ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ১৬

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ১৬
Arishan Nur

বাড়িটা কিছুটা পুরোনো আমলের ধাঁচে তৈরি করা। কোথায় যেন একটা রাজকীয় ভাব বিদ্যমান কিন্তু সহজেই ধরা যায় না ঠিক কোথায় রাজকীয় ভাব। একতলা বাসাটার বাউন্ডারির পাশ ঘেঁষে পরপর তিনটে তালগাছ। তারা প্রবেশ করতেই একটা শালিক উড়ে এসে দেয়ালে বসে কিচিরমিচির করে ডাক পাড়ে।

সমুদ্র বাউন্ডারির ভেতর গাড়ি রেখে দরজায় কড়া বাজায়। ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে দরজা খুলার শব্দ কানে আসে। আয়না মুখ ভোতা করে রেখেছে। যদি জানতো নারায়ণগঞ্জ তারা শায়লা চৌধুরীর ফার্মহাউজে আসবে তাহলে রাজীই হতো না। তবুও মনে প্রশ্ন রয়ে যায় সমুদ্র কীভাবে শায়লা আন্টিকে চেনে? সে চেনে কারণটা বিশাল বিস্তৃত। কিন্তু সমুদ্র চিনে কীভাবে? নানা চিন্তারা একে একে মাথায় জট পাকিয়ে ফেলে, ওমন সময় শায়লার কণ্ঠস্বর শোনা যায়।
–” কি হলো আয়ু? ভেতরে আসো।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আয়নার ধ্যান ভঙ্গ হলো। ইতিমধ্যেই সমুদ্র ভেতরে প্রবেশ করেছে। সে এক পা এগুতেই শায়লা সুন্দর করে হাসি দিলো। সে প্রত্যুত্তরে নিশ্চুপ থাকে। সমুদ্রের পানে তাকিয়ে বোঝা যাচ্ছে ও বেশ সহজ এ পরিবেশে। আরাম করে বেতের সোফাটায় পা এলিয়ে দিয়েছে৷ ড্রাইভিং করে বোধহয় কিঞ্চিৎ ক্লান্ত।
আয়না এসে দাঁড়িয়ে থাকে। সমুদ্র একবার তার দিকে তাকায় এবং ইশারায় বসতে বলে। কিন্তু আয়না যে কোন ভাবনায় ছিলো খেয়াল করে না। কারো হ্যাচকা টানে ওর সম্মোহন ফিরে। মুহুর্তের সে সমুদ্রর পাশে নিজেকে আবিষ্কার করলো। তাদের মধ্যে দূরত্ব এক ইঞ্চিও না।

সমুদ্র তখনো তার হাত ধরে রেখেছে। চোখ বুলিয়ে আশেপাশে তাকালো আয়না। ওইতো শায়লা চৌধুরী তাদের দুইজনের কাণ্ড দেখে হেসে সরে গেলেন। আয়নার এতো বেশি লজ্জা লাগলো। ছেলেটা এতো বেশি আক্কেল-জ্ঞানহীন কেন? বেশরমও মনে হয়! লাজ নেই একদম। ধ্যাত ভালো লাগে না।
সমুদ্র ভ্রু কুচকে বলে, ” কি হলো? কি বিড়বিড়িয়ে বলছো?”
–” কিছু না।”
–” মনে হলো আমাকেই কিছু বললে?”

আয়না একদম পাত্তা দিলো না। সে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অন্য সোফায় গিয়ে বসে। উনি বোধহয় খানিক হতবুদ্ধি হয়ে যায়৷ আয়না চোখ বুলিয়ে ড্রয়িংরুমটা দেখলো। একদম বাঙ্গালীয়ানার ছোঁয়ায় পরিপূর্ণ যেন!
শায়লা চৌধুরী ফিরে এসে বলে, ” এই যে নিউলি ম্যারিড কাপল, ফ্রেশ হবে নাকি নাস্তা সাজাবো?”
আয়না বলে উঠে, ” ফ্রেশ হবো।”

যেন ও সবকিছু থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে। আয়নাকে বাম পাশের একটা রুম দেখিয়ে দেওয়া হলো। ও ফ্রেশ হয়ে দশ মিনিট পর রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসতে-ই পিলে চমকে উঠে। ওর বাবা বসে আছে সোফায়। বাবা ওদের দুইজনের সঙ্গে বেশ হাসি মুখে গল্প করছেন। আচ্ছা সমুদ্র কী সবটা জানে? শায়লা আন্টির সাথে তার বাবার সম্পর্কের কথা? আয়নার মন ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। তাহলে উড়ো খবরটাই সঠিক? অবশ্য যা রটে তা ঘটে কিছু-মিছু। তবে সে মানে না। যতোদিন না বাবা নিজ মুখে না বলবে সে মানবে না৷

