রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৩৭ (২)

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৩৭ (২)
সিমরান মিমি

ঠাস করে দরজায় শব্দ হলো।হয়তো ভেতর থেকে উচ্চ গতিতে ধাক্কা মেরে দরজা টা লাগানো হয়েছে।উপস্থিত সকলের কানে গেলো ঠিকই। কিন্তু আমলে আর নিলো না।যে যার মতো চলে গেল রুমে।মহিলারাও গেল রান্নাঘরের দিকে।নাস্তাটাও করা হয়নি সকালে।বেলা বাজে দেড় টার ও বেশি।দুপুরের রান্না আরো আগেই শেষ। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো সবাই খেতে চলে আসবে।দ্রুতহাতে সামলাতে হবে সবটা।একটানা বিশ মিনিট থম মেরে বসে রইলো স্পর্শী।পানিগুলো বৃষ্টির মতো সারাগায়ে পড়ছে।সে ভাবছে।

আর্শিকে নিয়ে ভাবছে,পাভেলের সাথে তার বিয়ে নিয়ে ভাবছে।পরশ কে নিয়ে ভাবছে।বাবা-ভাইয়ের রাগ নিয়ে ভাবছে। নিজের বিয়ে নিয়ে ভাবছে।কিন্তু কিছুতেই সবটা মেলাতে পারছে না।কিছুই তার মনমতো হচ্ছে না।ভাবতে ভাবতে একপর্যায়ে মাথা হ্যাং হয়ে গেল।দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ করে উঠলো।আরো কিছুক্ষণ ভিজে দ্রুর গোসল সেরে নিলো।প্রত্যেক টা জীবনই প্যাঁচানো।কোথাও সুখ নেই।এইযে ঢাকায় থাকতে টিউশনি শেষে ভাবতো,”ইশশ!একটা পরিবার থাকতো,বাবা থাকতো, তাহলে আর এতো কষ্ট করতে হতো না।রাজকন্যার মতো চলতে পারতো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“অথচ আজ সেই রাজকন্যা হয়েও তার ঝামেলা পূর্বের ন্যায় কমছে না।বরংচ নিত্যদিনই বাড়ছে।তোয়ালে পেঁচিয়ে রুমে ঢুকে পুরো ঘর খুঁজতে লাগলো।কোথাও লাগেজ নেই।সেকি লাগেজ ড্রয়িংরুমে রেখে এসেছে?নাহ!সেতো আনেনি।নিশ্চয়ই ভাই বা বাবা এনেছে।আর অবশ্যই ড্রয়িংরুমেই রেখেছে।আলমারি থেকে অন্য পোশাক বের করে পড়ে নিলো। আলতো পায়ে নিচে নেমে সোফার সামনে এবং পেছনে খুঁজলো।কোথাও নেই।সোনালী এগিয়ে এলো দ্রুত।

“কিছু খুঁজছো মা?”
“হুম,কাকি আমার লাগেজ টা খুঁজে পাচ্ছি না।ওটা কি ভাইয়া তোমার কাছে দিয়েছিলো?”
“না তো। কই?সোভাম তো কোনো লাগেজ ই আনেনি।দেখেনি তো ওর হাতে।”
অবাক হলো আর্শি।বললো,
“তাহলে কি আব্বু এনেছে লাগেজ?”
ভাবলো সোনালী।দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“না,ভাইজান তো তোমাদের আগে আগেই হেঁটে আসলো।তার হাত ও তো খালি ছিলো।”

চমকালো স্পর্শী।তখনকার রেস্টুরেন্টের পুরো ঘটনাটা নিয়ে ভাবতে লাগলো।লাগেজ তো পরশ শিকদারের হাতে ছিলো দুটোই।বাবা প্রথমে থাপ্পড় দিলো।এরপর সোভাম গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে ওর হাত টেনে নিয়ে আসলো।আর সাথে সাথেই বাবা ও আসলো।তারমানে কি লাগেজ আনা হয়নি।তাহলে তো ওটা এয়ারপোর্টেই রয়ে গেছে।ও মাই গড!পরশ শিকদার কি লাগেজ টা আনবে?নাকি সোভাম ভাইয়ের করা অপমানের কারনে রেগে মেগে ফেলে দিয়ে আসবে।এখন বাড়ির কেউ যদি জানে তার পোশাকের লাগেজ পরশের কাছে।তাহলে তো হিতে বিপরীত হবে।যদি জিজ্ঞেস করে তার জামা-কাপড় পরশ শিকদারের জামা-কাপড়ের লাগেজের সাথে কেন?তাহলে কি উত্তর দিবে?ও আল্লাহ!বসে পড়লো স্পর্শী।আলতো হাসার চেষ্টা করে বললো,

