ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ১৭
Arishan Nur
একটু আগেও তো সব’টা ঠিক ছিলো! মনে হচ্ছিলো স্বপ্নের শুভ্র স্নিগ্ধ ভেলায় ভাসছে। আবেশে লাগছিলো যেনো অন্য পৃথিবীতে বিরাজ করছে। হুট করে কী হলো? আয়না টাল সামলাতে না পেরে বিছানায় বেশ খানিকটা নুইয়ে পরে। দুইহাত দিয়ে পড়ে যাওয়া থেকে সামলায় নিজেকে। চোখ ফেটে দু’ফোটা অশ্রুমালা বর্ষন হলো। এরপর একাধারে চক্ষু জুড়ে আশ্রুপাত শুরু হয়। নিজেকে কেমন খুব ঠুনকো মনে হচ্ছে৷ কেমন যেন খুব ছোট, ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে যার কারো কাছেই কোনো মূল্য নেই। একদম মূল্যহীন যেন! আসলেই কি সে এতোটা ঠুনকো?
আয়না আর কিছু বলতে পারেনা। কেমন নিশ্চুপ হয়ে যায়। ওনার ওই আদুরে নীলচে চোখে আয়না কোথাও নিজের জন্য ভালোবাসা খুঁজে পায় না। একটু আগেও দু’নয়নে কেবল মুগ্ধতা ছিলো এখন শুধুমাত্র ক্রোধ বিরাজমান! রুমের পিনপতন নীরবতা মনের ভেতরকার অনুভূতিগুলোকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এখন কিছু বলা মানেই সমুদ্রের রাগ আরো বাড়ানো, সে আর অপমানিত হতে চায় না। বিনা কোন অভিযোগে রুম ত্যাগ করে আয়না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আয়না ড্রয়িংরুম অব্দি এসে কেমন টলতে থাকে। রুমে কেউ নেই। সব লাইট বন্ধ করে ডাইনিংরুমে কেবল একটা অল্প পাওয়ারের হলুদ বাতি জ্বলছে। আবছা আলোয় কেমন মাথা ঘুরিয়ে উঠলো৷ আয়না বাথরুমের দিকে এগুলো। তার এখুনি এই মুহূর্তে বাসায় যেতে মন চাচ্ছে। এক সেকেন্ডও এই বাসায় থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে সে। অনেক কান্না পাচ্ছে তার। পানির কল ছেড়ে দিয়ে সে অনেকক্ষণ কান্না করে একা একা। চোখে পানির ছিঁটা দিতেই চোখ ভীষণ রকম জ্বালা করে।
চোখের পানি আর কলের পানি মিশে একাকার হয়ে গেলো। এতো কাঁদার পরও তার চোখ দিয়ে অবিরতিহীন ভাবে পানি বর্ষিত হচ্ছে। আজ কেন যেন জীবনের সমীকরণের হিসাবের রাফখাতায় সবটা গড়মিল হয়ে গেলো। কোনোভাবেই সমীকরণ মিললো না। দুঃখ-বেদনার ত্রিঘাত সমীকরণ মিলানো যেন বড্ড কঠিন! তার নিজস্ব সুখময় ইচ্ছার চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে এতো বড় পার্থক্য কীভাবে হলো? আয়না আস্তেধীরে ড্রয়িং রুমে এসে বসলো। কালকে অব্দি তো সবটা ঠিক ছিল! আজ একদিনের ব্যবধানে সে জীবনের রাশিমালা থেকে অনেককিছুই হারিয়ে ফেললো। সমুদ্রের জন্য তৈরি হওয়া খুব সুন্দর অনুভূতি গুলো কেমন গুমোট বিশ্রী অনুভূতিতে পরিনত হলো! সবকিছু বিষাদময় লাগছে তার।