শায়লা আন্টি কি সুন্দর কথা বলছে সমুদ্রের সঙ্গে ।
সমুদ্র বলে উঠে, ” আন্টি আপনি দিন-দিন ইয়ং হচ্ছেন৷ আপনার সৌন্দর্যের রহস্য কী?”
আয়নার তখন এতাও রাগ উঠলো। সে দ্রুত ওই রুমে ফিরে আসে। সঙ্গে সঙ্গে বাকি তিনজন সামান্য ভড়কে উঠে। ফাহাদ সাহেব আস্তে করে ডেকে বলে, ” আয়ু কী হলো মা?”
আয়না একদম শুনলো না সে ডাক। সমুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ” আমি দেখছি। আপনারা বসেন।”
ওই রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই দেখলো সে রাগে গজগজ করছে। ওকে আসতে দেখে আয়না একপ্রকার হামলে পড়ে সমুদ্রের উপর। এরপর দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ” আপনি তো খুব ধুরন্ধর মানুষ! ”

–” আমি আবার কী করলাম?”
–” ওই যে সুন্দরী মহিলার সঙ্গে ফ্লার্টিং করছিলেন? আচ্ছা সব মাঝবয়েসী সুন্দরী মহিলার কাছে আপনি সুন্দর থাকার ফর্মুলা চেয়ে বসেন কীনা?”
সমুদ্র ওর লাল হয়ে আসা নাকটার দিকে তাকিয়ে হোহো করে হেসে ফেলে। এরপর বলতে ধরে পাগল একটা কিন্তু ক্ষণেই বোবা হয়ে যায়। ফের কোন নাটক করবে কে জানে?
–” হাসছেন কেন? যা যা সুন্দরী মহিলার কাছে যান।”
–” সেজন্য-ই তো এলাম এখানে।”
কেমন ঘোর লাগা কণ্ঠে কথাগুলো বললো সমুদ্র।
আয়না চুপ বনে যায় এবং উলটো ঘুরলো যেন ওনার চেহারা দেখতে নাহয়। সমুদ্র ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে, ” সুন্দরী তো আমার বউ।”

–” ছাড়ুন বলছি।”
–” আজব! কেন?”
–” একদম ধান্দাবাজি করবেন না।”
আয়না জোরপূর্বক ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। সমুদ্রের মেজাজ খানিকটা খারাপ হয় তবুও চুপ থেকে বললো, ” একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিলো।”
–” বলুন।”
–” ছাদে যাই?”
–” এটাই আপনার জরুরি কথা?”
–” না।”

এরপর আয়নাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাত ধরে টানতে টানতে রুম থেকে নিয়ে ছাদের উদ্দেশ্য বের হয়। তখনো ফাহাদ সাহেব আর শায়লা একসাথে বসে কথা বলছিলো। আয়নার মনে হলো সে একটা গরু! কেমন গরুর মতো টানছে তাকে! তাছাড়া নিজেকে তার গরুর মতো বোকাও লাগছে। নাহলে এতোসময় লাগলো বুঝতে বাবা কেন এসেছেন?
ছাদে গিয়ে দাঁড়ালো দুইজন। আয়না চোখ-মুখ খিঁচে কিছুক্ষণ সবুর করে রাগ নিয়ন্ত্রিত করে। সমুদ্র তাকে ধাতস্থ হওয়ার সময় দেয়।
এরপর বলে, ” ফাহাদ আংকেল শায়লা আন্টিকে বিয়ে করেছে৷”
আয়না বেশ খানিকটা চমকে উঠে ভেতরে ভেতরে তবে অভিব্যক্তিতে প্রকাশ করে না৷ তবে, তবে চোখের কোণে পানি এসে ভীড় জমালো।
সমুদ্র তার দুইগালে হাত রেখে বললো, ” কাঁদার কি আছে? এটা খুব নর্মাল না?”

