রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৩৪
সিমরান মিমি
“কোথায় ছিলে তুমি?”
সদর দরজায় পা রাখার সাথে সাথেই গম্ভীর কন্ঠের আওয়াজ শুনে থমকে গেল স্পর্শী।ক্লান্ত চোখে-মুখে সোফার দিকে তাকাতেই সোভামকে দেখতে পেল।ঘামে জর্জরিত অবস্থায় ক্লান্ত হয়ে সেও সোফায় হেলিয়ে বসে আছে।শার্টের উপর থেকে দু/তিনটা বোতাম খোলা।পাশেই বাবা বসে আছেন।স্পর্শী ক্লান্ত পায়ে হেটে সোফায় বসলো।ইতিমধ্যে সোনালী বেগম ঠান্ডা শরবত নিয়ে এসেছে সোভামের জন্য।স্পর্শীকে দেখেই পুনরায় রান্নাঘরে গেল।স্পর্শী বাঁধ সাধলো।ক্লান্ত কন্ঠে বললো,
‘লেবু আছে কাকি।থাকলে একটু নিয়ে আসবে শরবত করে।চিনি দিবে না।শুধু নুন আর বরফ।পারলে একটু ঝাল মিশিয়ো।’
অবাক হয়ে তাকালো জিহান।চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।কিন্তু কিছু বললো না।স্পর্শী ভাইয়ের দিকে তাকালো।নুয়ে যাওয়া কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘মাত্র এসেছো?’
‘হুম।কিন্তু তুমি কোথায় গেছিলে?বাড়ির কাউকে বলে কেন যাও নি?রাত হয়ে গেছে,এমনিতেই আর্শি নিখোঁজ। তার উপর তুমি এরকম হুটহাট না বলে কোথায় গেছিলে?’
স্পর্শী ঠোঁট দুটো গোল করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।মাগরিবের আযান দিয়েছে প্রায় আধ ঘন্টা হয়ে গেছে।অথচ সেদিকে কোনো খেয়াল ‘ই ছিলো না।সামনের দিকে তাকাতেই দেখলো বাবা নামছেন সিঁড়ি দিয়ে।খারাপ লাগলো এবারে।মেয়েদের কে পেয়ে শামসুল সরদার ঠিক যতটা সাহস-শক্তি পেয়েছিলেন;আর্শির কাজে ঠিক ততটাই দুর্বল হয়ে পড়েছেন।শক্ত-পোক্ত বলিষ্ঠ দেহের এই বয়স্ক মানুষটার যেন কাঁধ ভেঙে গেছে।চোখ নিচে নামিয়ে ফেললো স্পর্শী।ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তরে বললো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
‘থানায় গেছিলাম।’
চমকে তাকালো সোভাম।
‘মিসিং ডাইরি করেছো?নাকি শিকদারদের এগেইনস্টে কেস করেছো।’
বিরক্তিকর নিঃশ্বাস ফেললো স্পর্শী।শান্ত কন্ঠে বললো,
‘আর্শি ছোট বাচ্চা না ভাইয়া।যথেষ্ট বুঝদার।ভালো-মন্দ বোঝার যথেষ্ট ক্ষমতাও রয়েছে ওর।প্রেমিকের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়েছে সে।তাই শিকদার দের এগেইনস্টে কেস করার কোনো মানেই হয়না।আর বাকি রইলো মিসিং ডাইরী।যেখানে ও স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়েছে সেখানে এসব করার কোনো প্রয়োজন’ই নেই।আমি গেছিলাম ও লোকেশন ট্রাকিং করতে।’
শামসুল সরদার নড়েচড়ে বসলেন।মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘কোথায় আছে ও?’
‘কক্সবাজারে আছে। আমি কাল সকালে রওনা দেব।বাড়ির কারো এতো টেনশন করার দরকার নেই।খেয়ে নাও।স্বাভাবিক ভাবেই থাকো।যে স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়েছে তার ব্যাপারে চিন্তা করা অনর্থক।যাওয়ার আগে একটা বার ভাবেনি পর্যন্ত পরিবারের সম্মান,বাড়ির মানুষদের ব্যাপারে।তার জন্য আমরা না খেয়ে বসে থাকবো কেন?কাকি রান্না হলে প্লিজ খাবার বারো।আমার খিদে পেয়েছে।’
ফুঁসে উঠলো সোনালী।কান্নারত কন্ঠে বললো,
‘তুই এমন পাষানের মতো কথাবার্তা বলছিস কেন?ও তো তোর’ই বোন।এমন সৎ বোনের মতো আচরণ করছিস কেন?তোর কি একটুও মায়া হয় না।ছোট্ট মেয়ে আমার।অবুঝ,না বুঝে একটা ভুল সিদ্ধান্ত না হয় নিয়েছেই তাই বলে ওকে ফেলে দেবো।আমার আর্শি কি না কি অবস্থায় আছে কে জানে?’
