মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ২২
নুজাইফা নূন
-” সাইফান পর্দা সরাতে ইতস্তত বোধ করছে দেখে সামিরা তাদের মাঝখান থেকে পর্দা সরিয়ে দিলো।পর্দা সরাতেই যেন সাইফানের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।আবারো আশাহত হয় সে।সিজদার মাথায় ঘোমটা টানা রয়েছে।সাইফান ভেতরে ভেতরে তার প্রেয়সীর মুখখানা দেখার জন্য ছটফট করলেও কিছু না বলে কাঙ্খিত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। অবশেষে সেই কাঙ্খিত মূহুর্ত উপস্থিত হলো।সিজদা সাইফান তিন কবুল বলে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো।বিয়ের কার্যক্রম শেষ হতেই সামিরা একটা বড় আয়না এনে তাদের সামনে ধরলো।সাইফান সিজদা আয়নার মধ্যে প্রথমবারের মতো দুজন দুজনকে দেখলো।সিজদার দিকে তাকিয়ে সাইফানের যেন নেশা ধরে গেলো। পাশ থেকে সামিরা বললো,
-” আয়নায় কাকে দেখছো ভাইয়া।”
-” আমার মনের রাজ্যের রানী কে বলে
সাইফান মিটমিট করে হেসে মনে মনে বললো,
-” আমি জিতে গিয়েছি মামা।কালা হয়েও এতো ভালো বউ পাবো এটা তো স্বপ্নেও ভাবিনি।আমার মন টা তো পেখম তুলে নাচতাছে।সাইফান কে হাসতে দেখে সামিরা বললো,
-দিল্লি কা”লাড্ডু খাচ্ছো নাকি মনে মনে?”
-” তুই কিন্তু বড্ড বাড় বেড়েছিস সামিরা।বড় ভাইয়ের সাথে মশকরা করছিস?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” সামিরা কিছু বলার আগে ফটোগ্রাফার এসে হাজির হয়। শুরু হয় ফটোশুট। খাওয়া দাওয়া, ফটোশুট, নাচ গান, হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে সময় যেন খুব দ্রুত কেটে যায়।ঘনিয়ে আসে বিদায় বেলা।সিজদার দুচোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়ছে।সালেহা বেগম সিজদা কে জড়িয়ে ধরে চোখে মুখে অজস্র চুমু খায়।তার বুক ও কষ্টে ফেটে পড়ছে।সিজদা কে সে তার নিজের মেয়ের মতো করেই এতো বছর আগলে রেখেছে। রাশেদ চৌধুরী এসে সিজদার হাত সাইফানের হাতের উপর রেখে দিয়ে বললো,
-” আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো বাবা।কখনো কষ্ট দিয়ো না।মেয়েটা বড্ড চাপা স্বভাবের। নিজের ভেতরের রাগ ,কষ্ট , অভিমান সবটা নিজের ভেতর পুষে রাখে।কখনো কাউকে বুঝতে দেয় না।”
-” আপনি চিন্তা করবেন না মামা।সিজদার রাগ , কষ্ট, অভিমান বুঝতে দিতে হবে না।আমি নিজেই বুঝে নিবো।আমি আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করবো আপনার মেয়েকে সুখে শান্তিতে রাখার।যে হাত একবার ধরেছি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই হাত ছাড়বো না।আপনি নিশ্চিতে থাকতে পারেন মামা।”
-” আমি মনে মনে এতো দিন সিজদার জন্য তোমার মতোই একটা ছেলে খুঁজছিলাম।এবারে আমি একটু শান্তি তে থাকতে পারবো বলতে বলতে চোখ ভিজে উঠলো রাশেদ চৌধুরীর।সিজদার কান্না থামছেই না।সালেহা বেগম কে জড়িয়ে ধরে কান্না করেই যাচ্ছে। সারাদিন কান্না করার দরুন সিজদা নাক লাল টুকটুকে হয়ে গিয়েছে।চোখ দুটো ফুলে উঠেছে। তবু ও তার কান্না শেষ হচ্ছে না।সিজদা খুব করে চাইছিলো বিথী চৌধুরী এসে তাকে একটু বুকে জড়িয়ে নিক। কিন্তু বিথী চৌধুরীর দেখা মেলে না।সালেহা বেগম অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে সিজদা কে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসে।সিজদা তখনো কেঁদেই চলেছে।সাইফান সিজদার হাতের উপর হাত রাখতে গিয়েও বারবার হাত সরিয়ে নেয়।সীজদার চোখের পানি সহ্য হচ্ছে না তার। খুব ইচ্ছে করছে নিজের হাতে সিজদার চোখের পানি মুছে দিতে। সাইফান নিজের ইচ্ছা কে দমিয়ে রেখে পকেট থেকে রুমাল বের করে সিজদার সামনে ধরে বললো,
-” চোখের পানি মুছে নাও।”
-” সিজদা একবার সাইফানের দিকে তাকিয়ে তার হাত থেকে রুমাল নিয়ে চোখ মুছে নিলো।কান্না থেমে গেছে তার। কিন্তু মাঝে মধ্যে হেঁচকি উঠছে।সিজদার এই অবস্থা দেখে সাইফান আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না।সাইফান সন্তর্পণে সিজদার এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিলো।সিজদা সাইফানের হাত ধরে তার নতুন ঠিকানায় রওনা হয়।।”