–” নর্মাল?”
–” হ্যাঁ! সবারই তো একটা সুন্দর-গোছানো জীবন যাপন করার রাইট আছে?”
আয়না কিছু বলতে পারলো না। কেবল সমুদ্রের বুকে আঁছড়ে পড়ে কান্না আরম্ভ করলো। সে কিছুক্ষণ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো। কাঁদতে কাঁদতে আয়নার বুঝি হিচকি উঠে যাবে৷ অতীতে বিচরণ করলো, শায়লা আন্টির সাথে পরিচয় অনেক আগে থেকেই। মিসেস রোদেলার সঙ্গে ব্যবসায়ীক সূত্রে পরিচয় হলেও একটা সময় ফ্যামিলি ফ্রেন্ড হয়ে যান উনি। মহিলার অল্প বয়েসে বিয়ে হয়। এরপর শ্বশুড়বাড়ি থেকে অত্যাচারিত হন। স্বামীভাগ্য ভালো ছিলো না।বিভিন্ন এনজিও তে কাজ করেন, থার্ড পার্টি হিসেবে নানারকম কাজে ইনভলভ হয়ে এখন নিজেই ব্যবসা করছে। উদ্যোক্তা তিনি। তবে সমুদ্রের সঙ্গে ওনার সম্পর্ক অস্ট্রেলিয়া থেকে ভালো হয়। মহিলা প্রায়ই যেত অস্ট্রেলিয়া৷ অস্ট্রেলিয়ায় গেলেই নানারকম মজার খাবার রান্না করে সমুদ্রের ডর্মে পৌঁছে যেতেন৷

সমুদ্রের ধারণা তার আর ইউশার রিলেশনশিপের ব্যাপারে মাকে শায়লা আন্টিই তথ্য দিয়েছিলো। তবুও শায়লা চৌধুরীর কাছে সে কৃতজ্ঞ। উনি অনেক বড় একটা উপকার করেছে। দূর ভীনদেশে সমুদ্র যখন ভঙ্গুর অবস্থায় ছিলো, উনি এসে যত্ন নিতেন! শায়লা আন্টি একবার বলেছিলো, দ্বিতীয় দফায় ওনার যে ভদ্রলোকের সঙ্গে সম্পর্ক, তারা কোর্ট ম্যারেজ করতেন সব ঠিকঠাক, কিন্তু ভদ্রলোকের বড়মেয়ে নাকি একদম রাজী না। বাবার দ্বিতীয় বিয়ের কথা শুনেই কান্নাকাটি, বাবার সঙ্গে জেদ করে নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে অসুস্থ হয়েছে৷ হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন একবার! এজন্য কোর্ট ম্যারেজ হলো না। সবটা আটকে আছে।

এসব আরোও অনেক আগের কথা। এরপর তো সমুদ্রের নিজের জীবনেই ঝড় এলো। ঝড়ে ভাঙ্গা বৈঠা নিয়ে ফিরে আসে দেশে। অন্যদের কথা স্মরণ থাকে না। পরবর্তীতে ভাগ্যের আজব বিবর্তনে ভদ্রলোকের আদুরে জেদী মেয়েটা তার ঘরের বউ হলো! যতোদিনে জেনেছে তখন বিয়ের কথা পাকা হয়ে গিয়েছে। আর তাদের বিয়ের মূল ঘটক তো শায়লা চৌধুরী-ই। উনি সমুদ্রর জন্য আয়নার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
সমুদ্র সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বললো, ” এই আর কতো কাঁদবা? আমার শার্ট ভিজে যাচ্ছে তো!”
আয়না একবার চোখ তুলে তাকায় এরপর আবার সমুদ্রকে জড়িয়ে ধরে। সমুদ্র বলে, ” তুমি চাইলে আমাকে ফ্রেন্ড ভাবতে পারো। আমি বন্ধু হিসেবে দারুণ! ”
আয়না এবার মাথা তুলে তার দিকে চেয়ে থেকে বলে, ” ফ্রেন্ড!”

–” চাইলে।”
–” চাই তো!”
সমুদ্র বলে উঠে, ” জানি তোমার খারাপ লাগছে বাট সবাইকে একসময় মুভ অন করতে হয়। ”
–” আমাকে বড় চাচা বাবার বিয়ের খবর আগেই দিয়েছিলো কিন্তু বাবা মুখে কিছু বলছিলো না জন্য আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না।”
–” তাহলে এতো কান্নাকাটি করলে কেন? আগে থেকেই তো জানতে! ”
— একবার কান্না শুরু করলে, আমি চাইলেও কান্না থামাতে পারি না। ”