বাবাও নিশ্চয়ই আর আগের মতো থাকবে না। নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। ফের নতুন করে জীবন আগাবেন। অপরদিকে সমুদ্রের দেওয়া আঘাতভরা অপমান — দুইটা পরপর তীরের তীক্ষ্ম আঘাতে তার হৃদয় যেন ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু চিৎকার করতে পারছে না। আত্মচিৎকার গুলো বোবা হয়ে বুকে চাপ দিচ্ছে। মনে হচ্ছে হার্টফেল হয়ে যাবে এতো ব্যথা।
আয়না দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে। ভীষণ মাথাব্যথা করছে । এতো এতো বিশ্রী অনুভূতির সঙ্গে যুদ্ধে বরাবরই হেরে কুপোকাত। আর একদম সহ্য হচ্ছে না তার। মনের ভেতরকার গুমোট শীতল বিষাদময় অনুভূতিগুলোর কাছে সে আজ পরাজিত। মুখে কোনো কথা নেই যেন৷ সবটা মন আর নিজের একাকীর মধ্যে চলমান। ঘড়ির কাঁটা পাল্লা দিয়ে চলছে৷ কতোক্ষণ পাড় হয়ে যায় জানা নেই। সে সোফাতেই চিত হয়ে ঘুমে ঢুলে পড়ে। আয়না কাঁদতে পারে না।
কান্না-কাটি করলেই ভীষণ শরীর দুর্বল লাগে, মাথাব্যথা করে। শ্বাস কষ্টের মতো কষ্ট হয়! দুর্বল হয়ে পড়ায় ভীষণ ঘুম পায় তার। চোখ বুঁজে আসে। আচমকা কারো হাতের শীতল স্পর্শ টের পেতেই আয়না নড়েচড়ে উঠলো। চকিতে উঠে সোফায় উঠে বসতেই পরিস্থিতি সম্পর্কে খেয়াল হলো। আয়না সামনের দিকে তাকাতেই দেখলো সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে৷ ওনার দিকে তাকাতেই কিছুক্ষণ আগের ঘটা বেদনাদায়ক দুর্ঘটনার কথা মনে পড়লো। ওটা দুর্ঘটনা নয় একদম! দুঃস্বপ্ন ও নাহ। কেবল ভাগ্যের নির্মম পরিনতি! আয়নার ফের চোখ ফেটে কান্না আসে। সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে ওর দু’গালে হাত রেখে চোখের পানি মুছে দিয়ে খুব আস্তে করে বলে, ” আয়না রুমে আসো। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
–” অপেক্ষা তাও আবার আমার জন্য? হাসালেন! একটু আগেই তো নিজ থেকে বের করে দিলেন এখন আবার অপেক্ষা করছেন কেন?”
সমুদ্র মনে হয় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কি বলবে না বলবে ভেবে পায় না। এরপর হাটু গেঁড়ে বসে বললো, ” এভাবে রিয়্যাক্ট আমি করতে চাই নি। বাট নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারিনি।”
–” কি এমন করলাম যে আপনি আমার সাথে এতো রুড হলেন?”
–” তুমি কিছু করো নি। সব দোষ আমার।”
–” আমি বিচার চাচ্ছি না আপনার কাছ থেকে।”
সমুদ্র ফোঁস করে দম ফেলে বলে, ” অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছো? এতো কান্নাকাটি কেন করলে? চোখের নিচটা তো ফুলে লাল আলু বনে গেছে। রুমে আসো। ঘুমাবে।”
আয়নার যেন ভীষণ রাগ লাগলো। সে একটু জোরে বলে উঠে, ” আপনি যান এখান থেকে।”
সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র তার মুখে হাত আলতো করে চেপে ধরে বলে, ” আস্তে! আওয়াজ করে আংকেল-আন্টিকে ঘুম থেকে তুলে আনতে চাইছো? প্লিজ সিনক্রিয়েট করো না।”
আয়না নির্লিপ্ত থাকলো। সমুদ্র বলে, ” রুমে আসো প্লিজ। রাত কয়টা বাজে খেয়াল আছে?”
