সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৬

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৬
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

নূহার পরশুর জন্মদিন এগিয়ে এলো রোদের মতো। ঝুপ করে সূর্য উঠে যেমন দিন আসে? অমন তাড়াহুড়োয় দ্বিগবিদিক ঘুরে বেড়াল ঘড়ির কাঁটা। এখন বাজে এগার‍টা ত্রিশ। নূহা টেবিলে বসে পড়ছে। আর মিনিট তিরিশেক পরেই ঊনিশ ছাড়িয়ে বিশের কোঠায় পা রাখবে সে।
আর এই জন্মদিন নিয়ে সারাদিন বেশ তোড়জোড় চালিয়েছেন আয়েশা। একা নন যদিও। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দায়িত্ব সামলেছে নাহিদ। বাবুর্চি ঠিক করা, ফুলের অর্ডার, কেক অর্ডার, বেলুন দিয়ে ঘর সাজানো, এরকম টুকিটাকি অনেক কাজ!

নাহিদের প্রতি মুগ্ধতায় আয়েশা খাতুন গদগদ এখন।
বাজারটা করতেও ওকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন।
কাল সন্ধ্যেবেলা অনুষ্ঠান। পুরো বিল্ডিংয়ের সাথে নিজেদের কিছু আত্মীয়-স্বজন ডাকা হয়েছে। সাথে দু চারজন অফিস কলিগ আসবে।
তবে নূহা ভার্সিটির কাউকে বলেনি। ওখানে কারো সাথে তার বিশেষ খাতির নেই। সবথেকে বড়ো কথা এই গোটা অনুষ্ঠান নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথাই নেই। শুধু মা-আর পুষ্পিতার আনন্দ দেখে স্বায় মিলিয়ে যাচ্ছে।
ভেতর ভেতর মনের সাথে প্রেমের যুদ্ধে বিধ্বস্ত সে। এই যে পড়তে বসেছে এখন? এটাও তো উশখুশে ভেতরটাকে ব্যস্ত রাখার প্রয়াস৷ আজকাল মাথায় মধ্যে সারাক্ষণ নাহিদ ঘুরে বেড়ায়। নূহা নিশ্চিত, এবার সেমিস্টারে ভার্সিটির টপার কেন? পাশের মুখ দেখবে কী না সন্দেহ!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আজকে সারাদিন নাহিদ ঘরে আসা-যাওয়া করেছে। মায়ের সাথে সাথে সব কাজে হাত লাগিয়েছে। চোখের সামনে তাকে এতবার ঘুরতে দেখে নূহার ভেতরটা কাহিল প্রায়!
বশীভূতের ন্যায় এক যুবকের প্রতি মগ্ন হওয়ার চিহ্ন মোছার কোনও অস্ত্র আছে? নেই। থাকলে নূহা কবেই মুছে ফেলতো।
ও লম্বা শ্বাস ফেলল। তপ্ত শ্বাসের ছোঁয়ায় বইয়ের পাতা একটু উড়ে দমে গেল আবার। নূহা ঘরের চারপাশটা দেখল এক পল। পুষ্পিতা কোথাও নেই। অনেকক্ষণ ধরেই দেখছে না।
কী করছে?
পরপর ভাবল,

কী আবার করবে,কাজ করছে হয়ত। এই মেয়েটাও না! আর কত কাজ করবে? জন্মদিন ওর,অথচ পুষ্পিতার লাফালাফি,ছোটাছুটি বেশি। পা দুটো জিরোচ্ছেই না। তারওপর নতুন নতুন প্রেম করছে। প্রেমিক পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে। আজকাল বই-ই ছুঁয়ে দেখে না। কদিন পর তো ওরও পরীক্ষা। রেজাল্টে যে কী করবে!
পুষ্পিতা তখন রান্নাঘরে। তাড়াহুড়ো করে হাতের কাজ সাড়ছে। আবার খেয়ালও রাখছে যাতে শব্দ না হয়। মাঝেমধ্যে সতর্ক নয়ন বুলিয়ে আনছে কক্ষ হতে। চুলায় একটা কেক বানিয়েছে সে। রাহাতের জন্যে বহুবার বানানোয়,হাত বেশ পাকা। কুসুম রঙের কেকের ওপর পুরোটা চকলেট ছড়ানো। নূহার ভীষণ পছন্দ এটা! পুষ্পিতা তার ওপর গোটা গোটা অক্ষরে লিখল,

