একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ২৭+২৮
Mousumi Akter
রোশান স্যারের অগ্নিঝরা চক্ষুদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে সারাহ’র চোখের আ’গু’ন কেমন যেন নিভু নিভু হয়ে এলো। হৃদয় কেঁপে উঠল ভয়ে। এই মানুষটা রেগে গেলে কেমন ভয়ংকর দেখায়। এত কঠিন রাগ সারাহ এত কাছ থেকে আগে দেখেনি। সে জানে রোশান স্যার রাগি, গম্ভীর মানুষ। কিন্তু সত্যিই রেগে গেলে এত ভয়াবহ রুপ ধারণ করে সেটা জানত না। ভয়ে সারাহ বার কয়েক ঢোক গিলল। ভীতু চোখে রোশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমার লাগছে।”
সারাহ’র এমন ভীতু চোখ আর নরম কণ্ঠ এই প্রথমবার শুনলো রোশান। সাথে সাথে সারাহ’র হাত ছেড়ে দিলো। তার মানে কি? সারাহ তাকে ভয় পেয়েছে। ভয় পেয়ে কণ্ঠ এমন নরম হয়ে গিয়েছে। সে কি একটু বেশীই রুড ভাবে কথা বলে ফেলেছে। দ্রুত নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল রোশান সিদ্দিকী। তীব্র বিরক্তিতে চোখ-মুখ ঝলসে যাচ্ছে তার। রাগ নিবারণ করতে ডানে-বামে তাকালো। নিজেকে সামলে নিয়ে সারাহ’র দুইগালে হাত রেখে আদরমিশ্রুত কণ্ঠে কথা বলতে ইচ্ছা করছিলো৷ হাত উঠিয়েও সে হাত আবার ঘুচিয়ে নিলো। সারাহ’র চোখে তাকিয়ে নত হয়ে মোলায়েম কণ্ঠে বলল,
” সরি, আমি তোমাকে হার্ট করতে চাইনি। কিন্তু তুমি সিরিয়াস মুহুর্তেও ফান করো কেন? এখন আমি কোনো ফানের মুডে ছিলাম না। তুমি আমার ওয়াইফ! আমার সিসুয়েশন যদি তুমি না বোঝো, আমার ভেতরে কি চলছে যদি না জানার চেষ্টা করো, তাহলে কে বুঝবে বলো?
প্লিজ সারাহ! আমাকে একটু বোঝার ট্রাই করো মাঝে মধ্যো। তাহলে আমার ব্যক্তিগত জীবন, কর্মজীবন দু’টোই সহজ হবে। তুমি জানো তোমাকে নিয়ে আমি কত টেনশনে থাকি। আমি যতটুকু সময় বাহিরে থাকি পা”গ’লে’র মত দুঃচিন্তা করি তোমাকে নিয়ে। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সারাহ বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে রোশানের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ! মানুষটার চোখে-মুখে তাকে নিয়ে চিন্তাররুপরেখা স্পষ্ট ভেষে উঠেছে। এই মানুষটা তাকে নিয়ে এত ভাবছে কেন? কীসেরই বা এত চিন্তা। সারাহ সামান্য ঠোঁট নাড়ালো। শান্ত চোখে রোশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” কীসের এত টেনশণ আমাকে নিয়ে স্যার? কি নিয়ে এত টেনশণ করেন?”
