মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ৩৮

মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ৩৮
মুশফিকা রহমান মৈথি

আধমরা আশরাফের কলার ছেড়ে পেছনে ঘুরতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো অভ্র। ভাঙ্গা ইটের স্তুপে নিথর পড়ে আছে ঐন্দ্রিলা। তার মাথার পেছন থেকে বইছে টকটক রক্তিম লোহুস্রোত। পিউ কান্নাভেজা স্বরে ডেকে যাচ্ছে ঐন্দ্রিলাকে। কিন্তু তার সাড়া নেই। অভ্রর পাজোড়া ভারি লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ দু টন পাথর বেঁধে দিয়েছে। চলতেই চাইছে না। রক্তাক্ত ঐন্দ্রিলার দৃশ্যটি এতো বিশ্রী লাগছে কেনো? ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে কেন?

সাদা টাইলসের করিডোরের নীল প্লাস্টিকে নতমস্তকে বসে আছে অভ্র। তার টিশার্টটা ভিজে আছে রক্ত। হাত জোড়ার রক্ত জমে কালচে হয়ে গেছে। কি বিশ্রী তীক্ষ্ণ গন্ধ। কিন্তু হেলদোল হলো না অভ্রর। কেমন অনুভূতিশূন্য চোখজোড়া। পিউ তার পাশে বসে আছে। অঝোরে কাঁদছে। তার কান্নার স্বর কানে বিঁধছে কাঁটার মত। তার কান্না দেখে যে কেউ ভাববে ঐন্দ্রিলা মারা গেছে। অন্যসময় হয়ে অভ্র রামধমক দিয়ে বসতো। কিন্তু আজকে সে নিশ্চুপ। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে মেঝের দিকে। তীব্র বিরহে মনখানা দূর্বল হয়ে আছে। কথা বলতেও অনীহা লাগছে। গলার কাছটায় মনে হচ্ছে কাঁটা বিধে আছে। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখখানা জ্বলছে। বুকে তীব্র হাহাকার জড়ো হয়েছে। কিছু হারিয়ে ফেলার তীব্র উত্তেজনা তাকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ঐন্দ্রিলার নিথর দেহখানা দেখার পর থেকেই এই অনুভূতি হচ্ছে। সেই প্রথমবার হাত কাঁপছিলো অভ্রর। জমে যাওয়া পাগুলো কোনোমতে টেনে ঐন্দ্রিলার কাছে গেলো। খুব ক্লান্ত স্বরে দুবার ডাকলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ঐন্দ্রি, এই ঐন্দ্রি?”
কিন্তু ঐন্দ্রিলা সাড়া দিলো না একবারো। ঘটনায় লোকজনের চঞ্চলতা বাড়লো। পিউ বিধ্বস্তের মতো সাহায্য চাইতে লাগলো। জমায়েত ছাত্রদের মধ্যেই একজন এম্বুলেন্স ডাকলো। অভ্র তখনো নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঐন্দ্রিলার দিকে। সব কিছু যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এই প্রথম বোধ হয় মাহাবুক হক অভ্র ভুলে গেলো তার কি করা উচিত। এই প্রথম বোধ হয় সে নিজের চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। পিউ তাকে ধাক্কা দিলে সে অর্বাচীনের মত চাইলো। পিউ অধৈর্য স্বরে বললো,

“ঐন্দ্রিলাকে তোল”
“ও কি ম’রে যাবে?”
অভ্র বিড়বিড় করে আওড়ালো। পিউ উত্তর দিতে পারলো না। চোখজোড়া ভিজে এলো তার। ভেজা স্বরে বললো,
“এখন এসব বলার সময় নেই অভ্র। ঐন্দ্রিলাকে হাসপাতালে নিতে হবে”
অভ্র আর প্রশ্ন করলো না। অনুভূতিশুন্য মানুষের মতো কোলে তুলে ঐন্দ্রিলাকে এম্বুলেন্সে উঠালো। পুরোটা রাস্তা তার হাতখানা ধরে থাকলো। যেনো হাতটা ছেড়ে দিলেই ঐন্দ্রিলা হারিয়ে যাবে চিরতরে। হাসপাতালে আনার পর প্রায় আধঘন্টার মাঝেই ঐন্দ্রিলাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকানো হয়েছে। এখনো অপারেশন চলছে। প্রায় ঘন্টা দেড়েক হয়ে গিয়েছে। নার্স শুধু একবার বেড়িয়ে বলেছে,

“রক্তের প্রয়োজন, রক্ত যোগাঢ় করেন এ পজেটিভ”
অভ্র তখন অনেক কষ্টে শুধিয়েছিলো,
“ঐন্দ্রিলা কেমন আছে?”
“অবস্থা ভালো না। অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। রক্তের প্রয়োজন। দোয়া করেন যেনো ইন্টারনাল রক্তক্ষরণ না হয়। ইটে বাজেভাবেই আঘাত পেয়েছেন। স্কাল ফ্রাকচার হয়েছে কি না বুঝা যাচ্ছে না। ডাক্তার দেখছেন”