“ হ্যাপি বার্থডে মাই হ্যাপিনেস!”
ওদের রান্নাঘরের ছোট্টো জানলাটা ছাদমুখী তৈরি। ভেতর না হলেও, সিঁড়ি থেকে কেউ ছাদে ঢুকলে এখানে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখা যায়।
পুষ্পিতা যখন কাজে মশগুল, হঠাৎ মনে হলো কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। মেয়েটা চকিতে চোখ তুলে চাইল। নাহিদ হাত নেড়ে নেড়ে ডাকছিল এতক্ষণ। ও চাইতেই এক টুকরো স্বস্তির হাসি টানল ঠোঁটে। চোখমুখের ইশারায় বোঝাল ঘরের দরজা খুলে দিতে।
পুষ্পিতার সরল কপাল বেঁকে বসে। দরজা খোলার জন্যে এভাবে ডাকছে কেন? ডোরবেল দিলেই তো হোতো। নাহিদ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে বোঝাচ্ছে। মানা করছে কথা বলতে।
পুষ্পিতা আর অত শত ভাবল না। নাহিদের ব্যাপারে সুপারিশ সে তীব্রর থেকে পেয়েছে। নূহার থেকে তো সব সময়ই পায়।
পুষ্পিতা হাত তুলে বোঝাল,খুলছি।
তারপর ছুটে এলো । দরজা খুলতেই শশব্যস্ত এগিয়ে এলো নাহিদ। ফিসফিস করে কিছু একটা বলল। সহসা
চোখ কপালে তুলল পুষ্পিতা,

“ এত রাতে?”
ওর কণ্ঠে অনুনয়,
“ প্লিজ! প্লিজ!”
পুষ্পিতা চিন্তায় পড়ে গেল। আবার নাহিদের অনুরোধ ফেলতেও পারছে না। একটু ভেবে বলল,
“ আচ্ছা। আপনি যান,আমি দেখছি।”
খুশি হলো নাহিদ। অমন ফিসফিস করেই জানাল,
“ থ্যাংক ইউ! থ্যাংক ইউ!”
পুষ্পিতা দোর চাপিয়ে ভাবল কিছুক্ষণ। কীভাবে কী করবে!
ঘড়িতে একবার দেখে নিলো সময়টা।
আচমকা কাঁধে হাত পড়তেই নূহা চমকে উঠল একটু! যেন গভীর ধ্যানে ছিল। পুষ্পিতা অবাক হয়ে বলল,

“ ওমা, এত কী ভাবছিলি?”
“ না,কিছু না। বল না কী বলবি? আম্মু ঘুমিয়েছে?”
“ হ্যাঁ। মাত্র শুতে গেল।”
“ ওহ।”
পুষ্পিতা হুট করেই আবদার ছুড়ল,
“ চল ছাদে যাই।”
নূহার চোখ প্রকট,
“ এখন!”
“ বাইরে কত বাতাস! ঠান্ডা! ভালো লাগবে চল!”
“ না রে, আমি এখন যাব না।”
পুষ্পিতা গাল ফুলিয়ে বলল,

“ তুই দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছিস, নূহা। আগের মত হাসছিস না,আনন্দ করছিস না। আমি খেয়াল করে দেখেছি, সব সময় কী একটা চিন্তায় থাকিস। কী হয়েছে তোর? যেটা আমাকেও বলা যায় না!”
শ্রান্ত চোখে চাইল মেয়েটা,
“ তুই তো নিজের জ্বালাতেই জ্বলছিস, আমি আর কী বলব!
কেমন করেই বা বলব, ভেতর ভেতর কীভাবে মরে যাচ্ছি আমি! প্রেমে এত ভোগান্তি আমাকে একটু আগেভাগে বলে রাখতি পুষ্পিতা। মনটাকে নাহিদের কাছে যাওয়া থেকে টেনেহিঁচড়ে হলেও আটকে রাখতাম আমি।”
কিন্তু অভিব্যক্তি লোকাতে চট করে হাসল সে। স্ফূর্ত গলায় বলল,
“ আচ্ছা বেশ। ছাদে গেলে প্রমাণ হবে তো আমার কিছু হয়নি? তাহলে চল যাই।”
“ আচ্ছা,আন্টিকে বলে আসি।”

