ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ১০
Arishan Nur
বিয়ের দিন সকাল দশটার পর আয়নার ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম থেকে উঠে তার বেশ সতেজ অনুভূত হলো। মাথাব্যথা, খারাপ লাগা এমনকি পা ব্যথা কোনোকিছুরই অস্তিত্ব খুঁজে পায় না শরীরে। বরং অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি ফ্রেশ লাগছে। সে আড়মোড়া ভেঙে ফোন হাতে নিয়ে দেখে সকাল সাড়ে সাত’টার দিকে সমুদ্রের একটা মিসড কল। তার গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে যায়৷ সমুদ্র বোধহয় মেডিসিন দেওয়ার পরও কিয়ৎক্ষণ পর আরেকবার এসেছিলো রুমে৷ ওইসময় আয়নার চোখ ভর্তি ঘুম থাকলেও হাল্কা জাগ্রত ছিলো সে। সমুদ্র যে তার পায়ে মলম লাগিয়ে দিয়েছিলো সে খেয়াল আছে তার। আয়নার বিয়ের দিনের সকালটা বেশ ভালো গেলো। ঘুম থেকে উঠে সে বাবার কাছে গেলো। বাবা তুমুল ব্যস্ত থাকার পরও তাকে নিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে বসলেন। আয়না বাবার সঙ্গে নাস্তা করলো৷ আলিয়া এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে বলে, ” আপা তোমার মেহেদী দেখি।”
আয়না নিজের দুইহাতের দিকে তাকালো। মেহেদী সারা রাত ধরে লাগানোই ছিলো। এতো ঘুমে ছিলো যে তোলা অব্দি হয়নি রাতে৷ আয়নার হাতভর্তি মেহেদীতে লালচে রঙ এসেছে ৷ তবে সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে আরোও গাঢ় হবে মেহেদীর রঙ৷
সে খাওয়া ছেড়ে উঠে হাতে সরিষার তেল মাখলো, এতে করে নাকি আরোও রঙ গাঢ় হয়। বারোটার মধ্যে আয়নাদের বাসার পরিস্থিতিতে ওভার উৎসব ভাব চলে এলো। তার বাবার যেন সবকিছুতে এলাহি কারবার করার ইচ্ছা জেগেছে। একটা গরু, একটা খাসি জবাই করা হলো। গ্যারেজেই বাবুর্চি এসে রান্নার আয়োজন করছে। ছাদে খাওয়ার ব্যবস্থা করা আছে। ঘরে ইভেন্ট প্ল্যানারা এসে ফুল দিয়ে বাসা-ঘর সাজাচ্ছে। বিল্ডিং এ মরিচ বাতি ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। হুলুস্থুল কাণ্ড যেন!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আয়না অবাক হয়, বাবা আকদতেই এই অবস্থা করে ফেলেছেন, বিয়ের মেইন অনুষ্ঠান আসলে কি করবে? আচ্ছা এতো এতো আয়োজনের মধ্যে সমুদ্রকে কি যৌতুক ও দিতে হবে? এ’ব্যাপারে উনি আদৌ কিছু বলেছেন? হয়তোবা বাবার কাছে যৌতুক চেয়েছে! তার বাবার উপর আর কতো চাপ দিবে? যৌতুক শব্দটা মাথায় আসার পর কেবল ওইটাই ঘুরঘুর করতে লাগলো। মাথা থেকে কিছুতেই সরাতে পারছে না। সে দ্রুত সমুদ্রের নাম্বারে ডায়াল করে৷ কোনো কিছু নিয়ে জিজ্ঞাসা থাকলে সরাসরি কথা বলাই উত্তম।
সমুদ্র একদম সকাল ছ’টার দিকে উঠে প্রোটিন শেক পান করে রাস্তায় কিছুক্ষণ জগিং করেছে। এরপর বাসায় ফিরে বিশ মিনিট ফ্রি হ্যান্ড এক্সসারসাইজ করে নাস্তা করে দেখে বাসায় কেউই ঘুম থেকে উঠেই নি। সে ফের রুমে ফিরে গিয়ে কিছুক্ষণ ল্যাবটবে সব ইমেইল চেক করে৷ তবুও সময় কাটেনি জন্য পুনরায় ঘুমাতে যায়। বাংলাদেশে আসার পর ঘুমানোর সময় বেশি পাচ্ছে৷
ফোনের আওয়াজে তার তীব্র অসময়ের তন্দ্রা সামান্য ছু’টে যায়। সে হাতড়ে ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখে। আয়না ইজ কলিং দেখে প্রায় ঘুমন্ত অবস্থায় ফোন রিসিভ করে। তার মনে হচ্ছিলো ফোন কানে নিয়েই সে ঘুমিয়ে যাবে৷
আয়না ওপাশ থেকে কিসব বললো। কেন যেন মাথায় কিছুই ঢুকলো না সমুদ্রের। তবে ও যখন বলে, ” আপনি কি যৌতুক চান?” সমুদ্র ঘুমের ঘোরে টলতে থেকে বললো, ” হু। দাও।”
— ” কিভাবে দিবো আপনাকে?”