-” ফুলে ফুলে সজ্জিত বিছানায় এক হাত ঘোমটা টেনে বসে রয়েছে সিজদা।বাহারি রঙের ফুল দিয়ে বাসর ঘর সাজানো হয়েছে। চারিদিকে ফুলের তাজা ঘ্রাণের মৌ মৌ গন্ধ ভেসে আসছে সিজদার নাকে।শুভ্র রাঙ্গা বিছানায় লাভ শেইপ করে তার মধ্যে S+ S লিখে রাখা হয়েছে।ঘরের দেয়াল ও কর্ণারে কালারফুল লাইটিং করা হয়েছে।সেখান থেকে মৃদু আলো ছড়িয়ে পড়েছে রুমের চারিদিকে।সেই সাথে উঠানামা করছে সিজদার বক্ষঃস্থল। অজানা ভয় জেঁকে বসেছে তার ভিতরে। স্বামী নামক অপরিচিত ব্যক্তি টাকে নিয়ে নানান ধরনের চিন্তা ভাবনা আসছে সিজদার মনে। চোধুরী ভিলার পাশের ফ্ল্যাটে রত্না নামে একটা মেয়ে কাজ করতো।সিজদার সাথে ভালো সম্পর্ক ছিলো তার। রত্না সিজদা কে বলেছিলো তার বাসর রাতের কথা।তার স্বামী নামক ব্যক্তি টার পশুর মতো তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে খুবলে খুবলে খাওয়ার কথা।সেসব কথা মনে পড়তেই সিজদার ভয় আরো বেড়ে গেলো। হার্ট বিট দ্রুত গতিতে লাফাতে শুরু করলো।সিজদার ভাবনার মাঝেই খট করে দরজা খোলার আওয়াজ হয়। ভয়ে কেঁপে উঠে সিজদা।খামচে ধরে শাড়ির আঁচল।কপাল থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম বের হয়।”
-” সাইফান দরজা লক করে মাথার পাগড়ি খুলে সোফার উপর রেখে আলমারি থেকে একটা প্যাকেট বের করে সিজদার পাশে গিয়ে বসে।সিজদা সাইফানের উপস্থিত টের পেয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে সাইফান কে সালাম দেয় ।সিজদার কণ্ঠস্বর শুনে ভালো লাগা ছেয়ে গেলো সাইফানের মনে।আহা্ কি মিষ্টি কন্ঠস্বর।সাইফান সালামের উত্তর নিয়ে বললো,
-” আজ সারারাত কি এভাবেই ঘোমটা দিয়ে রাখার পণ করেছো? অবশ্য তুমি চাইলে ঘোমটা দিয়ে থাকতেই পারো।আমার কোনো সমস্যা নেই।”
-” সাইফানের কথা শুনে সিজদা তড়িৎ গতিতে
মাথার ঘোমটা সরিয়ে নিলো। সিজদা ঘোমটা সরাতেই সাইফানের মনে হলো যেন তার ঘর আলোকিত হয়ে উঠেছে।সাইফান মুগ্ধ দৃষ্টিতে সিজদার দিকে তাকিয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ।তার চোখের পলক যেন পড়তেই চাচ্ছে না।সাইফানের এহেন কার্যে সিজদার লজ্জা, অস্বস্তি টের পেয়ে সাইফান চোখ নামিয়ে নিয়ে সিজদার সামনে প্যাকেট টা রেখে দিলো।সিজদা প্যাকেট টা নেড়েচেড়ে দেখে বললো,
-” কি এটা?”
-” আমার তরফ থেকে তোমার জন্য প্রথম গিফট।তবে এখন এটা খুলবে না।আমার ছুটি শেষ হলে যখন আমি চলে যাবো।তখন খুলে দেখবে।”
-” আচ্ছা।”
-”আই থিংক বেনারসী পরে থাকতে তোমার সমস্যা হচ্ছে। তুমি চাইলে চেঞ্জ করে নিতে পারো। তুমি যে পোশাক পরতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করো।সেই পোশাক ই পরো।”
-” আচ্ছা।”
-” তোমার যদি কোন সমস্যা না থাকে ।তাহলে আমরা আমাদের নতুন জীবন শুরু করার আগে দু রাকাত নফল নামাজ আদায় করতে পারি।”
-” ঠিক আছে বলে সিজদা বিছানা থেকে নেমে লাগেজ থেকে একটা সুতি থ্রিপিস নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলো।প্রায় দশ মিনিট পর সিজদা শাড়ি চেঞ্জ করে মুখের মেকাপ ধুয়ে অজু করে ওয়াশরুম থেকে বের হয়।সিজদা কে দেখে বুকে কাঁপন ধরে সাইফানের।সিজদার প্রতিটি রুপেই বিমোহিত হয়ে যাচ্ছে সাইফান।মেকাপহীন সিজদা কে সাইফানের চোখে আরো স্নিগ্ধ, মহোনীয় লাগছে।সিজদা বের হতেই সাইফান বললো,
-” চলো শুরু করি।”
-” জ্বি বলে সিজদা সাইফান দুজনেই নামাজে দাঁড়িয়ে যায়।নামাজ শেষ হলে সাইফান সিজদার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-” আজ সারাদিন নিশ্চয় কিছু খাওয়া হয় নি?চোখ মুখ শুকিয়ে মলিন হয়ে গিয়েছে। টেবিলের উপর খাবার রাখা আছে।খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ো।”
মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ২১
-” কোথায় ঘুমাবো আমি?”
-” কেন খাটে?”
-” আমি খাটে থাকলে আপনি কোথায় থাকবেন?”
-” আমি ও খাটেই থাকবো।”
-” খাটে কথাটা শুনে মুখটা চুপসে গেল সিজদার। অজানা ভয়, শঙ্কায় গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠে তার।”