পুষ্পিতা ছুটল। সেই চপল গতির দিক চেয়ে মুচকি হাসল নূহা।
পুষ্পিতার এমন চঞ্চলতা সে কোনওদিন দেখেনি। আগে কী বিষণ্ণ মুখে ঘুরত! ভয়ডরে চুপসে থাকত সারাদিন। এত হাসি তো দূরের কথা, তেমন কথাই বলত না।
আর আজ,এক সঠিক পুরুষের ছোঁয়ায় কতখানি বদলে গেছে! কী উৎফুল্ল!
বন্ধুর উচ্ছ্বাস দেখে নিজের কষ্ট বেমালুম ভুলে গেল নূহা। পুষ্পিতা ফেরত এলো
মিনিট কয়েকে। আয়েশা সবে শুতে যাওয়ায় সজাগই ছিলেন। এত রাতে ছাদে যাওয়া নিয়ে
প্রথমে দোনামনা করলেও, পুষ্পিতার মুখের ওপর বিশেষ আপত্তি করেননি।
মেয়েটা ছটফটিয়ে বলল,

“ আন্টি যেতে বলেছেন। তবে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। তাড়াতাড়ি চলে আসতে হবে।”
অনীহাতেও হাসল নূহা।
“ আচ্ছা,চল।”
পুষ্পিতা তক্কে তক্কে হাঁটছিল। ইচ্ছে করে পেছনে থেকে নূহাকে সামনে দিয়ে রাখল । ছাদের দরজার এখানে বাল্ব জ্বলছে। হলদে প্রভায় সব কিছু মোটামুটি পরিষ্কার দেখা যায়।
নূহা সেই আলো গায়ে মেখে চৌকাঠ পেরিয়ে পা রাখল ছাদে । কিন্তু পুষ্পিতা গেল না। দাঁড়িয়ে পড়ল দোরগোড়ায়। নূহা ভেতরের দিক এগোতেই সে ছুট লাগাল পালাতে।
পাশের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসা মানুষটার সাথে সময় মিলতেই শক্ত বুকে ধাক্কা লাগল জোরে। তোপে উলটে পড়তে ধরল পুষ্পিতা। তীব্র চট করে কনুই টেনে ধরে। পরপরই,দুষ্টু হাতটা ইচ্ছে করে কোমরে নিয়ে যায়। তারপর ঝট করে টেনে আনে কাছে। অস্থির পুষ্পিতাকে বলে,

“ রিল্যাক্স! এত ছোটাছুটি কীসের?”
মেয়েটা হাঁপ ছাড়ার বদলে গুটিয়ে গেল আরও।
লতানো কোমরে তীব্রর হাতের ছোঁয়া বৃহৎ করে তা। পুষ্পিতা আইঢাই করল হাত সরাতে।
তীব্র বুঝে নিলো। হাত সরাল সহসা৷ এতক্ষণে রুদ্ধ শ্বাস ঝাড়ল
পুষ্পিতা। ঠিকঠাক হয়ে দাঁড়াল। তীব্রর কণ্ঠ সাবলীল,
“ কটা বাজে এখন? বাইরে কী করছিলে?”
পুষ্পিতা অমনি উদ্বেল হয়ে উঠল। হড়বড়িয়ে বলল,

“ জানেন, নাহিদ ভাই মনে হয় নূহাকে কিছু একটা সারপ্রাইজ দেবে। আমাকে বলেছিল ওকে ছাদে নিয়ে আসতে। নূহা এত অবাক হবে না! আমার তো ভেবেই আনন্দ হচ্ছে।”
পুষ্পিতা যত প্রফুল্ল,ততোধিক সন্দেহী চোখে চাইল তীব্র। দুই ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“ সারপ্রাইজ দিচ্ছে নাহিদ! বাবাহ, আমার অবশ্য আগেই মনে হয়েছিল এদের মধ্যে কিছু একটা আছে।”
পুষ্পিতা মিহি স্বরে প্রতিবাদ করল,
“ একদম না। এমন কিছু হলে তো নূহা আমাকে বলত।”
“ এসব তোমাকে কেন বলবে?”
“ বারে! আমরা বেস্টফ্রেন্ড না?”
“ বেস্টফ্রেন্ড হলেই সব বলতে হয়? তুমিও বলবে।
“ হ্যাঁ, বলব তো।”
তীব্র কণ্ঠস্বর নেমে এলো হঠাৎ।
“ সব বলবে?”
“ হ্যাঁ।”
ডান ভ্রুটা তুলল সে,

“ সব? আমাদের মধ্যে যা হবে, সেটাও?”
পুষ্পিতা সাগ্রহে ঘাড় নাড়তে গিয়েও সতর্ক হলো৷ তীব্রর চোখমুখে পরিবর্তন নেই। অথচ ঠোঁটের ভাঁজে চকচক করছে দুষ্টুমি। কুণ্ঠায় পুষ্পিতার ধরণী দ্বিধা হয়ে যায়। তীব্র আরও কিছু বলতেই যাচ্ছিল,মেয়েটা সেই সময় দিলো না। হাঁসফাঁস করে মুখটা চেপে ধরল ওর।
মাথা নাড়ল ঘনঘন।
“ আর কিছু বলতে হবে না। চুপ করুন,চুপ করুন।”

