ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৮
Arishan Nur
গতানুগতিকভাবে সময় দৌঁড়াচ্ছিলো। সময় আটকে রাখার সুযোগ নেই কারো। সেকেন্ড পেরিয়ে মিনিট, এবং মিনিট পেরিয়ে ঘণ্টা পাড় হলো। সন্ধ্যার আগেই নিজের বাসার উদ্দেশ্য সমুদ্র বের হয়। তার উচিত ছিলো আরোও একঘন্টা আগে বের হওয়া কিন্তু সেটা নানান ফ্যাসাদে সম্ভব হয়নি। ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে ওলরেডি সাড়ে ছয়টা বাজতে চলেছে। বিকেল থেকেই নাকি মেহেদীর অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। তার ইতিমধ্যেই বেশ ক্লান্ত লাগছে৷ মনে হচ্ছে একটু ঘুমিয়ে নিতে পারলে বেশ আরাম বোধ করত। আহা কতোদিন ধরে শান্তিমতো ঘুমায় না সে। রোডের সম্মুখে বাঁক নিতে নিতে হতাশাভরা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।
চোখ হঠাৎ করে জ্বালাপোড়া শুরু করে। চোখের সঙ্গে মনের কানেকশন দৃঢ়। যা মন দেখতে চায়, তা দু’চোখ খুঁজে বেড়ায়– কে জানি বলেছিলো কথাটা! সম্ভবত কোনো দার্শনিক হবে বোধহয়। তাহলে কী চোখ জ্বালাপোড়ার অর্থ মন পোড়া? সে ভাবলো, আগামীকাল তার বিয়ে। আর চব্বিশঘণ্টাও বাকি নেই। সে কী পারবে সবকিছু সামলিয়ে উঠতে?কখনো হাপিয়ে গেলে? বিয়ের করার সিদ্ধান্ত কি তবে ভুল?নতুন করে জীবন গুছাতে গিয়ে কোনোরকমে ভুল করলে এর খেসারত কীভাবে দিবে? নিজের মনের সন্দিহান ভাবনাগুলো কার সাথে শেয়ার করবে? সে নিজেই পরিবারের সবার বড়। ফোঁস করে শ্বাস ফেলতেই তার মনে হলাও, তার একসময়কার বেস্টফ্রেন্ড নীলার সঙ্গে কথা বলা যায়। কিন্তু নীলা নিজেই এখন প্রেগ্ন্যাসির লাস্ট মান্থ এ আছে। তবুও গাড়ি একসাইডে পার্ক করে নীলাকে কল লাগালো। বাসায় কারো সাথে কথা বলার ও পরিবেশ নেই, এতো হৈচৈ চলছে!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তিনবার কল হতেই নীলা ফোন ধরলো। সে ওপাশ থেকে এক্সাইটমেন্ট নিয়ে বললো, ” দোস্ত, কংগ্রাচুলেশনস। সর্যি রে, তোর বিয়েতে এটেন্ড করতে পারছি না। তবে তোর ভাগ্নি নিয়ে একদম নতুন বউয়ের মুখদর্শন করবো।”
সমুদ্র বেশ নিস্তেজ গলায় বলে, ” দোস্ত, আমি একদম পাজেলড হয়ে আছি রে। কি করলাম, কি করব, কেমনে মানবো কিছুই মাথায় কাজ করছে না৷ ঝোঁক-জেদের বশে, বাবা-মায়ের জন্য মায়া থেকে কীভাবে যে রাজী হয়ে গেলাম। এখন মনে হচ্ছে ভুল করছি কীনা!”
ওপ্রান্ত থেকে নীলা একপ্রকার ঝগড়াটে কণ্ঠে গা–লি দিয়ে খুব জোড়ে জোড়ে ধমক দিয়ে বলে, ” তোর মাথা ঠিক আছে? রাত পাড় হলেই তোর বিয়ে। বেয়াদব! এখন এইসব মাথায় আনছিস ক্যান?”
