মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ৩৮ (২)
মুশফিকা রহমান মৈথি
“আমার পুতুলকে এখনো ওরা ওই দরজা থেকে বের করে নি, আমাকে এখনই নিয়ে যাবেন না দয়া করে”
সৈয়দ মাহাবুল হক অভ্র অনুনয় করছে। তার কন্ঠ ভেজা। তীব্র বিরহে আকন্ঠ ডুবন্ত তার চোখজোড়া। কিন্তু আইনি লোকের কাছে আবেগময় কথার মূল্য থাকে না। তাদের হতে হয় কঠিন, দয়ামায়াহীন। অপরাধীদের সাথে দয়ার স্থান নেই। তাই পুলিশরাও শুনলো না। হাতকড়া পড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে এখনি।
ইদ্রিশ সাহেব, সালাম সাহেব বাধা দেবার চেষ্টা করলো কিন্তু লাভ হলো না। কানন মুখে আঁচল গুজে কাঁদতে লাগলো। খুব অসহায় লাগছে তার। ছেলের বউ অপারেশন থিয়েটারে। এখন ছেলেকে জেলে নিয়ে যাচ্ছে। এমন দিন কখনো দেখবেন সেটা তো আশা করেন নি। সাজানো সংসারে কার নজর লাগলো। গতকালও একত্রে রাতের খাবার খেয়েছিলেন সবাই। আড্ডার রোল পড়েছিলো। কি সুন্দর সংসার তার। অথচ এখন সব ই কাঁচের মতো চূর্নবিচূর্ন লাগছে। সাবেরা কঠিন মূর্তির মত বসে আছে। তার কিচ্ছু যায় আসে না। তার চিন্তা তার মেয়েকে নিয়ে। ইদ্রিশ সাহেব রুষ্ট স্বরে শুধালেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আমার ছেলেকে কেনো ধরে নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা? কি দোষ করেছে সে?”
“আশরাফ হোসেন নামক ছেলেটিকে বেরহমের মতো পিটিয়েছে। এখন সে আইসিউতে। জ্ঞান ফিরে নি। তার পরিবারের লোক জিডি লিখিয়েছে। কলেজে গুন্ডামি করে বেড়ায় আবার বড় গলায় জিজ্ঞেস করেন কি করেছে। উনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে। যদি কিছু বলার থাকে থানায় বলবেন”
পুলিশের তাড়া। তারা অভ্রকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো। তার চোখজোড়া তাকিয়ে রইলো অপারেশন থিয়েটারের দিকে। এই বুঝি কেউ খবর দিবে। কেউ তো বের হবে। কাতর স্বরে বললো,
“আমি কথা দিচ্ছি অপারেশন শেষ হয়ে আমি আপনাদের সাথে জাহান্নামেও যাবো। দয়া করে আমার পুতুলের অপারেশনটা শেষ হোক”
কেউ শুনলো না। তিন জন কন্সটেবল তার ঘাড় ধরে গাড়িতে ভরলো। গাড়ি স্টার্ট দিলো চালক। একটা সময় হাসপাতাল ছাড়িয়ে চলে গেলো নিজ গন্তব্যে। অভ্র বাহিরে তাকিয়ে রইলো। হৃদয়ের ব্যাথাটা তীব্র হচ্ছে। দমবন্ধ লাগছে। সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে ফেললেও হয়তো শান্তি মিলবে না।
থানার হাজতের মেঝেতে বসে আছে অভ্র। ডান হাতের রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে গেছে। হাতখানা ফুলে আছে। কিন্তু তার অনুভূতিশূন্য। এই হাতের জন্যই আজ ঐন্দ্রিলার এই অবস্থা। কি করে পারলো সে ঐন্দ্রিলাকে ধাক্কা দিতে। আজ তার জন্য ঐন্দ্রিলার এই অবস্থা। এই রক্ত তো সামান্য শাস্তি মাত্র। হাতখানা কেঁটে ফেলতে হচ্ছে। এতোটা গ্লানি কখনো অনুভূত হয়েছিলো কি অভ্রর? জানা নেই। এই প্রথম হয়তো গ্লানি, আফসোসের অনুভূতি হচ্ছে।
“ভাইজান কি কানতেছেন?”
