ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৭
Arishan Nur
পূর্নিমা রাত। আকাশে থালার মতো সোনালী রঙের বিশাল বড় চাঁদ উঠেছে। আজকের আকাশ একদম পরিষ্কার। আয়না যখন বাসার সামনে নামলো, সমুদ্র প্যাকেট হাতে তুলে দিয়ে বলে, ” কাল দেখা হবে।”
আয়না অকস্মাৎ একটু চমকে। আগামীকাল তাদের দুইজনের আলাদাভাবে গায়ে হলুদের ঘরোয়া আয়োজন হবে দুপুরে। এরপর সন্ধ্যায় মেহেদী উৎসব। ওইসময় সমুদ্রও আসবে৷ আয়না আগামীকালের অনুষ্ঠানের কথা ভাবতেই একটা ফাঁকা ঢোক গিললো। সমুদ্র তখনো গাড়ির ভেতরে বসে ছিলো। ওকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুধালো, ” তুমি আজ থেকেই আমার সঙ্গে থাকতে চাচ্ছো নাকি?”
আয়না তখন অন্য চিন্তায় বিভোর ছিলো। শুনেনি ঠিকঠাক। আয়নার মুদ্রাদোষ হলো কোনো কথা ঠিকমতো না শুনলেও, কথা ঠিকই বলে ফেলে। আজও ব্যতিক্রম হলো না৷
সে বলে উঠে, ” হু।”
সমুদ্র খানিক হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। এরপর আস্তে করে বলে, ” মেয়ে তো পুরাই তারছিড়া দেখছি!” তারপর বললো, “গাড়িতে উঠে পড়ো তাহলে। মা কিছু জিজ্ঞেস করলে, বলে দিবো, বউমা বিয়ের আগে থেকেই শ্বশুড়বাড়ি যেতে চায়। বাপের বাড়িতে আর মন বসছে না।”
আয়না ভড়কে গিয়ে সামান্য দূরে সরে এসে বলে, ” আয়া, মজা করছিলাম আমি। আসি।”
–” গুড নাইট।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আয়না সঙ্গে সঙ্গে একবার তার দিকে তাকালো। সে গাড়ি টান মেরে চলে গেলো।
সে বাড়ি ফিরতেই আলিয়া বেশ উৎসাহ নিয়ে প্যাকেট কেড়ে নিলো। বিয়ের শাড়ি দেখার জন্য সকাল থেকেই মনে মনে এক্সাইটেড সে। আয়না সরাসরি বাবার কাছে গেলো। বাবা বাসায় থাকলে, বাইরে থেকে ফিরে এসেই বাবাকে জানায় যে ঠিকমতো ফিরে এসেছে আর বাবা বাসায় না থাকলে ফোন দিয়ে জানায়। আয়না যখন বাবার সঙ্গে কালকের অনুষ্ঠান নিয়ে আলাপ করছিলো, তখন আলিয়া ফিরে এসে বললো, ” আপা দুইটা আউটফিটই দারুণ হয়েছে। ”
আয়না বাবার সঙ্গে কথা বলা বাদ দিয়ে বলে, ” দুইটা আউটফিট কই পেলি? একটাই তো নিলাম!”
আলিয়া মাথা ঝাকিয়ে না বোধহয় অর্থ প্রকাশ করে বলে, ” না। একটা শাড়ি, অন্যটা লেহেঙ্গা।”
লেহেঙ্গা শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আয়নার ভ্রু কুচকে যায়। সে দ্রুত বেগে নিজের রুমে দিকে ছু’টে৷ আলিয়া একবার বাবাকে দেখলো, পরক্ষণেই বড় আপার যাওয়ার পানে তাকালো।
ফাহাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলো, ” কি হলো তোমাদের দুই বোনের?”