সমুদ্র ক্লান্ত সুরে বলে, ” হুট করে এখন মনে হচ্ছে, আমি যদি না পারি? কনফিউজড লাগছে খুব। আগের কথাও মনে পড়ছে খুব।”
নীলা আরেকটা ভয়ংকর গা–লি দিয়ে বলে, তোর সমস্যা কিরে? ভালো একটা মেয়ের সাথে বিয়ে হচ্ছে, সুখে থাকার চেষ্টা কর।”
–” নীলা দোস্ত, তুই আমার পরিস্থিতি বুঝতে পারছিস না।”
–” এক বছরের বেশি হয়ে গেছে বা৷/)ল। এখনো তুই মুভ অন করিস নাই? ছাগল নাকি!”
–” বিষয়টি মুভ অন করার সাথে সম্পর্কিত নাহ। একচুয়ালি, প্রথমে তো আমি বিয়ের জন্য রাজীই ছিলাম না। বাসায় এসব নিয়ে প্রচুর গ্যাঞ্জাম করতাম৷ পরে ওদের এনগেজমেন্টের ছবি দেখে একপ্রকার জেদ, প্রচুর ইগো কারণে বিয়েতে রাজী হয়ে যাই।”
–” তুই বলতে কী চাস?”
–” সায়নের সঙ্গে দুইদিন আগে কথা হলো। ওদের এনগেজমেন্ট ভেঙে গেছে৷”
–” ভালোই হইছে৷”
সমুদ্র ফোঁস করে দম ফেললো। নীলা তাকে বুঝবে না। ঘুরেফিরে তাকেই দোষারোপ করবে, দরকার হলে গা–লি-গালাজ করবে। সে খট করে মুখের উপর কল কেটে দেয়৷
সমুদ্র কী করবে? এতোদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলো সে! ওর বিয়ে হলে, পরে নিজে বিয়ে করবে৷ কিন্তু ও কেন হুট করে বিয়ে ভেঙে দিলো তাও তার বিয়ের ঠিক ক’টা দিন আগেই? ওর বিয়ে ভাঙ্গন কী কোনোভাবে তার আকদ এর সঙ্গে সম্পর্কিত? নানারকম উদ্ভট চিন্তার সমাপ্তির পর সে সিদ্ধান্ত নিলো ওর সাথে একবার কথা বলা দরকার। নাহলে সে সে নিশ্বাস নিয়েও শান্তি পাবে না। সে ফোন থেকে সরাসরি নাম্বারে কল লাগায়। একবার, দুইবার, তিনবার কল হতেই ওপাশ থেকে মেয়েলি সুরে কেউ কথা বলে উঠে। এই কণ্ঠস্বর সমুদ্রের পরিচিত। অনেক বেশি পরিচিত!
সমুদ্র বলে উঠে, “কেমন আছো?”
একটু পর ওপাশ থেকে কাঙ্ক্ষীত ব্যক্তি ইংরেজিতে বললো, ” ভালো। কংগ্রাচুলেশনস।”
সমুদ্র চুপ থেকে একটা দম ফেলে বললো, ” অস্টিন স্যারের সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙ্গলে কেন?”
মেয়েটা খুব সুন্দর স্পষ্ট উচ্চারণে বলে, ” হি ইজ নট মাই টাইপ! আমি অন্যরকম কাউকে চাই।”
–” সামওয়ান লাইক মি?”
–” মেবি, কেয়ারিং লাইক ইউ!”
–” আমি কেয়ারিং ছিলাম?”
–” ইয়েস।”
–” স্টিল আমাকেও ছেড়ে দিলে।”
–” ইউ নো দ্যা রিজন সমুদ্র।”
–” না, সেটা মেইন রিজন ছিলো না।”
–” বাদ দাও।”
–” দিলাম।”
মেয়েটা ফোন কাটতে ধরলো, তার আগেই সমুদ্র ধমকের সুরে বলে, ” আমার কথা শেষ হয়নি। ভুলেও ফোন কেটে দিবে না।”
–” আর কি বলার আছে?”