–” আপনার রুমে আপনি-ই যান। আমাকে ডাকছেন কেন?”
সমুদ্র আশেপাশে তাকালো একবার, এরপর হুট করে আয়নাকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো।
আয়না বলে উঠে, ” নামান আমাকে। এসব কোন ধরনের ফাজলামো সমুদ্র? ”
–” ফাজলামো তো তুমি-ও করছো! ”
আয়না নড়াচড়া শুরু করে বলে, ” ছাড়েন আমাকে নাহলে কিন্তু ভালো হবে না।”
সমুদ্রের যেন কি হলো, সে একদম গম্ভীরমুখে বললো, ” আয়না প্লিজ! আই রিকুয়েস্ট টু ইউ, আর কোনো ঝামেলা করো না। রুমে চলো। নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিজেরা মিটাই। অন্যকে দেখিয়ে ঝামেলা না করি?”
এরপর একটু নর্মাল লো-ভয়েজে বলে, ” তাছাড়া এতো নড়াচড়া করলে দেখা যাবে আমার কোল থেকে পড়ে যাবে ফ্লোরে। এমনি এতো ভারী তুমি। দেখে মনে হয় কাগজের মতো পাতলা! একবার নিচে পড়লে কোমড় ভেঙে গেলে আমার সাথেই বিছানায় দিন-রাত শু’য়ে থাকা লাগবে।”
আয়না কিছু বলে না। এবারো নির্লিপ্ত থাকে৷ সমুদ্র রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে,” অভিমান নামক পাখিটাকে খাঁচাবন্দী করে রাখতে হয়। অভিমান বড্ড খারাপ। সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়।”
–” অভিমান হচ্ছে না বরং আপনার ব্যবহারের জন্য আপনা-আপনি আপনার থেকে মন উঠে যাচ্ছে। ”
আয়নাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে সে দরজা একদম লক করে দিলো। আয়না ফের উঠে যেতে চাইলে সমুদ্র তাকে আটকে ফেলে, এরপর কাছে এসে বললো, অযথাই যুদ্ধ-যুদ্ধ কেন আমাদের মধ্যে?”
–” সেটা আপনি জানেন। সবকিছু আপনার মর্জি মতো চলে৷ আমাকে তো নিজের হাতের কাঠের পুতুল ভাবছেন। যখন যা খুশি করবেন, যা মন চায় করবেন। আমাকে সব মেনে নিয়ে চলতে হবে।”
–” এতো কথা বলো তুমি!”
–” আপনার যা ইচ্ছা তাই করবেন আর আমাকে চুপচাপ সব মেনে নিতে হবে?”
–” সেটা কখন বললাম?”
আয়না সরে এসে সমুদ্রের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বললো, ” বিয়ে করেছেন। কিনে নেননি যে যা ইচ্ছা করবে সেটাই করবেন।”
–” আয়না এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো। বললাম তো ওভাবে ওভার-রিয়্যাক্ট করা আমার ঠিক হয়নি। আসলে ওই নামে ডাকা আমার পছন্দ না।”
–” পছন্দ কী আমাকেও না? আপনি কী আদৌ ভালোবাসেন আমাকে? নাকি আপনার মনে অন্যকেউ আছে? ”
আয়নার খুব সহজ একটা প্রশ্ন ছিলো ওর কাছে৷ কিন্তু এতেই যেন সমুদ্র হাসফাস করে। খামোশ থাকে দু’দণ্ড। জবাব হীন হয়ে পড়ে৷ কোনো ভাবে কী আয়নার মনে তার উপর সন্দেহ হানা দিয়েছে?
