রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৫
সিমরান মিমি
পড়ন্ত বিকেল।পশ্চিম আকাশের সূর্য অস্তমিত হয়ে তার স্থানে উদয় হয়েছে লাল-কুসুমের আভা।সেই আস্তরণের প্রভাবে পৃথিবীর রুপ হয়েছে ইষৎ আরক্তিম। আর্শি ভেতরের রাস্তায় ছুটছে।স্পর্শীকে ভয় পেয়ে দৌড়ালেও ঝগড়া করতে মোটেও পিছপা হচ্ছে না।হতাশ হলো স্পর্শী।বোনকে বকতে বকতে নিজেও গেল পিছু পিছু।
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকলো আর্শি।মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে তার।যদি জানতো এমন কিছু হবে তাহলে কস্মিনকালেও সে বাড়ির বাইরে বের হতো না।ইশশ!ক্রাশের সামনে প্রেস্টিজ একদম পাঞ্চার হয়ে গেল।মুখখানাকে অন্ধকার করে রুমের মধ্যে ঢুকতেই পিপাসা এগিয়ে এলো।আজ একদিন যাবৎ মেয়েদের সাথেই ঘুমায় সে।তাদের বাবার সাথে কথা তো দূর সামনে যেতেও লজ্জা পায়।আর শামসুল সরদার ও যথাসাধ্য এড়িয়ে চলে তাকে।আর্শির গায়ে হাত দিয়ে বললো,
“ওমা,জ্বর উঠছে নাকি?মুখটা এমন শুকনো কেন?”
আর্শি ঠোঁট উলটে ফেললো।মাকে জড়িয়ে ধরে নালিশ স্বরুপ বললো,
“তোমার মেয়ে আমাকে সারাদিন মারে।আজকে কত্তগুলো ছেলেদের সামনে বসে মেইন রোডে দাঁড়িয়ে কিল মারছে।আমার কি লজ্জা করে না।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সবটা শুনলো স্পর্শী।কিন্তু ভেতরে আর ঢুকলো না।এখন গেলে গাদাখানেক কথা শুনাবে পিপাসা।এর থেকে বাবার ঘর শ্রেয়।আলতো পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল দোতলায়।
বাবার ঘরের একপাশে বিশাল বইয়ের তাক।সেখান থেকে হুমায়ুন আহমেদের “অপেক্ষা” বইটি হাতে নিলো।এই বইটা এর আগেও একবার পড়েছে স্পর্শী।কিন্তু তাও এক নতুন চিন্তাধারা তার অনুভূতিটাকে নতুন করে রাঙালো।বাবা নিশ্চয়ই এই গল্প পড়েছে মায়ের জন্য।হয়তো বইয়ের পাতায় খুঁজেছে প্রিয় মানুষের অনুপস্থিতিতে ঠিক কিভাবে অপেক্ষা করতে হয়।
তবে বস্তুতপক্ষে সত্যি কথা বলতে গেলে এই বইটা তেমন পছন্দের নয় স্পর্শীর।হুমায়ুন আহমেদের লেখা এই বইটাই হয়তো তাকে টানতে পারেনি।যতটা ধৈর্য্য নিয়ে লেখক বইটা শুরু করেছিলেন তার দ্বিগুণ গতিতে অতি ব্যস্ত হয়ে উপন্যাস টাকে শেষ করেছেন।এই বইটার সবগুলো চরিত্র কেমন ধোয়াশা।সবচেয়ে অপছন্দের চরিত্র হচ্ছে সুরাইয়া।উপন্যাসে সুরাইয়াকে না পাগল চিহ্নিত করেছে আর নাতো একজন স্বাভাবিক মানুষ।