বিরক্ত হলো স্পর্শী।ধমক দিয়ে বললো,
‘ওহহো, চুপ করবে তুমি।যাচ্ছি তো তোমার অবুঝ মেয়েকে দেখতে।কি অবস্থায় আছে সেটা বুঝতেই যাচ্ছি কাল সকালে।এবার একটু থামো।’
সোভাম উঠে দাঁড়ালো।শার্টের বাকি বোতাম গুলো খুলতে খুলতে বললো,
‘রাত হয়ে গেছে।এখন রওনা দিলে পৌছাতে প্রায় পাঁচটা বেজে যাবে।তার থেকে সকালে যাওয়াই ভালো।আনটি, চিন্তা করবেন না।আমি সকালেই যাচ্ছি। ‘
ভ্রুঁ কুঁচকে ফেললো স্পর্শী। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘তুমিও যাচ্ছো মানে?নাহ,প্রয়োজন নেই।আমি একাই সামলাতে পারবো।’
রাগন্বিত হলেন শামসুল।ধমক মেরে বললো,
‘তুমি একা যাবে মানে?এটা কি ছেলেখেলা নাকি?অনেকটা দুরের পথ।তোমাকে একা ছাড়বো কোন আক্কেলে?বিপদ বলে কয়ে আসে না।হয় সোভাম যাবে নয়তো আমি যাবো। ‘
রাগ লাগলো স্পর্শীর।বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে বললো,
‘ওহ আব্বু প্লিজ!আমাকে ভয় দেখিয়ো না।পুরো একুশটা বছর কাঁটিয়ে এসেছি একা।কোনোদিন রাত দশটার আগে বাড়ি ফিরতে পারি নি টিউশন থেকে।অজস্র ভয়ংকর অলিগলি পেরিয়েছি একা একা।ছোট্ট বোনটাকে আজ সতেরো বছর ধরে আগলে এসেছি বড় ভাই হয়ে।আমার কপালে যদি কোনো খারাপ বিপদ লেখাই থাকে তাহলে সেটা অজস্র মানুষের মধ্যেও ঘটবে।তাই বলে একা হাটতে ভয় পাবো?
থেমে,
আশ্চর্য! তোমরা পারিবারিক ব্যাপারটাকে রাজনৈতিক বানানোর জন্য উঠেপড়ে কেন লেগেছো?ওরা পালিয়ে গেছে।এখন যদি দলবল নিয়ে সেখানে খুঁজতে যাই তাহলে ভয় পেয়ে আরো দূরে চলে যেতে কতক্ষণ?ওরা যদি ভয় পেয়ে কোনো খারাপ ডিসিশন নিয়ে নেয় তখন কি করবে?তাছাড়াও একসাথে সবাই মিলে গেলে একটা সিনক্রিয়েট হবে সেখানে।একটা ঝামেলা হওয়ার আশংকাও কম নয়।শেষে ছেলেটা যদি ক্ষোভ নিয়ে আর্শির কোনো ক্ষতি করে দেয় তখন?তখন ওর পরিবারকে হাজার জেল খাঁটালেও আমার আর্শি কি ফিরবে?
আব্বু একটু মাথা ঠান্ডা করে ভাবো।আমার ফ্রেন্ড আছে কক্সবাজারে।ও ওখানকার’ই স্থানীয়।আমি ওর কাছেই যাচ্ছি।ও আর্শিকে খুঁজতে আমাকে হেল্প করবে।আমার ছোট বেলার বান্ধবী।আমরা সেই স্কুল থেকে একসাথে পড়ছি।আমার ওর সাথে কথাও হয়েছে।ওখানে গিয়ে আমার কম-পক্ষে দু-তিন দিন থাকতে হবে।সেখানে আমি গেলে থাকা যায়, কিন্তু পরিবার সুদ্ধ গেলে তো কেমন দেখায় তাই না?চিন্তা করো না প্লিজ।আমি ঘন্টায় ঘন্টায় আপডেট জানাবো তোমাদের।’
সোভাম রাগন্বিত দৃষ্টিতে বাবার দিকে একবার চাইলো।এরপর থমথমে পায়ে হেটে সোজা উপরের দিকে চলে গেল।শামসুল সর্দার ও অভিমানী দৃষ্টিতে একবার মেয়ের দিকে তাকালেন।এরপর মান জড়ানো কন্ঠে বললেন,
‘যা ইচ্ছা করো।এমনিতেও তোমাকে বাঁধা দেওয়ার কোনো অধিকার নেই আমার।আমার ভাগ্য তা হতে দেয় নি।একা বিশৃঙ্খলায় বড় হয়েছো।এখন তোমাকে শৃঙ্খলে বাঁধার সাধ্য কার।তবে একটা কথা মনে রেখো,বাবা হিসেবে তোমাকে বিয়ে দেওয়া আমার দায়িত্ব। যথেষ্ট বড় হয়েছো।এখন বিয়ের প্রস্তুতি নাও।আর হ্যাঁ, বিয়ের পর একটু শৃঙ্খলে থাকার চেষ্টা করো।”
থেমে বিরবির করে উপরে যেতে যেতে বললো,
‘যে মেয়ে বানিয়েছে তোমার মা,আমার তো এখন থেকেই সেই অভাগার জন্য মায়া হচ্ছে।’
রাত প্রায় আট টা।শিকদার বাড়ির সবাই বর্তমানে খাবার টেবিলে।সবার চোখমুখ থমথমে। নেই কোনো হাসি।যেন বাধ্য হয়ে রোজকার কাজ সমাপ্ত করছে সবাই।স্পর্শী খেয়ে-দেয়ে কারো সাথে কোনোরুপ কথা না বলেই রুমে ছুটলো।তার মেজাজ এখন তুঙ্গে শিকদার বাড়ির চরম এক অসভ্য লোক তাকে ফোনের পর ফোন দিয়েই চলেছে খাবার টেবিলে বসে।বারবার কেটে দেওয়ার পরেও নেই কোনো বিরতি।এ যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কে কতবার ফোন দিতে পারে আর কে কতবার কাঁটতে পারে।প্রতিটা লোকমা মুখে নিতেই ঘাম ছুঁটে গেছে স্পর্শীর।ভাগ্যিস ফোনটা সাইলেন্ট ছিলো।নয়তো বাধ্য হয়ে সবার সামনেই রিসিভড করতে হতো ফোন।আর কেউ যদি কোনো ভাবে বুঝে নিতো যে এটা শিকদার বাড়ির বড় ছেলে তাহলে কি জবাব দিতো?কিভাবে বলে বোঝাতো যে এই অসভ্য লোকটার সাথে কলে কথা বলার মতো কোনো সম্পর্ক নেই তার।তাও বারবার ফোন করতে থাকে।ভদ্রতার কারনে মাঝেমধ্যে বাধ্য হয়ে রিসিভড করতে হয়।
রুমে ঢুকেই ভেতর থেকে দরজা আটকে দিলো। এরপর দ্রুতপায়ে বারান্দায় গেল।ফোন রিসিভড করে নিচু কন্ঠে ধমকের সুরে বললো,
‘কে মরেছে?’
অবাক হয়ে গেল পরশ।আশ্চর্যের সুরে বললো,
‘কে মরবে?কারোর মরার কথা ছিলো?’
দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সামলালো স্পর্শী।বললো,
‘তাহলে এত্তোবার ফোন দিচ্ছেন কেন?দেখছেন না কেঁটে দিচ্ছি।তারপরেও এতোবার ফোন দিচ্ছেন কেন?চক্রান্ত করছেন ছোট ভাইয়ের মতো।যে একটাকে তো নিয়ে ভেগেছে,এবার অন্যটাকেও নিয়ে নেই।’
হাসলো পরশ।এরপর বললো,
‘তোমার কি মনে হচ্ছে পরশ শিকদার তোমার প্রতি উইক?সে বারবার তোমাকে পটানোর জন্য ফোন দিচ্ছে?হা,এরথেকে অলৌকিক ভাবনা চিন্তা পৃথিবীতে আর হতে পারে না।প্রয়োজনে আজীবন অবিবাহিত থাকবো তাও তোমার মতো ডাকাতকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করবো না।যাই হোক,প্রথম ফোন টা ভুল গেছিলো।আমি কাঁটতেই যাচ্ছিলাম।কিন্তু তার আগে তুমি কেঁটে দিয়ে আমার জেদ টা বাড়িয়ে দিয়েছো।শোনো মেয়ে,এতোটাও অহংকার করো না।সুযোগ পেলে সুদে-আসলে বুঝিয়ে দেবো।’
হাসলো স্পর্শী।ব্যঙ্গ করে বললো,
‘হ্যাঁ, ওই আমার নাম্বার টাতেই সবসময় ভুল করে ফোন আসে।তাই না?’
নড়েচড়ে বসলো পরশ।বললো,
‘হ্যাঁ সেটাই তো।তোমার নাম্বার দেখলেই আমার হাত সুড়সুড় করতে থাকে।কেন জানো?আমার আবার পাগল রাগিয়ে দিতে ভালো লাগে।আশেপাশে আজকাল তেমন কোনো পাগল চোখে পড়ে না।ভাবলাম তুমি তো কোনো অংশে পাগলের চেয়ে কম নও।কিছু বললেই দাউদাউ করে জ্বলে ওঠো।তাই একটু বিনোদন নেওয়ার জন্য ফোন দিই।’
হা হয়ে গেলো স্পর্শী।কিছু বলার প্রয়াস করতেই পরশ পুনরায় বললো
‘কাল ক’টায় রওনা দিচ্ছো?’
‘আপনাকে বলবো কেন?’
‘তুমি একা যাচ্ছো?নাকি তোমার ডাকাত ভাই ও যাবে?’
রাগে গিজগিজ করে উঠলো স্পর্শী।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘আমার ভাই সম্পর্কে একটাও বাজে কথা বললে গাল টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।ফোন কাটুন।আপনার সাথে কথা বলতে আমি ইন্টারেস্টেড নই।কি বলবেন সোজাসাপ্টা বলুন।ঘুমাবো এখন।’
পরশ সিরিয়াস হলো।শান্ত কন্ঠে বললো,
‘তুমি কি একা যাচ্ছো?গাড়ি নিচ্ছো কি সাথে।শোনো,গাড়ী খুবই সাবধানে রাখবে, ওরা যেন টের না পায়। ওরা বুঝতে পারলে কিন্তু হিতে বিপরীত হবে।কথা তো শুনবে না। পারলে একটু লুকিয়ে লুকিয়ে খুজোঁ।আর ওদেরকে কোথাও দেখা মাত্রই আমাকে কল করবে।ওকে।’
মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো স্পর্শী।
‘আমি কোনো গাড়ি নিচ্ছি না সাথে।এমনি ভাড়া করে যাবো।’
অবাক হলো পরশ।পরক্ষণেই বিজ্ঞদের মতো বললো
‘ভাড়ায় গেলে কমপক্ষে এগারো ঘন্টা লাগবে তোমার।এর থেকে তুমি আমার সাথে যেতে পারো। ‘
নাক ছিটকালো স্পর্শী।
‘নো নিড।আমি একাই যেতে পারবো।আপনার যদি খুব করে একজন সঙ্গী প্রয়োজন হয় তাহলে কোনো পাগল সাথে নিয়ে যাবেন।এতে সময়টাও খুব তাড়াতাড়ি কেটে যাবে।আপনি তো পাগলদের সাথে কথা বলতে খুব বেশি পছন্দ করেন।হবেই তো,নিজের মেন্টালিটির মানুষ ই বেশি ভালো লাগে।গুড নাইট।’
‘ওকে।তুমি কক্সবাজার গিয়ে পৌছাতে পৌছাতে আমি ওদের কে গিয়ে নিয়ে আসবো পিরোজপুরে।’
হাসলো স্পর্শী।বললো,
‘ওকে,দেখা যাবে কে আগে পৌছায়।’
ফোন কাটার সাথে সাথে স্পর্শী রুমে এলো।দরজা খুলে নিচে উঁকি দিয়ে সবার উপস্থিতি দেখে নিলো।নাহ,বাবা নেই ড্রয়িংরুমে।নিশ্চয়ই নিজের রুমে রয়েছেন।জোরপায়ে বাবার রুমের সামনে গেল। আলতো টোকা মেরে বললো,
‘আব্বু,আসবো?’
শামসুল সরদার শোয়া থেকে উঠে বসলেন।শান্ত কন্ঠে বললেন,
‘এসো।’
স্পর্শী গটগট পায়ে ঢুকলো।সোজা বিছানার উপর বসে বাবার বুকে আলতো করে মাথা রাখলো।চমকে উঠলেন শামসুল।মেয়ের মাথায় হাত জড়াতেই স্পর্শী বলে উঠলো,
‘সরি।রাগ করেছো?’
‘নাহ,রাগ কেন করবো?’
মানলো না স্পর্শী।পুনরায় বাবাকে জড়িয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বললো,
‘মিথ্যা বলছো।আমি জানি তুমি রাগ করেছো আমার উপর।কিন্তু কিচ্ছু করার নাই।আমি একাই যাবো।কোনোরকম গন্ডোগোল পাকাতে চাই না আমি।’
মাথা নাড়লেন শামসুল।শান্ত কন্ঠে বললেন,
‘বুঝলাম।কিন্তু ক’টায় রওনা হচ্ছো?’
‘আমি সকাল সাত’টার মধ্যেই রওনা দিবো।তুমি কিছু টাকা দাও তো।আমার কাছে যা আছে তা শর্ট পড়ে যাবে।’
চমকে গেলেন শামসুল।তাড়াহুড়ো করে উঠলেন বিছানা থেকে আলমারির নিচের ড্রয়ারের মধ্যের সিন্দুক খুললেন।এক বান্ডিল টাকা বের করে মেয়ের সামনে দিয়ে বললেন,
‘আমি ডাকতে চাইছিলাম তোমাকে।দরজা বন্ধ দেখে ভাবলাম হয়তো ঘুমাচ্ছো।তাই আর ডাকিনি।’
স্পর্শী সযত্নে বান্ডিল টা হাতে নিলো।পুরোটা হাজার টাকার নোট।সেখান থেকে গুনে গুনে বিশ হাজার টাকা নিয়ে বাকিটা বাবার হাতে দিয়ে বললো,
‘নাও। আর লাগবে না।এটাতেই হবে।’
কক্সবাজার।সারি সারি সবুজ ঝাউবীথি, পাহাড়, ঝর্ণা, আর নরম বালির মাঝে দীর্ঘ অপরূপ সৈকত কক্সবাজার। সাগরের নীল জলরাশি আর ঢেউয়ের গর্জন সাথে হিমেল হাওয়ায় মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশ। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। সৃষ্টিকর্তা যেন রূপসী বাংলার সব রূপ ঢেলে দিয়েছে বালুর আঁচলে। ১২০ কিলোমিটারের দীর্ঘ দর্শনীয় সমুদ্র সৈকতের কারণে প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিয়াসী পর্যটক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কক্সবাজারে ঘুরতে আসে। নাজিরার টেক থেকে শুরু করে শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত সৈকতের বেলাভূমি। ভ্রমণকারীরা কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগরের পাড় ঘেঁষে বয়ে যাওয়া মেরিন ড্রাইভ প্রাণবন্ত হয়ে উপভোগ করে।
চোখ বুজে কল্পনার এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্যে হারিয়ে গেল স্পর্শী।জীবনে এ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি সেখানে।ব্যস্ততার কারনে পারেনি শখকে প্রশ্রয় দিতে।আজকেও পারতো না হয়তো।ব্যাস বোনের জন্য ঘুরতে হচ্ছে সেখানে।এই তো আর কয়েক ঘন্টা মাত্র। এরমধ্যেই তো পৌছে যাবে সেই মনোমুগ্ধকর পরিবেশে।
বস্তুত পিরোজপুর থেকে চারভাবে কক্সবাজার যাওয়া যায়।পিরোজপুর থেকে সোজা গোপালগঞ্জ হয়ে মুন্সিগঞ্জ, এরপর কুমিল্লা হয়ে ফেনী যেতে হয়।এরপর সীতাকুণ্ড থেকে চট্রগ্রামের পথে ধরে তারপর কক্সবাজার।ভীষণ ঘোরানো-প্যাঁচানো পথ।প্রায় এগারো ঘন্টা প্লাস সময় নষ্ট হয়ে যায় এতে।মাথায় হাত দিয়ে চেয়ে রইলো স্পর্শী।মাইগড এতটা সময় ওয়েস্ট করে গেলে তো পরশ শিকদারের কথাই ঠিক হয়ে যাবে।এবারে বিকল্প পথ খুঁজতে লাগলো।এটাতে দশঘন্টায়’ই যাওয়া যাবে।সোজাসুজি পথ এটা।পিরোজপুর থেকে বরিশাল গিয়ে সেখান থেকে নোয়াখালী, ফেনী। এরপর সেই আগের রাস্তা ধরেই সীতাকুণ্ড হয়ে চট্রগ্রাম তারপর কক্সবাজার।নাহ,এই পথ ও পছন্দ হলো না স্পর্শীর।জলপথে গেলে তো পুরো চাঁদপুর হয়ে প্রায় একদিন লেগে যাবে পৌছাতে পৌছাতে।
শেষে বাধ্য হয়ে আকাশ পথেই রওনা দিলো।বাড়ির গাড়িতে এখান থেকে বরিশাল গিয়ে তারপর প্লেনে যাবে।ড্রাইভার সাথে নিয়ে বাড়ির সবাইকে বিদায় দিয়ে উঠে পড়লো গাড়িতে।একটানা দেড় ঘন্টা গাড়ি চলার পর তারা পৌছালো এয়ারপোর্টে। গাড়ি বিদায় দিয়ে এগিয়ে গেল সামনে।হাতের ট্রলি নিয়ে সামনে এগোতে এগোতে সময় দেখে নিলো।ঘড়িতে মাত্র আট’টা চল্লিশ বাজে।বরিশাল টু কক্সবাজার প্লেন ছাড়বে সাড়ে নয়টায়।প্লেন ছাড়ার পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যেই সেটা কক্সবাজারে ল্যান্ড করবে।
স্পর্শী প্রথমে চেক-ইন করে নিলো।সাধারণত দেশের বাইরে গেলে ইমিগ্রেশন-সহ আরো অনেক ঝামেলার কাজ সম্পন্ন করতে হয়। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণের জন্য শুধু টিকিট দেখালেই হয়ে যায়।এরপর নির্দিষ্ট কিছু কর্মকর্তার কাছে গিয়ে লাগেজের ওজন মেপে নিয়ে জমা দিয়ে দিলো।সাধারণত সাত কেজির উপরে কোনো যাত্রী মাল বহন করতে পারে না।এর বেশী করলে তাকে অতিরিক্ত চার্জ দিতে হয়।সমস্ত নিয়মকানুন পালন করে প্লেনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
ইতোমধ্যে মাইক্রোফোনে নির্দেশনা দিয়ে চলছে কর্মচারীরা।আর মাত্র পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যেই কক্সবাজার পৌছাচ্ছে স্পর্শী।তাও ওই শিকদারের আগে।সেখানে গিয়েই সবার প্রথমে ভিডিও কল করে দেখাবে তাকে।ভাবতেই উত্তেজনা কাজ করছে।উফফফ!আর তর সইছে না স্পর্শীএ।হাতের ফোনটা নিয়ে গুটি গুটি অক্ষরে মেসেজ দিলো,
‘আপনি কতদুর?আমি আর পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যেই পৌছাবো।দেখলেন তো, আপনাকে সেই হারিয়েই দিলাম।’
মেসেজ দিয়ে মুচকি হেসে দিলো স্পর্শী।নিশ্চয়ই অবাক হয়ে যাবে।
‘আমরা একসাথেই পৌছাচ্ছি স্পর্শীয়া।’
আচমকা পেছন থেকে ফিসফিসে কন্ঠে পরিচিত কন্ঠস্বরটা শুনতেই চমকে গেল স্পর্শী।তাকাতেই অবাকের সপ্তম আশ্চর্যে পৌছালো।কালো প্যান্ট,শার্ট, মাস্ক এবং ক্যাপ পড়া এক যুবক তার দিকেই হেলে আছে।চোখ দুটো দেখতেই চোয়াল শক্ত করে ফেললো।এ যে আর কেউ নয়।পিরোজপুরের সেই অসভ্য এমপি।নিজের যাবতীয় সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় চরম হতাশায় মুখমণ্ডল বিকৃত করে ফেললো স্পর্শী।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৩৩
‘ব্যাস হয়ে গেলো।এতো এতো গাড়ি থাকতে সেই এয়ারপোর্টেই আসতে হলো?’
ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে দুপা সামনে এগিয়ে গেল পরশ।পুনরায় পেছন ফিরে তীর্যক হাসি দিয়ে বললো,
‘প্লেন টা কি তোমার বাপের?নাকি শুধু ডাকাত চড়ার জন্য বানিয়েছে?’