনজন বন্ধু। এর থেকে আর কি প্রমাণ চাও?”
স্পর্শী হতবাক হয়ে গেল।বললো,
“আমি সেই ভিডিও আপ্লোড করি নি।আর নাতো তা ধারণ করেছি।এটা হয়তো ক্যাম্পাসের অন্য কেউ করেছে।আর বাকিটা রইলো মেরেছি বলে।তো বেশ করেছি।আমার বোনকে ডিস্টার্ব করেছিলো বাজেভাবে যার কারনে মেরেছি।ওর চরিত্রের ঠিক নেই।শুধু আমি না ভার্সিটির প্রতিটা স্টুডেন্টকে ও জ্বালাতো।আর এই যে,আপনি তিনজন সাক্ষীর কথা বলছেন।আমি পুরো ভার্সিটির স্টুডেন্টদের কথা বলছি।প্রত্যেকে আমার হয়ে সাক্ষী দিবে।গিয়ে জিজ্ঞেস করুন আপনার এমপির ভাইয়ের সম্পর্কে।
ইনস্পেকটর কোনো উত্তর দিলো না।তাড়াহুড়ো করে চলে গেল থানার বাইরে।কিছুক্ষণের মধ্যেই কান্নারত অবস্থায় থানায় ঢুকলো পিপাশা।স্পর্শীকে লকাপের মধ্যে দেখতেই অস্থির হয়ে উঠলো।বার বার বিলাপ করে বললো,
” তোকে হাজার বার এই সব ঝামেলা থেকে দূরে থাকতো বলছিলাম।শুনলি না তো আমার কথা।এবারে কি হবে?কেন মারামারি করতে গেলি ছেলেদের মতো।”
স্পর্শী মায়ের উদ্দেশ্যে শান্ত কন্ঠে বললো,”ওই ছেলেটা ওর বন্ধুদের সাথে নিয়ে আর্শি কে তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো সেদিন।তাই মেরেছি।কিন্তু ওটার ভিডিও আমি ছাড়ি নি।”
পিপাশা মহিলা কনস্ট্রাবেল এর দিকে তাকিয়ে,”কোথাকার না কোথাকার ছেলে আত্মহত্যা করে মরেছে।তার জন্য আমার মেয়েকে কেন ধরে এনেছেন?ও কি করেছে?ও তো হোস্টেলেও থাকে না, আমার সাথে বাসায় থাকে।তাহলে ওকে কেন খুন কেসে ফাঁসালেন আপনারা?”
বলে চারদিকে তাকালো।হুট করেই স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“আর্শি কই?মিনতি ভাবি বললো যে ও তোর গাড়ির পেছন পেছন ছুটেছে।কিন্তু ওকে থানায় দেখছি না।বাসায় ও নেই।তাহলে ও কোথায়?”
চমকে উঠলো স্পর্শী।মস্তিষ্ক যেন ফাঁকা হয়ে গেছে তার।উদভ্রান্তের মতো বললো,”ওকে তো বাসায় থাকতে বলেছিলাম।তাহলে কোথায় গেল।মা,তুমি এক্ষুণি যাও।আমার কথা চিন্তা করো না,ওকে খোঁজো।যাও
পিপাশা কোনো সময় নষ্ট না করেই ছুটলো থানা থেকে।স্পর্শী উদভ্রান্তের মতো করতে লাগলো।যে ভয়টা সে পাচ্ছিলো সেটাই হলো।পুরুষ মানুষকে মোটেও বিশ্বাস নেই তার।কনস্টেবলের উদ্দেশ্যে বললো, “আমার বোনকে খুঁজুন প্লিজ!ওকে পাওয়া যাচ্ছে না।ওই এমপি ওকে জোর করে তুলে নিয়ে গেছে। আমি জানি।ওই এমপি কে ধরুন।না হয় আমাকে ছেড়ে দিন।আমায় যেতে দিন প্লিজ!বোনকে খুঁজতে হবে।মা একটুতেই অসুস্থ হয়ে পড়বে।আমার যে বাপ-ভাই নেই।বোনকে খুঁজতে হবে আমাকে।প্লিজ!