সমুদ্র নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়। মন যা বলতে চাচ্ছে তা মুখে আসতেই ব্রেইন বাঁধা দিচ্ছে। কিন্তু আজ এ বিষাক্ত লগ্নে বুঝি মনের জোড় বেশি ছিলো। সে অনেকদিনের চাপা আর্তনাদপূর্ণ ইচ্ছার কথা বলে দিলো।
–” আমার কাছে ফিরে আসতে চাও? আগের সবকিছু ভুলে যেতে কোনো সমস্যা নেই আমার। যা হয়েছে সেটা অতীত। অতীত টেনে আনবো না কখনো। তুমি রাজী থাকলে সব ফেলে অস্ট্রেলিয়া চলে আসবো।”
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে দু’দন্ড নিরবতা রইল, এরপর তাচ্ছিল্যপূর্ণ অট্টহাসির শব্দ কানে আসতেই সমুদ্রর কান গরম হতে লাগলো।
মেয়েটা বলে উঠে, ” আর ইউ ইনসেন? সমুদ্র, তুমি এখনো সেই আগের মতো ট্রিপিক্যাল রয়ে গেছো।”
তাকে আর কিছু না বলার সুযোগ দিয়ে মেয়েটা ফোন কেটে দিলো। সমুদ্র ঠায় ফোন কানে নিয়ে বসে থাকলো। আচমকা তার ফোনে নোটিফিকেশনের শব্দ ভেসে আসে। সে স্কাইপি অন করতেই একটা ছবি চোখে পড়লো। তার প্রাক্তন প্রেমিকার অন্য আরেকজনের সঙ্গে বেশ কাছাকাছি থাকা অবস্থায় ব্যক্তিগত একখানা সুন্দর ছবি। সমুদ্রের মাথায় ঠিক মাঝ বরাবর তীব্র পীড়া শুরু হলো। খুব অসহ্যনীয় লাগলো তার কাছে! হুট করে চোখের কোণে একবিন্দু জল এসে বিনা নিমন্ত্রণে উপস্থিত হলো। আর কতোভাবে নিয়তি তাকে উপহাস উপহার দিবে? আর কতো ছোটো হতে হবে তাকে? ভাগ্য কেন বারবার তার উপর হাসে!
সে সীটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। নাহ এভাবে চলবে না। তাকে শক্ত হতে হবে৷ অনেক শক্ত। এতো শক্ত মনের হতে হবে যেন কোনোকিছুতেই আর প্রভাবিত না হতে পারে! খুব করে রসায়নের দর্শক আয়ন হতে মন চাচ্ছে৷ কতো বিক্রিয়ায় চালাও না কেন, কতো তাপমাত্রা বাড়াবে বাড়াও, কতো চাপ দিবে দেও, তবুও আমি কোনোধরনের আবেগীয় কার্যধারায় অংশগ্রহন করবো নাহ। একদম ইমোশনলেস যন্ত্র হতে হবে। খোদা, মনটাকে পাথর বানিয়ে দিলে খুব ক্ষতি হতো? এতোদিন বহুবার সে মন থেকে চেয়েছে ওকে ভুলে যেতে কিন্তু সক্ষম হয়নি৷ কিন্তু আজ বুঝি সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো, যেদিন সমুদ্র নিজ থেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো আর কোনোদিনও ওর কথা মাথায় আনবে না। সেন্ড করা ছবিটা দেখবার পর থেকে মাথায় কেমন পাগলা খ্যাপাটে জেদ চেপে বসে। তাকেও অন্যকারো সাথে জড়াতে হবে। সেও দেখিয়ে দিবে সে ফেলনা না। তারও লাইফে সে অন্যকোনো মেয়েকে জড়াতেই পারে। ওর সংসারের চেয়েও সুখের সংসার তার চাই!
বাসায় যখন সমুদ্র পৌঁছে তখন সাতটার বেশি বাজে৷ মিসেস রোদেলা মুরুব্বি মেহমানদের নিয়ে গল্প-আলাপে ব্যস্ত। সমুদ্র কে দেখেই তার কেমন অগোছালো, এলোমেলো লাগলো। মা সে তার! চোখ দেখেই বুঝে ছেলে-মেয়ের কিছু হয়েছে কিনা! সে উৎকণ্ঠাবোধ করতে লাগলেন৷
সমুদ্র তাকে দেখে এগিয়ে এসে, নিজেকে স্বাভাবিক রেখে এমনভাবে কথা বললো যেন একটু আগে কিছু ই হয়নি।
সে বললো, ” আম্মু এক কাপ কড়া লিকারের চা দাও। দুধ চা দিবে সাথে চিনি দুই চামচ।”
মিসেস রোদেলা চোখ বড় করে তাকালেন ছেলের দিকে। ছেলের চোখ-মুখ দেখে তার মন বলছে,নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে৷ কিন্তু কথা বলার ভঙ্গি খুব নর্মাল। আদৌ কী নর্মাল?