নূহা যখন আবিষ্কার করল পেছনে পুষ্পিতা নেই,ততক্ষণে অনেকটা দেরি। সামনের পুরুষালি অবয়ব এগিয়ে আসছে এদিকে।
নূহা চমকে গেল খুব! চোখ বড়ো করে বলল,
“ আপনি?”
নাহিদের দুটো হাত পেছনে। পুরূ ঠোঁটে বাধ ভেঙেছে হাসির। ভীষণ উত্তেজিত সে,
“ শুভ জন্মদিন নূহা!”
নূহা বিস্ময়ে আকাশ থেকে পড়ল। বারোটা বেজে গেছে? আজ ওর জন্মদিন, সেজন্যই নাহিদ ঠিক এই সময়ে উইশ করতে এলো? ছেলেটার কাছে ও এতটা গুরুত্বপূর্ণ?
নাহিদ বাম হাতটা সামনে আনল তক্ষুনি।
এক থোকা গোলাপ তাতে। বলল নিষ্পাপের মতো,
“ সেদিন বুকেই থেকে গোলাপ বের করলেন না? তখনই বুঝেছিলাম এটা আপনার প্রিয় ফুল। তাই এত্ত গুলো এনেছি।”

নূহার ওষ্ঠপুট আলাদা হয়ে গেল।
স্তম্ভিত সে ভালোলাগার দোলায়। নাহিদ তাগিদ দিলো,
“ কী হলো, নিন।”
ও জড়ের মত হাতে নিলো ঠিকই। তবে আঙুল বোলাতেই কপাল গোছাল,
“ এগুলো তো নকল।”
“ হ্যাঁ, আর্টিফিশিয়াল। কিন্তু দেখতে আসল ফুলের মত না? অনেক খুঁজে পেয়েছি জানেন। ভাবলাম, গাছের ফুল দিলে আজকের পরেই নষ্ট হয়ে যাবে। আপনার জন্মদিনে আমার দেয়া প্রথম উপহার নষ্ট হলে চলে? তাই এমন কিছু এনেছি যেটা আপনার পছন্দও হবে,আবার সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দিতেও পারবেন। যখন এটা দেখবেন,মনে করবেন এই অধমের কথা।”

নাহিদ হেসে হেসে বললেও নূহার চোখদুটো টলমলে হলো।
পরক্ষণে উদাস হাসল সে। বোকা ছেলে! আমি তো তোকেই মনের মধ্যে সারাজীবনের জন্যে নিয়ে বসে আছি। আলাদা করে মনে করার কী আছে?
“ ওই হাতে কী?”
নাহিদ মনে পড়ার ভঙ্গি করে বলল,
“ ও হ্যাঁ। দাঁড়ান।”
ডান হাত সামনে আনতেই একটা ছোটখাটো কেকের দেখা মেলে। নূহা হাঁ করে বলল,
“ কেকও এনেছেন?”
নাহিদ সানন্দে জানায়,
“ অবশ্যই। আমি ভেবেই রেখেছিলাম জন্মদিনে আপনাকে সবার আগে কেক খাওয়াব। সেজন্যেই তো পুষ্পিতা…”
কথার ভেতর জ্বিভ কাটল ও,

“ সরি! সে তো এখন আমার হবু ভাবি। ওনাকে অনুরোধ করে আপনাকে এখানে এনেছি।”
নূহার হাসি বাড়ল পুষ্পিতার তখনকার কাণ্ড ভেবে। এজন্যেই ছাদে আসার এত পাঁয়তারা! যে মেয়ে আগে একটা মিথ্যে বলতে গেলে দশবার তোতলাতো, সে আজ পাকা অভিনয় করেছে। আর নূহা ধরতেই পারেনি?
এজন্যেই পেছন থেকে ভেগে গেছে গাধীটা।
তীব্র ভাইয়ার সাথে থেকে থেকে কত উন্নতি করেছে তাহলে!
নাহিদ বেশি সময় নিলো না। পকেট থেকে মোম বের করে ফটাফট বসিয়ে দিলো কেকে। তাড়া দিলো ফের,
“ নিন ফুঁ দিন। এত বাতাস না! নিভে যাবে। নিন নিন।”
নূহা মাথা নুইয়ে ফুঁ দেয়। সাথে সাথে নাহিদ চাপা কণ্ঠে আওড়াল,
“ হ্যাপি বার্থডে টু ইউ! হ্যাপি বার্থডে টু ইউ!”