আলিয়া উত্তর দিলো হাসিমুখে, ” বাবা, আপার বিয়ের শাড়ি আনপ্যাক করেছি৷ খুব সুন্দর। ওটা নিয়েই ব্যস্ত আমরা।” বলে আপার কাছে যেতে লাগলো।
ফাহাদ সাহেবও খুশি হলো। বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে তার দুই মেয়ে আজকে সকাল থেকেই খুব খুশি। সে গতকাল থেকেই ছুটি নিয়েছেন। বাসায় আয়োজনের সব তদারকি করা লাগছে। ভাবলেন শায়লাকে ফোন দেওয়া উচিত একবার।
আয়না নিজের বিছানায় ট্রায়াল দেওয়া খয়েরী রঙের লেহেঙ্গাটা দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। নিজের হাত দিয়ে লেহেঙ্গাটা ছু’য়েও অবাক লাগছে যে আসলেই এটা তার বাসায়! কীভাবে সম্ভব? সে তো না করে দিয়েছিলো। সেলসম্যান ভুলে দিয়ে দিলো নাকি? সঙ্গে সঙ্গে সে শপিং ব্যাগ থেকে ক্যাশম্যামো তুলে নেয়। পেমেন্ট রিসিটে দুইটা আউটফিটের প্রাইজই দেওয়া। লেহেঙ্গাটার দাম আড়াই লাখ টাকা দেখে তার চোখ কপালে। সমুদ্র এতো দাম দিয়ে তাকে কিনে দিলো? শুধুমাত্র তার পছন্দ হয়েছে বলে? আয়নার এটা ভাবতেই খুব খুশি লাগলো। মনের মধ্যিখানে কেমন হিমেল হাওয়া বয়ে যায়৷ চারপাশে রঙিন প্রজাপতি উড়তে লাগে বোধহয়!
আলিয়া তার পাশে এসে দাঁড়ায় এবং বলে, ” আপা এই লেহেঙ্গা মেহেদীর অনুষ্ঠানে পড়ো। একদম হানিয়া আমীরকে ঝাঁপিয়ে যাবে!”
আয়না মৃদ্যু হাসে এরপর বলল, ” পাগল তুই!”
আলিয়া কি হলো কে জানে আপার হাত জড়িয়ে নিয়ে কাঁধে মাথা রেখে বললো, ” আপা, আমার কান্না পাচ্ছে। তোমার বিয়ে হয়ে গেলে আমরা বাসায় একা কীভাবে থাকবো?”
শতশত আয়োজন যেন মুহুর্তের মধ্যে বৃথা যায়। একহাতে নতুন সম্পর্কের আহ্বানের চিহ্ন, অন্যহাতে পুরাতন সম্পর্কের বাঁধন ছেঁড়ার ব্যথা। আয়না আলিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে, ” আমি তো এখনই যাচ্ছি না। পরেরটা পরে দেখা যাবে।”
আলিয়া মুখ ভোতা করে বলে, ” তোমাকে যাইতেই দিব না। ভাইয়াকে বলবো উনি যেন এখানে আসেন থাকতে। তোমরা আমাদের সাথে থাকবে।”
আয়না বেশ শব্দ করে হাসে। আগামীকালের প্রস্তুতি নিয়ে দুই’বোন ব্যস্ত হয়ে যায়। সমসাময়িককালে বাঙ্গালী ইয়ং মেয়েদের মধ্যে পাকিস্তানি ড্রামা, ওদের সাজগোছ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মেয়েরা পাকিস্তানি জামা, মেকাপ নায়ক-নায়িকা সহ–সবকিছুর ফ্যান হয়ে গেছে৷ আয়না-আলিয়া ও ব্যতিক্রম নয়৷ ওরা মেহেদী অনুষ্ঠানে পাকিস্তানি ড্রামার নায়িকার মতো সাজবে বলে পরিকল্পনা করেছে৷