রোশান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মোলায়েম কণ্ঠে বলল,
” তুমি একটা বোকা মেয়ে সারাহ! বুদ্ধিহীন। যেকোনো পরিস্থিতি সামলানোর মত কোনো বয়স বা বুদ্ধি কোনটাই তোমার হয়নি। না’হলে একজনের জন্য রুটি, একজনের জন্য পরোটা, একজনের জন্য ভাত, মাংস এসব রান্না করতে কিচেনে যেতেনা। আমি জানি তুমি রান্না জানোনা। তাহলে এতকিছু রান্নার দায়িত্ব কেন নিলে? নতুন বউদের পায়ে পায়ে ভুল ধরে সবাই। মানুষ তোমার ভুল ধরবে, হাসাহাসি করবে, তখন আবার কষ্ট পাবে তুমি। আমি তোমাকে ঘুম থেকে উঠে বই পড়তে বলেছি। অথচ তুমি বই না পড়ে এসব কাজে লেগে পড়েছো। এত আইটেম রান্না করে কখন পড়বে? কখন কলেজে যাবে? কখন কোচিং যাবে? আমার কাছে জিজ্ঞেস করতে ফোন করে একবার। সেসব না করে বোকার মত রান্না করতে চলে গিয়েছো। তুমি কি আদৌ রান্না জানো? হ্যাঁ তোমাকে সব শিখতে হবে। তবে সেটা এখনিই নয়। আস্তে ধীরে। আগে লেখাপড়ায় মনোযোগ দাও প্লিজ! এ বাড়িতে দু’জন কাজের লোক আছে। রান্না আর ঘর গোছানো ছাড়া অতিরিক্ত কাজ নেই। সো তোমাকে এত প্রেসার না নিলেও চলবে। ”
সারাহ এ বাড়িতে পা দিয়েই বুঝেছে কোনো একটা কারণে রোশানের মা তাকে মেনে নিতে পারছে না। সাথে জিনাত ও তাকে সহ্য করতে পারছে না। ইচ্ছা করেই রোশানের মা তাকে প্রাচীন যুগের কায়দায় টর্চার করতে চাইছে।ইচ্ছা করেই সকালে এত রান্নার আইটেম দিয়েছে। শ্বাশুড়ির নামে তার ছেলের কাছে নালিশ দেওয়া যাবেনা। শ্বাশুড়িকে অন্যভাবে ঠিক করতে হবে। সারাহ এসব কথার উত্তর না দিয়ে বলল,
” এত পড়াশুনা করে কি হবে। পড়াশুনার চেয়ে রান্নাবান্না সহজ বেশী। আমি পড়াশুনার চেয়ে রান্নাবান্নায় ইন্টারেস্টেড বেশী।” বলেই সারাহ রোশানের অয়্যারড্রবের কাছে গেলো। অয়্যারড্রব খুলে কিছু খুজছে। এদিকে রোশান হতবিহম্বলের মত সারাহ’র দিকে তাকিয়ে আছে। না মানে তাকে যে পড়াশুনা নিয়ে এত রামায়ণ পড়ানো হলো, সে বলে কি। এই মেয়েকে তো কোনভাবেই সোজা করা যাচ্ছেনা। বিরক্ত চোখে সারাহ’র দিকে তাকিয়ে রইলো। রোশান যে বিরক্ত সারাহ সেটা বুঝতে পেরেছে। বুঝতে পেরেও প্রসঙ্গ এড়াতে বলল,
” কোন কালারের প্যান্ট আর শার্ট পরবেন আজ। বলুন বের করে দিই। পরমেশ্বর,পতির সেবাযত্ন না করলে জাহান্নাম হবে আমার কপালে।”
রোশান সারাহ’র দিকে এগিয়ে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমি তোমাকে কিছু বলেছি সারাহ! আমার কথা মন দিয়ে শুনতে বলেছি, আমার খেদমত করতে বলিনি। ”
সারাহ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। মুচকি হেসে জবাব দিলো,
“আমাকে এতটা সরল আর বোকা ভাববেন না স্যার। আপনার টেনশণ আর অশান্তি আরোও কয়েকগুন বৃদ্ধি করে এসছি। একটু পরেই টের পাবেন।”
রোশান ভ্রুঁ কুচকে জিজ্ঞেস করল,
“কি করেছো আবার?”
“আপনার টেনশণ বৃদ্ধি, যান গোসলে যান। আপনার শার্ট,প্যান্ট আমি এগিয়ে দিবো। আজ আমার পছন্দে শার্ট পরবেন।”
রোশান সারাহ’র ভাব সাব কিচ্ছু না বুঝে খানিকটা অবাক হয়েই শাওয়ার নিতে গেলো। মনে মনে টেনশন করছে, কি অকাম করেছে মেয়েটা। ভাবতে ভাবতে রোশানের গোসল করা শেষ হলো। সে টাওয়াল দরজা খুলে সারাহ কে বলল,
“শার্ট, প্যান্ট দাও।”
সারাহ ভীষণ দুষ্টু মেয়ে। সারাক্ষণ মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি ঘুর ঘুর করে। রোশান সিদ্দিকী গম্ভীর বলেই আরো বেশী করে দুষ্টুমি করে। সে নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসছে আর রুম থেকে শার্ট, আর আন্ডারওয়্যার ছুড়ে মারলো। শার্ট গিয়ে পড়লো বালতির ভেতর আর আন্ডারওয়্যার গিয়ে রোশানের মুখের ওপর। রোশান আন্ডারওয়্যার ধরে বড় বড় চোখে তাকিয়ে দেখে চোখ দুটো কপালে তুলল। এসব কি? সে সারাহ’র দিকে আশ্চর্যজনক চাহনিতে তাকিয়ে আন্ডারওয়্যার দেখিয়ে বলল,
“হোয়াট ইজ দিস?”
