একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৩৫
Mousumi Akter
একটা পার্কে বসে আছে তন্ময় আর ছোঁয়া সাথে আছে মৃন্ময় এবং দ্বীপ। দ্বীপ মোবাইল ফোনেই ভীষণ ব্যস্ত আছে। দীর্ঘদিন দিন পর পরীর মত সুন্দর একটা মেয়ের সাথে ফেসবুকে রিলেশন হয়েছে। মেয়েটা ভীষণ লক্ষী। ওর নাম তাহারিম। বাসা রংপুর। লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপ হলেও মনের দূরত্ব বিন্দু পরিমান নেই। ভালবাসা খাঁটি হলে কাছে আর দূরে বলে কিছুই হয়না। দ্বীপ এক সাইডে বসে চ্যাটিং করে যাচ্ছে। মৃন্ময় ওদের দু’জনের মাঝের সমস্যা সলুউশনের চেষ্টা করছে। গতরাতে তন্ময় সু’ইসা’ইডের চেষ্টা করেছে। বোর্ড পরীক্ষা শেষ হলেই ছোঁয়ার এনগেজমেন্ট হবে। এবং ছোঁয়াও সে বিয়েতে সম্মতি জানিয়েছে। মৃন্ময় সারাহ’র সাথে কথা বলার জন্য উঠে গেলো। তখন তন্ময় নিরবতা ভেঙে ছোঁয়ার হাত ধরে অশ্রুসিক্ত চোখে বলল,
” তুই কি সত্যিই এ বিয়েতে রাজি ছোঁয়া।”
তন্ময়ের গায়ে আজ বেগুনি রঙের একটা পাঞ্জাবি, পরণে সাদা পায়জামা। ঘেমে পাঞ্জাবীর বুকের কাছটায় ভিজে গিয়েছে। ফর্সা সুন্দর মুখশ্রীতে দুঃচিন্তার ছাপ। কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। নাকের ডগা থেকে ঘাম বেয়ে পড়ছে। সিল্ক চুলগুলো ফ্যানের বাতাসে উড়ছে। ছোঁয়া এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার সামনে বসে থাকা রুপকথার নায়কের দিকে। তার পক্ষে কি আদৌ সম্ভব এমন সুন্দর পুরুষের ভয়ানক ভালবাসা উপেক্ষা করা। নারী কি টাকায় আটকায় নাকি ভালবাসায়? ছোঁয়া দম ধরে রইলো কিছুক্ষণ। ভেতরে কি চলছে কারো বোঝার উপায় নেই। তন্ময়ের থেকে হাতটা ঝাড়ি মেরে সরিয়ে নিয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” আমি রাজি না থাকলে কি বিয়ে হত? আমি এই বিয়েতে রাজি বলেই বিয়েটা হচ্ছে।”
ছোঁয়ার কথা যেন তন্ময়ের হৃদয়ে তলোয়ার চালানোর মত যন্ত্রণা দিলো। বুকে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। তবুও মন মানতে নারাজ। তন্ময় সম্পূর্ণরুপে সিওর এসব ছোঁয়ার মনের কথা নয়। তন্ময় আবারও ছোঁয়ার হাত নিজের দিকে টেনে নিলো। শক্ত করে ছোঁয়ার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
” ছোঁয়া জা’ন আমার। প্লিজ! ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। এমন করিস না প্লিজ! তোর দু’টো পায়ে ধরি আমি। তুই বললে এ শহরের সবাইকে ডেকে সবার সামনে তোর পায়ে ধরে তোকে ভিক্ষা চাইবো। তুই বললে আজীবন তোর বাবার গোলাম হয়ে থাকব। আমি তোর বাবার পায়ে ধরব। তুই যা বলবি তাই করব। শুধু আমাকে ছেড়ে যাসনা। তুইতো জানিস ছোঁয়া আমার জীবনে আর কেউ নেই। ভালবাসা বুঝতে শেখার পর থেকে আমি শুধুই তোকে ভালবাসি। আমার শিরা -উপশিরা, শরীর, মনে সর্বত্র জুড়ে শুধু তোর বসবাস ছোঁয়া৷ তুই জানিস তুই ছাড়া আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আমার অক্সিজেন তুই ছোঁয়া। এই পৃথিবীতে আমার সম্পদ বলতে মা আর তুই ছাড়া কেউ নেই ছোঁয়া। দু’জনের একজনকে ছাড়াও আমি বাঁচব না ছোঁয়া। ”
ছোঁয়া আবারও নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো তন্ময়ের থেকে। বেশ কঠিন গলায় বলল,
” তুই কি একটা বাচ্চা ছেলে তন্ময় এমন করছিস। তোর এত পা-গ-লা-মির মানে কী? আমরা তো বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড নই। উই আর জাস্ট ফ্রেন্ডস তন্ময়। অন্য কিচ্ছু নেই আমাদের মাঝে। আমি কি কখনো তোকে বলেছি তোকে আমি বিয়ে করব বা ভালবাসি তোকে। আমি যখন এমন কিছু বলিই নি তাহলে তুই কোন আশায় আমাকে নিয়ে এত কিছু ভেবে রেখেছিস?”