অত্যন্ত বিরক্তিকর এক মা’কে সৃষ্টি করেছে হুমায়ুন আহমেদ।বাস্তবে একজন পাগল ও তার সন্তানকে আগলে রাখে,অথচ এই গল্পে তার উলটো প্রকাশ হয়েছে।সবচেয়ে পছন্দের যদি কোনো চরিত্র থাকে সেটা হচ্ছে নায়িকা মিতু এবং বোনের চরিত্র।মুন্নী চরিত্র টা কে প্রথমে রহস্যময় করলেও পরবর্তীতে এটা নিয়ে খোলসা করেনি।আবার ইমনের বাবার পরিণতি ও খোলসা করেনি। আদোও সে মারা গেছে নাকি অন্যকোথাও বিয়ে করেছে এমনটা কিছুই ক্লিয়ার করা হয়নি।তার উপর শেষে গিয়ে ইমনের সাথে নাটকীয় এক স্মৃতি হীনতা ঘটিয়েছেন।মানে কি অদ্ভুত! কাউকেই চিনতে পারছে না শুধুমাত্র নায়িকা আর ছোট চাচা ছাড়া।বিরক্ত হলো স্পর্শী। রেখে দিলো বই। এরপর খুঁজতে লাগলো নতুন বই।হাতের কাছে ধরা দিলো প্রিয় একটা বই।সেটাকে নিয়ে পুণরায় খাটে গেল।ডুবে গেল সেই বাউন্ডুলে, ছন্নছাড়া হিমুর মধ্যে।
প্রায় মিনিট খানেকের মধ্যে ভেসে উঠলো আননোন নাম্বার।রিং বাজছে অনবরত।রিসিভড করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে পুরুষালী কন্ঠে বলে উঠলো,
“আর্শিয়া সরদার আছে?আমি ওর ক্লাস টিচার বলছি।বেশ কিছুদিন ধরে কলেজে মিসিং সে।ও কি অসুস্থ?”
স্পর্শী অবাক হয়ে নাম্বারের দিকে তাকিয়ে রইলো। গলার এই স্বর টা পরিচিত হলেও ঠিক ধরতে পারলো না।বললো,
“ও একটু অসুস্থ’ই।কিন্তু আপনি আমার নাম্বার পেলেন কোথায়? কলেজ শিটে তো মায়ের নম্বর দেওয়া ছিলো।”
ঘাবড়ে গেল ওপাশের যুবক।বড্ড রিস্ক নিয়ে ফোন করেছে সে।আমতা-আমতা কন্ঠে নিজেকে যথাসম্ভব সামলে বলে উঠলো,
“এটা আর্শি নিজেই দিয়েছে।ওর কাছে একটু দেওয়া যাবে।সামনে এক্সাম, নোটিশ দেওয়া হয়েছে।রুটিন ও অলরেডি পাবলিশড করা হয়ে গেছে।”
ততটা মনযোগ দিলো না স্পর্শী।তার মন এখন উপন্যাসের পাতায়।ত্রস্ত পায়ে বইটাকে হাতে তুলে এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে।জোর গলায় বললো,
“এই আর্শি,তোর ফোন।টিচার কথা বলবে।”
ছুটে এলো আর্শি।কিছুটা অবাক’ই হলো।তাকে কেন টিচার ফোন করবে? হাত বাড়িয়ে ফোনটা কানে নিতেই রুমে চলে গেল স্পর্শী।আর্শি শান্ত গলায় বললো,
“হ্যালো,আসসালামু আলাইকুম স্যার!”
ওপাশ থেকে চাপা হাসির শব্দ পাওয়া গেল।এরপর গমগমে কন্ঠে ভেসে আসলো,
“তোমার বোনের থেকে একশো হাত দূরে নিরাপদ জায়গায় গিয়ে দাঁড়াও।আমি টিচার নই,তোমার পাভেল ভাই।”
উত্তেজনায় হার্ট ব্লক হওয়ার মতো অবস্থা আর্শির।দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে অস্ফুট আর্তনাদ করলো।বললো,
“পাভেল ভাই,আপনি..আপনি আপুর ফোনে কেন ফোন করেছেন?আল্লাহ!ও বুঝতে পারলে সুনামি বইয়ে দিবে।আপনি মায়ের ফোনে দিতেন।তাহলে তো আর কোনো ভয় থাকতো না।”
ভ্রুঁ কুঁচকে ফেললো পাভেল।শাসনের সুরে বললো,।
“গর্দভ! আমি তোমার মায়ের নাম্বার পাবো কোথায়?এই নাম্বারটাও তো ভাইয়ার ফোন থেকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এনেছি।”
এইমুহুর্তে একদম ছাঁদের সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে আর্শি।কিছুক্ষণ পর পর নিচে তাকিয়ে অবস্থান বুঝে নিচ্ছে বাড়ির লোকজনের ।ওপাশের কথার পরিপ্রেক্ষিতে বললো,
আচ্ছা আমি বলছি, আপনি লিখুন।016-1**7*9***5।লিখেছেন?”
