রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২০ (২)

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২০ (২)
সিমরান মিমি

রৌদ্রজ্জ্বল সকাল।ঘড়ির ঘন্টার কাঁটা’টা তখন দশ টার ঘরে। আর্শিকে নিয়ে আলতো পায়ে ব্রিজের দিকে এগোচ্ছে স্পর্শী।ব্রিজের ওই পাশেই রিকশা স্ট্যান্ড।সামনে আরেকটু আগাতেই দেখলো এক কলেজ পড়ুয়া মেয়ে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছে।গায়ে সাদা ইউনিফর্ম। স্পর্শী এগিয়ে গেল তার দিকে।আলতো হেসে বললো,
“হ্যালো বুনু।”
মেয়েটি একঝলক স্পর্শীর দিকে তাকালো।দেখে তো মোটেই পরিচিত লাগছে না তার কাছে।তারপরেও সে বললো,
“হায়।আপনাকে তো চিনলাম না।”
স্পর্শী হাসলো।মেয়েটা দেখতে অনেক টা কিউট।এই যে মুখের এক্সপ্রেশন এটা দারুণ লাগছে স্পর্শীর কাছে।চঞ্চল কন্ঠে বললো,

“আমাদের চিনবে না।ঢাকা থেকে এসেছি।শোন,তুমি একটু সরদার বাড়ির ঠিকানা টা বলতে পারবে আমায়?ওই যে সাবেক এমপি শামসুল সরদার ওনার কথা বলছি।কোন রাস্তা দিয়ে যেতে হয় সেটা বললেই হবে।”
হাস্যোজ্জ্বল কিউট চাঁদের মতো মুখ টায় মুহুর্তে ‘ই অমাবস্যা ঘিরে ধরলো।তার মুখভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছে সে এই মুহুর্তে রেগে গেছে। কিন্তু হঠাৎই এই রাগের কারন বুঝতে পারলো না স্পর্শী।মেয়েটা তাকে মুখ ঝামটা মেরে বললো,
“জানিনা।”
পরক্ষণেই হনহন করে কলেজের মধ্যে চলে গেল।স্পর্শী অবাক হলো।মনে মনে বললো,”আজব এক জায়গায় চলে এসেছি।এখানকার সবাই ‘ই কি পাগল নাকি?আশ্চর্য! ”
ফুচকা ওয়ালা বেশ কিছুক্ষণ ধরে স্পর্শীর দিকে চাইছে।এবারে বলেই ফেললো,
“কি হইছে আপা?”
স্পর্শী তার দিকে তাকিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“বুঝতে পারলাম না মামা।আমি শুধু এটা বললাম যে ‘সরদার বাড়িটা কোনদিকে তার রাস্তাটা দেখিয়ে দিতে।আর ওমনি এমন করলো।”
ফুচকাওয়ালা হেসে ফেললো।বললো,
“আরে আপা আপনার’ই তো ভুল।ওই মাইয়া তো পরশ শিকদারের বইন।যে কিনা এইবার এমপি হইছে।শিকদার দের বিরোধী পক্ষ তো সরদার। এইজন্য রাগ করছে।”
স্পর্শী ছোট ছোট চোখ দিয়ে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“অসভ্য মেয়ে,আমার বাপের গোষ্ঠী শুনে এমন ভান করলো গা জ্বলে যাচ্ছে আমার।ইচ্ছে করছে ঠাস করে একটা চটকানা লাগাই দেই গালে।একদম ওর ভাইগুলোর মতো হয়েছে।”
আর্শির মন খারাপ হলো।বোনের দিকে তাকিয়ে মলিন কন্ঠে বললো,

“কিন্তু পাভেল ভাই ভালো।উনি অন্যসবার মতো না।”
মুহুর্তেই ধমক মারলো স্পর্শী।বললো,
“এই তুই চুপ থাক।সব ভাইকে চিনি আমি।আমাকে মানুষ চেনাস না।তোর থেকে কমপক্ষে সাড়ে চার বছর আগে আমি পৃথিবীতে এসেছি।”
আর্শি মুখ চেপে হাসলো।বললো,
“আপু,তুমি আম্মুর মতো ডায়লগ দিচ্ছো।”
হেসে দিলো স্পর্শী।এরপর কৌতুহলী হয়ে বললো,