পাশের এক কয়েদির কন্ঠ শুনতেই চমকে উঠলো অভ্র। তার দিকে অর্বাচীনের মতো চাইল সে। ছোট ছেলে, কত বয়স হবে? উনিশ অথবা বিশ। হ্যাংলা, শুকনো চেহারায় উশখোখুশকো কিছু অনিয়ন্ত্রিত দাড়ি। মুখখানা ফুলে আছে৷ চোখের কাছটায় রক্ত জমাট। ভ্রুর কাঁটা অংশে রক্তরস বের হচ্ছে। চুরি করে ধরা পড়েছে বলে গণপিটুনি খেয়ে এখন জেলে। সে হাসি মুখে বললো,
“কাইন্দেন না, ওরা বেশিক্ষণ ধইরা রাখবো না। ঘন্টাখানেক পর এমনেই ছাইড়ে দিবো। আপনেও কি চুরি করছিলেন?”
অভ্র মাথা নাড়লো। ছেলেটা কৌতুহলের সাথে শুধালো,
“তাইলে?”
“একজনকে পিটিয়ে আইসিউতে পাঠিয়েছি”
“এতো বিশাল সংবাদ। তয় আপনি কান্দেন কেন? আমি যতদূর জানি যারা মা’রে তারা কান্দে না! যারা মা’রে তারা হাসে”
অভ্র উত্তর দিলো না। তার গাল কি ভিজে গেছে? শেষ কবে কেঁদেছিলো সে? অভ্র নিজেও জানে না সে কাঁদছে কেনো! শুধু এতোটুকু অনুভূত হচ্ছে, তার ঐন্দ্রিলার কিছু হলে সে হয়তো নিজেকে সুস্থ রাখতে পারবে না। আচ্ছা ঐন্দ্রিলা কেমন আছে? সুস্থ আছে তো? ওর জ্ঞান ফিরেছে? মেয়েটা যতই ভাব দেখাক সে ভেতর ভেতর বড্ড ভীতু। সে কি অভ্রকে খুঁজছে? আজকাল অভ্রকে সে চোখে হারায়। অভ্রর যখন জ্বর হলো কি দুশ্চিন্তা তার। তিনটে দিন মেয়েটির জীবন যেনো ওষ্ঠাগত হয়েছিলো। ক্ষণে জ্বর মাপা, কি খাবে না খাবে নিয়ে ব্যস্ততা। ঘন্টায় ঘন্টায় চা বানিয়ে দেওয়া, ডেঙ্গু হলো কি না সেই নিয়ে চিন্তা আলাদা। তার জীবন যেনো পরিক্রমণ করছে অভ্রকে ঘিরে। অভ্রর বাজে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে ঐন্দ্রিলার এমন মিষ্টি ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া। আচ্ছা, ঐন্দ্রিলা ছাড়া জীবনটা কেমন হবে? কথাটা ভাবতেই বুকখানা কেঁপে উঠলো। তখন ই একজন কন্সটেবল এসে হাজতের দরজা খুলে দিলো। কর্কশ স্বরে বললো,
“আপনার জামিন হয়ে গেছে”
অভ্র জেল থেকে বেরিয়ে দেখলো অসি সাহেবের সামনে পিউ এবং আউওয়াল সাহেব বসে আছেন। অসি তাদের নোনতা বিস্কিটের সাথে লাল চা খেতে দিয়েছেন। আউওয়াল সাহেব চা খেলেন না, কিন্তু সৌজন্যতাবোধের জন্য একটা নোনতা বিস্কিট খেলেন। অভ্র আসতেই অসি সাহেব হাত বের করে বললেন,
“জোয়ান পোলাপাইন, রক্ত গরম। মাথায় রক্ত উঠলেই মারতে ইচ্ছে করে। বাবা এমন আর কইরো না ঠিক আছে? হেহে”