সারাহ দুষ্টামি করে হাসছে আর বলছে,
“আপনার প্যান্ট।”
রোশান দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“এটা চেয়েছি তোমার কাছে?”
“নাম তো বলেন নাই কি প্যান্ট চেয়েছেন। দেখলাম লাল,নীল,হলুদ, সাদা, কালো রঙের সাজানো ছোট ছোট প্যান্ট আছে, তাই দিলাম।বাই দ্যা ওয়ে গোলাপি রং নেই আপনার?”
রোশানের চোখে মুখে তীব্র বিরক্তি। বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
“ডিজগাস্টিং! ইউ আর ডিজগাস্টিং!”
সারাহ হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
ডায়নিং এ রোশানের মা-বাবা, দাদু, জিনাত আর ওশান বসে আছ। রোশানের দাদু সারাহ’কে বলল,
” আমার দাদাভাই কই?”
সারাহ মিহিকণ্ঠে বলল,
” গোসল করেছে, মনে হয় চেঞ্জ করছে।”
” ও আসুক, তুমি বসো আমাদের সাথে।”
এরই মাঝে রোশানের মা বলে উঠল,
” সারাহ এ বাড়ির বড় বউ বাবা। ও কীভাবে খেতে বসবে৷ সবাইকে খাইয়ে তবেই ও খাবে। আজ থেকে এ বাড়ির সব দায়িত্ব সারাহ’র৷ এতদিন এসব আমি করেছি এখন সারাহ করবে।”
রোশানের দাদু বলল,
” এ বাড়িতে সারাজীবন কাজের লোক ছিলো। বেশী কিছু বলতে চাচ্ছিনা।”
এরই মাঝে শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে রোশান ডায়নিং এ প্রবেশ করল। দাদুর পাশের সীটে গিয়ে বসল। সারাহ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ি পরাতে পেটের কাপড় সরে গিয়েছে। ওশান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সারাহ’র পেটের দিকে। যাকে বলে কু-দৃষ্টি। সবার ভীড়ে এটা কেউ খেয়াল-ই করেনি। রোশান ফ্ল্যাক্স থেকে চায়ের কাপে গরম পানি ঢেলে তাতে একটা টি-প্যাক দিয়ে সারাহ’র দিকে তাকিয়ে বলল,
” তুমি দাঁড়িয়ে কেন বসো।”
সারাহ মিহি কণ্ঠে বলল,
” পরে বসছি।”
রোশান চোখ গরম দেখিয়ে বলল,
” বসতে বলেছি।”
তখনি জিনাত এসে রোশানের পাশের চেয়ারে বসে পড়ল। রোশান রাগান্বিত চোখে সারাহ’র দিকে তাকালো। এর মানে তোমার জন্য উটকো ঝামেলা এসে পাশে বসল। এতক্ষণে তুমি বসলে আর অন্য কেউ বসার সুযোগ পেতোনা। জিনাত এক গাল বেহায়া হাসি দিয়ে বলল,
” শুভ সকাল রোশান।”
রোশান কোনো উত্তর দিলনা। সে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। ডায়নিং টেবিল ভর্তি খাবারের দিকে চোখ বুলালো।
জিনাত একটা প্লেট নিয়ে বলল,
“সারাহ,আমার রুটি মেক করেছো?”