তারপর কেক কাটল নূহা। দুদিকে ক্রস করে দুটো পোচ দিতেই নাগিদ ব্যস্ত ভাবে হাতে তুলল একটু।
সংকোচশূন্য বলল, “ হাঁ করুন।”
নূহা হাঁ করল । কেক খাওয়াতে গিয়ে ঠোঁটের ত্বকে লাগল অল্প! নাহিদ আজ হয়ত বেশিই যত্ন করার যুদ্ধে নেমেছে। একেবারে জড়োতাহীন সেটুকু মুছিয়ে দিলো সে।
নূহার সব কিছু থমকে গেল তখনই। টের পেলো গলবিলে কিছু কান্নারা কুণ্ডলী পাঁকিয়ে ঘুরছে। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার।
ওই যে সেদিন যেভাবে পুষ্পিতাটা তীব্র ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে শার্ট ভেজাল? ঠিক অমন।
নাহিদ হাস্যোজ্জ্বল আননে ভ্রু উঁচায়,

“ খুব অবাক হয়েছেন, তাই না? হু হু মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।”
কথার পিঠে যুতসই উত্তরটা এলো না। কেমন আচমকা বলে বসল নূহা,
“ মিস্টার ঢেঁড়স, আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরব আমি?”
নাহিদের হাসি মুছল। হকচকাল তার উজ্জ্বল চেহারা। মূকের ন্যায়
চেয়ে থাকার মাঝেই নূহা জড়িয়ে ধরল ওকে৷ ছেলেটা স্তব্ধ হয়ে পড়ে। শক্ত হয় পোক্ত দেহ। সেকেন্ড দুয়েক কাটল হয়ত। যেভাবে ধরেছিল, ওভাবেই বুকে থেকে সরে এলো নূহা। বিহ্বল নাহিদের সাথে চোখ মেলানোর সাধ্য তার নেই। বরাবরের কাঠখোট্টা মেয়েটা আজ যেন পুষ্পিতার মতোই মূর্ছা যাচ্ছে লাজে।
ছুট্টে যাবে ভেবেও দাঁড়িয়ে গেল আবার। জ্বিভে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

“ আমি কথা না বললে আপনার খারাপ লাগে। রাগ করলে ঘুম আসে না। আমার জন্যে কেক এনেছেন, সবার আগে খাওয়াবেন ভেবে। জন্মদিনের উইশটা অবধি করলেন সবার প্রথমে। এসবের কারণ কি শুধুই বন্ধুত্ব নাহিদ? একবার ভাববেন। প্লিজ ভাববেন।”
তারপর পালিয়ে গেল নূহা। নাহিদ যদি প্রশ্ন করে,সেই ভয়ে।
কিন্তু অনুভূতি থেকে কি আর পালানো যায়?
পরদিন,

আয়েশার সাথে সব কিছুর বন্দোবস্ত নাহিদকেই করতে হচ্ছে। বুধবার হওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা। আয়েশা হাফ বেলা ছুটি নিলেন তাও। বাসার কাজ রাতে এগিয়ে রেখে অফিস থেকে দুপুরের পর ফিরলেন।
সন্ধ্যায় আয়োজন গাঢ় হলো। সারা বাড়ির ভেতর মরিচ বাতির আলো আর বিরিয়ানির কড়া গন্ধ ছুটে বেড়াচ্ছে।
পুষ্পিতা থেমে নেই। সব কিছুর জন্য লোক আলাদা, অথচ কোনাকানি থেকে কাজ খুঁজে আনছে মেয়েটা। আয়েশা কতবার মানা করলেও শুনছে না। শেষে, ঠেলে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন তিনি। আদেশ করলেন শক্ত করে,
“ এখন মেহমান আসা শুরু হবে। যাও, তৈরি হও!”

পুষ্পিতা ঘরে এসে দেখল নূহা বোম হয়ে বসে। তার মন ভালো নেই। চিত্ত গগণে গুরুগম্ভীর মেঘ জমেছে আজ। কাল রাতের ওই কাজটা একদম উচিত হয়নি। পুষ্পিতা না হয় ইমোশনাল। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিন্তু ওতো এমন নয়৷ প্রেমে পড়তেই এত হাবলা হয়ে গেল? এখন অবধি কিচ্ছু না হতেই জড়িয়ে ধরল নাহিদকে? এখন লোকটার সাথে চোখ মেলাবে কী করে?
নূহার জন্যে আয়েশা পছন্দ করে একটা সাদা গাউন কিনেছেন। আজকের দিনেই তো জন্মেছিল মেয়েটা। শূন্য কোল আলোয় ভরিয়ে পূর্ণ করেছিল তাকে।