“এই একটা জিনিস দেখেছিস।ওরা তিন ভাই ছিলো।আরো একটা বোন পেলাম।এখন এক হালি হলো। না জানি আরো কতগুলো আছে।মাই গড!একবার ভেবে দেখেছিস?নিশ্চয়ই ওদের বাপ সুবিধার ছিলো না।আস্তাগফিরুল্লাহ!আস্তাগফিরুল্লাহ!
দু-বোনে হাসতে হাসতে দু প্লেট ফুচকা খেল।এরপর ফুচকাওয়ালাকে সরদার বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলে দিলেন।খাওয়া শেষে পুণরায় ব্যাগ কাধে নিয়ে চললো স্ট্যান্ডের দিকে।দু মিনিটের মধ্যে ব্রিজের এপাশে এসে পৌছালো।রিকশাওয়ালা কে বলতেই তিনি চললো সরদার বাড়ির দিকে।মিনিট পাঁচেক রিকশা চলার পর’ই থেমে গেল চালক।সিট থেকে নেমে বললো,

” নামেন,আইয়া পড়ছি। ওই যে সামনের বড় গেট’টা দেখতেছেন ওইডাই সরদার বাড়ি।”
রিকশা থেকে নেমে পড়লো দু-বোন।ভাড়া মিটিয়ে সামনে আগাতে লাগলো।বুকের ভেতর দুড়ুমদুড়ুম করে হাতুড়ি পেটাচ্ছে। অজানা একটা অনুভূতি ঘিরে ধরেছে তাদের।হাত পা ক্রমশ কাঁপছে।এটা তাদের বাড়ি।তাদের ঘর।অথচ ভাগ্যের কি লীলা।আজ বছরের পর বছর তাদেরকে বাসা ভাড়া করে থাকতে হচ্ছে।যেখানে রাজকন্যার মতো থাকার কথা সেখানে দিনের পর দিন লোকাল বাসে পুরুষের হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে।চোখ ভরে এলো স্পর্শীর।আর্শি একধ্যানে চতাকিয়ে রইলো সাদা বাড়িটার দিকে।বাড়ির সামনের অংশটায় সাদা চুনাপাথর ব্যাবহার করতে হয়েছে।অবাক হয়ে স্পর্শীকে বললো,

“আপু দেখো একদম প্রাসাদের মতো।এটা আমাদের বাড়ি।”
বলেই উৎফুল্ল হয়ে হেসে ফেললো। স্পর্শী তাকালো।বললো,
“অনেক পুরোনো আমলের বাড়ি তো। এই জন্যই আগের দিনে জমিদার দের মতো প্রাসাদ বানানো হয়েছে।এখনকার সব বাড়িই তো ডুপ্লেক্স। তবে যাই বলিস, রুচি আছে বলতে হবে।”
মেইন গেটের দারোয়ান গেটের ভেতর দিকে বসে বসে ঝিমুচ্ছিলো।হুট করেই চোখ খুলে দুটো মেয়েকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কি চাই?”
স্পর্শী দারোয়ানের উদ্দেশ্যে বললো,

“আমরা শামসুল সরদারের কাছে এসেছি।উনি তো পূর্বে এমপি ছিলেন।ওনার সাথে ই কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছি।উনি কি বাড়িতে আছেন?”
দারোয়ান মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বললো।পরক্ষণেই জিজ্ঞেস করলো,
“আপনারা ওনার কি হোন?কোনো সমস্যা থাকলে পার্টি অফিসে অপেক্ষা করেন এইভাবে বাড়ি পর্যন্ত চইলা আসছেন কেন?”
স্পর্শী কিছুটা বুঝতে পারলো।নিশ্চয়ই সবার বাড়ির মধ্যে ঢোকার অনুমতি নেই।তাই হয়তো দারোয়ান দোটানায় পড়েছে।এ পর্যায়ে কন্ঠকে উচ্চে উঠিয়ে জোরালো গলায় বললো,
“আমি ওনার পরিচিত।আত্মীয় হই।আপনি গেট খুলবেন কি না?নাকি আমি ওনাকে এখানে ডাকবো এরপর আপনাকে বকাবকি করলে কিন্তু আমার দোষ নাই।”
লোকটি ঘাবড়ে গেল মনে হচ্ছে।এ পর্যায়ে গেট খুলে দিয়ে বললো,
“আগে বলবেন না আপনি বড় সাহেবের আত্মীয়।”