ওপাশ থেকে হু’ কন্ঠস্বর ভেসে আসলো।সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা,তখন ডাকছিলা কেন?কিছু বলতে চাইছিলা নাকি?ভাই সাথে ছিলো। তাই শুণতে পারি নি।এখন বলো?”
হা হয়ে গেল আর্শি।তার বিশ্বাস ই হচ্ছে না পাভেল ভাই এতটা স্বাভাবিক ভাবে তার সাথে কথা বলছে।কি জন্য ডেকেছিলো সেটা জানতে চাইছে।আনন্দে চোখ টা ঝাপসা হয়ে এলো।কোমল কন্ঠে বললো,
“এমনিই আপনাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে গেছিলাম।আপু সাথে ছিলো খেয়াল করি নি।”
কন্ঠকে আরেকটু মধুর করলো পাভেল।মেয়ে পটাতে ওস্তাদ সে।আর এইটুকু মেয়েকে সে পটাতে পারবে না এটা অসম্ভব।চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“কপালের সেলাই কবে খুলবে?ব্যাথা কি কমেছে?ধুর!দেখেশুনে চলবা না তুমি?”
আহ!বসে পড়লো আর্শি।প্রতিটা কথা যেন তার হৃদয়ে নতুন করে আরেক অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে।যেটা পূর্বের অনুভূতি গুলোকে আরো গাঢ় করছে।মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না আর্শির।দম যেন অজানা এক আবেগে আটকে যাচ্ছে। প্রতিটা কথা যেন জড়িয়ে যাচ্ছে বারবার।ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আয়েষ করে বসলো পাভেল।বুঝলো কাজ হয়ে গেছে।এবারে কথা বের করতে হবে।আদুরে কন্ঠে আবারো জিজ্ঞেস করলো,
“শোনো, তুমি কি তোমার আব্বুকে আমাদের ব্যাপারে বলছিলা?”
শ্বাস আটকে গেল আর্শির।কি বলবে সে?পাভেল কি তার সাথে প্রেম করছে।সে কি এই সম্পর্কের কথা আব্বুকে জানাতে বলছে।কিন্তু তাদের প্রেম হলো কখন?কেউ তো কাউকে প্রপোজ করে নি এখনো। অবুঝ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি বলবো, পাভেল ভাই?’
আশাহত হলো পাভেল।নাক -মুখ খিঁচিয়ে গালি দিতে ইচ্ছে করছে।আজ ভাইয়ের জন্য এই বাচ্চামেয়ের সাথে এত্তো ঘ্যানঘ্যান করতে হচ্ছে তার।আজ বিকালেও স্পর্শীকে যতটা রাগী অবস্থায় দেখলো তাতে শিউর সে এখনো ভাইকে দেখতে পারে না।যেকোনো সময় ফাঁসিয়ে দিতে পারে ভেবেই এই কাজে অগ্রসর হয়েছে।নিজেকে যথাসম্ভব সামলে রেখে বললো,
“ওই যে তোমাকে কিদন্যাপ করেছিলাম ওই ব্যাপারে।বাড়িতে কি বলেছো?”
মুখখানা চুপসে গেল আর্শির।সে কি না কি ভেবেছিলো।আর কি হলো?মলিন কন্ঠে বললো,
“নাহ,এখনো বলি নি।তবে আপু হয়তো বাবাকে বলে দিবে।”
চমকে উঠলো পাভেল।উত্তেজিত হয়ে বললো,
“এই না না না।একদম না।দেখো আর্শি।তুমি ভীষণ বুঝদার।দেখো,এই কথাগুলো যদি বাবাকে বলো তাহলে আবার ঝামেলা বাঁধবে।মারা-মারি,কাটাকাটি, এমনকি খুনোখুনি হয়ে যেতে পারে।কি দরকার এসবের?আমি তো ছেড়ে দিয়েছি তোমায়।আপুকে বুঝিয়ে বলবা।ওকে মাই গুড গার্ল।
সম্মোহিত হওয়ার ন্যায় মাথা দুলিয়ে আর্শি বললো,” আচ্ছা।”
ত্রস্ত পায়ে রুমে ঢুকলো পরশ।নিত্যদিন ভাইকে ক্রমশ যন্ত্রণা দিতে থাকা পাভেল কে আজ চুপচাপ রুমের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকতে দেখে সন্দেহ হলো।দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই তড়িঘড়ি করে ফোন কাঁটলো পাভেল।ভ্রুঁ কূঁচকালো পরশ।মুহুর্তেই ছো মেরে ফোন নিজের হাতে নিয়ে এলো।কল লিস্টে স্পর্শীর নাম্বার ভেসে উঠতেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।কঠিন কন্ঠে বললো-
“এটা ওই মেয়েটার নাম্বার না?কি বলছিলি ফোনে?”