সারাদিন অফিস সংক্রান্ত কর্ম মাথায় ঘুরে, সে না বুঝেই বলে, ” ইমেইল পাঠাও। নাহলে ড্রাইভে সেন্ড করতো। দেখছি।”
আয়না একটু জোরে করে হতভম্ব হয়ে চেচিয়ে উঠে বললো, ” যৌতুক ও আপনাকে ইমেইল পাঠিয়ে দিতে হয়?”
সমুদ্রের তখন সবে ঘুম ছ’টে, ব্রেইন অবসর থেকে কাজে নামলো। সে চোখ কচলিয়ে বললো, ” কি বলছো? আবার বলো। ঘুমে ছিলাম বুঝতে পারি নাই।”
আয়না কাচুমাচু করে বলে, ” আপনি কি বিয়ে করার সময় যৌতুক নিচ্ছেন?”
সমুদ্র ফোনের এ’প্রান্ত থেকে বলে, ” যৌতুক আবার কী?” এরপরে এক সেকেন্ড থেমে বলে, ” সারাদিন মাথায় এসব উদ্ভট জিনিস ঘুরে কেন?”
আয়না দৃঢ়তার সঙ্গে বলে, ” উদ্ভট কেন হতে যাবে? সমাজে এসব হচ্ছে না?”
সমুদ্র বলে, ” সমাজে তো দেনমোহর ব্যবসাও হচ্ছে। আমি কি বলেছি নাকি তুমি দেনমোহর নিয়ে ব্যবসা করছো?”
–” আপনি আমাকে দেনমোহরও দিবেন?”
সমুদ্র ফোন কানে নিয়েই চিত হয়ে শুয়ে বলে, ” তোমার কি মনে হয় আমাদের বিয়েটা খেলা-খেলা বিয়ে? টয় ম্যারেজ?”
–” তা নয় তবে আপনি তো কিছুই বলেননি আমাকে। ”
–” তোমার বাবা সরাসরি আলাপ করে নিয়েছে৷ তাছাড়া ছোট মানুষ তুমি, এজন্য তোমার সাথে আলোচনা করিনি।”
–” আমি ছোট মানুষ হলে, ছোট মানুষকে বিয়ে কেন করছেন?”
সমুদ্র দু’পল ভাবলো এরপর উত্তর দিলো, ” ছোটকে বিয়ে করা যায় কিন্তু টাকা-পয়সার আলাপ করা যায় না।”
আয়না আরোও কিছু বলতে চাচ্ছিলো তার আগেই সমুদ্র বলে উঠে, “একটু পর তোমার বাসার উদ্দেশ্যই বের হবো। তখন যা বলার বলবে।”
আয়নার তখন বউ সাজা প্রায় শেষ। ঘোমটার সেটিং করানো হয়ে গেছে৷ লাল শাড়িতে তাকে সত্যিকারের বউদের মতোই লাগছে। সে বারবার নিজেকে মিররে দেখছে। বিশ্বাস ই হচ্ছে এই বউটা সে নিজে!