সে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে, ” দু’লাইন বেশি বুঝো? একবারও এ’কথা বলেছি যে তোমাকে অপছন্দ করি? লিসেন আয়না আমি এসব ভালোবাসায় বিশ্বাস করি না৷ লাভ ইজ লাইক মিথ টু মি। ভালোবাসা নিয়ে আমার চিন্তাভাবনা অন্যরকম। আমার কাছে এখন দায়িত্ব মানেই ভালোবাসা। এর বাইরে এক্সট্রা কোনো ডেফিনিশন নাই। তোমার সব ধরনের চাহিদা মেটানো আমার জন্য অত্যাবশকীয়। এখন স্বামীর দায়িত্বকে যদি ভালোবাসা মানতে চাও, সেটার তোমার উপর ডিপেন্ডেবল।”
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে সে এরপর আয়নার দিকে তাকায়। ওর চোখ-মুখ এখনো ফুলে আছে। চোখ ভেজা।
সে আরোও বলে, ” প্লিজ কেঁদো না। এজ এ হাসবেন্ড আমি চাই না আমার ওয়াইফ কষ্ট পাক, রাতভর কাঁদুক।”
আয়না তার কথা কিঞ্চিৎ নড়ে উঠে। সম্পর্কের জটিলতা এতো তীব্র বেদনাদায়ক কেন? তার এই মুহূর্তে সবকিছুই অসহ্য লাগছে। সে চোখ ঘুরিয়ে নেয়৷
–” এই তুমি চাইলে আমাকে ওশেন বলে ডাকো। সমুদ্র নামটা কঠিন লাগলে দরকার হলে খাল-বিল ডাকো। বাট নামের ময়নাতদন্ত করো নাহ। ”
সমুদ্র রসিকতা করে পরিবেশ হাল্কা করতে চাইলো কিন্তু লাভ হলো না৷ আয়নার যেন প্রতিক্রিয়া নেই কোনো। বেশি-ই হার্ট হয়েছে কী?
আয়না সুধালো, ” কোনো নামেই আর ডাকবো না।”
–” তোমার রাগ-ক্ষোভ দেখি আমার চেয়েও বেশি। ”
আয়না বেড থেকে উঠে দাঁড়ালে সমুদ্র খপ করে ওর হাত ধরে ফেলে যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে। আয়না হাত ছাড়ানোর জন্য জোড়াজুড়ি করলে সমুদ্র বলে উঠে, ” কি চাও?”
আয়না হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে, ” আপনার থেকে দূরত্ব চাই।”
সমুদ্র কিয়ৎক্ষণ চুপ থাকলো। সে চিন্তাও করেনি আয়না এমন কিছু বলবে! বিয়ের সাতদিনের মাথায় এমন কিছু শুনতে হবে কল্পনাও করেনি। আচ্ছা সে দিনকে দিন রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্টে এতো বাজে হয়ে যাচ্ছে কেন? বাসায়ও আগের মতো কারো সাথে ভালো সম্পর্ক নেই। নতুন সম্পর্কটাতেও কেমন তালগোল পাকিয়ে দিলো! আগের সত্তা নিজের মধ্যে থাকলে এতোক্ষণে জোর করে হলেও কোলে তুলে কতোগুলো চু–মা খেয়ে প্রেমিকার রাগ ভাঙ্গাত। গান গেয়ে মন খারাপ দূর করে দিত! এখন আর ওসব পারে না। সবকিছুতে যান্ত্রিকতা এসে গেছে। আগের মতো মেন্টাল স্টিমিনা নাই নিজের মধ্যে! তবে জীবনের স্রোতের মাঝে পা যেহেতু ভাসিয়েছে, এখন গা ভিজলে তা সামলাতে হবেই।
সে বলে, ” তাহলে কি ধরে নিব সম্পর্ক শেষ করে দিতে চাচ্ছো?”
সম্পর্ক শেষ শব্দ দুটি আয়নার কানে বাজলো খুব জোরে। বাহ কি সহজ উনার জন্য সবকিছু! এতো অবলীলায় বলে দিলো সম্পর্ক শেষ করবে কীনা৷ আয়না চোখ বেয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে৷ সত্য বলতে আয়না ভীষণ আবেগী। ওর মনে কোনো কালো কিছু নেই৷ কখনোই কারো জন্য অশনি কিছু কামনা করি নি। নরম মনের হওয়ায় হয়তো সমুদ্র ওকে নাজুক ভাবে!