ঘাবড়ে গিয়ে দাঁত কেলিয়ে হেসে দিলো পাভেল।ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে সন্দেহী চোখে বললো,
“কি ব্যাপার!নাম্বার টা দেখি ঠোঁটস্থ।পুরবীর নামটা ও তোর মনে থাকে না, অথচ এই মেয়ের ফোন নাম্বার ও মুখস্ত।আব্বুকে জানাবো নাকি?
চোখ দিয়ে কটমট করে উঠলো পরশ।পাভেলের কান টেনে ধরে বললো,
” কথা ঘুরাতে চাইছিস, তাই না?সত্যি করে বল এই মেয়ের সাথে কি কথা বলছিলি তুই?বললাম না ওদের এড়িয়ে চলতে।”
ঘাঁড় কাঁত করে ব্যাথাতুর শব্দ করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো পাভেল।ভাইয়ের থেকে একহাত দূরে পিছিয়ে বসলো।বালিশ টাকে কোলে নিয়ে মুখভঙ্গি সিরিয়াস করলো।বললো,
“আমি কি ইচ্ছা করে কথা বলতেছি নাকি?তোর জন্যই তো বলতে হচ্ছে।কি দরকার ছিলো হুট করে কিদন্যাপ করার।এবার যদি কোনোভাবে সরদার রা জেনে যায় ওদের মেয়েকে কিদন্যাপ করছিলি তাহলে কি হবে একবার ভাবতে পারছিস?বড় বড় আর্টিকেল ছাপা হবে তোর বিরুদ্ধে।আব্বুর মানসম্মান সব চান্দে উঠবে।এরপর তুই এমপি কেন প্রধানমন্ত্রী হলেও ঘরছাড়া করতে দু-বার ভাববে না।আমি চাই না আমার ভাইয়ের ক্যারিয়ার শুরুর আগেই শেষ হোক।
পরশ মন দিয়ে শুনলো।এরপর হেয়ালি করে বললো,
” বুঝলাম।তো এখন আপনি কি করতে চাইছেন?ওই মেয়েটার কাছে ক্ষমা চাইতে।”
নাক ছিটকালো পাভেল। বললো,
“আরে ধুর।সে রকম কিছু না।ওর বড় বোন যতটা ডেঞ্জারাস, ছোট বোনটা ঠিক ততটাই নরম।ওকে বাগে নেওয়া খুব সহজ। তাই বুঝাচ্ছিলাম পটিয়ে-পাটিয়ে।যাতে বাপের কাছে এসব কিছু না বলে আর নাতো বোনকে বলতে দেয়।”
পরশ উঠে দাঁড়ালো। হেয়ালি করে পুনরায় বললো,
“তোর কি মনে ওরা তোর কথায় চুপ করে থাকবে?বলার হলে এতোদিনে বলতো।তোর এতো নাটক করতে হবে না।আমি বুঝে নেব।”
★ফোনের নাম্বার টার দিকে তাকিয়ে রইলো আর্শি।মনের মধ্যে অজস্র রঙিন প্রজাপতিরা ডানা ঝাপটাচ্ছে।প্রাণ টা অতি চঞ্চলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চাইছে।ইচ্ছে হচ্ছে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে নাঁচতে।এ কেমন অনুভূতি! ফোন হাতে বাবার রুমের সামনে যেতেই দেখলো দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।আলতো টোকা মারতেই ভেতর থেকে থমথমে কন্ঠে স্পর্শী বললো,
“এখন ফোন লাগবে না।নিয়ে যা সাথে।বিরক্ত করবি না আমায়।”
শুনতেই আনন্দে গদগদ হয়ে উঠলো আর্শি।এক ছুটে নিজেদের রুমে গেল।বিছানায় শুয়ে উপর হয়ে ঢুকলো পাভেল ভাইয়ের আইডিতে।