ফাহাদ সাহেব বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। আগামীকাল বাসায় ছোট একটা অনুষ্ঠান করবেন৷ পড়শু বড় করে অনুষ্ঠান। আকদের অনুষ্ঠান পড়শুদিন। পড়শুদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে বেশ বিচলিত সে। সব ঠিকঠাক হবে তো? একাকী বোধ করতে লাগলেন সে। আয়নার মা, আয়না যখন সিক্স গ্রেডে পড়ে তখন মৃত্যুবরণ করে। দুইটা ছোট ছোট বাচ্চা মেয়ে নিয়ে সে বেশ বিপদে পড়ে যান৷ আলিয়া তখন থ্রিতে পড়ত। এতো ছোট বাচ্চা মেয়ে নিয়ে সে যেন সর্বহারা হয়ে পড়েন। গ্রাম থেকে বাবা-মা আসলেন বাচ্চা দু’টোকে দেখার জন্য।
তখন থেকেই আব্বা-আম্মা তার বাসায়ই থেকে আসছেন। তার মা-বাবাও আয়না-আলিয়া কে চোখে হারায়। বিপত্নীক পুরুষ সে। উঠতি বয়সী, টীনএইজ মেয়ে দু’টোকে নিয়ে আত্মীয়-স্বজনরা বেশ বাঁকা কথা বলত। তারই আপন ভাই বলেছিলো, মেয়ে দুটা বিগড়ে যাবে৷ মা মরা মেয়ে, নষ্ট, উচ্ছশৃখল হবে। কিন্তু নাহ, তার মেয়ে দুটো বেশ ভদ্র-নম্র। বড় হওয়ার পর যারাই ওদের দেখে সবাই প্রশংসা করে, বলে, মেয়ে দুইটা এতো মিষ্টি! বাবা হিসেবে তখন দুশ্চিন্তামুক্ত লাগে। পড়ালেখায় ও ভালো দুই’বোন। ফাহাদ সাহেব নিজেও মেধাবী ছিলেন ছাত্রজীবনে। বিসিএস দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা হন। এখন বেশ উচ্চ পদে আছেন। ক্ষমতা, সম্মান অনেক আছে তার। সম্পদ-টাকাও আছে ভালো পরিমাণে৷ সৎ পথে উপার্জন করেন বিধায় খুব সম্পদ নেই, তবে আপার মিডেল ক্লাস যাকে বলে সেরকম লাইফ লিড করছেন৷
সে শায়লাকে কল লাগালো। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ হলো।
ফাহাদ সাহেব বলে, ” তোমাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ।”
–” ধন্যবাদ কেন?”
–” তুমি না হলে আয়ুর এতো ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারতাম কিনা সন্দেহ৷ এখন নিজেকে খুব দায়মুক্ত লাগছে। আমি মারা গেলেও আর চিন্তা থাকবে না। আমার মেয়ের দায়িত্বে এখন আরেকজন ভাগীদার। আর আয়ুর কাঁধে শক্ত হাত থাকলে, আলিয়া কে নিয়ে ভাবতে হবে না। আয়ু ঠিকই ছোট বোনকে আগলে রাখবে।”
–” মেঘ, এসব কি ভাবছো? তুমি নাতি-নাতনীদের নিয়ে স্কুল যাবে, বুঝলে? উল্টা-পাল্টা ভাবনা বাদ দেও। তুমি এখনো ইয়ং ম্যানই আছো।”
–” সৃষ্টিকর্তার যা ইচ্ছা। যাইহোক, তোমার কথা অনুযায়ী ওদের দুইবোনকে গতকাল বাইরে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিলাম। কালকে থেকে দুইজন ই খুব খুশি।”
–” কি করছে ওরা এখন?”
–” বিয়ের জামাকাপড় নিয়ে কিসব করছে, কি সব বলে কিছুই বুঝি না। গতকাল দুইঘন্টা ধরে পার্লারে কি জানি করলো। এসব মাথার উপর দিয়ে যায় আমার।”
— ” এই জেনারেশনের বাচ্চা-কাচ্চাদের বোঝা খুব কঠিন।”
–” আগামীকাল দাওয়াত থাকলো। সন্ধ্যার মধ্যে আসবে৷”
–” আয়না যদি কিছু মনে করে? রিয়্যাক্ট করলে?