অভ্র দাদাজানকে দেখে মাথা নামিয়ে ফেললো। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। অসি সাহেব খুব অতিথি আপ্প্যায়ন করছেন আউওয়াল সাহেবের। কারণ তিনি অভ্রর গ্রামের ছেলে। তার পড়াশোনার সময় আউওয়াল সাহেব টাকাও ধার দিয়েছিলেন। সেই সুবাদে খুব সম্মান করে সে আউওয়াল সাহেবকে। সেজন্য তিনি একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছেন। উপরন্তু পিউ আশরাফের বিরুদ্ধে অ্যাবিউজের কেস করবার হুমকি দিয়েছে, ঐন্দ্রিলার আজকের অবস্থা আশরাফের জন্য এমন দাবিও তার। কয়েকজন বন্ধুদের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে তৈরি করেছে। আশরাফের জ্ঞান ফেরাতে হুমকিটা ভাল করেই কাজে লেগেছে। ফলে কেস উঠিয়ে নিয়েছে আশরাফের পরিবারের লোকজন। এজন্য চারঘন্টা পর অবশেষে মুক্তি পেয়েছে অভ্র। আউওয়াল সাহেব অভ্রর সাথে কথা বললেন না। অসিকে আন্তরিক স্বরে বললেন,
“হেলাল, তোমার অনেক ধন্যবাদ”
“কাকা যে কি বলেন! আপনাকে সহায়তা করতে পেরেছি এটা আমার সৌভাগ্য”
“আজ তাহলে উঠি”
“জি কাকা”
থানার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে বিল্লাল। অভ্র তাকে দেখেই প্রথম যে কথাটা শুধালো,
“ঐন্দ্রি কেমন আছে?”
বিল্লাল চোখ ছোট ছোট করে শুধালো,
“তুই কি ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে চিন্তিত?”
তার কন্ঠে ভৎসনার তীক্ষ্ণতা অনুভূত হলো। অভ্রর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ক্রোধিত স্বরে বলল,
“ফাজলামি করতেছিস?”
“ফাজলামিটা শুরু করেছে অভ্র?”
খুব শান্ত স্বরে পাল্টা প্রশ্ন শুধালো বিল্লাল। বিদ্রুপ টেনে বলল,
“শখের পুতুল কি সারাজীবন থাকে? একটা সময় তো নষ্ট হয়ে যায়, পুরানো হয়ে যায়। আর পুতুল যেহেতু তাকে ভালোবাসার সাথে রাগও সহ্য করতে হবে। ঐন্দ্রিলাও সেটাই সহ্য করছে। রাগ হয়েছে ভেঙ্গে ফেলেছিস তুই? সমস্যা নেই, খেলনা ভেঙ্গে গেলে এমন কষ্ট সব বাচ্চাদের হয়। নতুন খেলনা পেয়ে গেলেই ভুলে যাবি”
বিল্লালের শান্ত স্বরে কথাগুলোর ধার ক্ষতমাংসে পচন ধরানোর মতো যন্ত্রণা দিলো যেনো। অভ্র নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো। গলা চেপে ধরলো নিজের পরম বন্ধুর। তার চোখ লাল হয়ে আছে। চোয়াল শক্ত। এখন ই খু’ন করে ফেলতে পারে বিল্লালকে। বিল্লাল হাসলো। খুব নরম স্বরে বলল,