সারাহ বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“হ্যাঁ, খালা উনার রুটিটা দিন।”
সারাহ মনে মনে বলল, আমার সাথে ভালো ব্যবহার করলে আমি ভীষণ ভালো, খারাপ ব্যবহার করলে আমিও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ত্যাড়া মেয়ে। আমাকে শায়েস্তা করতে আসলে জাস্ট শায়েস্তা হয়ে যেতে হবে। আমাকে শাবানা ভাবলে ভুল হবে। আমি হলাম শাবনূর এর বিরাট বড় ফ্যান। পাশাপাশি রিনা খানের থেকেও ট্রেনিং নিয়েছি।
রোশান এইবার তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আম্মু, এ বাড়িতে সকালে চা-নাস্তার পরিবর্তে ভাতের আয়োজন কবে থেকে শুরু হল?”
রোশানের মা একটা প্লেট নিতে নিতে বললেন,
” এখন তো বাড়িতে বউমা এসছে। খাবারের মেনু চেঞ্জ করলে সমস্যা কি। এখন থেকে নতুন নতুন আইটেম খাবো।”
রোশান আবারও চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বিচক্ষণতার সাথে তার মা’কে প্রশ্ন করল,
” তাহলে এ বাড়িতে এক্সট্রা কাজের লোক বৃদ্ধি পেয়েছে বলতে চাইছো।”
রোশানের মা এই ভারী কথা মানে বুঝল না। সে বেশ খুশী মনে উত্তর দিলো,
” হ্যাঁ, মতিয়ার সাথে সারাহ রান্না বান্না করলে, মতিয়ার চাপ কম থাকবে।”
রোশান চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল,
” আচ্ছা।”
এরই মাঝে ওশান বলল,
” ভাবি তুমি আমাকে খাবার তুলে দাও। আমি তোমার হাতে খেতে চাই।”
সারাহ ওশানের দিকে এগিয়ে গেলো। ওশানের প্লেটে পরোটা তুলে দিলো। ওশানের উদ্দেশ্য সারাহ’কে আরেকটু খারাপ নজরে দেখা। যেটা সারাহ টের পাইনি। রোশান আড়চোখে ওশানের দিকে তাকালো। সারাহ’কে দিয়ে কাজ করানোতে রোশান বিরক্ত হচ্ছে। তাছাড়া ওশানের চরিত্র নিয়ে রোশানের সারাজীবন সন্দেহ। ওশানের চোখের চাহনি রোশানের কাছে পছন্দ হয়না। বিষয় টা নিয়ে আজই সারাহ’কে সতর্ক করতে হবে।
ওশানকে পরোটা দেওয়ার পর ওশান ওর পাশের ফাঁকা চেয়ারর সারাহ’কে বসতে বলল। সারাহ না বসে রোশানের কাছে এসে দাঁড়ালো। কারণ সারাহ’র মন পড়ে আছে জিনাত আর রোশানের দিক। জিনাত যতবার রোশানের কাছাকাছি যায় ততবারই সারাহ’র শরীর অগ্নির মত জ্বলে ওঠে। সে রোশান’কে ভালবাসেনা। কিন্তু রোশানের পাশে জিনাতকে দেখলেই মনে হয় তার ব্যক্তিগত জিনিসে জিনাত হস্তক্ষেপ করছে। রাগে সারাহ’র শরীর কাঁপতে থাকে। তবে কি জেলাসি ভালবাসার পূর্বলক্ষণ। মতিয়া জিনাতের প্লেটে দুইটা তুলে দিল। রুটির সাইজ বাংলাদেশের মানচিত্রের চেয়ে ভয়াবহ আকার দেখতে। আর পুড়ে একাকার অবস্থা। এমন অদ্ভুত সাইজের রুটি পৃথিবীতে আগে পরে কেউ দেখেনি। রুটির দিকে তাকিয়ে ওশান ফিক করে হেসে দিলো। হাসি কন্ট্রোল করতে পারল না। রোশান একবার রুটি, একবার সারাহ’র দিকে তাকাচ্ছে। রোশানের ঠোঁটে কিঞ্চিৎ পরিমাণ হাসি। রোশানের বাবা এবং দাদু দু’জনেই হাসছে। জিনাত চিৎকার দিয়ে উঠে বলল,
” এ কোনো রুটি হল? দেখতেই কেমন দেখাচ্ছে। রুটির সাইজের যে অবস্থা, চেহারা আরোও ভয়াবহ। ”
সারাহ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
” দেখতে যেমন ই হোক, খেতে অসাধারণ হয়েছে। খেয়ে দেখুন। অনেক কষ্ট করে আপনার জন্য বানিয়েছি।”
জিনাত রোশানের দিকে তাকালো। রোশান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালোনা। সে ফুলের ব্যাপার টা ভুলে যায়নি। রোশানের বাবা বললেন,
” খেয়েই দেখো কেমন হয়েছে।”
জিনাত একটু রুটি ছিড়ে গালে দিয়ে সাথে সাথে থু ফেলে বলল,
“এই মেয়ে তোমার সাথে কোন জন্মের শত্রুতা আমার হ্যাঁ। রুটিতে কেউ এত কড়া হলুদ দেয়। সাথে কড়া মরিচ আর লবন দিয়েছো সাথে দিয়েছো আদা। জীবনে রুটি খাওনি। ইচ্ছাকরে এসব করেছো তাইনা?”