মিসেস রোদেলা বলে উঠে, ” মেহেদীর অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। তুই মাত্র বাসায় এলি। ওখানে যেতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে না?”
সমুদ্র খুব সুন্দর করে হাসলো, এরপরে বলে উঠে, ” মেহেদীর আয়োজন যার জন্য চলছে, সে উপস্থিত আছেই। মেয়েরা সব আছে না ওখানে? আমি পুরুষ মানুষ, আমার এমনি ওখানে কাজ নেই। লেইট হলেও সমস্যা নেই। ”
এরপর একটু ঝুঁকে মায়ের কাছটায় ছড়িয়ে থাকা ডেকোরেশনের অপ্রয়োজনীয় জিনিস সরিয়ে দিলো। মিসেস রোদেলা সামান্য নড়চড় করলেই এসব জিনিস পত্রের কোণা এসে তার গায়ে বিঁধছিলো।কিন্তু গল্পে মশগুল থাকায় ওগুলো সরান নি আর। তার ছেলে এতোকিছু দেখে কখন? দু’মিনিট ও হয়নি এখানটায় এসে দাঁড়িয়েছে। তাতেই চোখ পড়লো যে মায়ের বসতে অসুবিধা হচ্ছে। মিসেস রোদেলা না পারতে এখানটায় বসেছেন। সব গেস্টরা বসে আছে। সে বরের মা হয়ে অন্যকোথাও থাকলে ব্যাপারটা ভালো দেখায় না৷ বসার আর অতিরিক্ত জায়গাও ফাঁকা ছিলো না।
সমুদ্র রুমে এসে শাওয়ার নিলো। শাওয়ার না নিলে মাথাব্যথা যাবে না। বাসার পরিবেশ এতো বেশি তার প্রতিকূলে, ওই বাড়ি না গেলে, অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকলে, এ বাসায় ঝড় যাবে। সে ঝামেলা চাচ্ছে না৷ কার জন্য ই বা ঝামেলা করবে? এখন আর এতো এনার্জিও নেই।
শাওয়ার নিয়ে খালিগায়েই একটা মেডিসিন খেয়ে নিও। খুব কাজের ঔষধ। এই মেডিসিন সেবনে নার্ভ রিলিফ থাকে। দুশ্চিন্তা কমে। আস্তে আস্তে মাথাব্যথা ও কমবে৷ তখনই মা রুমে আসলেন চা হাতে।
সমুদ্র বলে, ” ভিতরে আসো।”
মিসেস রোদেলা চা টেবিলে রেখে ছেলের চুল টাওয়াল দিয়ে মুছে দিয়ে বলে, ” বাবু, আলমারিতে পাঞ্জাবি রাখা আছে। রেডি হো তাড়াতাড়ি। আর ড্রাইভার নিয়ে যাবি। একা ড্রাইভ করে যেতে হবে না।”
–” বড় হয়ে গেলাম, বিয়ে দিয়ে দিচ্ছো তাও বাবু বলে ডাকা অফ করবে না?”
–” সারাজীবন বাবু বলেই ডাকবো। আমার নাতি-নাতনীদের সামনেও তোকে বাবু বলে ডাকব দেখিস! ”
সমুদ্র চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, ” তাহলে নাতি-নাতনীদের কি বলে ডাকবা আম্মু?”
মিসেস রোদেলা একটু ভাবুক হয়ে বললো, ” বাবু জুনিয়র।”
সমুদ্র হেসে বলে, “ফানি।”
সমুদ্র আয়েসি ভঙ্গিতে চা খাচ্ছিলো। মিসেস রোদেলার কেন যেন মনে হলো ছেলের মধ্যে তাড়া নেই যাওয়ার। দেরি কেন না গেলেও ওর মধ্যে ব্যাকুলতা নেই।
–” কিছু কি হয়েছে?”