আলতো হাতে শাড়ির কুচিটা ঠিক করে নিলো স্পর্শী।আজকে জীবনের প্রথম তার খুব করে রুপা হতে ইচ্ছে করছে।হিমু বিহীন রুপা।উপন্যাসে হিমু রুপাকে অপেক্ষা করালেও আজ স্পর্শী কোনো হিমুর প্রতিশ্রুতি ছাড়াই তাকে খুঁজে বেড়াবে।মায়ের পুরো আলমারি খুঁজে নীল রঙের শাড়ি পেল না।শেষ মেষ হাফ সিল্কের একটা অফ হোয়াইট কালারের শাড়ি পেল।কালো একটা ব্লাউজের সাথে ঝটপট পড়ে নিলো।গাজরা নেই।বাস্তবিক ভাবে আজ অবধি কখনো শাড়ি পড়েছে কি না মনে নেই স্পর্শীর।হয়তো সাধ্য থাকলেও কখনো সাধ জাগেনি আর নাতো সময় পেয়েছে।হালকা সাজে চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে বড় দুল পড়ে নিলো।ব্যাস হয়ে গেছে তার সাজ।চোখে কাজল দিয়ে লাস্ট ফিনিশিং টা করতেই দরজা খুলে পা সবার অগোচরে বের হলো।আর্শি রুমে আছে।মা মেঝো কাকির সাথেই রান্নাঘরে।ছোট কাকি নিজের রুমে বসে আছে।বাদবাকি বাড়ির ছেলেরা কেউই এখনো ফেরেনি।
পা টিপে সবার গতিবিধি কে একবার নজরে এনে আলগোছে সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল।গেটের সামনে মধ্যবয়স্ক দারোয়ান বসে আছে।সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। পাত্তা দিলো না স্পর্শী।গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে গেট পেরিয়ে রাস্তায় বের হলো।
কি অদ্ভুত জীবন টা।এই তো কিছুদিন আগেই এই সময়টা সে ওই কোলাহল পূর্ণ যানবাহনে চড়ে বাড়ি ফিরতো টিউশনি শেষ করে।কতই না অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতো।কখনো প্রতিবাদ তো কখনো সবার আড়ালে অশ্রুবিসর্জন। আহ!মনে পড়লেই কেমন কেঁপে ওঠে শরীর।অথচ আজ…. আজ সে মুক্ত পাখির মতো।তার একটা বাসা রয়েছে।এই অচেনা অঞ্চলে এতো রাতে সারাটা সময় থাকলেও ভয় নেই।কেননা তার রক্ষক রয়েছে।গায়ে আঁচড় পড়ার আগেই তাকে বিপদমুক্ত করবে তারা।
মৃদু বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে আঁচল ওড়াচ্ছে স্পর্শী।আলতো পায়ে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে মেইন রাস্তার দিকে।ওখানকার ধানক্ষেতের সামনে দাঁড়ালে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।বাতাসের দমকা হাওয়ার তীব্রতা অন্তরস্থল ছুঁয়ে যায়।রাস্তার দুপাশে কিছুটা ব্যাবধানের পর পর ল্যাম্পপোস্ট লাগানো।তার আলোয় অনেকটাই অন্ধকার সরে আলোকিত হয়েছে প্রকৃতি।স্পর্শী হাটতে লাগলো ধীরপায়ে।
নিস্তন্ধ রাত।এখান থেকে সদর খানিকটা দূরে।বিপরীত দিক থেকে একটা বাইক এগিয়ে আসছে।দুজন পরিপূর্ণ যুবক বসে আছে তাতে।হাই স্পিডে চালানো বাইক টা হুট করেই থামিয়ে দিলো সুজন দেওয়ান। পেছনে থাকা রকিব থমকে গেল সামনে তাকিয়ে।দুরেই একটা ছায়া আলতো পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। সাদা শাড়ির আস্তরণ, হাটু অবধি চুল গুলো দেখতেই গলা শুকিয়ে গেল তার।আমতা-আমতা করে বললো,