“গ্রো আপ অভ্র। পুতুল পুতুল করে যার সাথে খেলে এসেছিস তাকে ভালোবেসে ফেলেছিস তুই। সৈয়দ মাহাবুল হক অভ্র প্রেমে পড়েছে। আকন্ঠ প্রেমে ডুবেছে। মেনে নে। ঐন্দ্রিলা তোর আসক্তি নয়। কখনো ছিলো না। তুই সারাটাজীবন ওকে ভালোবেসেছিস। যদি তা না হত তাহলে আজ তুই এতো বিধ্বস্ত হতি না। পাঁচ বছর আগেও যখন ঐন্দ্রিলা তোর মুখ দেখা বন্ধ করে দিয়েছিলো একই অবস্থা হয়েছিলো তোর। ওর মনোযোগ আকর্ষণে পাগল হয়ে গিয়েছিলি। পাগলও তোকে দেখে বলে দিবে তুই প্রেমে দেবদাস হয়ে গিয়েছিস”
বিল্লালের গলা ছেড়ে দিলো অভ্র। মস্তিষ্ককোষের তীব্র সংঘর্ষ শুরু হলো। সে ঠকায় নি ঐন্দ্রিলাকে। সে ঠকায় নি।
হাসপাতালে ঐন্দ্রিলাকে দেখার সুযোগ পেলো না অভ্র। ঐন্দ্রিলার একটি ব্রেইন সার্জারি হয়েছে। ইটের উপর পড়ার কারণে তার ডিফিউজ এক্সোনাল ইঞ্জুরি নামক ট্রমাটিক ব্রেইন ইঞ্জুরি হয়েছে। যার ফলে মস্তিষ্কের পশ্চাৎভাগের এক্সন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। মোট তিন ঘন্টার অপারেশন ছিলো। নয়টা সেলাই লেগেছে। এখনো জ্ঞান ফিরে নি ঐন্দ্রিলার। তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। ডাক্তাররা বেশ চিন্তিত। বারবার মিটিং বসছে। শহরের বড় নিউরোসার্জনকে ডাকা হয়েছে। জ্ঞান না ফেরা অবধি কিছু বলা যাচ্ছে না। সাবেরার নিষেধাজ্ঞার জন্য এক পলক তাকে দেখতে দেওয়া হয় নি। সালাম সাহেব কোনোমতেই স্ত্রীকে বোঝাতে পারে নি। নীলাদ্রি বোঝানোর চেষ্টাও করে নি। তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে, অভ্রকে প্রচুর মারতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু হাসপাতালে অসভ্য মানুষের মত মারপিট অশোভনীয়। অভ্র অসহায়ের মত দাঁড়িয়েছিলো ভোর অবধি। অবশেষে তাকে জোর করে কানন বাড়ি দিয়ে আসলো।
ক্লান্ত পায়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করলো অভ্র। ঘরময় ঐন্দ্রিলার গন্ধ। ঐন্দ্রিলার জামাকাপড়গুলো এলোমেলো হয়ে পরে আছে বিছানার উপর। অভ্র জামাটা হাতে নিলো। নাকের কাছে ধরে বসে রইলো। বুকের ভেতরটা হাহাকার করছে। চোখখানা জ্বলছে। ঘরের সব কিছু ভেঙ্গে ফেললে ই এই হাহাকার থামবে। দমবন্ধ লাগছে। টেবিলের উপর ঐন্দ্রিলার বইখাতাগুলো হা করে খোলা। মেয়েটির সামনে পরীক্ষা। পড়তে পড়তে খোলা রেখেই চলে গেছে। এসে আবার চিৎকার করবে কেনো বইগুলো কেউ গুছায় নি। অভ্র টেবিলের সামনে যেতেই চোখে পড়লো খাতায় কাটাকাটি করে কিছু লেখা। খাতাটা হাতে নিতেই স্তব্ধ হয়ে রইলো। ঐন্দ্রিলা চিঠি লিখেছে। চিঠিটা পড়তে শুরু করলো অভ্র,
“অপ্রিয়, অসভ্য, নির্লজ্জ পুরুষ,