সমুদ্র আয়নার পাশে দাঁড়িয়ে বলে, ” শায়লা আন্টি খুবই ভালো মনের। জীবনে অনেক দুঃখ পেয়েছে। এখন সেও সুখে থাকতে চায়। যে যেভাবে চায় তাকে সেভাবে থাকতে দেও। বাঁধা হয়ো না।”
আয়নার এবার আর এতো রাগ-ক্ষোভ লাগছে না। সত্য বলতে বাবার সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে মিসবিহেইভ করার পর সে মনে মনে অনুতপ্ত ছিলো। একবার মনেই হয়েছিলো বাবাকে বলবে ফের শায়লা আন্টির সাথে যোগাযোগ করতে। ও হ্যাঁ, আয়না আবার বাবাকে জেদের বশে বলেছিলো ওনার সাথে যেন কথা না বলে।

সে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো, ” আমার আর এখন একবিন্দু খারাপ লাগছে না।”
আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় সমুদ্রের আচরণ বেশ নরম মনে হলো ওর। বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলো নিজ থেকে। আয়না একবার সমুদ্রের চোখের দিকে তাকায়।ওমন নীলচে মণির দিকে তাকালে মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে পড়ে। আচ্ছা উনি এতো হ্যান্ডসাম কেন?
সমুদ্র জিজ্ঞেস করে, ” আমায় এমন ফ্যালফ্যাল করে দেখছো কেন?”
প্রশ্নের তোপে পড়ে সে লাজুক হাসে এরপর হুট করে জিজ্ঞাসা করে, ” আপনি যে এতো হ্যান্ডসাম? তাও অস্ট্রেলিয়া ছিলেন, আপনার গার্লফ্রেন্ড ছিলো কখনো?”

এহেন প্রশ্নে যেন সমুদ্র ভড়কে যায়। কেমন ভয়ার্ত চোখে একবার তাকালো। এরপর এক কদম পিছিয়ে যায়। আয়না বুঝে পায় না ওনার আবার কী হলো?
সমুদ্রের ভেতরকার সকল নম্রতা কই জানি হারায়, সে কঠিন সুরে বলে, ” এসব কেমন প্রশ্ন আয়না? এই টাইপ কথা-বার্তা আমার পছন্দ না।”
–” আরে এতো রিয়্যাক্ট কেন করছেন? ফ্রেন্ড বললেন তাই জিজ্ঞেস করলাম। ফাজলামি করছি জাস্ট। ”
সমুদ্র কপালে পড়ে থাকা চুল গুলো হাত দিয়ে সরিয়ে খানিক চুপ থাকে। বুঝতে পারে আয়নাও রেগে যাচ্ছে তাই খানিক গলার ভয়েজ কোমল করে বলে, ” এজন্য ছোটদের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করা যায় না৷ কি সব আজাইরা প্রশ্ন করে। চলো নিচে চলো।”

ছাদে তখন ছোট একটা ল্যাম্প লাইট জ্বলছিলো৷ কোথা থেকে জানি সাইকেলের হর্ণের আওয়াজ কানে আসছিলো। তারা নিচে ফিরে আসে। ফাহাদ সাহেব আর শায়লা চৌধুরী বুঝি তাদের অপেক্ষায় ছিলো। আয়নার মনে হলো সব পরিকল্পনা মাফিক হচ্ছে। ফার্মহাউজে এনে আয়নাকে সমুদ্রের মাধ্যমে তাদের বিবাহের খবরটা দিবে এমনই প্লান ছিল।

ফাহাদ সাহেবের পাশে গিয়ে আয়না বসলো। ফাহাদ সাহেব বলে, ” ডিনার করবে না তোমরা? আসার পর থেকে নাকি কিছু-ই খাও নি। এটা কেমন কথা? নতুন জামাইকে না খাইয়ে কেন রেখেছো?”
আয়না একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিলো না বরং সুধালো, ” বাবা আমি তোমাদের অনেক বিরক্ত করি?”
ফাহাদ সাহেব অদ্ভুত ভঙ্গিতে মেয়ের দিকে তাকালো। তারপর বলে উঠে, “তুমি তো আমার লক্ষী মেয়ে। বিরক্তিকর কেন হবে? এমন প্রশ্ন কেন করলে?”