বলতে বলতে হাটু মুড়িয়ে বসে পড়লো ফ্লোরে।এরইমধ্যে কানে বাজলো এক বিরক্তিকর কন্ঠ।যিনি আফসোসের স্বরে বলছেন,” ইশ!মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনাদের খুনের আসামী’র।যে কি না কোনোরকম শাস্তি ছাড়াই জেল থেকে ছাড়া পেতে চাইছে।
থেমে স্পর্শীর একদম কাছাকাছি চলে এলো পরশ।মাঝখানে শুধুমাত্র কয়েকটা লোহার শিকের ব্যাবধান।নিচু স্বরে বললো,
“বোনকে খুঁজতে যাবে?আচ্ছা বাদ দাও।সে তুমি খুঁজতে যেতেই পারো। তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই।কিন্তু আমি যে তোমার অনুভূতি’টা জানতে এসেছি।কেমন লাগছে বোনকে হারিয়ে?উফফস!এতো তাড়াতাড়ি অনুভূতির কি বুঝবে। যখন ছিন্নভিন্ন লাশ টা সামনে আসবে, তখনই অনুভূতির প্রকাশ পাবে।তাই না?”
চকিতে উঠে দাঁড়ালো স্পর্শী।সারা শরীর রাগে,ক্ষোভে ঘিনঘিন করছে।শরীরের রক্তগুলো টপগবগ টগবগ করে ফুটছে।ছয় ইঞ্চি ব্যাবধানের শিকের ফাঁক গলিয়ে দুহাত দিয়ে পরশের কলার চেপে ধরলো।রাগে গিজগিজ করতে করতে বললো,”আমার বোনের একটা চুল পরিমান ক্ষতি করলেও সেটার মহাসাগর পরিমাণ পালটা আঘাত আপনি পাবেন।আমাকে ঠুনকো ভাববেন না মোটেও।আমার বোনকে সসম্মানে আমার মায়ের হাতে তুলে দিন।নাহলে হিতে বিপরীত হবে।”
পরশ আলতো হাতে স্পর্শীর হাত ছাড়ালো নিজের কলার থেকে। তারপর নিচু স্বরে বললো, “হ্যাঁ, তুলে তো দিবোই।তবে সেটা সম্মান সহ দিতে পারবো কি না, কথা দিতে পারছি না।”
মুহুর্তেই এক দলা থুথু ছুঁড়ে মারলো পরশের মুখের উপর।তাজ্জব হয়ে গেল পরশ।স্পর্শী চেঁচিয়ে উঠে বললো,
“চরিত্রহী।অসভ্য।তোর মতো জানোয়ার কে জনগণের প্রতিনিধি কে বানিয়েছ?আদোও কি তোর এই নিকৃষ্ট চেহারা সবাই জানে?না জানলেও সমস্যা নেই।খুব শীঘ্রই জানবে।মাত্র চব্বিশ ঘন্টা।এর মধ্যেই ওই জেল থেকে সসম্মানে আমি ছাড়া পাবো।মাইন্ড ইট।
রাগের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছে গেল পরশ।বাম দিয়ে ঘেন্নার সাথে গায়ের থুথু মুছেই স্পর্শীর চুল ধরে ফেললো।এ যেন চুলের উপর কোনো ভয়ংকর দানবের থাবা পড়েছে।যন্ত্রণায় ঠোট কামড়ে ধরে কঁান্না আটকালো।পরশ নিচু স্বরে বললো,” তোর বোনকে খুঁজে পাচ্ছিস না বলে এই রাগ।অথচ তুই যে আমার জলজ্যান্ত ভাইটা’কে খুন করেছিস।তার বেলায়?এখন দেখ কতটা কষ্ট লাগে প্রিয়জন হারাতে।আর মুক্তি।সারা জীবনেও পাবি না।