আলিয়া একটু পর পর রুমে আসছে৷ আকদ হওয়ায় বাসাতেই সাজানো হয়েছে তাকে। খুব বেশি সাজেনি। সিম্পেল সাজ যাকে বলে। আলিয়া এসেই বললো, ” আপা সুন্দর করে হাসো।”
আয়না হাসি দিতেই সে ছবি তুলে ফেলে বললো,”
দুলাভাইকে তোমার ছবি পাঠাবো।”
আয়না ঠোঁট বাকিয়ে বলে, ” ওনার সময় আছে নাকি ছবি দেখার?”
আলিয়া এক মিনিট পর হাসি দিয়ে বলে, ” দুলাভাই তোমাকে দেখার জন্য উদগ্রীব! দেখো মুহূর্তের মধ্যে সীন করে, তোমার আরোও ছবি দেখতে চাচ্ছে!”
আয়না ছোঁ মেরে ফোনটা তার হাতে নিয়ে দেখে আসলেই ম্যাসেঞ্জারে সমুদ্রের সঙ্গে আলিয়ার চ্যাটিং হয়েছে৷ সমুদ্র তার ছবিতে লাভ রিয়্যাক্টও দিয়েছে। আবার আলিয়াকে উদ্দেশ্য করে ম্যাসেজ দিয়েছে, অনেক সুন্দর লাগছে। আরোও ছবি তুলে এখনি পাঠাও।
আয়না মনে মনে বলে, ” বজ্জাত ব্যাটা অন্যদের সামনে ভাব এমন ধরে যেন কতো দরদ তার, অথচ ফাঁকা বাশ ভেতর ভেতর।”
আলিয়া ভয়েজ ম্যাসেজ দিলো, ” ভাইয়া, এভাবে তো ফ্রিতে বউ দেখা যাবে না। বোনাস গিফট দিলে আমি ভেবে দেখতে পারি।”
আয়না ভাবেনি এটারও রিপ্লে উনি দিবেন। প্রয়োজনীয় ইমেইল ছাড়া যে একটা বাড়তি টেক্সট দেয় না তার এতো আজাইরা সময়ও হবে! কিন্তু সমুদ্র রিপ্লে দিলো। আয়নাও পড়লো কি লিখেছে৷ সে টেক্সট দিয়েছে কিছুটা এমন, ” নিজের বউকে দেখতেও বোনাস গিফট দিতে হয়? আপু, তুমি তো আমার চেয়েও বড় ব্যবসায়ী! ঠিক আছে দিবো গিফট তোমাকে। এবার ছবি পাঠাও।”
আয়না টাস্কি খেল টেক্সটটা পড়ে৷ আলিয়া কিছুক্ষণ জোরে জোরে হেসে আয়নার আর একটামাত্র ছবি তুলে পাঠালো। ওটাও সঙ্গে সঙ্গে সীন হলো। আয়না আর দেখলো না। সে বউ সেজে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়ালো। উপস্থিত আত্নীয়দের সঙ্গে আন্তরিক ভাবে ছবি তুললো। বাবার সাথে ছবি তুলে৷ মিলিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে ছবি তুললো। আজ সে কেন যেন বেশ খুশি। অথচ এক সপ্তাহ আগেও পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে এই দুশ্চিন্তায় সে অসুস্থ বোধ করছিলো৷ কিন্তু একটু পর যে তার বিয়ে এতে তার কোনো কষ্ট হচ্ছে না। বরং সমুদ্রের জন্য অচেতন মূলকভাবে হলেও অপেক্ষায় আছে৷
জামাইবাবু বিড়াল হয় ভয় জন্য মিলিকে বারান্দায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ বরযাত্রী এলো ঠিক ছয়টার দিকে। একদম ঘড়ি ধরা সময়ে এলো তারা। আয়না তখন রুমে বসেছিলো।
সমুদ্রের জন্য দরজায় ফিতা দিয়ে গেইট ধরা হলো। টাকা না দিলে মেয়েপক্ষরা বরকে ভেতরে যেতে দিবে না। সমুদ্র এমনিতেই ঘাউড়া, সে মোটেও টাকা দিতে রাজী নয়। পিউ-শ্রাবনকে জানায় দিলো, ওদের বলতে যে বর কোনো টাকা দিবে না৷ এমনি গেইটের ফিতা খুলে দিতে। কিন্তু ওরা দুইজন সমুদ্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলো।
ফিতার ভেতর দিয়ে টপকে ওদিকে গিয়ে আলিয়ার সঙ্গ দিয়ে বললো, ” ভাইয়া, জলদি ভাবীর ননদ, বোন আর দেবরকে বিয়ের গেইট ধরা বাজেট দাও। আফটার ওল ভাইয়ার বউয়ের জন্যই তো বাজেট পেশ করছি!”