“সুজন ভাই,ওটা কি সামনে?দেখে তো পেত্নি মনে হচ্ছে।”
সুজন কিছুক্ষণ ভাবলো।তার নিজের ও সন্দেহ হচ্ছে।কিন্তু ঘাঁবড়ালো না।রকিবের উদ্দেশ্যে বললো,
“সিগারেট আছে না সাথে।দুইটা জ্বালা।আর ভয় পাইস না।এমন কিছু হইলে আস্তে কইরা কাছে গিয়া গাড়িটা জোরে টান দিবো।”
মাথা নাড়ালো রকিব।পকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে একটা সুজন এবং অন্যটা নিয়ের মুখে নিলো।এরপর ধীর গতিতে বাইক চালাতে শুরু করলো সুজন।মানবী টার কাছে যেতেই টের পেল স্পর্শী।গাড়ির উপস্থিতি টের পেয়ে পিছনে ফিরলো।এরপর রাস্তার মাঝখান থেকে সরে গেল কিছুটা সাইডে।থমকে গেল সুজন।বাইকের গতি আর কমালো। একধ্যানে তাকিয়ে রইলো স্পর্শীর দিকে। রকিবের উদ্দেশ্যে নিচু স্বরে বললো,
“মামা ছবি তুলতে পারলে এক হাজার তোর। বুঝতে পারে না যেন।”
দ্রুতই ক্যামেরা বের করলো রকিব।স্পর্শী আলতো পায়ে হাটছে আর বাইক ও তার সাথে তাল মিলিয়ে চলছে।ব্যাপার টা বুঝতেই দাঁড়িয়ে পড়লো।সুজনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“সমস্যা কি আপনার।যাচ্ছেন না কেন?”
কথা বলতে গিয়ে গলাটা পরিস্কার করে নিলো সুজন।এরপর বললো,
“আমি যেইটা ভাবছি সেইটাই ঠিক।”
ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো স্পর্শী। বললো,
“তা আপনি কি ভেবেছেন?”
এক হাত দিয়ে মাথা চুলকে সুজন বললো,
“পেছন থেইকা দেইখা ভাবছি কোনো মানুষ হবা না তুমি।সামনে দিয়া দেইখা প্রমাণ পাইলাম। তুমি তো পরী।
হাসলো স্পর্শী।বললো,
” আপনি কি জানেন, আপনি ফ্লার্টিং লেভেলে খুব কাঁচা।এভাবে মেয়ে পটানোর চেষ্টা করলে তো মেয়েরা পটবে না।নতুন কিছু ইউজ করুন।আপডেট হন।ওকে।”
বলেই উলটো ঘুরে হাটলো। সুজন পিছু নিতে গিয়েও গেল না।রকিবের উদ্দেশ্যে বললো,
“ছবি তুলছিস?”
ফোনটা হাতে দিলো রকিব।লুকিয়ে তোলার কারনে খুব বেশী সুন্দর হয়নি।কিছুটা ধোঁয়াশা উঠেছে।কিন্তু এতেই খুশি সুজন।বাইক চালিয়ে যেতে যেতে বলল,
“খোঁজ নিস তো, মেয়েটা কে?”
স্পর্শী এবার উলটো পথে হাঁটতে শুরু করলো।এখানে বই আনেনি।ফলস্বরূপ একা ভালো লাগছে না বাড়িতে।রাস্তার এক কোণ দিয়ে ধানক্ষেতের পাশে গেল।অনেক টাই শুকনো মাটি। বাতাস আসছে খুব জোরালো ভাবে। বসে পড়লো সেখানে।মিনিট খানেকের মধ্যেই রাতের দ্বিতীয় বাইক টা থামলো।নিশ্চয়ই কিছুক্ষণ আগের সেই ছেলেটি আবারো আসছে।বিরক্ত হলো স্পর্শী।পিছু ফিরে তাকাতেই দেখলো সোভাম নেমে এদিকেই আসছে।শাড়ির আঁচল গুছিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠলো স্পর্শী।
ইতোমধ্যে কপালের মাঝখানটায় সরু ভাঁজ পড়েছে সোভামের।থমথমে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“এখানে কি করছো তুমি?”