“একিই এমপি সাহেব,আপনি এসব কি করছেন?অন্তত আপনার মতো ব্যাক্তির থেকে আমি এটা আশা করিনি।বুঝতে পারছি ভাইয়ের মৃত্যুতে অনেক টা রাগ আপনার ভেতরে।তাই বলে কোনো আসামীর গায়ে এভাবে হাত তুলতে পারেন না আপনি।” ইন্সপেকটর ভেতরে ঢুকেই বললেন।
পরশ নিজেকে সং যত করলো।স্পর্শী ব্যাঙ্গ করে বললো,”এটা আর কি দেখলেন?এর থেকেও জঘন্য লোক উনি।ব্যস সেটা সবাইকে দেখিয়ে বেরান না।”
রাত কেটে ভোর হলো। ভোর পেরিয়ে দুপুর শেষ,বিকেল হতে চললো।সেলের এক প্রান্তে হাটু মুড়িয়ে বসে আছে স্পর্শী।প্রতিটা সেকেন্ড যেন দিনের মতো কাটছে।আর্শির কথা পুলিশ কে বললেও তারা গ্রাহ্য করেনি।বান্ধবী বা অন্যকারো বাসায় হয়তো আছে বলে এড়িয়ে গিয়েছে।জোর দিলে তারাও জোর খাঁটিয়ে বলে, “তারা দেখছে।মাত্র তো চব্বিশ ঘন্টা হলো।এতো তাড়াতাড়ি খুঁজে কি করে পাবে?
স্পর্শী হতাশ হয়ে তাকিয়ে রইলো থানার মেইন দরজার দিকে।এর’ই মধ্যে বেশ কয়েকটা পায়ের আওয়াজ এলো।সামনের রুমে বসা দারোগার সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে সেলের দিকে এগিয়ে এলো।এরা স্পর্শীর অপরিচিত কেউ নয়।মায়ের সাথে উকিল।পাশেই ফারজানা রুমি আপু,ভার্সিটির ছাত্রনেতা সহ আরো বেশকিছু শিক্ষার্থী।তাদের দেখতেই চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো স্পর্শীর।উকিল বললো,
” তোমার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ কোনো প্রমাণ নেই।আর যেহেতু এটা সুইসাইড। তাই জোরটাও অনেক কম।কোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়ে এসেছি।তবে যতদিন না পর্যন্ত এই কেস টা শেষ হবে ততদিন পর্যন্ত তুমি পুলিশের নজরে থাকবে।তাছাড়া প্রতিদিন থানায় এসে হাজিরা দিয়ে যেতে হবে।তবে এই সময় টার মধ্যে চেষ্টা করবে কোনো ঝামেলায় না জড়াতে।
সব ফর্মালিটি পূরণ করে থানার সামনে বের হতেই পিপাশা স্পর্শীর পায়ের কাছে বসলো।হাউমাউ করে কেঁদে বললো,
রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ১০
“তোরে ছাড়ানোর ইচ্ছা আমার ছিলো না।বরং তুই জেলে থাকলেই আমি নিশ্চিন্ত থাকতাম।তোর পায়ে পড়ি।আমার ছোট্ট মেয়েটা রে এনে দে।কত না কত শত্রু বানাইছিস তা তুই জানিস।আমার মেয়েটারে বলি দিস না।ওরে আইনা দে।আজ দেড় দিন শেষ। ইজ্জত টুকু তো জানি পাইলাম ই না, অন্তত প্রান টুক আমার কাছে দিয়া দে।আমি তোর পায়ে ধরি।মেয়েটারে পাইলে আমি ওরে নিয়া অনেক দূরে চলে যাব।তোর ইচ্ছামত তুই থাকিস।তোরে বাধা দিব না।আমার আর্শিরে এনে দে।