তন্ময় শান্ত থেকে অশান্ত হয়ে গেলো। শান্ত তন্ময় এই প্রথমবার গর্জে উঠে বলল,
” আমাদের মাঝে কিচ্ছু ছিলোনা মানে? না ছিলো কি? আমাকে যদি ভাল না বাসবি আমার প্রতিটা জন্মদিনে নিজের হাতে কেক বানিয়ে, আমার জন্য পায়েস রান্না করে আমার জন্য পাঞ্জাবী কিনে কেন দিস তুই? সাথে আমার মায়ের জন্যও শাড়ি। দেখ আজকের পরা পাঞ্জাবীটাও তোর দেওয়া। আমার দেওয়া প্রতিটা ফুল খুব যত্নে গুছিয়ে রাখা, আমার সাথে বৃষ্টিতে ভেজা, কোচিং শেষে পার্কে বসে গল্প করা, বাসায় যা রান্না করিস আমার জন্য গোপনে এনে খাইয়ে দেওয়া, আমার সামান্য অসুখ হলে আমার মায়ের মত পা’গ’ল হওয়া, রোজ রাতে টিউশনি শেষে দেখা করা, নড়াইল পদ্মবিলে গিয়ে পদ্মতোলা, এমন লক্ষাধিক স্মৃতি আছে, সেসব কি ভালবাসা নয়!”
ছোঁয়া অন্যদিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল,
” ওগুলা জাস্ট ফ্রেন্ড হিসাবে করেছি। তুই ফ্রেন্ডশীপের ভিন্ন মিনিং করলে দোষ কি আমার?”
তন্ময় ছোঁয়ার গাল ধরে নিজের দিকে ঘোরালো। চোয়াল শক্ত করে বলল,
” ওসব ফ্রেন্ড হিসাবে ছিলো? তাহলে তোকে আমি কিস করেছিলাম সেটা কি ছিলো। তুই সেই কিসের রেসপন্স ও করেছিস। সেটাও কি বন্ধুত্ব ছিলো? কিসের মত সুন্দর অনুভূতি একমাত্র ভালবাসার মানুষকেই করা যায়। উত্তর দে ওটাও ফ্রেন্ড হিসাবে নিয়েছিস।”
তন্ময়ের এট্যাকে ছোঁয়া উত্তর দেওয়ার ভাষা হারালো। বুকের মাঝে ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে তার। চোখে মুখে মিথ্যার স্পষ্ট জাল ধরা পড়েছে। চোখ মুখ কাঁপছে ছোঁয়ার। তন্ময়ের আকুতিভরা চোখের দিকে তাকাতে পারছেনা। তন্ময়ের হাত থেকে নিজের মুখটা সরিয়ে নিয়ে বলল,
” হ্যাঁ ওটাও এমনিই ছিলো। সবই এমনি ছিলো।”
তন্ময় এবার আরোও বেশী উত্তেজিত হয়ে বলল,
” মৃন্ময় কি তোকে কিস করেছে কোনদিন? দ্বীপ কি কিস করেছে। এতই যদি নরমাল ব্যাপার হত; তুই ওদের সাথেও করলি না কেন? তুই মিথ্যা বলছিস আমাকে। বাবার প্রেসারে বিয়েতে রাজি হচ্ছিস। কেন সত্য বলছিস না।”
ছোঁয়া এবার চিৎকার করে বলে উঠল,
” আমার ইচ্ছা আমি বিয়ে করছি, তোকে কেন সব কিছুতে কৈফিয়ত দিবো। তুই আমাকে ফোর্স করতে পারিস না তন্ময়।আমি তোর ফিলিংস এর মূল্য দিতে পারিনি তাই ক্ষমা করিস। আমি গেলাম। কোনদিন আমাকে আর বিরক্ত করবিনা। তাহলে ভুলে যাবো তুই আমার ফ্রেন্ড।”
বলেই ছোঁয়া টেবিল থেকে উঠল চলে যাবার উদ্দেশ্য। সাথে সাথে তন্ময় ছোঁয়ার হাত টেনে ধরল। ফের আরেকবার ভিখারির মত করুণ কণ্ঠে বলল,