সাদার মত শুভ রং গায়ে জড়িয়ে রাখুক। নূহার সব কিছু বিষাদ ঠেকলেও, মায়ের কথা ভেবে তৈরি হয়েছে।
পুষ্পিতা একবার ভাবল, কথা বলবে। পরক্ষণে ঠোঁট টিপে নিলো।
একটু আগে যখন এসেছিল,নূহা বলেছে একটু একা ছেড়ে দিতে।
কী যে হলো মেয়েটার! জিজ্ঞেস করলে কিছু বলছেও না।
পুষ্পিতা শ্বাস ঝেড়ে নিজের কাজে মন দিলো।
ও একেবারেই সাজগোজ করে না। আজ অবধি ভারী চেহারায় মেকআপ কখনও ছোঁয়ায়নি । একটু কাজল,আর কখনও ছোট্টো একটা টিপ।
কিন্তু আজকে কী হলো কে জানে!

নিজে থেকে মন ভরে সাজল পুষ্পিতা। লাল টুকটুকে জামার সাথে বড়ো দুটো ঝুমকা ঝোলাল কানে। ঠোঁট ভরে লিপস্টিক পড়ল। চোখে গাঢ় কাজলের সাথে দুহাত ভরতি চুড়ি। পিঠ সমান চুলগুলো ক মাসে বড়ো হয়েছে কিছুটা। সর্বক্ষণ বেঁধে রাখা ওদের আজ খুলে দিলো হাওয়ায়।
নূহা মনমরা হয়ে বসেছিল। টুংটুং শব্দ শুনে ঘাড় ফেরাল এমনি। পরিপাটি পুষ্পিতাকে দেখেই
ঝটকা লাগল চোখে। আর্তনাদ করে বলল ,

“ এ কী! এ আমি কাকে দেখছি?”
পুষ্পিতা ঘাবড়ে গেল। বোকা বোকা চোখে বলল,
“ ভালো লাগছে না,তাই না?”
বসা থেকে তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেল নূহা। এক লাফে ওর সামনে এসে দাঁড়াল। কণ্ঠ শৃঙ্গে তুলে বলল,
“ এটা কে? আমার ঘরে তো আকাশের চাঁদ নেমে এসেছে।”
ইঙ্গিত বুঝে লজ্জা পেলো পুষ্পিতা। চিত্তে মৃদূ দ্বিধাদ্বন্দ্ব,
“ সত্যিই ভালো লাগছে?”
“ ভালো? কী যে সুন্দর লাগছে তোকে কীভাবে বোঝাব। এরকম একটু সেজেগুজে থাকলেই তো পারিস। আল্লাহ রূপ দিয়েছেন বলে কি যত্ন করবি না? তুই আজ বাইরে যাস না বুঝলি। যদি জিন-ভূতের নজর পড়ে।”
“ ধ্যাত!”
নূহা চিবুক তুলল আঙুলে। কণ্ঠ সন্দিহান,

“ সত্যিই করে বলতো, আজ হঠাৎ এত সাজের ঘটা কেন? বিশেষ কারো জন্যে?”
পুষ্পিতা চিবুক গলায় নিয়ে মাথা ঝাঁকাল। নূহা হাসল। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলল,
“ তোদের পাশাপাশি দেখতে আমার যে কী ভালো লাগে! চোখটা জুড়িয়ে যায় বুঝলি! দোয়া করি,তোদের সম্পর্কে কারো নজর না লাগুক!”

এর মধ্যে ও ঘর হতে হাঁক ছুড়লেন আয়েশা। ডাকছেন নূহাকে। ফুপি এসেছে ওর।
পেছন পেছন পুষ্পিতাও এলো। আয়েশা অবাক হয়ে বললেন,
“ বাহ! সুন্দর লাগছে তো তোমাকে! আমার একটা ছেলে নেই বলে কিন্তু সত্যিই আফসোস হচ্ছে আজ।”
পুষ্পিতা ভীষণ লজ্জা পেলো! কী একটু সেজেছে,তাতে সবার কত প্রসংশা! কিন্তু যার জন্যে এত কিছু, সে কোথায়?
সদর দরজা আজকে খুলেই রাখা। ছাদে সব তদারকির জন্যে এতবার যাতায়াত করতে হচ্ছে! এক পাশে রান্না চলছে। অন্যপাশে কটা চেয়ার-টেবিল বসানো। শুধু কেক কাটা হবে বসার ঘরে।
আর সেই কেক আনার দায়িত্ব নিয়েছে, তীব্র স্বয়ং। নাহিদ খুব ব্যস্ত আজ! শ্বাস ফেলতেও পারছে না। তাই সে নিজেই আনতে গেল। নূহার প্রতি তীব্রর বেশ সফটকর্ণার আছে। মেয়েটা সাহায্য না করলে ভীতু মেয়েকে পাওয়ার পথ এমন সহজ হোতো?