সারাহ’র মুখের ভাব এমন যেন সে এসব না জেনে করেছে। খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
” আমি আপনার জন্য ইউটিউব থেকে স্পেশাল একটা রুটি বানানো রেসিপি দেখেছি। শুধু আপনার একটু প্রশংসা পেতে আপু।”
জিনাত সারাহ’র দিকে রুটি এগিয়ে দিয়ে বলল,
” তোমার স্পেশাল রুটি তুমিই খাও।”
সারাহ এবার একটু কঠিন কণ্ঠে বলল,
” যেমন ই বানিয়েছি ওটা খেতে হবে আপনাকে।”
“কেন?”
“আমি পারি নাকি, পারিনা সেটা না জেনে কেন আমাকে রুটি বানাতে বলেছেন। জিজ্ঞেস তো না করে ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। বানাতে যখন বলেছেন, যেমন বানিয়েছি তেমনই আপনাকে খেতে হবে। আমার কষ্ট আমি মাগনা হতে দিবোনা আপু।”
জিনাত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমাকে কি গোরু পেয়েছো? এই অখাদ্য আমাকে খেতে বলছো।”
সারাহ এবার স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
” আমাকেও গোরু ভাবলে ভুল হবে।”
জিনাত তার ফুপ্পির দিকে তাকিয়ে বলল,
” দেখলে ফুপ্পি তুমি।”
রোশানের মা মেজাজের সাথে বলল,
” ওই রুটি ওর মা-বাবার জন্য রেখে দাও। মেয়েকে কি শিখিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়েছে শুনব। সামান্য একটা রুটি বানাতে পারেনা।”
বলেই অন্যান্য খাবার চেক করে দেখল সবখাবারে অতিরিক্ত ঝাল আর লবন। দু ‘একটা বাদে। রোশানের মা সারাহ কে বলল,
” তুমি কি একেবারেই আমড়া কাঠের ঢেঁকি। একটা খাবারও কি খাওয়ার উপযুক্ত রেখেছো। তোমার মা কি তোমাকে খাওয়া ছাড়া কিচ্ছুই শেখায় নি।”
রোশান এইবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” লাগলে কাজের লোক আরোও চারটা নাও। তবুও অশান্তি করোনা। ” বলেই সবার মাঝ থেকে সারাহ’র হাত ধরে রুমে নিয়ে গেলো। রোশানের বাবা রোশানের মায়ের দিকে তকিয়ে বলল,
” ছেলেকে হাতছাড়া করে ফেলবে তুমি এইবার ই। আমিতো তোমাকে শায়েস্তা করতে পারিনি এইবার যদি হও।”
রোশান রুমে গিয়ে সারাহ’কে বলল,
” আমি জানি তুমি রুটি গোল বানাতে না জানলেও রুটিতে ওসব অদ্ভুত জিনিস দিতে হয়না সেটা জানো। কিন্তু এমন করলে কেন?”
সারাহ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
” বিকজ জিনাত কে আমার সতীন সতীন লাগে। ”
রোশান হা করে সারাহ’র দিকে তাকিয়ে রইলো। মানে কি সারাহ জেলাস? রোশানের কেন যেন ভাল লাগলো। মৃদু হাসিতে ভরে উঠলো তার ঠোঁট।
কেটে গিয়েছে দশ দিন….