” প্লিজ ছোঁয়া এভাবে যাসনা। তুইতো জানিস আমি তোকে কত ভালবাসি। বাঁচতে পারব বল! আমি জন্মগত গরিব ছোঁয়া। দারিদ্রতা আমার দূর্বলতার জায়গা কিন্তু এতে আমার দোষ নেই। আমি ইচ্ছা করে দরিদ্র ঘরে জন্ম নিইনি। আগে যদি জানতাম গরিব হলে পৃথিবীতে ভালবাসার মানুষকে পাওয়ার পথে অনেক বড় বাঁধার কারণ হবে তাহলে সৃষ্টিকর্তাকে বলতাম আমাকে যেন তোর থেকে বড়লোকের ঘরে জন্ম দেন। পরের জন্মে যেন আমি যেন ভীষণ ধনী ঘরের সন্তান নই। কারণ টাকা থাকলেই সব পাওয়া যায়। এইযে দেখ, দিনের পর দিন সাধনা করে তোকে পাচ্ছিনা অথচ অচেনা অজানা কেউ সাধনা ছাড়া তোকে পেয়ে যাবে। কারণ তার টাকা আছে। ”
ছোঁয়া চোখ বন্ধ করে বলল,
” আর কতবার আমাকে লোভী বলবি। আর কতবার এসব বলে অপমান করবি। যা তোর মনে আছে বল।”
তন্ময় এর বুক কেঁপে উঠল। সে কি ছোঁয়াকে আঘাত দিয়ে ফেলল। দ্রুত অনুনয়ের স্বরে বলল,
” না ছোঁয়া তুই লোভী না। আমি জানি তোর পরিবার তোকে প্রেসার দিচ্ছে। একবার সব ছেড়ে আমার হাত ধরে দেখ, আমি তোর বাবার যোগ্য জামাই হয়ে দেখাব। তোর যোগ্য স্বামী হয়ে দেখাব। প্রুভ করে দিবো মানুষ চাইলে ছোট থেকে বড় হতে পারে। আর আমি তা পারব ছোঁয়া।”
ছোঁয়া আর পারছে না। কোনভাবেই তন্ময় এর কথা উপেক্ষা করতে পারছেনা। কিন্তু যেভাবেই হোক তন্ময়ের কাছ থেকে তাকে পালাতে হবে। একটা দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
” আমি আসি তন্ময়। আমার বাবাকে আমি কখনো কষ্ট দিতে পারব না। মায়ের খেয়াল রাখিস। আমাকে আর যদি আটকে রাখার চেষ্টা করিস বুঝব তুই লোভী।”
তন্ময়ের সমস্ত পৃথিবী ধরে কাঁপতে শুরু করল। চেনা মানুষের অচেনা রুপ তাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে। এত বড় কথাটা ছোঁয়া তাকে শোনাতে পারল। ছোঁয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে কাঁন্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
” হ্যাঁ আমি লোভী। ভীষণ লোভী, তোর ভালবাসার লোভী আমি। ”
মৃন্ময় আর দ্বীপ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ওদের দু’জনকে দেখছে। ততক্ষণে অসুস্থ অবস্থায় সারাহ ও এসে হাজির হয়েছে। তন্ময়ের অসহায়ত্ব ওদের তিনজনকে কষ্ট দিচ্ছে। ওদের কথোপ-কথন শেষ হলে ওরা তিনজন ভেতরে প্রবেশ করল। মৃন্ময় আর দ্বীপ ভেঙে পড়া তন্ময় কে ধরল। ছোঁয়ার দিকে অগ্নি চোখে তাকাল ওরা দু’জন। যেন এখনি চোখ দিয়ে গিলে খে’য়ে নিবে। মৃন্ময় রাগান্বিত হয়ে বলল,