স্পর্শী আর কিচ্ছু বললো না।সোজা বাড়ির দিকে চলে গেল।বিশাল এরিয়া নিয়ে বাড়ি টি তৈরী করা।গেট থেকে ঢুকেই দুপাশে নানা ফুল এবং ফলের বাগান।মাঝখান দিয়ে রাস্তাটা।এবং রাস্তার শেষ প্রান্তে বাড়িটি অবস্থান করছে।বাড়ির সামনে আসতেই দেখলে ডান পাশে গাড়ি রাখার গ্যারেজ। সদর দরজায় ঢুকতেই দেখলো ভেতর থেকে বন্ধ।দরজার বাম পাশের কলিং বেল টিপতেই ওপাশ থেকে দরজা খুললো।বেশ লম্বাচওড়া একজন সুদর্শন মধ্যবয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছে ওপাশে।স্পর্শী তাকে দেখে আলতো হেসে সালাম দিলো। পরক্ষণেই বললো,
“আমরা কি ভেতরে আসতে পারি?”

লোকটি খানিক’টা ভাবনায় পড়লো।হুট করেই অচেনা কেউ বাড়িতে ঢোকার অনুমতি চাইছে।এদের পরিচয় না জেনে বাড়িতে প্রবেশ করানো মোটেও ঠিক নয়।আবার জেলার একজন নামকরা সাবেক সম্মানিত এমপি শামসুল সরদারের বাড়িতে কেউ ঢোকার অনুমতি চাইছে। এই মুহুর্তে কোনো নেগেটিভ উত্তর মুহুর্তে র মধ্যে হেডলাইন হয়ে যাবে।
বিশদ ভাবনার পর লোকটি সালামের উত্তর দিলো।বললো,
“হ্যাঁ, আসো।”
এরপর পেছন ফিরে সোফার দিকে যেতে লাগলো।স্পর্শী ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
“শামসুল সরদার বাড়িতে আছেন?”
লোকটি মাথা নাড়িয়ে সোফায় বসলো।এরপর সামনের দুই মানবীর উদ্দেশ্যে বললো,
“বোসো।

স্পর্শী আর্শিকে পাশে নিয়ে বসলো।ত্বরিত গতিতে আবারো বললো,
” ওনাকে একটু ডেকে দিন না।কিছু কথা ছিলো।”
সামান্য হাসি পেল লোকটির।ভণিতা করে বললো,
“এর আগে কি শামসুল সরদার কে দেখেছো?”
স্পর্শী মাথা নাড়িয়ে বললো,”জ্বী না,আমরা এই এলাকায় নতুন।আজ সকালেই ঢাকা থেকে এসেছি।ওনাকে একটু ডেকে দিন না।খুব দরকার ছিলো।”
এবারে মুখভঙ্গি সিরিয়াস করে বসলো লোকটি।গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“আমিই শামসুল সরদার।বলো কি বলবে?
স্তব্ধ হয়ে গেল স্পর্শী।পা থেকে মাথা পর্যন্ত একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।এই সুদর্শন লোকটিই তার বাবা।মায়ের বর্ণনার থেকেও একশো গুণ সুন্দর বাবা।চোখ দুটো টলমল করে উঠলো। অশ্রুরা যেন বাঁধ মানতে চাইছে না।ইচ্ছে হচ্ছে ঝাপিয়ে পড়তে বাবার বুকে।অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো।আর্শি বোনের হাত চেপে ধরে কানে কানে বললো,

” আপু,আব্বু তো ভীষণ হ্যান্ডসাম। ”
অসস্তিতে পড়লেন শামসুল সরদার।এরকম অচেনা দুটো মেয়ে তাকে একদৃষ্টিতে দেখছে আবার কানে কানে ফিসফিস করছে বিষয়টা খুবই অসস্তিকর।কাশি দিয়ে বললেন,
“কি বলবে তোমরা?”
চমকে উঠলো স্পর্শী।তাকালো বাবার দিকে।এরপর ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললো,