–” না, করবে না। তাছাড়া তোমার থেকে কিছু সাহায্যও দরকার। আসা লাগবে তোমাকে।”
–” আচ্ছা। আসবো।
ফাহাদ সাহেব ফোন রাখলেন৷ ফাহাদ ইসলাম তার সার্টিফিকেট নাম। কিন্তু মেঘ বলে গুটিকয়েক মানুষ তাকে ডাকে।
সমুদ্র সকাল থেকেই সামান্য বিরক্ত। সাদা-আসমানী মিশেল রঙের পাঞ্জাবি পড়ে বর সেজে বসে আছে। তাকে ঘিরে আত্মীয়দের এতো শোরগোল আর ভালো লাগছে না। সে চাচ্ছে এইসব হলুদ-সবুজ যা করবে তাড়াতাড়ি করুক। দুপুরে তাকে বেরোতে হবে৷বিশেষ মিটিং এ ক্লাইন্টের কোনোরকম মনোরঞ্জনে ঘাটতি থাকলে চতুর্থ প্রোজেক্ট হাত ছাড়া হয়ে যাবে। কিন্তু তার বাড়ির লোকদের এতে কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা নিজেদের মতো ব্যস্ত। সে বাসার ড্রয়িংরুমে বসে আছে। একটু পর তাকে হলুদ লাগাবে। সে ঘড়ি দেখলো। বারোটার বেশি বাজে। দু’টোর আগেই পৌঁছাতে হবে৷
মিসেস রোদেলা এসে বলে, ” মুখটা গোমড়া করে রেখেছিস কেন?”
–” যা করার জলদি করো। দুইটার আগে আমাকে প্লিজ মাফ করে দিও।”
মিসেস রোদেলা হাসলেন। মা আজকে খুব পরিপাটি করে সবুজ রঙের শাড়ি জড়িয়েছেন গায়ে। তার বাবাকেও সবুজ পাঞ্জাবিতে দেখা হলো। বাবা-মা ম্যাচিং জামা পড়েছে! নিশ্চয়ই পিউয়ের বুদ্ধি এসব! একটু পর পিউকেও দেখা গেলো। সে অবশ্য হলুদ রঙের শাড়ি পড়েছে। বোনকে দেখে অবাক হলো সে। শাড়ি পড়ার জন্য ওকে বেশ বড় বড় লাগছে! বিশ্বাসই হচ্ছে না এটা তার ছোট্ট বোন।
হলুদের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। সমুদ্রকে ড্রয়িংরুমের মাঝে বসানো হয়েছে। ফ্লোরিং করে সুন্দর করে বসার ব্যবস্থা। পেছনে গাদা ফুল দিয়ে সাজানো স্টেজের মতোন করে ডেকোরেশন করা। সামনে একগাদা খাবার৷ সবার আগে হলুদ লাগাতে তার মা-বাবা আসলো। মিসেস রোদেলা অল্প হলুদ হাতে নিয়ে তার আদরের পুত্রের কপালে হলুদ ছোঁয়ালেন। দু’সেকেন্ডের ব্যবধানে মিসেস রোদেলার চোখ টলমল করে উঠে। সে আঁচলে মুখ ঢেকে একটু কাঁদলেন।
ইশরাক রহমান বলে উঠে, ” ছেলের বিয়ে দিচ্ছো, কাঁদার কি হলো? ছেলেকে তো আর ঘরজামাই পাঠাচ্ছো না যে তোমাকে রেখে শ্বশুড়বাড়ি যাবে৷”
মিসেস রোদেলা কান্নাভেজা গলায় বলে, ” আবেগ, তুমি ওসব বুঝবে না। তোমার ডাকনাম টাই কেবল আবেগ, মনের ভিতরে আসলে তোমার কোনো আবেগই নাই। তুমি একটা নিরাবেগ মানুষ!”