প্রিয়র তালিকায় তোকে আমি কখনোই রাখতে পারলাম না অভ্র। তোর মনে আছে আমার প্রিয় পুতুলটা কি বিশ্রীভাবে ভেঙ্গেছিলি তুই? বিনিময়ে আমি তোর হাত কামড়ে রক্তাক্ত করেছিলাম। সেদিন আমি খুব কেঁদেছিলাম। তোর কাজ ই তো আমাকে কাঁদানো। মনে আছে, স্কুলে আমার চুলে চুইংগাম লাগিয়ে দিয়েছিলি। তোর জন্য আমার মাজা অবধি চুল কেটে ফেলতে হয়েছিলো। তোর জন্য আমাকে শুধু কাঁদতে হয়েছে। আমাদের ছেলেবেলা ঠিক যেন এক চিরন্তন দ্বন্দ্বের কাব্য। শৈশব, কৈশর—আমরা পাশাপাশি থেকেও যেন দূরে ছিলাম।
তুই ছিলি আমার চিরশত্রু, যে প্রতিনিয়ত আমাকে খোঁচা দিত, বিদ্রুপের আগুন জ্বালিয়ে রাখত। আমাদের শৈশবের সেই ঝগড়াগুলো ছিল যেন প্রতিদিনের নিয়ম, কৈশরের সেই অভিমান আমাদের গল্পের উপত্যাকায় টানা সেই বিরামচিহ্ন। আমাদের সমীকরণটা কতো ভিন্ন তাই না? কখনও কথার তীর, কখনও অবজ্ঞার আঘাত। বিয়েটাও ছিলো কোনো নাটিকার মধ্যাংশের মতো।
তবে আজ সবটাই মনে হয় অহেতুক, সেই শত্রুতার আড়ালে কিভাবে যেনো অনুভব করছি এক অদ্ভুত টান, এক অমোঘ আকর্ষণ। তুই হয়ে গেলি আমার জীবনের এমন এক উপস্থিতি, যাকে উপেক্ষা করতে চেয়েও পারছি না। তোর সঙ্গ, তোর প্রতিটা তর্ক যেন আমার প্রতিদিনের প্রয়োজন। তুই আমার রাগের কারণ, আবার সেই রাগের মাঝে লুকিয়ে ছিল এক মিষ্টি অনুভূতি, কি অদ্ভুত তাই না?
তুই, যে একসময় ছিলি আমার শত্রু, আজ আমার হৃদয়ের গভীরে এমনভাবে জায়গা করে নিয়েছিস যে, তোকে ছাড়া এক মুহূর্তও ভাবা যায় না। তোর সেই বিদ্রুপের হাসি, যে হাসি একদিন আমাকে বিষময় মনে হতো, আজ তা যেন আমার জীবনের সবচেয়ে মধুর সুর। তোর প্রতিটা ঝগড়া, প্রতিটা খোঁচা আজ প্রেমের এক অমলিন রং মাখা স্মৃতি।
তুই-ই আজ আমার জীবনের কবিতা, তুই-ই আমার সমস্ত অনুভূতির ভাষা। তুই-ই আমার সমস্ত চেতনার কেন্দ্রবিন্দু, তুই ছাড়া আমার জগৎ আজ শূন্য। তোকে মেঘেদের সাথে গল্প করতেও আমার ক্লান্তি আসে না। আমি আর কাঠগোলাপের কাছে তোর নালিশ করি না। বরং চাঁদের জ্যোৎস্নার নিচে তোর মাঝে ডুবে থাকার পায়তারা করি। আচ্ছা, শত্রুতার এই গল্প থেকে কি আমাদের সমীকরণ বদলাবে? প্রণয়ের মিষ্টতা মিশে কি আমরা লিখতে পারবো কোনো মহাকাব্য? কি মনে হয়? আমার প্রেমে পড়তে পারবি অসভ্য ছেলে! উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম।
ইতি
তোর একমাত্র বউ
অভ্র চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে আছে। চোখ থেকে অশ্রুকনা গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। পুরুষদের কি কাঁদতে আছে? কিন্তু আজ যে মনটা ভার হয়ে আছে। এই অশ্রুগুলো যার জন্য সে কি কখনো জানবে, এই অভদ্র ছেলেটি শুধু কাঁদাতে নয়, কাঁদতেও পারে।