“সরি আংকেল।সরি!আসলে আমি আপনাকে এর আগে কখনো দেখেনি।তাই চিনতে পারিনি।সত্যিকথা বলতে গেলে আমি পিরোজপুরে এসে ভীষণ ঝামেলায় পড়েছি যার কারনে আপনার ছবিটাও দেখা হয়নি।আংকেল আমি অনেক বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি।প্লিজ সাহায্য করুন।আমি আজ সকালেই আমার বোনকে নিয়ে পিরোজপুর নেমেছি।ঘুরতে এসেছিলাম এখানে।হোটেল রাখার জন্য আপনার এক লোককে বলতেই তিনি আপনাদের হোটেলের কথা জানান।এরপর অন্য পক্ষের আরেকটা ছেলে এসে তাদের হোটেলে নেওয়ার কথা বলে।এভাবে টানা হেঁচড়া করতে করতে দুজনেই সেখানে মারামারি শুরু করে হস্পিটালে ভর্তি হয়। এখন আমি পড়েছি ঝামেলায়।কেউ’ই তাদের হোটেলে আমাকে রাখতে চাইছে না।এমনকি আমি সোভাম ভাইয়াকেও অনেক রিকোয়েস্ট করেছি কিন্তু উনি রাজী হন নি। শিকদার হোটেলেও আমাকে রাখবে না।অথচ তারা হুমকি দিয়েছে আমি যদি আপনাদের হোটেলে থাকি তাহলে আমাদের ক্ষতি করবে।আমার ভীষণ ভয় করছে আংকেল।প্লিজ সাহায্য করুন।আমি জানি আপনি বললে আমাকে হোটেলে রাখবে কিন্তু আমি সেখানে থাকতে চাইছি না।”

শামসুল সরদার ভাবনায় পড়লো।বললো,
“হোটেলেও থাকবে না তাহলে থাকবে কোথায়?”
গলা খাকারি দিয়ে গলা পরিস্কার করে নিলো স্পর্শী।আমতা আমতা করে বললো,
“আসলে আংকেল আমি পুরাতন সব নিদর্শনের উপর একটা রিপোর্ট তৈরী করছি।আপনার বাড়িটা পুরাতন আমলের।ভীষণ সুন্দর।আমি একজন ভবিষ্যৎ জার্নালিস্ট। আমি চাইছিলাম আপনার বাড়িটার উপরে একটা ভিডিও বানাতে।আর এটা আমি কোনো সোশ্যাল মিডিয়ায় আপ্লোড করবো না।ব্যাস নিজের কাছে রেখে দিবো।আসলে আমার আর্কিটেকচার সাব্জেক্ট টাও ভীষণ ভালো লাগে। আর এইসব পুরনো জিনিস ঘেটে দেখার খুব ইচ্ছে আমার। আপনি আমাকে না হওয়া প্রত্নতত্ত্ববিদ ভাবতে পারেন।”

বলেই হেসে দিলো।কিন্তু শামসুল সরদার এখনো গম্ভীর।তার মুখের ছাপ দেখে কোনো আশার আলো খুঁজে পেল না স্পর্শী।শেষ মেষ নিজের মেজাজকে ধরে না রাখতে পেরে বললো,
“আসলে আমি তো আর এখানকার ভোটার নই যে আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।এখানকার কেউ হলে ঠিকই ভোটের আশায় সাহায্য করতেন।আসার সময় কত লোক বললো আপনি সবাইকে সাহায্য করেন।আপনি প্রয়োজনে আমাকে আপনার বাড়ি রাখবেন তাও শিকদারের লোকের হাত থেকে রক্ষা করবেন।আরো কত্ত কি?”
ঠোঁট চেপে আলতো হেসে দিলেন শামসুল সরদার।ভেতর থেকে এক মহিলা নাস্তার প্লেট হাতে হাসতে হাসতে আসলেন।স্পর্শীর সামনে দিয়ে বললেন,

“একদম খাঁটি কথা বলেছো নেতারা তো এমন’ই। ”
সরদার স্পর্শির দিকে তাকিয়ে বললো,
“এবারের নির্বাচন শেষ। খুব অল্প সংখ্যক ভোটের ব্যাবধানে হেরেছি।এরপর আবার পাঁচ বছর পর নির্বাচন।বেঁচে থাকলে তো আবার দাঁড়াবো। অথচ তুমি আমাকে লোভ দেখাচ্ছো?
শিউরে উঠলো স্পর্শী।মলিন কন্ঠে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
” আমার মাথায় যতগুলো চুল,আল্লাহ ততগুলো বছর আপনাকে বাঁচিয়ে রাখুক।”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২০

মুগ্ধ হয়ে স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে রইলো শামসুল সরদার। আলতো হেসে বললো,
“তুমি যতগুলো দিন পিরোজপুরে আছো,আমার বাড়িতে থাকতে পারো। আমার কোনো সমস্যা নেই। ”
খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে গেল স্পর্শী। আর্শি গোমড়ামুখে বললো,
“ওহ,আমি বুঝি এখানে থাকবো না?আমাকে তো অনুমতি দেন নি।শুধু আপুকেই থাকতে বললেন।

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২১