আয়না বলে, ” কিছু না। এমনি বাবা৷ ”
এরপর উঠে এসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে, ” আসুন, আপনাকে খেতে দিই।”
সমুদ্র নড়েচড়ে উঠলো। হলো কি এই মেয়ের? এতো স্বাভাবিক আচরণ! একটু আগেই কেঁদে বুক ভাসালো, না না কেঁদে শার্ট ভাসালো এখন আবার খুব নর্মাল বিহেইভ করছে?
সে ডাইনিং টেবিলে এসে বসলে শায়লা চৌধুরী ই সব সার্ভ করে দেন। প্রত্যেকটা খাবার ই বাঙ্গালী খাবার। সমুদ্রের যেসব প্রিয়।

আয়না বলে, ” আমরা বেরুবো কখন?”
সমুদ্র ভাত খেতে খেতে বললো, ” আজকে এখানেই রাতে থাকবো।”
আয়না হতভম্ব হয়ে বসে থাকে। তাদের রাত্রী যাপনের ও প্ল্যান ছিল অথচ তাকে কিছুই বলেনি। আয়না অল্প খেয়েই উঠে পড়ে। তাদের আজ থাকার জন্য বরাদ্দ করা রুমে চলে যায়। ফাহাদ সাহেব একটু আগেই খেয়েছেন জন্য উনিও রুমে গিয়ে বিশ্রাম নেন৷
সমুদ্র উঠে পেছনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। শায়লা একবার সমুদ্রের পানে তাকালো। উনি জানেন সমুদ্র এখন সিগারেট খাবে। ছেলেটা ভীষণ ভদ্র– মানুষের সামনে সিগারেট খায় না। উনি হাতের কাজ সেড়ে একটা সুতির সাদা-নীল মিশেলে টাই-ডাই করা শাড়ি হাতে নিয়ে আয়নার রুমে ঢুকে।
এরপর জিজ্ঞেস করলো, ” আয়ু আসবো?”
আয়না বলে, ” আসেন।”

সে চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকার। এমন মেন্টাল প্রিপারেশন-ই নিয়েছে৷ এখন আর যুদ্ধ বা ঝগড়া করে লাভ নেই কেবল অশান্তি বাড়বে। আর সে অশান্তির বিপক্ষে। চাইলেও আর কিছু হবে না। তাই মেনে নেওয়াই উত্তম। তাছাড়া সমুদ্রের সামনে সে চায় না কোনো সিনক্রিয়েট করতে।
শায়লা এসে শাড়ি দেখিয়ে বলে, ” এটা পড়ো। তোমার সালোয়ার কামিজ টা যে গর্জিয়াস, গরম লাগছে না? শাড়ি একা পড়তে পারো তো?”
আয়না বলে, ” না। হেল্প লাগে।”
–” আসো আমি হেল্প করি।”
শায়লা চৌধুরী খুব সুন্দর করে ওকে শাড়ি পড়িয়ে দেন। আয়নার নিজেকে দেখে মনে হয়, শুভ্র মেঘের ভেলা যেন!

শায়লা চৌধুরী অল্প করে সাজিয়ে দেয় ওকে৷ এরপর বললো, ” তারপর সমুদ্র সাহেব কে তোমার বর হিসেবে কেমন লেগেছে? ”
আয়না দু’পল ভেবে বলে, ” একদম অসভ্য আর বেয়াদব।”
আসলে সমুদ্রের ব্যাপারে ভালো কথা মুখ দিয়ে বের হয় না। আপনা-আপনি বেয়াদব তকমা লাগাতে ইচ্ছে করে। যে লজ্জা দিয়েছে অফিসে একবার! তবে বুঝে ফেলে কথাটা বলা ঠিক হলো না৷
শায়লা চৌধুরী হতভম্ব হয়ে চেয়ে রয়। এরপর মৃদ্যু হেসে বলে, ” তোমরা এ’যুগের মেয়েরা ভীষণ এডভান্সড তো!”

সমুদ্র দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে সিগারেট টানছে। রাত হলে বড্ড ধোঁয়ার নেশা চেপে বসে মাথায়। শহরের বাইরের দিকে রাত গুলো কেমন নিস্তব্ধ। নিরিবিলি। গতদিন বৃষ্টি হওয়ায় কোথায় পানি জমেছে সেখান থেকে ব্যাঙের ডাক কানে আসছে।
সারাদিনে ঘটে যাওয়া বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবে সে। এরপর একবার নিজেকে নিয়ে ভাবলো। অতীতের সকল কালোর সঙ্গে সংগ্রাম করে এগিয়ে তো এলো। এখন জীবনে কেবল বর্তমান বিদ্যমান। নতুন সম্পর্কটাকেও পুরাপুরিভাবে পরিপূর্ণ করতে চায় সে। ধীরপায়ে রয়ে-সয়ে তাদের রুমের দিকে আগায় সমুদ্র। রুমে আসতেই চোখ গেলো আয়নার দিকে। ও মিররের সামনে বসে কী যে করছে। আজ শাড়ি পড়েছে। শাড়ি পড়লে ওকে বেশ মানায়। মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে থেকে সমুদ্র বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে বলে, ” তুমি কি এখন সাজতে বসবা?”