” তন্ময় কোনদিন বলতে পারেনি তবে আমি বলছি, তুই আর তোর বাপ দু’জনেই লোভী। তোর বপের অমন টাকা ভরে আমি মু’ ‘ * তি ও না। তোর বাপ তোর জন্য টাকাওয়ালা ছেলে খুঁজেছে ঠিকই কিন্তু তোর বাপের সমস্ত সম্পত্তি দিয়েও তন্ময়ের মত ছেলেকে কেনার ক্ষমতা নেই। তন্ময় একটা ডায়মন্ড। তুই আর আর তোর বাপ তন্ময়ের যোগ্যই নয়। আমার বোন হলে আমি তন্ময়ের সাথেই বিয়ে দিতাম৷ কত টাকার প্রয়োজন তোর বাপের। তোর বাপের কি টাকার এতই অভাব যে বড়লোক ছাড়া বিয়ে দেওয়া যাবেনা। তোর বাপকে শাহাবাগে থালা নিয়ে বসতে বল। ”
দ্বীপ বলল,
” তন্ময় ছাড়া তোর বিয়ে অন্য কারো সাথে হতে দিবোনা। কোনদিন ও না। দেখি তোর বাপ তোকে কীভাবে বিয়ে দেয়। কি ভেবেছিস তুই, এভাবে তন্ময়ের জীবনটা শেষ করে তুই বড়লোক ছেলের গলায় মালা দিবি। জীবনেও হতে দিবোনা। যদি তন্ময় কাদে তোকেও কাদতে হবে।”
সারাহ ছোঁয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” বেবি কি হয়েছে? এসব কি শুনছি। আমি জানি সামথিং ইজ রং। প্লিজ মাথা ঠান্ডা কর। দেখ, তন্ময় কেমন পা-গ-লা-মি করছে। আঙ্কেল সব মেনে নিবে। তুই তন্ময়কে বিয়ে করে নে। আমরা আছি সবাই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি জানি অনেক সমস্যায় আছিস তুই।”
ছোঁয়া সারাহ’র থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশ কঠিন গলায় বলল,
” আমার ড্রাইভার ওয়েট করছে। আমি এ বিষয়ে আর কথা বলতে চাইনা। তাছাড়া আমি তন্ময়কে কোনদিন ভালবাসিনি।”
একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৩৪
সারাহ হাজাররকম ভাবে ছোঁয়াকে বোঝানোর ট্রাই করল। কিন্তু কোনো কাজ হলোনা। ছোঁয়া কারো কথা না শুনে তন্ময়কে ভেঙে চুরে একাকার করে গাড়িতে উঠে চলে গেলো। তন্ময় বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কাঁন্নাকাটি শুরু করল। মৃন্ময়,দ্বীপ, সারাহ সবাই তন্ময়কে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কারো কোনো সান্ত্বনা তন্ময়ের হৃদয়ের যন্ত্রণা কমাতে পারল না। কেউ যেন ধারালো তলোয়ার দিয়ে তন্ময়ের হৃদয়টা টুকরো টুকরো করে দিলো। মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করছে তন্ময়। এই যন্ত্রণা বড়ই ভায়বহ। যে পেয়েছে সেই জানে। এমন যন্ত্রণার কোনো ওষুধ এই পৃথিবীতে নেই।