সমুদ্র তৎক্ষনাৎ ওর সামনে এসে গাল দু’টোয় আলতো করে হাত রেখে বললো, ” আমি চাই আমাদের সম্পর্ক অনেক দূর গড়াক।”
এরপর আয়নার ডান গালে নিজের ঠোঁট ছু’য়ালো। ওর চোখের পানি যেন চু–ষে নেয় সে। আয়না ফের সরে আসে। সমুদ্র ভ্রু কুচকে তাকায়। এরপর ইচ্ছাকৃতভাবে প্রসঙ্গ পাল্টাতে উদগ্রীব হয় সে। বলে উঠে, ” তোমার ডিহাইড্রেশন হয়ে যাবে। পানি খাও৷ এতো চোখের পানি ফেলেছো। প্রেশার ফল করবে৷”
আয়না দ্রুত বেগে আক্রমনাত্মক স্বরে বললো, ” সাপ হয়ে কামড়াবেন আর ওঝা হয়ে ঝাড়বেন?”
সমুদ্র এবারে ওকে টেনে এনে বেডে ফেলে দিয়ে নিজে ওর উপর এসে ঝুকে শু’লো৷
তারপর বললো, ” আমি মোটেও ওঝা না। সাপ না। ডাক্তার আমি।”
আয়না মুখ ঘুরিয়ে নিলো যেন সে একদম সমুদ্রকে দেখতে চায় না। এতে সমুদ্র ভীষণ রকম পীড়া অনুভব করে। সেই থেকে চায়না, না ঠিকমতো কথা বলছে, না প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, এমনকি তাকাচ্ছেও না। এতোটাও অবহেলা করা ঠিক না। মানুষের অবহেলা পেতে আর ভালো লাগে না। আয়না তার থেকে সরে এসে বেডের মাঝে বালিশ দিয়ে দিলো। এরপর ও’পাশ ঘুরে শু’য়ে পড়ে। সমুদ্র বুঝে পায় না কি করা উচিত? এতোবেশি টানাহেঁচড়া করলে সম্পর্কের বাঁধন না ছিঁড়ে যায়। নিজের ইগো একপাশে রেখে সিন্ধান্ত নিলো সর্যি বলবে। সর্যি শব্দটা সে একদম মুখে আনে না। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম।
সে বলে উঠে, ” এই ঘুমিয়ে পড়েছো?”
আয়না ও’পাশ ঘুরেই জবাব দেয়, ” হ্যাঁ। ”
–” বাহ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা বলো তুমি!”
এরপর বিছানার মাঝে রাখা কুশন দুটো হাত দিয়ে টেনে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে আয়নার নিকটে অবস্থান করে বলে, ” সর্যি আয়না।”
আয়না কোনো প্রতিক্রিয়া এবারো দেখালো না। হতাশ হয় সমুদ্র। এটাই লাস্ট অপশন ছিলো। এরপর কি করবে সে? জানা নাই। ভেবেছিলো ইন্টি–মেসি পর্যায়ে মাধ্যমে হয়তো শেষ ধাপে পৌঁছে যাবে কিন্তু এখনো মনে হচ্ছে আরো অনেক কিছু দেখা বাকি।
সে আয়নার পাশ ঘেঁষে শু’য়ে চুলে হাত দিতেই আয়না একদম ওদিকে ঠেসে গিয়ে বললো, ” কাল ভার্সিটি আছে। ঘুমাবো আমি।”
–” এতো সুদর্শন ইয়ং হাসবেন্ড রেখে তুমি ওই দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকবে?”
আয়না জবাব দেয় না। মনে হয় ঘুমানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। ওর ঘুম প্রয়োজন। সমুদ্র সব বুঝে কিন্তু ঐ অনুযায়ী মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কার্য সাধনা করতে ব্যর্থ হয় সে বারেবারে।
সে বলে, ” আচ্ছা তোমায় আমি দূরত্ব উপহার দিলাম। আশা রাখি, আমাদের মধ্যকার দূরত্ব সম্পর্কটা ধ্বংস করবে না, যেহেতু দূরত্ব ঋনাত্মক নাহ।”
সে নিজেও সরে এসে শু’য়ে পড়ে অপরদিক ঘুরে। আসলে কাছাকাছি হওয়া মানেই কাছাকাছি থাকা না। এইতো একহাত দূরত্বে অবস্থান করেও তারা কতোটা দূরের মানুষ! তাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব হিসেব করলে ক্যালকুলেটরে ম্যাথ ইরর আসবে। হিসেবের খাতিরে আলোকবর্ষ একক ব্যবহার করা লাগবে৷ এতোটা দূরত্ব ৷ মুহুর্তের মধ্যে দু’ হৃদয়ের মাঝে কয়েক আলোকবর্ষ পরিমাণ দূরত্ব দু’জনকেই বড্ড পীড়া দেয়।
তখন কেবল সকাল। সাতটাও বাজে নি। আয়না রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই দেখে ফাহাদ সাহেব আর শায়লা চৌধুরী নাস্তার টেবিলে বসে আছেন। চা খাচ্ছেন। আয়নার ভঙ্গুর হৃদয় যেন আরোও ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়। সে কারো দিকে না তাকিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে ধরলে শায়লা চৌধুরী জিজ্ঞেস করে, ” আয়ু এতো সকালে কই যাচ্ছো?”
ফাহাদ সাহেব ও মেয়ের দিকে তাকায়। আয়না জবাবে বলে, ” বাসায় যাচ্ছি।”
–” সেকি কথা! এতো সকালে কেন যাচ্ছো? কই কিছুই তো বললে না আগে? সমুদ্র কোথায়?”
আয়না কেবল উত্তর দেয়, ” উনি ঘুমায়। আমি একাই যাব এখন।”
শায়লা চৌধুরী বলে, ” কেন? আমাদের কিছুই বললে না?”
এতেই আয়না চটে যায়। সে বলে উঠে, ” আপনাদের পারমিশন নিতে হবে এখন? আপনি কে আমাকে জিজ্ঞেস করার?”
–” তা মিন করিনি।”
শায়লা যতোটা শান্ত থাকলো, ওতোটা শান্ত ফাহাদ সাহেব থাকলেন না। তিনি বলেন, ” আয়ু এটা কেমন ব্যবহার? ”
ওনার কথায় রাগের আভাস পাওয়া যায়। আয়না কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে আসে৷ বাবার প্রশ্নেরও উত্তর দেয় না৷
ফাহাদ সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ” আয়না থামো৷ আমি তোমাকে যেতে বলেছি?”
কতোদিন পর বাবা আয়নাকে এভাবে থমক দিলো তাও আয়না বলে ডেকে! শায়লা চৌধুরীর সামনে এমন আচারণে সে আরোও মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়৷
শায়লা চৌধুরী ফাহাদ সাহেব কে ঠাণ্ডা হতে বললেন। এরপর আয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” তোমার বাবার গাড়ি নিয়ে যাও।”
ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ১৬
আয়না আর কোনো কথা না বলে কেটে পড়ে। ফাহাদ সাহেব ভ্রু কুচকে তাকালেন মেয়ের যাওয়ার পানে। আয়না এতো এমন না। বরং খুব শান্ত স্বভাবের।
শায়লা চৌধুরী বলে, ” ও হয়তো আমাদের বিয়ের খবর পেয়ে কিছুটা ট্রমায় আছে। এজন্য বাসায় যেতে চাচ্ছে। তোমার ওকে বকা দেওয়া ঠিক হলো না। বুঝতে হবে ওর মানসিক অবস্থা।”
ফাহাদ সাহেব থম মেরে বসলেন। মেয়ে কি কষ্ট পেলো নাকি?