ইশরাক রহমান বুঝে পেলেন না সে আসলে কি এমন ভুল বললো? কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে তর্কে গেলেন না। বুদ্ধিমান মানুষ স্ত্রীর সঙ্গে তর্কে যায় না। সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান।
ইশরাক রহমান ছেলের গালে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে, সামনে থাকা বাহারি রকমের খাবার থেকে ছেলের সবচেয়ে পছন্দ লাড্ডু, সেটা মুখে তুলে দিলেন৷ ছেলেটা ছোট থেকেই লাড্ডু আর কালোজাম মিষ্টি পছন্দ করে।
বাবা যখন লাড্ডু হাতে তুলে তাকে খাইয়ে দিলো, সমুদ্র বেশ খানিকটা অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। বাবার তাহলে খেয়াল আছে তার লাড্ডূ প্রিয়! তার বাবা সরে আসতে চাইলে, সে আলতো করে হাত এগিয়ে বলে, ” আব্বু?”
ইশরাক রহমান থেমে গিয়ে বলে, “কি?”
সমুদ্র সামনের ট্রে থেকে একটা কালোজাম মিষ্টি তার বাবার মুখে তুলে দিলো। মিসেস রোদেলা পিতা-পুত্রের এমন সুন্দর মুহূর্ত দেখে খুশিতে আপ্লূত হলো! সে সমুদ্রের কপালে দু’টো চুমু খেয়ে বললো, ” অনেক সুখী হো”
সমুদ্র বলে, ” দোয়া করো।”
ইশরাক রহমান বলে উঠে, ” দুয়া সবসময়ই করি যেন তোমরা খুশি থাকো।”
বাবার সঙ্গে সে উঠে দাঁড়িয়ে কোলাকুলি করলো। কতোদিন পর সে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো তা আর মনে করতে পারলো না। ছেলে ও মেয়েরা বড় হওয়ার পর, মেয়ে ও ছেলের দুই জাতির ক্ষেত্রে, বাবার সাথে সম্পর্ক ভিন্ন দু’রকমের হয়৷ মেয়েরা বাবাদের সঙ্গে ঝগড়া করে, আবার একটু পর বাবা বাবা বলে ডেকে আবদার করে। বাবারাও মেয়েদের প্রতি বেশি নরম থাকে। কিন্তু ব্রাউন ফ্যামিলিতে ছেলেদের একটা সময় পর বাবার সঙ্গে একটা দূরত্ব চলে আসে। যদি আবার তাদের মধ্যে ইগো রিলেটেড কোনো ঝামেলা থাকে, তাহলে কতদিন পরপর কথা বলে নিজেরাই ভুলে যায়।
সমুদ্রর বেশ ভালো লাগছে। বাবা-মা সরে যাওয়ার পর মিসেস ইভানা আসলেন। সঙ্গে তার ছেলে শ্রাবণ ও ছিলো। ইভানা সমুদ্রের গালে হলুদ লাগিয়ে মোটা হলুদ খামে টাকা গিফট দিতে গিয়ে বলে, ” না করবি না একদম। ”
সমুদ্র উপহার গ্রহণ করে বলে, ” এটারই তো দরকার। ”
শ্রাবণ বলে উঠে, ” ভাইয়া তোমার তো সেই ইনকাম হচ্ছে। ”
সমুদ্র বলে উঠে, ” তুইও বিয়ে কর, তোরও ইনকাম হবে তাহলে।”
শ্রাবণ বলে, ” আগে তো বিয়ের কথা মুখেই নিতা না, আজ আমাকে বিয়ে দেওয়ার অফার দিচ্ছো!”
–” আমি একা কেন ফাঁসবো? সঙ্গে তোকে নিয়েই ফাঁসি।”
শ্রাবণ হাসতে হাসতে বলে, ” ভাই এরকমভাবে আমিও ফাঁসতে চাই। ভাই, তোমার কোনো শালী আছে? থাকলে লাইন সেট করে দেও?”
ইভানা ছেলের কান টেনে ধরে বলে, ” পড়াশোনা নাই আবার বিয়ে করবেন উনি! সিজিপিএ দেখছিস নিজের? এই সিজিপিএ দেখলে মেয়ের বাপ ভুলেও বিয়ে দিবে না।”
শ্রাবণ বলে উঠে, ” আম্মু, বিয়ে দেও, বিয়ে দিলে পড়াশোনায় মনোযোগ আসবে।”
সমুদ্র সহ উপস্থিত সকলে হেসে ফেলে। না হেসে উপায়ও নেই শ্রাবণ ছেলেটা এতো বেশি সারকাজম করতে পারে!