স্পর্শী অবাক হলো।এক প্রথম হয়তো সোভাম ভাই তার সাথে কথা বলেছে।অদ্ভুত এক ভালোলাগায় ছেঁয়ে গেল। আলতো হাসার চেষ্টা করে বললো,
“এইতো একটু ঘুরতে বের হলাম।”
কপালের ভাঁজগুলো আরো জোরালো হলো সোভামের।গম্ভীর মুখে বললো,
“এটা ঢাকা নয়। সেটা বুঝে শুনে চলাফেরা করবে।এতো রাতে পাগলেও শাড়ি পড়ে ঘুরতে বের হয় না।আশেপাশের লোকজন দেখলে ভাববে বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে এসেছো।বুঝেছো?”
আলতো পায়ে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলো স্পর্শী।খামখেয়ালি কন্ঠে বললো,
“আশেপাশের লোকজন কে কি বললো, না বললো সেটা আমার দেখার বিষয় নয় ভাইয়া।ইচ্ছে করেছে শাড়ি পড়েছি,আবার ভালো লেগেছে ঘুরতে বেরিয়েছি।এতে তাদের কি?”
ঠোঁট দুটো গোল করে নিঃশ্বাস ছাড়লো সোভাম।বোনের পিছু পিছু হেঁটে উঠে গেল রাস্তায়।বললো,
“এখানে আশেপাশে নেশাখোর ছেলেপেলের অভাব নেই।এভাবে একা একা বের হওয়া মোটেও সেফ নয়।এটা বোঝার যথেষ্ট ক্ষমতা তোমার আছে।তারপরেও ভয় হয় না?বাইকে ওঠো।”
স্পর্শী উঠলো।এরমধ্যেই বাইক স্টার্ট করলো সোভাম।ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তরে বললো,
“উহুম, আমি কাউকে ভয় পাই না।”
হাসলো সোভাম। কিন্তু স্পর্শীর অগোচরে।আজ দুপুরের দিকে ছাদের দরজায় তেলাপোকা দেখে আর ছাদে যায় নি সে।দরজা না খুলেই চলে এসেছে।সেই মেয়ে বলছে ভয় পায় না।হেয়ালি করে বললো,
“নিজেকে বাহাদুর ভাবো নাকি?”
স্পর্শী ভাবলো কিছুক্ষণ।কেমন জানি এক ভালোলাগা কাজ করছে ভাইয়ের সাথে কথা বলতে।না চাইতেও কেমন ন্যাকামি করে কথা গুলো বলছে সে।আশ্চর্য! কি এক অদ্ভুত পরিবর্তন।বাপ-ভাইয়ের সাথে কথা বলতে গেলেই সে আদুরে ন্যাকা হয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে বললো,
“নাহ,বাহাদুর কেন হতে যাবো? বাহাদূর তো হয় ছেলেরা।আচ্ছা বাহাদুরের ফিমেল ভার্সন কি ভাইয়া?”
সোভাম বাইক চালাতে চালাতে বললো,
“জানি না তো।নেই মনে হচ্ছে।”
গেটের সামনে এসে গেছে বাইক।থামাতেই নেমে পড়লো স্পর্শী।সোভাম বাইক ধরে সামনে এগোতে লাগলো।ভাইয়ের পেছন পেছন যেতে যেতে বললো,
“তাহলে আমি বাহাদুরের বউ হবো।অত্যন্ত সাহসী যাকে বলে।”
মুহুর্তেই গেট বন্ধ করতে করতে দারোয়ান মুখ চেপে হেসে দিলো।ভ্রুঁ কুঁচকে ফেললো স্পর্শী।ইতোমধ্যে হাটতে হাটতে গেরেজের কাছে এসে গেছে তারা।স্পর্শী সোভামের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“দারোয়ান কাকা ওমন করে হাসলো কেন?”
রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৪
সোভাম থামলো।স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে বললো,
“চাচা হাসছেন কারন ওনার নাম বাহাদুর।”
বাকরুদ্ধ হয়ে গেল স্পর্শী।একধ্যানে তাকিয়ে রইলো গেটের দিকে।সর্বনাশ!