দ্বীপ আর তন্ময় অনেক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে ক্লান্ত। দ্বীপের কয়েক’ক টা সিগারেট খাওয়াও শেষ। অথচ মৃন্ময়ের খোঁজ নেই। এইদিকে তন্ময় বসে বসে ছোঁয়ার সাথে চ্যাটিং করছে। তন্ময়ের কোনো হুঁশ জ্ঞাণ নেই। সে যখন ছোঁয়ার সাথে চ্যাটিং করে পৃথিবীর কোনো হুঁশ ই থাকেনা। দ্বীপ তন্ময়ের ফোনটা হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলল,
“শালা, তুই আর ছোঁয়া মিঙ্গেল। সারাহ আর রোশান স্যার। মৃন্ময় তার বাড়িতেই একজনকে পেয়ে গিয়েছে। এদিকে আমি এক হতভাগা। সারাদিন সিগারেট ই ফুঁ দিয়ে যাচ্ছি। তোদের হাতে এবং পায়ে ধরি। কানা,খোড়া যাই হোক আমার সমস্যা নেই, শুধু নিঃশ্বাস চলছে এমন একটা মেয়ে আমাকে খুঁজে দে। জাস্ট একটা গার্লফ্রেন্ড হলেই হবে আমার। আর কিচ্ছু লাগবে না। ”
তন্ময় দ্বীপের ভিখারি অবস্থা দেখে বলল,
” মেসেঞ্জারে টেক্সট দিতে’তো কোনো মেয়েরেই বাদ রাখিস না। তোর আবার গার্লফ্রেন্ডের অভাব পড়ল কবে। ”
” ভাই ওইখানে টাইমপাস করি। সিরিয়াস কিচ্ছুই নেই। ”
তন্ময় মৃন্ময়ের কাঁধে হাত রেখে বলল,
” দেখবি, ওই টাইমপাসের মাঝে রিয়েল একজন’কে পেয়ে যাবি।”
দ্বীপ হতাসাগ্রস্থ চোখে তাকিয়ে বলল,
” হয়ার ইজ মাই রিয়েল গার্ল ব্রো।”
” পেয়ে যাবি হুট করেই। আগে চল মৃন্ময়’কে ধরে নিয়ে আসি। শালা কি করছে দেখে আসি। ”
তন্ময় আর দ্বীপ দু’জনে মৃন্ময়ের বাড়ির পেছনে গিয়েই দু’জন বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো। মৃন্ময় হ্যাংলার মত বাড়ির পেছনের কচু বাগানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছে। কি দেখার জন্য দাঁড়িয়ে আছে ও৷ এমন সময় তরীর সৎ মা দিশা এসে দাঁড়ালো দিশার রুমের জানালার পাশে। পরণে একটা হট নাইটি ড্রেস পরা। সে জানালার পাশে এসেই মৃন্ময়’কে ডাকল,
‘ হেই দেবরজি, কেমন আছো?’
দিশার চোখে,মুখে, ঠোঁটে কামনা ভরা। মৃন্ময় অনিচ্ছাকৃত হাসি দিয়ে বলল,
” ভালো, আপনি এখানে কেন?”