আজ এক সপ্তাহ কেটে গেছে। ঐন্দ্রিলার জ্ঞান ফিরেছিলো পরদিন। মাথার আঘাতটা খুব গুরুতর নয়। আইসিউ থেকে আজ কেবিনে শিফট করা হবে। মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ। লম্বা চুলগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। ডাক্তার বলেছে ছয়মাস রেস্ট নিতে হবে। মস্তিষ্কে কোনো চাপ দেওয়া যাবে না। যা ক্ষতি হয়েছে তার বিশ্রাম এবং ঔষধই যথেষ্ট। সেলাই শুকাতে সময় লাগবে। সবাই তাকে সময় সময় করে দেখা করতে এলেও অভ্র এখনো আসে নি। তার চোখজোড়া তো শুধু তাকেই খুঁজছে। আর না পেরে সাবেরাকে শুধিয়েই বসলো,
“অভ্র কোথায়? ও আসে না কেনো আমাকে দেখতে?”
সাবেরা উত্তর দেয় না। নীলাদ্রি কিছু বলে না। অবশেষে কেবিনে শিফট করা হলো ঐন্দ্রিলাকে। শ্বশুরবাড়ির সবাই এসেছে আজ একসাথে। সুযোগ পেয়ে কাননকে শুধালো,
“মা, অভ্র কোথায়? ও কি খুব ব্যস্ত?”
কথাটা বলতেই গলা ধরে এলো ঐন্দ্রিলার। কানন মলিন হাসলো। সাবেরার দিকে তাকালো। সাবেরা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। কাননও কম জেদি নয়। এতোদিন ঐন্দ্রিলার অসুস্থতা এবং ছেলের নিরবতায় সে মেনে নিয়েছে সবকিছু। আর নয়। মলিন স্বরে বলল,
“সাবেরার কার্ফিউ ভেঙ্গে কি করে তোমাকে দেখতে আসবে সে। যতই হোক দোষী সে, তাই শাস্তি তো প্রাপ্য”
“মানে?”
“আমার ছেলেটা বাহিরে বসে আছে। এখন নয়। এই সাতটা দিন সে তীর্থের কাকের মত বসে ছিলো আইসিউ এর বাহিরে। খাওয়া নেই, ঘুম নেই। সে অপেক্ষা করছে তার পুতুলের”
ঐন্দ্রিলার হতবাক বসে রইলো। চোখজোড়া ঝাপছা হয়ে আসছে। অভিমানী স্বরে বললো,
“সে তো কারোর কথা শোনার মানুষ নয়। তাহলে?”
“তোমার জন্য সে সবকিছু মেনে নেয়”
“তাহলে তাকে বলুন আমি ডাকছি”
মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ৩৮
কানন হাসলো। সাবেরা দ্বিরক্তি করার সুযোগ পেলো না। কানন অভ্রকে টেনে কেবিনে নিয়ে এলো। অভ্র নতমস্তক দাঁড়িয়ে রইলো দরজার ধারে। ঐন্দ্রিলার মেজাজ খারাপ হল খুব। রাগী স্বরে বললো,
“মরে গেলে আসিস”
এই বাক্যটাই যেন যথেষ্ট ছিলো অভ্রকে নাস্তানাবুদ করতে। একপ্রকার ছুটে এলো সে। উন্মাদের মত জড়িয়ে ধরলো ঐন্দ্রিলাকে। মুহূর্তবাদে ঐন্দ্রিলা অনুভব করলো তার কাঁধে উষ্ণতরলের উপস্থিতি। অভ্র কাঁদছে?………