কেক আনতে সময় লাগেনি। জিপ নিয়ে উড়ে এসেছে তীব্র। সিঁড়ির সবশেষ উঁচু ধাপে পৌঁছালে আপনাআপনি চোখ পড়ল ভেতরে। খোলা দোরের ওপাশে, লাল জামায় মোড়ানো পুষ্পিতাকে দেখে পা জোড়া তার থমকে গেল সেখানেই। তীব্র হাঁটা থেকে দাঁড়িয়ে যায় । বক্ষভাগে কিছু একটা দুম করে লাগে। টালমাটাল আঙুল হতে কেকের বড়ো প্যাকেটটা খসে পড়তে চাইলে, কোনও রকম সামলে নিলো সে। পুষ্পিতার খোলা চুল ফ্যানের বাতাসে উড়ছে। পুরন্ত ঠোঁটের লিপস্টিক, সাথে মৃগনয়নের কাজল? সব মিলিয়ে বিমোহে তীব্রর শ্বাস আটকে এলো। বিলাতি নয়ন ঝলসে গেল সুরূপার রূপের তাপে।

মেয়েটা এত সেজেছে কেন আজ? এমনিতেই ওকে একটু ছুঁতে,একটু কাছে পেতে তীব্রর পৌরুষ ছটফটিয়ে থাকে। কত যত্নে,নিবেশনে নিজেকে আয়ত্বে রাখে, কেউ জানে না। সেখানে এমন মাতাল করা রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে কেন? চায়টা কী?
তীব্র আরেকদিক ফিরে ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। চোখ বুজে সামলাল নিজেকে। কোনওরকম হেঁটে হেটে ঘরে ঢুকল তারপর। বিধিবাম! চোরা নজর বারবার পুষ্পিতাতে ঘুরছে।
মেয়ে কাজে ব্যস্ত তখন। অতিথি যারা এসেছেন পায়েস দিচ্ছে তাদের।
তীব্রকে দেখেই আয়েশা বললেন,

“ ওইতো, তীব্র এসেছে।”
চকিতে চাইল পুষ্পিতা। চোখাচোখি হতেই হাসল ঠোঁট মেলে।
এত মানুষ বিধায় পারল না কাছে ছুটে যেতে।
তীব্র শুধু একবার তাকাল। এরপর ভান করল পুষ্পিতা বলতে এখানে কেউ নেই। কেক আয়েশার হাতে দিয়ে,এসে বসল সোফায়।
ভদ্রমহিলা শ্বশুর বাড়ির লোকদের সাথে ওর গুণগানে মশগুল হয়ে পড়লেন। এমন সুদর্শন শিক্ষিত ছেলে দেখে সবাই আপ্লুত,গদগদ।

কিন্তু তীব্রর মন কি এসবে আছে?
সামনে ঘুরঘুর করা মেয়েটাতে পূর্ণ দৃষ্টি বেহায়ার ন্যায় ঘুরছে তার।
সাতটা বাজতেই কেক কাটার হিড়িক উঠল। বসার ঘরে ছোটোখাটো জটলা বাঁধল নিমিষে। নূহা কেকের সামনে দাঁড়িয়েও আনচান আনচান করছে। চারপাশের লোকজন পেরিয়ে উৎসুক চোখদুটো দেখছে সদর দরজার দিকে। নাহিদ আসবে না?

আজ সারাদিন মানুষটা ওর সাথে কথা বলেনি। নূহার পরিতাপ বাড়াতে তাকায়ওনি তেমন।
এই দুই বন্ধু কী শুরু করেছে? পালা করে করে এত জাল্বাচ্ছে কেন ওদের? তার আশার আলো জ্বলল শেষে । একটু বাদেই নাহিদকে ঘরে ঢুকতে দেখা যায়। আয়েশা নিজে ডেকে এনেছেন।
এতক্ষণে যেন বুকের ভার ভার ভাবটা নেমে গেল
নূহার। হাসি হাসি মুখে কেক কাটল সে। সবাই হাত তালি দেয়। সমস্বরে শুভেচ্ছা জানায় জন্মদিনের।
পুষ্পিতার চোখ তীব্রর ওপর। মানুষটা এসে থেকেই ওকে ভালো করে দেখছে না। কেন? নূহা তো বলল সুন্দর লাগছে। আন্টিও বললেন। তবে স্যারের কি ভালো লাগেনি?
পুষ্পিতার একটু মন খারাপ হলো। হঠাৎ কানে গেল ফোন বাজছে ওর।
এখন কে ফোন করবে?