–” নাতো। এখন কেন সাজবো?”
–” সেটা তুমি-ই ভালো জানো। তোমরা মেয়েরা তো সারাদিন-সারারাত ওই আয়নায় নিজেকে দেখেই পাড় করে দিতে পারো।”
–” বাহ আপনি দেখছি মেয়ে নিয়ে অনেক জানেন।”
সমুদ্র দু’হাত প্রসারিত করে আরাম করে আড়মোড়া ভাঙ্গলো যেন৷ এরপর আয়নার দিকে তাকিয়ে বলে, ” আমি কী অনেক খারাপ নাকি?”
আয়না ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে, ” কেন এমন প্রশ্ন?”
সমুদ্র তার দিকে এগিয়ে এসে বলে, ” তাহলে এতো দূরত্ব কেন?”
আয়না চকিতে উঠে। এরপর হুট করে তার হাতে টান লাগে। মুহুর্তের মধ্যে সমুদ্রের বুকে নিজেকে আবিষ্কার করলো। ওর কেমন আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। সমুদ্র আস্তে করে ওর কাঁধে পড়ে থাকা চুল গুলো নিয়ে খেলা শুরু করে। কেমন শিহরণ বয়ে যায়। ওর শ্বাস-নিশ্বাস ঘণ ও গভীর হতে লাগে। হৃদস্পন্দনের গতি ক্রমশ পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পায়। কেঁপে-কেঁপে উঠে সে। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই বুঝতে পারে সমুদ্রের মন আর হাত আজ বড্ড চঞ্চল।

সমুদ্র আস্তে করে ওকে পাঁজাকোলে তুলে বিছানার বসে। আয়না আস্তে করে চোখ খুলতেই সমুদ্র ওর দু’চোখের পাতায় চু-মু খায়৷ ওনার খোঁচা খোঁচা দাড়ি এসে আয়নার গালে খুঁচতে থাকে। একটা হাত আয়নার হাতের আঙুলের ভাঁজে গুঁজে দেয়। আরেকটা হাত আজ বড্ড বেখেয়ালি! ওর ভারী নিশ্বাসের উষ্ণতা যেন আয়নার মধ্যকার সুপ্ত নারী বাসনাকে জাগিয়ে তুলে। সে ওনার শার্ট আকড়ে ধরে। সমুদ্র টাল সামলাতে না পেরর ধপ করে আয়নার দিকে ঝুঁকে পড়ে। আয়নাকে খুব যত্ন করে বিছানায় শুইয়ে দেয়। ওর কপালের চুলগুলো বারবার উড়ে আসছিলো মুখের সামনে। সমুদ্র হাত দিয়ে তা সরিয়ে কপালে ঠোঁট ছোঁ’য়ায়। এবারে আয়না নিজ থেকে সমুদ্রের কপালে একটা চুমু খায়। কি ভীষণ আদুরে ছিলো সেটা। উনিও আবেশে চোখ বুজে ফেলে। ওনার নীলচে চোখের দিকে তাকাতেই আয়না যেন খেই হারায়।
আয়না ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে, ” আই লাভ ইউ সমু। লাভ ইউ সো মাচ্ মাই ওসেন।”
সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে ফেলে। ওর চেহারার রঙ পালটে যায় ক্ষণে। চোখ-মুখ শক্ত করে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে একপ্রকার চেচিয়ে উঠে বললো, ” এক কি বললে তুমি? কি নামে ডাকলে?

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ১৫

— ” সমু বলে! কেন কি সমস্যা?”
–” আমাকে আমার নামে ডাকবে। এসব সস্তা ফালতু জিনিস কই থেকে আসে মাথায়? সমুদ্র নাম আমার। হাউ ডেয়ার ইউ? প্লিজ আউট ফ্রম হেয়ার। জাস্ট বিরক্ত লাগছে তোমাকে। বের হও এখনি প্লিজ। চেহারা দেখতে চাইছি না তোমার।”
আয়না তবুও ওর হাত ধরলে, এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দেয়।

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ১৭