খ্যাচখ্যাচে গলায় কথাটা বলেই নার্স চলে গেলো। পিউ সাথে সাথেই বাসায় ফোন করেছে। নিজের পরিচিত কিছু মানুষকে রক্তের জন্য ফোন করেছে। অভ্র কখনো নির্বোধের মতো তাকিয়ে আছে অপারেশন থিয়েটারের দিকে। বুকখানা কাঁপছে তার, তার পুতুল ফিরবে তো? এতো অশান্তি লাগছে কেনো? এই অনুভূতি কতৃত্ব হারাবার নয়। প্রিয় খেলনাটা ভেঙ্গে যাবার নয়। এই অনুভূতি তার থেকেও গাঢ়, বুকের বা পাশের ব্যথাটা খুব তীক্ষ্ণ। খুব কাছের কাউকে হারিয়ে ফেলার তিতকুটে অনুভূতি এটা। অভ্রর মনে হলো তার পৃথিবীটা কেমন থেমে গেছে। কেউ তার সাজানো জীবনে বিরহের কালো রঙ ঢেলে দিয়েছে। সব শুন্য লাগছে। নিজেকে অসাড় লাগছে। প্রাণহীন লাগছে সব কিছু। পুতুল ভাঙ্গার যন্ত্রণা কি এতো গভীর হয়?

পিউয়ের ফোন পাবার প্রায় পনেরো মিনিটের মাঝেই সাবেরা, সালাম সাহেব এবং সালাম সাহেব ছুটে এসেছেন। তার দশ মিনিট পর কানন, ইদ্রিস সাহেব, আউওয়াল সাহেব এবং বিল্লাল এসে পৌছালো হাসপাতালে। নীলাদ্রি পিউয়ের কাছে এসে উদ্বিগ্ন স্বরে শুধালো,
“ঐন্দ্রিলা কোথায়?”
“ও.টিতে”
“তুমি ঠিক আছো?”
“হ্যা”

খুব ক্ষীন স্বরে উত্তর দিলো পিউ। তার মুখ দেখে মোটেই ঠিক মনে হলো না। খুবই বিধ্বস্ত লাগলো তাকে। কাঁধতে কাঁধতে চোখজোরা ফুলে গেছে। নীলাদ্রি তাকে সান্ত্বনার স্বরে বললো,
“ঐন্দ্রিলার কিছু হবে না”
পিউ নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। সাবেরা অভ্রর সামনে দাঁড়িয়ে রুঢ় স্বরে শুধালো,

“কি করে হলো এমন? আমার মেয়ে এখন অপারেশন থিয়েটারে কেন?”
অভ্র উত্তর দিলো না। এখনো মেঝের দিকেই চেয়ে রইলো। তাকে জড়োবস্তুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাগে নিয়ন্ত্রণ হারালেন সাবেরা। সর্বোচ্চ শক্তিতে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো অভ্রর গালে। তার এমন আচারণে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো। কানন কিছু বলতে চাইলো ছেলের সাফাই গেয়ে। কিন্তু ইদ্রিস সাহেব আটকে দিলেন। আউওয়াল সাহেবও রুষ্ট চিত্তে বসে রইলেন। যতই হোক আজ তার ঘরের বউ ও.টিতে। সাবেরা চিৎকার করে উঠলো,
“আমি ভরসা করে মেয়েকে তোমার হাতে দিয়েছিলাম। ওকে লাশের মতো শুয়ে থাকতে দেখার জন্য তোমার সাথে বিয়ে দেই নি। এতো রাগ হবে কেনো তোমার? আজ তোমার জন্য ঐন্দ্রিলার এই অবস্থা? এই তোমার ভালোবাসা?”
“সাবেরা শান্ত হও। এটা হাসপাতাল”

“কেনো শান্ত হবো আমি, আমার মেয়ে মরতে বসেছে। যদি ওর কিছু হয়ে যায়? ও যদি, ও যদি…”
কথাটা শেষ করতে পারলো না সাবেরা। তার গলা ধরে এসেছে। মেয়ে যে তার খুব আদুরে সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও মা-মেয়ের সমীকরণটা ভিন্ন। নিজেদের আত্মজেদের কারণে নিজেদের মাঝে বিশাল বড় অভিমানের পাহাড় গড়েছেন। কিন্তু ভালোবাসায় তো খামতি নেই। সালাম সাহেব স্ত্রীকে শান্ত করতে চাইলেন। অভ্র তখনো নিশ্চুপ। তার মুখে কথা নেই। মাটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। রক্তের তাগিদা দিতে আবারো নার্স এলো। বিরক্ত স্বরে বললেন,

মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ৩৭

“রক্ত কোথায়?”
নীলাদ্রি এবং বিল্লাল এগিয়ে গেলো। তাদের রক্ত “এ পজেটিভ”। এর মাঝেই ঘটলো বিপদ। কোথা থেকে পুলিশ উপস্থিত হলো। আশরাফের অবস্থা ভালো নয়। আইসিউতে ভর্তি, জ্ঞান ফিরে নি। তার পরিবারের অর্থ, ক্ষমতার অভাব নেই। তাদের ছেলেকে কেউ মে’রে যাবে সেটা তো হয় না। অভ্রর নামে জি.ডি করেছে তারা। ফলে পুলিশ এসেছে অভ্রকে গ্রেফতার করতে। পুলিশ যখন তার হাতে হাতকড়া পড়াতে গেলো, তখন অভ্র তার নিরবতা ভাঙ্গলো। অনুনয়ের স্বরে বললো,
“আমার পুতুলকে এখনো ওরা ওই দরজা থেকে বের করে নি, আমাকে এখনই নিয়ে যাবেন না দয়া করে”………

মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ৩৮ (২)