বাটন ফোনের রিংটোনের শব্দ বেশ কড়া। এত ভিড়েও ও ঘর হতে এখানে ছুটে আসছে।
পুষ্পিতা জটলা ছেড়ে বেরিয়ে এলো। রওনা করল কামরায়। অমনি আরেক জোড়া পা সাথে সাথে চলল তার।
ফোন বিছানায় রাখা। হাতে তুলতেই অবাক হলো পুষ্পিতা। তীব্রর নম্বর! আশ্চর্য! স্যার তো ওখানেই ছিলেন। আবার কল করলেন কেন?
পুষ্পিতা প্রশ্ন আর বিভ্রান্তিতে ডুবছিল। আচমকা কানে এলো রুমের দরজাটা খট করে আটকে যাওয়ার শব্দ। ত্রস্ত পিছু ফিরল সে। তীব্র পা দিয়ে দোর ঠেলে দিয়েছে। অমনি মেয়েটা বলতে গেল,
“ স্যার ফোন.”

কিন্তু পুরোটা সম্পূর্ণ হলো না। তীব্রর চোখের ভাষায় বদলে গেল সব।
মৃগের ন্যায় আঁখি জোড়ায়,ঠেসে এলো জড়োতা।
তীব্র এগিয়ে আসছে।
প্রেমিকের এই নজর পুষ্পিতা বোঝে। মেয়েলি দেহে এমন চাউনী কাঁটা ফোটাতে যথেষ্ট যে!
শুধাল থেমে থেমে,
“ ককিছু বলবেন স্যার?”
তীব্রর জবাব এলো না।
পুষ্পিতার শঙ্কা গাঢ় হলো। বাড়ি ভরা অতিথি! এর মধ্যে স্যার আর ও এক ঘরে। কেউ দেখে নিলে!”
ভাবনার মধ্যেই কপালের ওপর কিছু উষ্ণ হাওয়ার ঝটকা এসে লাগে। ওপাশের শরীরটা কেমন কাছে চলে এসেছে। পুষ্পিতা ভড়কে গেল ভীষণ। প্রকট চোখে দরজার দিকটা দেখল এক বার।
চাপা কণ্ঠে বলল,

“ স্যার,সরে দাঁড়ান! কেউ দেখবে।”
তীব্র শুনল না। নিজের মত বলল
“ একটা কথা বলার আছে।”
পুষ্পিতা ভীত চোখে শুধায়,
“ ককী কথা?”
তীব্রর কণ্ঠে মাদকতার সুর,
“ তুমি মানুষ না পরী?”
পুষ্পিতার আশঙ্কা পালটে গেল ব্রীড়ায়। তনুমনে শিরশিরে ভাব।
মাথা নুইয়ে বলল,
“ আপনার কী পছন্দ?”
তীব্রর জবাব তৈরি,
“ আমার তো গোটা তুমিটাই পছন্দ।”

পুষ্পিতা বুকের উত্তালতা কমাতে হাতের আঙুল কচলে গেল সমানে। থুতনি তখন বক্ষপটে মিশে।
তীব্রর বিলাই চোখে অন্য কিছু আজ। হয়ত প্রখর কোনও কামনা। যা নজরে মিলে আবর্ত হলো পুষ্পিতার সমস্ত আনন জুড়ে। আরেকটু ঘনিষ্ঠ হতেই মেয়েটার পিঠ মিশল খাটের কাঠে গিয়ে।
কাঁপা চোখ তুলল।
তীব্রর মাঝে রাখ-ঢাক নেই। শূন্যের কোঠায় সরে যাওয়ার তাড়া। আশঙ্কা নেই কারো ভাবাভাবি নিয়ে।
আজ সে প্রেমিক! ভালোবাসার যুদ্ধে জেতা এক সাহসী বীরের ন্যায় পুষ্পিতার ক্ষুদ্র চেহারায় দেহ নামিয়ে আনল। সুনয়নার ঘন পল্লবে দৃষ্টি গেঁথে ডাকল,

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৫

“ ভীতু মেয়ে!”
পুষ্পিতার উত্তর জড়িয়ে এলো,
“ হহুঁ!”
“ আমায় একটা চুমু ধার দেবে? কথা দিচ্ছি,এক্ষুনি ফেরত দিয়ে দেবো।”

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৭