বড়রা হলুদ মাখিয়ে দিয়ে ডাইনিং এ দুপুরে খেতে যায়। তখন ড্রয়িংরুমে কেবল ছোটরা উপস্থিত ছিলো। শ্রাবণ, পিউ আর তাদের কিছু কাজিন এসে দাঁড়ালো সমুদ্রকে ঘিরে।সমুদ্র ভ্রু কুচকে বলে, ‘কি?’
শ্রাবণ বলে, ” ভাইয়া বলো তো, চিকেন ফ্রাই করার আগে মুরগীকে হলুদ-মশলা দিয়ে মাখানো হয় কেন?”
সমুদ্র ভ্রু কুচকে রেখেই বলে, ” আমি কীভাবে জানবো?”
তার উত্তর শোনার আগেই সব কাজিন হলুদ নিয়ে তার উপর হামলে পড়ে৷ মুখে, হাতে, পায়ে, মাথায় এমন কোনো জায়গা নাই যেখানে হলুদ মাখায়নি তারা।এতো দ্রুত এমন আক্রমণে সমুদ্রর তাল ছু’টে যায়। সে তটস্থ হতে পারে না। তাকে হলুদ দিয়ে পুরা মাখামাখি করে ফেলার পর শ্রাবণ জবাব দিলো, ” হলুদ দিয়ে ম্যারিনেট করলে স্বাদ বাড়ে বুঝলে ভাই, খাওয়ার সময় টেস্ট বেশি লাগে। এইজন্য তোমাকে হলুদ দিয়ে ম্যারিনেট করে দিলাম। যেন তোমারও টে–স্ট বাড়ে।”
সমুদ্র শ্রাবণের কাঁধে কিল মেরর বলে, ” বেয়াদব কোথাকার! ”
এবার শ্রাবণ বলে, ” ভাইয়া কিছু দাও আমাদের। তোমার বিয়ে বলে কথা। মজা করবো না আমরা?”
–” আমি কিছু দিতে পারবো নাহ। ”
শ্রাবণ আর পিউ একসঙ্গে বলে উঠে, ” ভাইয়া আজকে রাতে ব্যাচেলর পার্টি করি ছাদে প্লিজ? প্লিজ?”
সমুদ্র এ,” নো, নো নেভার।এইসব হবে না।”
পিউ খুব নম্র সুরে বলে উঠে, ” ভাইয়া আলিয়াও রাজী। আমরা অনেক এক্সাইটেড।”
শ্রাবণ প্রশ্ন করে, ” আলিয়া কে রে? ”
পিউ বলে, ” কোনো মেয়ের নাম শুনলেই ডিটেইলস জানা লাগবে?”
শ্রাবণ বলে, ” কতো বললাম তোর একটা বান্ধবীকে পটায় দে। দিলি না। গার্লফ্রেন্ড থাকলে মোটেও অন্য মেয়েদের পাত্তা দিতাম না।”
পিউ সমুদ্রেকে বলে, ” ভাবীরও সমস্যা নেই যদি তুমি রাজী থাকো। ”
সমুদ্র বুঝলো ওরা আগে থেকেই প্লান করে রেখেছে। সে রাজী হলো না। কিন্তু তার কাজিন-বোন সবগুলো খুব নাটকবাজ। কানের সামনে ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকলো। ওদের এক কথা, ভাইয়া রাজী নাহলে আজ ভাইয়াকে শাওয়ার নিতে রুমে যেতেই দিবে না। এভাবেই রাখবে। মিসেস রোদেলা আসলেন একবার। সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ করে বলে, ” আম্মু দেখো! ওরা এসব কি করছে আমার সঙ্গে? এখন আবার পার্টি চায়। নাহলে ছাড়বে না আমাকে।”
মিসেস রোদেলা বলে, ” আমি এসবে নাই। তোদের যা ইচ্ছা কর। আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে। আমার কোনো কিছু তেই বাঁধা নেই।”
সমুদ্রের আম্মুর এমন কথায় ওরা আরোও লাই পায়৷
আসলেই তাই সমুদ্রকে উঠতে দেয় না। এদিকে এতো বেশি হলুদ গায়ে মাখিয়েছে যে পুরা শরীর কুটকুট করছে৷ এমনকি মুখেও কাঁচা হলুদের স্বাদ পাচ্ছে সে। উপায় না পেয়ে রাজী হয়ে যায় সে। এরপর শাওয়ার করতে প্রায় দৌঁড়ে রুমে ঢুকে সমুদ্র। রুমের দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে দেয়। তিনবার শ্যাম্পু-সাবান লাগিয়ে গোসল সেড়ে সাদা ফর্মাল শার্ট পড়ে বের হয় সে। তিনবার সাবান মাখার পরও মনে হচ্ছে, তার গা দিয়ে হলুদের গন্ধ এখনো যায়নি। মিররে নিজের চেহারা দেখে মনে হলো গালে-কপালে এখনো হলদে ভাবটা যায় নি৷ কি একটা অবস্থা!
সে না খেয়েই মিটিংয়ের উদ্দেশ্য বের হলো। মিটিং শব্দটা দিয়ে আসলে অসভ্যতাকে ঢেকে দিচ্ছে সে। আসলে কিছু বড় পার্টির নেতা, বিজনেজ ম্যানকে নিয়ে একটা ছোট-খাটো বিনোদন আসরের ব্যবহার করেছে। এই পার্টিতে সে ডকুমেন্টস নিয়ে যাচ্ছে। তবে আজকেই চতুর্থতম প্রোজেক্টের ডিলে সাইন করায় আনবে। পার্টি অবশ্য দুপুর থেকে সারারাত চলবে। সে সন্ধ্যায় চলে আসবে। সমুদ্র গুলশানের একটা বাসার ভেতরে ঢুকলো। বাসার ভেতরে প্রবেশ করতেই কেমন ঝাঁঝালো তেতো গন্ধ নাকে আসে বাড়ি খায়। এই গন্ধের সঙ্গে সমুদ্র পরিচিত। পার্টি শুরু হয়ে গেছে৷ সে এগিয়ে এসে বলে, ” কেমন আছেন রুহুল ভাই?”
–” ভালো।”
–” খেয়েছেন ঠিকঠাক? ”
রুহুল সাহেব বলে, ” এতো আয়োজন করেছো তোমরা? অনেক খেলাম৷ আমি আর খেতে পারবো না।”
সমুদ্র হেসে বলে, ” আসল আয়োজন তো বাকিই আছে। রাতের জন্য অপেক্ষা করুন।”
বিজনেজ ম্যানস ও নেতা সহ সাত-আট জন মানুষ বসে আছে। সমুদ্র সহ আরোও তিনজন কোম্পানির মালিক এই পার্টির আয়োজক৷ লাখের বেশি খরচ করেছে সমুদ্র এদের পিছে। শুধুমাত্র এদের মন রাখার জন্য। যেন কাজে কোনো ঝামেলা না করে। ওনারা খুশি থাকলে দু’টো-তিনটে প্রোজেক্ট ভবিষ্যতে আরোও পাবে৷ ইদানীং প্রায়ই ওনাদের গিফট দেওয়া হচ্ছে৷
সমুদ্র রুহুল সাহেবের পাশে বসে বললো, ” সাইনটা এখনই করে ফেলেন?”
–” আরেকটু দেখি। কেমন আয়োজন করেছো তোমরা।”
–” আয়োজন পছন্দ নাহলে ডিল সাইন করবেন না?”
উনি ভারী জোরে হাসলো। সমুদ্র বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলো না। পরক্ষণেই মনে হলো সে তো পাকাপোক্ত ভাবে ব্যবসায়ী হয়ে যাচ্ছে। ম– দের নেশার চেয়েও তার কাছে ডিল-প্রোজেক্ট, টাকা বেশি ম্যাটার করে।
ওই মুহূর্তে ফ্ল্যাটের ভেতর ছয়জন সুন্দরী নারী প্রবেশ করে। উপস্থিত সবার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে ওদেরকে প্রবেশ করতে দেখে। সমুদ্র তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে রুহুল সাহেবের দিকে তাকায়। রুহুল সাহেব খুব বিশ্রীভাবে হেসে বলে, ” এখন সিগনেচার দেওয়াই যায়।”
মেয়েগুলোর রুপ আছে বলাই যায়। সমুদ্রও একবার তাকালো। সুশীল ভদ্র সমাজ এ ওদের ডাকা হয় আই//টেম গা– র্ল আর বাংলা পরিশুদ্ধ ভাষায় হয়তোবা নর্ত & কী বা আরোও অন্যকিছু! দুপুরে বেশ জমপেশ খাওয়া-দাওয়া হলো। সমুদ্রও খেলো। খাবেই বা না কেন? কয়েক লাখ টাকা ব্যয় করেছে এসবের পিছে। বিকেলের দিক থেকে একটা মেয়ে বারবার তাকে অফার দিচ্ছে। সে বুঝতে পারছে এই আড্ডায় সবচেয়ে সুদর্শন সে-ই বোধহয়। পার্টি তখন বেশ জমজমাট। নে%শা কঠিন হতে লাগে৷ গানের ভলিউম বাড়তে থাকে। তার হাতেও ড্রিংকস এর গ্লাস।
সমুদ্রের মাথাব্যথা করতে শুরু করলো হঠাৎ। সে উঠে বারান্দায় যেতে লাগলে, একজন রমণীর সঙ্গে ধাক্কা লেগে শার্টে ম%দ্যপা–নীয় গায়ে এসে লাগে। সে ভীষণ রেগে উঠে কটমট করে তাকায়৷
রমণী বললো, “পরিষ্কার করে দিই নিজ হাতে?”
–” দিন।”
রমণী নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে সমুদ্রের শার্টে ঘষামাজা শুরু করে। ওর কেমন জানি লাগলো। নিশ্বাস গরম হতে লাগলো। মেয়েটা আবেদনময়ী, লাস্যময়ী হয়ে তার দিকে অগ্রসর হতে থাকে৷ বেশ খানিকটা নিকটে এসে দাঁড়ায়। চোখে-মুখে অন্যকিছু, অপবিত্র ইচ্ছা খেলে যাচ্ছে মেয়েটার নজরে। সমুদ্র দাঁড়িয়ে থাকে৷ মেয়েটার হাত আস্তে আস্তে ওর শার্টের বোতামের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে, তবুও থামায় না সে। তবে যখন একটা শার্টের বোতাম খুলে নেয়, সে এক ঝটকায় মেয়েটার হাত সরিয়ে দিয়ে ধাক্কা দেয় মেয়েটাকে। তাদের দিকে কারো নজর নেই। যে যার মতো ব্যস্ত। সমুদ্র বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।
ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৬
ফোনে তখনই নোটিফিকেশন এসে ভীড় জমালো। সে ফোন অন করতেই দেখলো আয়নার ছবি তাকে পাঠানো হয়েছে৷ আয়নার পরনে কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি। গালে হলুদ লাগানো। একটু আগের ছবি নিশ্চয়ই। সমুদ্রের হলুদ ছোঁয়া শেষ হওয়ার পর কণের হলুদ ছোঁয়া শুরু হয়েছে। দুটো ছবি দেওয়া হয়েছে। সে একদৃষ্টিতে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তখনই পেছনে থেকে খুব নরম একটা ছোঁয়া অনুভব করে সে। সঙ্গে সঙ্গে শিরদাঁড়া দাঁড়িয়ে যায় তার। মেরুদণ্ড অব্দি কম্পিত হয়। সে ফোনের ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে নির্জীব কণ্ঠে বলে, ” একটু আগেই আমার গায়ে হলুদ ছোঁয়ানো হয়েছে। এখন এই শরীরে কেবল আমার স্ত্রীর অধিকার থাকবে। ও ছাড়া আর কেউ আমাকে ভুল করেও ছু’য়ে দেখুক আমি তা চাই না।”