–” ক্লান্ত লাগছে মা। খুব ঘুমাতে মন চাচ্ছে।”
–” অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে ইচ্ছামতো ঘুমাস। দরকার হলে আগামীকাল দুপুর অব্দি ঘুমিয়ে তারপর বরযাত্রী নিয়ে যাস।”
সমুদ্র জানে সে যতোই টাল-বাহানা ও অযুহাত বানিয়ে ফেলুক না কেন, মা তাকে পাঠাবেই। লাভ নেই কোনোকিছু বলেও।
মিসেস রোদেলা নিজ গরজেই পাঞ্জাবি বের করলেন।
সমুদ্র বলে, ” পাঞ্জাবিও পড়তে হবে?”
–” অবশ্যই।”
অগত্যা রেডি হয়ে এসে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল সেটিংস করলো। মা তখন রুমে কি যেন খুঁজছেন। সে পারফিউম মাখতে গিয়ে পারফিউমের ব্রান্ড ও ফ্লেভার দেখে নেয়। ওর পছন্দের পারফিউম ছিলো এটা। এরপরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গায়ে মেখে হাত থেকে ফেলে দেয় পারফিউমটা৷ সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় বোতলখানা৷
মিসেস রোদেলা বলে, ” কি হলো?”
–” ভুলে হাত থেকে পরে গেছে৷ সর্যি।”
সে ফিরে এসে ছেলের হাতে সেদিনকার এনগেজমেন্ট রিং পরিয়ে দিলেন। সমুদ্রর একটু হাত কাঁপলো। ওইদিন বাসায় এসেই এটা খুলে রেখেছিলো। আবার পরানোর কি দরকার ছিলো? ড্রয়ারে রেখেছিল যেন কেউ না দেখে। মা তবে এটাই খুঁজছিলো!
সমুদ্র বের হয়ে গাড়িতে উঠেই সবার আগে রিংটা খুলে পকেটে ঢুকালো। এরপর ফোন হাতে নিতেই দেখে, অনেকগুলো মিসড কল এসেছে। পিউ-শ্রাবনের। অথচ সে টের পায় নি। ফোন সাইলেন্টে ছিলো বুঝি! খেয়ালও নেই তার।
অবশ্য জীবনের যে পর্যায়ে সুখ স্বয়ং সাইলেন্ট অবস্থায় আছে, সেখানে ফোন সাইলেন্ট থাকবার খোঁজ রাখা কেবলই নিজের সঙ্গে মশকরা বৈকি কিছুই নাহ!
রাত সাড়ে আটটারও বেশি বাজছিলো৷ আয়নার হাতে তখন মেহেদী লাগানো হচ্ছে। হাতের তালুর দিকে মেহেদী পড়ানো প্রায় শেষের দিকে। গেস্ট মোটামুটি সবাই এসে যাচ্ছে। কিন্তু আয়না একটু অস্থির চিত্তে৷ ছাদের সদর দরজার দিকে তাকিয়ে আছে৷সমুদ্র আসছেন না কেন এখনও? দেরি কেন করছেন উনি? সে একাই চিন্তিত না। সমুদ্রের বোন পিউকেও খুব আপসেট দেখাচ্ছে। সব আত্মীয়রা প্রশ্ন করছেন কেন ছেলে এখনো আসেনি! কোনো সমস্যা কীনা! তাদের কাছে উত্তর নেই। ফোনও ধরেনি যে আপডেট পাওয়া যাবে৷
আয়নার পিউয়ের জন্য মায়া লাগলো। মেয়েটার হাবভাব এমন যে বড়ভাই দেরি করায় সব দায় যেন ওর। আয়নার মনে হয়, সমুদ্র আর পিউ নিজের ভাই-বোন না। হতেই পারে না। ইন ফ্যাক্ট, সমুদ্র এই পরিবারের ছেলেই না। ওকে নিশ্চয়ই ব্রীজের সামন থেকে কুড়িয়ে এনেছে। নাহলে এতো মিষ্টি একটা ফ্যামিলির ছেলে এতো তেতো কেন? সুইট বোনের বিটার ভাই কেন?