সমুদ্র নিজের দলের মন্ত্রী-সৈন্যকে বিপক্ষ দলে ভীড়তে দেখে হতাশ হয়ে পকেট থেকে টাকা বের করে দেয়। সে বুঝেই গেছে ওর সবদিকই লস আজ।
টাকা দেওয়ার পর আলিয়া ফিতা খুলে দিয়ে, শরবত আর মিষ্টি খাওয়ালো। সোফায় বসার পর সমুদ্র বারবার আয়নাকে খুঁজতে থাকে। আয়নাকে দেখতে না পেয়ে সে আলিয়াকে জিজ্ঞেস করে, ” তোমার আপু কোথায়?”
আলিয়া হাসিমুখে জবাব দেয়, ” আপা রুমে। কাজী সাহেব ডাকলে, বিয়ে পড়ানোর সময় এসে বসবে। ভাইয়া কি আপুকে বেশি মিস করছেন?”
সমুদ্র কী বলবে ভেবে পেল না। সে দেখলো তার ফোনে ফ্রেন্ডরা কল দিচ্ছে৷ নিশ্চয়ই তাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য। সে রিসিভ করতে পারছে না। তবে নীলার ফোন ধরলো সে। নীলার কন্ঠস্বর কেমন কঠোর লাগলো ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে। ও বলে উঠে, ” দোস্ত, যতো ঝড়ই আসুক না কেন আজ তুই আয়ানকেই বিয়ে করবি। প্রমিজ কর আমাকে।”
সমুদ্র করে বলে, ” বিয়ে করতেই এসেছি ওকে।”
নীলা বলে, ” তোর ভাগ্যে আয়নাই আছে। এজন্য ওকে পেতে যাচ্ছিস তুই। তোরা সুখী হো। বাকি সব কিছু ছলনা, কেবল আয়নাই তোর জন্য সত্য।”
সমুদ্র বুঝে পায় না নীলার এসব কথা বলার অর্থ কি? সে ফোন রেখে কাজী আসার অপেক্ষায় থাকে। ঠিক সাতটার দিকে যখন কাজী আসলো। মেয়েকে নিয়ে আসার পালা এখন। ওমন সময় সমুদ্রের ফোন বেজে উঠে৷ আয়নাকে তখন ড্রয়িংরুমে আনা হচ্ছে। লাল শাড়ি পড়ে বউ সাজে আয়না উপস্থিত হলো যখন, ওই সময় সমুদ্রের ফোন ভাইব্রেট হচ্ছিলো।
ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৯
সে স্ক্রিনে তাকাতেই ভুত দেখার মতো পিলে চমকে উঠে। স্ক্রিনে ভেসে উঠা নামটা বহু প্রতিক্ষিত একটা নাম। বহুবার চেয়েছে এই নাম্বার থেকে একটামাত্র কল আসুক। সে বিড়বিড় করে “ইউশা” নামটা উচ্চারণ করে। চারপাশ অন্ধকার দেখলো সে। ও কেন কল দিচ্ছে? আর কি চাই সমুদ্রের কাছে? আরোও বেশি করে ওকে ভেতর থেকে ভেঙে দিতে কল করেছে? নাকি ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে?