দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৪

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৪
তাসফিয়া হাসান তুরফা

দোলা নিশীথের সামনে দাঁড়ায়। নিশীথ ওর দিকে তাকায়না আজ, বরং উদাসীন ভাবে আকাশ দেখতেই ব্যস্ত! মানুষের একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে। যখন খুব মন খারাপ হয়, আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের পানে মন খারাপ আড়াল করতে থাকে। নিশীথও এখন তাই করছে। ওকে এমন দেখে দোলার মন মোমের ন্যায় গলে যায়। নিশীথের গালে হাত রেখে বলে,

—আপনার কি এজন্য মন খারাপ?
—যে বিষয় দেখার অভ্যাস আছে তা নিয়ে আর মন খারাপ করে কি হবে!
নিশীথ হেসে বলে। দোলা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
—পৃথিবীতে এমন অনেক মা-বাবা আছে যারা নির্দিষ্ট কোনো সন্তানের প্রতি দূর্বল। এটা শুনতে কষ্টকর হলেও আমাদের কিছু করার নেই। এ বিষয়ে আপনার মন খারাপ কিভাবে দূর করবো আমি জানিনা তবে এটা বলতে পারি যে এমনটা শুধু আপনার ক্ষেত্রেই হয়নি, আপনার মতো আরও হাজার সন্তান আছে! এমনকি আমার বাসাতেও আছে!
—কে?
—কামিনি!
দোলা হেসে বলে। নিশীথ ভ্রু কুচকে তাকালে ও বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—মা আমাদের তিন ভাইবোনের মাঝে আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। হয়তো আমি প্রথম সন্তান তাই! এটা ওরা দুইজনও জানে। শিমুল এটা নিয়ে কিছু না বল্লেও কামিনি ছোটবেলায় ভীষণ রাগ করত। অভিমান করে কথা বলতোনা আমাত সাথে। কিছু হলেই আমাকে বলতো “তুমি তো মায়ের ফেবারিট, তুমি বল্লে মা ঠিকি শুনবে!” এরপর মায়ের সাথেও এটা নিয়ে রাগারাগি করতো। পরে অবশ্য মা বসে ওকে আদর করে বুঝিয়ে দিতেন যে তিনি ওকেও ভীষণ ভালোবাসেন, শুধু আমাকে একটু বেশি। এই যা! তো আপনিও কিছু মনে করেন না প্লিজ। আমি জানি হয়তো মন খারাপ হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, তবে এমনটা প্রায় পরিবারেই হয়।

—তোমার মা তাও কামিনিকে কাছে টেনে বুঝিয়েছে এ ব্যাপারে। স্বাভাবিক একটা সম্পর্ক আছে তাদের মাঝে। অথচ বড় হওয়ার পর আমার সাথে বাবার শেষ কবে ওমন স্নেহের কথোপকথন হয়েছে আমার ঠিক মনে নেই!
নিশীথের কথাগুলো দোলার বুকে গিয়ে লাগে! বিয়ের আগে ও বাইরে থেকে দেখে ভাবতো, নিশীথের স্বচ্ছল জাঁকজমকপূর্ণ জীবনে কোনোকিছুর অভাব নেই। অথচ যবে থেকে ওকে বিয়ে করেছে, নিশীথকে পুরোপুরি চিনেছে, দোলার মন থেকে এ ভ্রান্ত ধারণা দূর দূর করে পালিয়েছে! আমরা সবসময় বাইরে থেকে মানুষের জীবন সম্পর্কে যা দেখি বা শুনি, বাস্তবে আদৌ যে তার জীবন সে ছবির মতোই হাসিখুশি হবে, তার মানে নেই। বাস্তবতা বড় কঠিন, অত্যন্ত বিশ্রি। নিশীথের জীবনটাও যেন তার অনন্য প্রমাণ! ওর জীবনে কখনো বাহ্যিক কোনোকিছুর অভাব না থাকলেও, অভ্যন্তরীণ অভাব বেশ আছে। বাবা থাকার পরেও যে বাবার আদর-ভালোবাসা পায়নি তার চেয়ে অভাবী আর কেউ আছে?

আর সে কীনা এমন এক মানুষকে ভালোবাসতে কার্পণ্য করছিলো? রাগে দোলার নিজের প্রতি ঘৃণা আসে। ওর মাথায় বারবার নিশীথের বলা প্রশ্নটুকু ঘুরপাক খায়! ঠিক কতটুকু কষ্ট বুকে চেপে রাখলে কোনো মানুষ ওভাবে কথাটা বলে? আচ্ছা, আয়মান সাহেব কি নিশীথের এ কষ্ট জানেন? তার নিজেরও কি কষ্ট হয়না সন্তানের থেকে এ দূরত্বে? নাকি সব আদর-ভালোবাসা-কষ্ট শুধুই নিশানের জন্য?
আজ দোলার আয়মান সাহেবের উপর রাগ হয়। প্রচন্ড রাগ! যে বাবা দুই সন্তানের মাঝে এমন প্রত্যক্ষদর্শী আচরণের ভিন্নতা দেখায়, সে বাবার প্রতি যেকোনো মানুষেরই ক্ষোভ ব্যতীত আর কিছুই আসবেনা!

নিজ রুমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে একটি হাতঘড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আছেন আয়মান সাহেব। ঘড়িটি মূলত নিশীথের। যেটা সেদিন ওর রুম পরিষ্কার করতে যেয়ে খুজে পেয়েছিলো কাজের মেয়ে, তা আসমা বেগমকে দিয়েছে এবং তিনি ছেলের প্রিয় ঘড়িটা সযত্নে নিজের ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিয়েছেন। আয়মান সাহেব চিরুনি নিতে ড্রয়ার খুলতেই নিশীথের এ ঘড়িটা তার চোখে পড়ে। সাথে সাথেই তার মনে পড়ে যায় এ ঘড়ি নিয়ে ছেলের কিছু স্মৃতির কথা! নিশীথ তখন ভার্সিটিতে প্রথম সেমিস্টার। বাইক, ঘড়ি, নিত্যনতুন গ্যাজেটস এর প্রতি নিশীথের ভীষণ দূর্বলতা! রোজ নতুন নতুন স্টাইলে ভাব মেরে ভার্সিটি যায়।

এমন পারসোনালিটির কারণে পুরো ভার্সিটি জুড়েই ছিলো ওর বেশ নামডাক। একদিন কি যেন মারামারিতে জড়িয়ে হস্তাহস্তির এক পর্যায়ে নিশীথ নিজেও ব্যাথা পেয়েছিলো, সাথে ওর সাধের প্রিয় ঘড়িটাও ভেঙে গেলো। ওদিন বেচারার কত্ত মন খারাপ। একেতো এত্ত দামী ঘড়ি, তার মাঝে লিমিটেড এডিশন হওয়ায় ঘড়িটা পাওয়া মোটেও সহজলভ্য কিছু না। অনলাইন, টাইমজোন সব জায়গা খুজেও নিশীথ কোথাও পেলোনা। কিছুদিন পর ওর বার্থডে। আয়মান সাহেব দেশে ছিলেন না তখন। আরেফীন সাহেবের থেকে যখন শুনলেন নিশীথের এই অবস্থা তখন লন্ডনে বসে তিনি ঘড়িটার ব্যবস্থা করে দিলেন। পাউন্ড হিসেবে দাম বেশি পড়লেও ছেলের জন্মদিনের গিফট হিসেবে ঘড়িটা পাঠিয়ে দিলেন দেশে। ঘড়ি পেয়ে নিশীথের খুশি দেখে কে! ওর খুশি দেখে আরেফিন সাহেব জানাতে ভুলে গিয়েছিলেন ঘড়িটা তিনি ওর হাতে দিলেও আসলে সেটা কে পাঠিয়েছে ওর জন্য। ফলে নিশীথেরও আর জানা হয়েছিলোনা বাবার কথা।

আয়মান সাহেব রোজ লক্ষ্য করতেন, ছেলে তার এই ঘড়ি ছাড়া বাইরেই যেতোনা! সযত্নে রাখতো ঘড়িটাকে। আর আজ কিনা এতগুলো দিন পেরোলো অথচ জীবনের ব্যস্ততায় ঘড়ি তো দূরের কথা শখের কোনোকিছুরই পরোয়া নেই নিশীথের। যেন শখের নারীকে পেয়ে শখের সবকিছুই দিব্যি ভুলে গেছে সে! আয়মান সাহেব নিশীথকে মনে করে বড়সড় এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন বুকের অন্তঃস্থল থেকে। এইযে এত বছর পর নিশান দেশে ফেরার খুশিতে আজ তারা বাইরে খেতে যাবেন, কাকতালীয় ভাবে নিশান বেছে বেছেই যেন নিশীথের পছন্দের রেস্টুরেন্ট বুক করেছে গুলশানে। অথচ তারা সবাই যাবে সেই নিশীথ বাদে। কেন সে এখানে থাকতে পারলোনা? কেন আলাদা হয়ে গেলো তাদের থেকে? ওর কি একটাবার খারাপ লাগেনা বাবার কথা ভেবে? নাকি সারাজীবন মা ও দাদুকে ভালোবাসতে বাসতে বাবাকে ভালোবাসার কথা ভুলেই গেছে সে?

—নিশীথকে মিস করছো?
আয়মান সাহেব যখন নিজের ভাবধ্যানে মগ্ন, ঠিক তখন নিশানের গলা শুনে তিনি চমকে উঠেন। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখেন নিশান হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে, মুচকি হেসে তার দিকে তাকিয়ে। খানিকটা পরখ করে উনি দেখলেন, নিশান আদৌ তার দিকে নয় বরং তার হাতে ধরে রাখা নিশীথের ঘড়িটার দিকে চেয়ে হাসছে! আয়মান সাহেব খানিকটা লজ্জা পেলেন যেন। কাচুমাচু করে আবার ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে ঘড়িটা তুলে রেখে নিজেকে স্বাভাবিক করে চিরুনি হাতে চুল আচড়াতে আঁচড়াতে বললেন,

—ওকে মিস করার কি আছে?
বাবার কথায় ও তার চমকে যাওয়া রিয়েকশন দেখে এতক্ষণে নিশানের পেট ফেটে হাসি পেলো। হো হো করে হেসে উঠতেই আয়মান সাহেব বিরক্তি নিয়ে ওর দিক চাইলেন। ও হাসি থামাতেই বললেন,
—হয়েছে তোর? এটা বলতে এখানে এসেছিলি?
নিশান হেটে এসে বলে,
—বলতে এসেছিলাম তো অন্যকিছু তবে তোমায় এত মনোযোগ আর আবেগ দিয়ে নিশীথের ঘড়ি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থেমে গেলাম। ছেলে হয় ও তোমার। মিস করতেই পারো, বাবা। এখানে ত্যাড়া ভাবে উত্তর দেওয়ার কি আছে?

—আমি কোনো কথা বললেই তো তোদের কাছে ত্যাড়া লাগে। ভালো কথা তো বলতেই পারিনা কখনো!
—আচ্ছা বাবা, রাগ করেনা। যেটা বলতে এসেছিলাম ওটা শুনো।
—হ্যাঁ, বল। কি বলবি?
—আমরা তো সন্ধ্যার পরপর বেরোচ্ছি। নিশীথকেও ফোন করে বলি। ফ্রি থাকলে ও আর দোলনচাঁপাও আসবে আমার সাথে!

নিশীথ আসবে শুনে আয়মান সাহেবের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো মুহুর্তেই! বিষয়টা নিশানের দৃষ্টিগোচর হলো সাথে সাথেই। ও বুঝলো, আয়মান সাহেব মুখে স্বীকার না করলেও নিশীথকে মিস করছেন এবং তিনি ওকে ডাকায় বেজায় খুশি! তাই বাপকে পরোখ করে দেখবার জন্য ও হঠাৎ মুখ গম্ভীর করে বললো,
—না থাক, হয়তো বিজি থাকবে। আমরা একাই যাই চলো! ওকে আমি অন্য কোনোদিন খাওয়াবোনি একা!
নিশান লক্ষ্য করলো, নিশীথকে বলবেনা শুনার সাথে সাথেই আয়মান সাহেবের মুখে নেমে এলো আধার। তবে তা ওর সামনে প্রকাশ না করার যথাযথ চেষ্টা করলেন তিনি। ভাবলেশহীন মুখে বললেন,

—দেখো যা ভালো মনে করো। তবে আমার মনে হয় ট্রিট যখন দিচ্ছোই সবাইকে একসাথে দেওয়াটাই বেটার। টাকা ও সময় দুটোই সেভ হবে!
—আচ্ছা? তাহলে ঠিক আছে। ওকে কল দিই যেয়ে।
—হুম

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৩

নিশান চলে যেতে নিচ্ছিলো। আয়মান সাহেবও পেছনে মুড়ে পারফিউম দিচ্ছিলেন। নিশান চলে যেতে নিয়েও একবার পেছন ফিরে তাকালো। উল্টোদিক ঘুরে থাকলেও আয়নার মাঝে আয়মান সাহেবের মুখে লেগে থাকা এক চিলতে হাসি ওর নজর এড়াতে পারলোনা!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৫