” এই হাওয়া,বাতাস খেতে এসছি।”
মৃন্ময় মনে মনে বলল,
‘মা*গিদের মত রাস্তার পুরুষদের শরীর দেখানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে। স্রেফ তরীর জন্য তোর মতো মা* গি বাসায় রেখেছি। আমার জা’ন টার মুখ দেখার জন্য। ইচ্ছা করতেছে ধরে যশোর পল্লিতে রেখে আসি। ওখানে থাকলে ফ্রিতে শরীর দেখানো লাগবেনা। রেগুলার টাকাও ইনকাম হবে।’
এমন সময় তরী ওর রুমের জানালার পাশে এসে দেখল,
মৃন্ময় দিশার সাথে কথা বলছে। দিশার পোশাক আর কথা বলার ভঙ্গী দেখে তরী মৃন্ময়ের দিকে তাকালো। মুহুর্তের মাঝে মুখটা মলিন হয়ে গেলো। মৃন্ময় দিশার সাথে কথা বলার জন্য এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে সাথে জানালাটা বন্ধ করে দিলো। তরীর জানালা বন্ধ করার কারণ টা মৃন্ময় বুঝল না। মৃন্ময়ের বুকের মাঝে কেমন বাড়ি মেরে উঠল। মেসে যাওয়ার আগে তরীর একটা মিষ্টি হাসিই তো দেখতে চেয়েছিলো।
দ্বীপ এসে বলল,
“কীরে শালা জানালার পাশে এসে, বৌদি দেখছিস।”
মৃন্ময় তার দুই গালে হাত রেখে বলল,
“অস্তাগফিরুল্লাহ, উনি আমার শ্বাশুড়ি মা। ”
দ্বীপ কৌতুহলী হয়ে বলল,
“এই বাচ্চা তোর শ্বাশুড়ি মা।”
“হু, তরীর বাপ এই মাল বিয়ে করে আনছে। ভাই এর নজর সারাক্ষণ আমার দিকে। ”
তন্ময় বলল,
“ইজ্জত মান দেখতেছি সব যাবে। চল মেসে চল।”
মৃন্মত আহত কণ্ঠে বলল,
“শোন ওর হাসি মুখ না দেখে যেতে পারব না।”
তন্ময় মৃন্ময়ের গেঞ্জির কলার ধরে টেনে বলল,
“কাল এসে দেখিস, তুই তো এখন মেসেই থাকিস না। হুট হাট চলে আসিস। আগে বাড়িই আসতে চাইতি না।”
মৃন্ময় হতাসাগ্রস্থদের মত বলল,
“আসলেই বাবা পড়াশুনা আর ফিউচার নিয়ে যে জ্ঞান দেয় আমাকে দেখলেই তার এই জ্ঞান মনে পড়লে আর বাড়িতে আসতে মন চায়না। এত কিপটা আমার বাপ কি বলব ভাই। নিজে ২৩ বছর বয়সে বিয়ে করেছে। ছেলের যে বউ লাগে বোঝেনা। আমাকে কি বলে দিতে হবে আমার বউ লাগবে।এত বড় বাড়ি এসব কে খাবে? ছেলে তো আমি একাই। আমি নাকি উপার্জন না করলে বিয়ে দিবেনা। ”
দ্বীপ বলল,
” আমি তোর বাপকে বলব, আপনার ছেলে বউ ভেবে আমাকে জড়িয়ে ধরে মধ্যরাতে।”
“জড়িয়ে ধরে কি করি সেটাও বলিস।”
ওরা তিনজনে হো হো করে হেসে উঠল। এরই মাঝে দ্বীপের আইডিতে একটা মেয়ে মেসেজ করল,
” ভাবি কেমন আছে?”
দ্বীপ চোখ বড় বড় করে উত্তর দিল,
” কার ভাবি?”
” আমার ভাবি, আপনার বউ।”
দ্বীপ উত্তর রিপ্লাই দিলো,
” আমি সিঙ্গলে রে বইন, বিয়ে শাদী পোড়া কপালে নেই।”
এর পর থেকে দ্বীপের সাথে আননোন মেয়েটার চ্যাট হচ্চে। সারারাত জেগেও চ্যাট হচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা কে? দ্বীপের মনে প্রবল আগ্রহ জাগল। সে কি ফেইক আইডি নাকি সত্যি মেয়ে। মৃন্ময় বা তন্ময়ের ফেইক আইডি নাতো! কনফিউজড দ্বীপ।
ঘড়িতে রাত নয়টা বাজে। সারাহ পড়ার টেবিলে বসে বই এর পৃষ্টায় একটা মানুষ আঁকাআঁকি করছে। এমন সময় ছোঁয়ার নাম্বার থেকে ফোন এলো। সারাহ ফোন রিসিভ করল। দু’জনে ভাল-মন্দ গল্প শুরু করল। কখন যে রোশান পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সারাহ জানেনা। ফোনের ওপাশ থেকে সব শোনা যাচ্ছে। ছোঁয়া বলল,
“রোশান স্যার কেমন আদর করেরে?”
সারাহ দুষ্টুমি করে বলল,
” আর বলিস না। সারারাত ঘুমাতে দেয়নারে। প্রচুর দুষ্টু উনি। প্রচুর আদর করে।”
“কেন কেন কি করে?”
“আমাকে জড়িয়ে না ধরলে তার ঘুমই আসেনা। একশ টা চুমু না দিয়ে সে ঘুমোতেই চায়না।”
ছোঁয়া অবাক হয়ে বলল,
“আল্লাহ দেখে তো বোঝা যায় না স্যার এমন। ”
এমন সারাহ পেছনে ঘুরে দেখল, থমথমে মুডে রোশান দাঁড়িয়ে আছে। সারাহ দ্রুত ফোন কেটে দিলো। রোশান গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“কি বলছিলে?”
সারাহ আমতা আমতা করে বলল,
” কিছুনা।”
“আমার স্টুডেন্ট ওরা, আমার ইমেজ নষ্ট করছো তুমি।”
“আপনার শালা আর শালী ওরা। আমি যদি স্টুডেন্ট হয়ে বউ হতে পারি, ওরা কেন পারবে না।”
রোশান ভ্রুঁ কুচকে বলল,
” তোমাকে আমি জীবনে একটা চুমু দিয়েছি?”
সারাহ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
” সেজন্যই তো বিয়ের এতদিন হলো একটা বাচ্চা-কাচ্চার মুখ দেখলাম না।”
” হোয়াট কিসব বলছো তুমি। বাচ্চা নেওয়ার মত বয়স হোক তোমার আগে।”
সারাহ আবার ও মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“বিয়ের বয়স যখন হয়েছে বাচ্চা নেওয়ার বয়স ও হয়েছে।”
রোশান হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বলল,
“সুয়ে সুয়ে বিড়বিড় করো, বাচ্চা আকাশ থেকে পড়বে।”
“বাচ্চা পেট থেকে পড়বে জানি। সেটা আমার পেট হোক আর আপনার সেটা নিয়ে সমস্যা নেই।”
রোশান হাতের ঘড়ি খুলে বেশ সিরিয়াস ভাবে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কি জানো বেবি কীভাবে হয়?”
“জি।”
” প্লিজ বলো! কীভাবে হয়।”
“কবুল বললে।”
রোশান ঠোঁটের কোনে বাঁকা হেসে বলল,
” জানতাম উত্তরটা এমন হবে। বিয়ে করেছি বাচ্চা মেয়ে। উত্তর তো এমন হবেই।”
সারাহ ফোঁস করে উঠে বলল,
“বাচ্চা বিয়ে করতে বলেছিলো কেউ?”
” কথায় কথায় ছ্যাঁৎ করে ওঠাও বাচ্চাদের লক্ষণ। বাচ্চা এত ইজি ব্যাপার নয় সারাহ। আমি তোমাকে এখনো স্পর্শ ও করিনি। বিকজ তুমি আমাকে এখনো এক্সেপ্ট করতে পারোনি। যেদিন তুমি আমার হৃদয়ের কাছাকাছি আসতে পারবে, সেদিন আমার হার্টবিট কন্ট্রোল করতে একটা যুগ কেটে যাবে। স্পর্শ তো দূরে থাক। আই নো তুমি এইগুলা বুঝবা না। ”
সারাহ মুগ্ধ হয়ে রোশানের কথা শুনছে। এত ভাল লাগে কেন উনার কথা শুনতে। পৃথিবীর সব মিষ্টি যেন উনার কথা বলার ধরণে মিশ্রিত। এমন সময় জিনাত না বলেই ঘরে প্রবেশ করল। এমন মুহুর্তে জিনাতের আসাতে সারাহ বিব্রত হলো। জিনাত একটা ড্রেস পরে এসে রোশান’কে দেখিয়ে বলল,
” কেমন লাগছে?”
রোশান জিনাতের দিকে না তাকিয়ে বলল,
” নাইস, আমরা ঘুমাব। তুমি এসো এখন।”
বারবার রোশানের থেকে প্রত্যাখ্যান হয়েও জিনাত রোশানের কাছে আসে। এই আসার কারণ টাই বা কি! এখানেও কি কোনো কাহিনী আছে। যেটা সারাহ’র অজানা। অতীতে কি কিছু ছিলো। জিনাত রুম থেকে যেতেই রোশান ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলো। সারাহ’র দিকে তাকাতেই সারাহ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ২৬
” নাইস।”
রোশান মাথায় হাত দিয়ে বলল,
” এইবার এই নাইস আর কতদিন শুনব কে জানে? আল্লাহ বাঁচাও আমাকে।”