ঠিক তখনই শোরগোল শোনা গেলো। শোরগোলের উৎস খুঁজতে গিয়ে আয়নার সদর দরজার সামনে চোখ গেলো। সমুদ্র এসেছে৷ হাতে ফুলের তোড়া সমেত এসেছেন জনাব। কিন্তু আয়নার ওর চোখের দিকে তাকাতেই খটকা লাগে৷ কেমন নীলচে মনির চোখ দু’টো লাল লাল আভা ছড়াচ্ছে।রেগে আছেন নাকি?
তাকে ঘিরেই জটলা। আয়না চোখ ফিরিয়ে নিলো।
সমুদ্র তখন পিউ আর আলিয়ার সঙ্গে কথা বলছিলো। আলিয়া বলে, ” ভাইয়া, আপনার জন্য সেই বিকেল থেকেই অপেক্ষায় আছি।”
— “দেরি হয়ে গেলো। দুপুরে মিটিং ছিল। আসার পথে এতো জ্যাম৷ কিছু করার ছিলো না।”
আলিয়া বলে, ” বুঝতে পেরেছি ভাইয়া। ইদানীং খুব জ্যাম রাস্তায়।”
সমুদ্র এগিয়ে যায় আয়নার দিকে। ঢাকা শহরে থাকার একটা সুবিধা হলো কোথাও দেরি করলে রাস্তার জ্যামকে দায়ী করে পাড় হওয়া খুব সহজ। আয়নার পানে একবার তাকালো সে। তার কিনে দেওয়া লেহেঙ্গাটাই পড়েছে। বেশ মানিয়েছেও তাকে। দুইহাত ভর্তি মেহেদী দিয়ে বসে আছে। চোখ নিচের দিকে। সে এগিয়ে এসে ফুলের ব্যুকেটা তার সামনে রাখলো। লালচে খয়েরী গোলাপের ব্যুকে এনেছে সমুদ্র। ওখান থেকে একটা লাল গোলাপ টেনে বের করে আয়নাকে দিলো৷ আয়না হতভম্ব হয়ে তার দিকে চোখ তুলে তাকায়। সে কি ভুল দেখছে? সমুদ্র তাকে ফুল দিচ্ছে! এ আদৌও সম্ভব?
সমুদ্র বললো, ” বেশি লেইট করে ফেললাম নাকি?”
মেহেদী পড়া হাতে আয়না আলতো করে গোলাপ হাতে নেয়। মুখে কিছু বললো না।
সে পুনরায় বললো,” একটু প্রবলেমে আটকা পড়েছিলাম। হোপ সো ইউ উইল আন্ডারস্ট্যান্ড!”
মেহেদী আর্টস্ট বলে, ” ভাইয়া আপনি দেখছি দারুণ রোমান্টিক। দেরি করেছেন জন্য সর্যি গিফটও এনেছেন। বাহ! বাহ!”
আয়না তখন সমুদ্রের দিকে তাকালো। দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে থাকে দু’ মাইক্রো সেকেন্ড। আর্টিস্ট মেয়েটা বুঝলো মেহেদী দেওয়া হাতে ফুল ধরতে আয়নার অসুবিধা হচ্ছে।
তাই সে বলে উঠে, ” ভাইয়া এতো যত্ন করে ফুল দিয়েছে৷ আপু আপনি চুলে গুঁজে নেন গোলাপটা। দারুণ মানাবে আপনাকে। আপনার লেহেঙ্গার সঙ্গে ফুলটা যাবেও সেই রকম।”
আয়নার বাম কানের সাইডে খোপার সঙ্গে লাল গোলাপ বেঁধে দেওয়া হলো। গর্জিয়াস লেহেঙ্গার সঙ্গে আয়না একদম কোনো জুয়েলারি পরেনি। কাজেই ফুল গুঁজে দেওয়ায় যেন ষোলা আনা পূর্ণ হলো। সমুদ্র একধ্যানে তাকিয়ে থাকে।
আলিয়া সেটা দূর থেকে লক্ষ্য করে বলে উঠে, ” ভাইয়া জানি আপা অনেক সুন্দরী। তাই বলে ফুলটাইম আপার দিকে তাকিয়েই থাকা লাগবে?”
সমুদ্র একটু নড়েচড়ে উঠলো, এরপর বললো, ” আমি আসছিই তো তোমার বোনকে দেখতে।মেহেদী পড়ছো তোমরা। আমার আর কী কাজ আছে?”
আলিয়াসহ বাকি সবাই বললো, ” ভাইয়া আপনিও মেহেদী পড়েন তাহলে। ”
সমুদ্র মুখ বাকিয়ে বলে, ” এই হোপ, ছেলেরা আবার মেহেদী পড়ে নাকি?”
মেহেদি আর্টিস্ট বলে,” আপুর নামটা আপনার হাতে লিখে দেই ভাইয়া?”
সমুদ্র-আয়না দু’জনে পিলে চমকে উঠে। সমুদ্র মনে হয় মেহেদি পড়ার কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলো। ওর ওমন চেহারা দেখে আয়নার হাসি পায় বেশ৷ সমুদ্র অশান্ত অবস্থায় হাতের আঙুলে মোচড়াতে লাগে৷ রিংটা খুলে ফেললেও পরে কোনো এক কারণে আবারও এ বাসায় আসার আগে পরে নিয়েছে৷
সমুদ্রকে পুনরায় জোড়াজোড়ি করা হয়। এবারে সে মুখ খুললো। বলে উঠে, ” হাতে নাম না লিখে মনে নামটা লিখে রাখলাম। প্লিজ হাতে মেহেদী না।”
আয়না তার এমন কথায় হাল্কা ভীমড়ি খায়। সমুদ্রের অবস্থা দেখে তারও মায়া হয়। বেচারা মেহেদী পড়ার ভয়ে কেমন চুপসে গেছে।
সে সমুদ্রকে ডিফেন্ড করে বলে, ” থাক তো। বাদ দাও। ওনার এসব মেয়ালি জিনিস পছন্দ না।”
মেহেদী আর্টিস্ট অনেক সময় নিয়ে আয়নার হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছিলো। হাতের মধ্যখানে সমুদ্র নামটাও লিখে দিলো। মেহেদী হাতে লাগানো শেষ করার নামও নেই আর্টিস্টদের মধ্যে । আয়নাও অতি আগ্রহী হয়ে বসে বসে মেহেদী লাগানো দেখছে। সমুদ্র নিজেই বিরক্ত হয়ে উঠে। সে মনে মনে ভাবে, মেয়েরা মেহেদী পড়ার সময় যতোটা ধৈর্য্যশীল থাকে, এমন ধৈর্য্যশীল হয়ে স্বামীর কথা শুনলে কোনোদিন কোনো দম্পতির মধ্যে ঝগড়াই হতো না।
এমন সময় ছাদে মিউমিউ শব্দের আওয়াজ পাওয়া যায়। বিড়ালের আওয়াজ শুনেই কান খাড়া হয়ে আসে৷ সমুদ্রের । আশেপাশে তাকাতেই দেখে তার দিকে একটা সাদা বিড়াল ছুটে আসছে। সে সঙ্গে সঙ্গে এক প্রকার লাফালাফির ভঙ্গিমায় চেয়ারে লাফ দিয়ে পা তুলে উঠে বসে বলে উঠে, ” ওহ গড! এইসব কী!”
মিউমিউ ডাক তুলে মিলি আয়নার কাছে এসে দাঁড়ায়। সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে বলে, ” এই! এই! না! যাও! এই বিড়াল কেন এখানে? আজব!”
ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৭
আয়নাসহ মেয়ে পক্ষের সকলের মধ্যে চাপা উত্তেজনা। এই প্রথম কোনো বিয়ের ফাংশনে জামাইকে পা তুলে চেয়ারে উঠে চেচামেচি করতে দেখা যাচ্ছে৷
পিউ ছু’টে এসে বললো, ” বিড়াল কে এনেছে? ভাইয়া তো বিড়াল ভীষণ ভয় পায়। বিড়াল যেখানে ভাইয়া সেখানে যায়ই না। বিড়াল থেকে পালায় থাকে।”