“ওহহো!ট্রলির চাকায় ধুলো লেগেছিলো দেখে আমিই তো ওটা আমার বারান্দায় রেখেছিলাম।আর দেখো এখন সারাবাড়ি খুঁজছি।তোমার চোখের ডাক্তার দেখাও কাকি।আমার হাতেই ছিলো ওটা।আর তুমি বলছো দেখো নি।”
হাসলো সোনালী।বললো,
“হুম, চোখের সমস্যা যে বাড়ছে এটা গত মাস থেকেই বুঝছি।মাথা ও যন্ত্রণা হয় অনেক।রাতে ঘুমাইলে চোখের দুই পাশ দিয়া পানি পড়ে।ঢাকা দিয়া নাকি ডাক্তার আসবে সামনে সোমবার।দেখাবো ভাবছি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।আমি নিয়ে যাবো তোমায়।”

“স্পর্শীয়া,খেতো আসো।”
চমকে উঠলো স্পর্শী। তাকিয়ে দেখলো বাবা হেঁটে যাচ্ছে ডাইনিং এর দিকে।কাকা ও এসে বসে পড়েছে।একে একে রিহান,জিহান,সোভাম সবাই আসছে। স্পর্শী আলতো পায়ে হেঁটে গেল সেদিকে।নিশ্চুপ হয়ে চেয়ারে বসে প্লেট নিয়ে নিলো।প্লেটের দিকে তাকিয়েও বোঝা যাচ্ছে বাবা আড়চোখে তাকাচ্ছে তার দিকে।পাত্তা দিলো না স্পর্শী। মা টেবিলের একপাশে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।সোনালী বেগম খাবার বেড়ে দিচ্ছে।স্পর্শী মায়ের দিকে চাইলো।শান্ত কন্ঠে বললো,

“এদিকে আসো।”
ধীর পায়ে এগিয়ে এলো সোনালী।স্পর্শী মাকে এক হাত দিয়ে কোমড় জড়িয়ে কাছে নিলো।বললো,
“কিছু বলবা?”
মাথা উঁচুনিচু করে নাঁড়িয়ে বললো,’হুঁ’।
“বলো।”
পিপাসা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো।কম্পনরত কন্ঠে বললো,
“আর্শির কোনো খোঁজ পেয়েছিস?”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো স্পর্শী।খাবারে দলা পাঁকাতে পাঁকাতে বললো,

“হুম,পেয়েছি।ও কক্সবাজারেই ছিলো।তোমার মেয়ে বিয়ে করেছে মা।যেদিন রাতে পালিয়েছে তার পরের দিন সকালেই বিয়ে করেছে।ওরা ওখানে একটা রিসোর্টে ছিল।আমরা খুঁজতে গেছি দেখে ওখান থেকেও পালিয়েছে।জানো মা,আমি ওদের গাড়ির পেছন পেছন ছুটছিলাম।ও ঘুরে দেখলো আমায়।তাও গাড়ি থামায় নি।
থামলো স্পর্শী।গলা জড়িয়ে যাচ্ছে কেমন।ঢোক গিলে বললো,
” ভুলে যাও ওকে।এমনিতেও তো বিয়ে দিতে।যাক না নিজের পছন্দ মতো।এখন তোমার মেয়ে আর ছোট্ট নেই।কোনো এক বাড়ির বউ সে।দেখিনা ওর নিজের সিদ্ধান্ত ওর জন্য কতটা ভালো হয়।খারাপ হলে তো ওর এই নির্লজ্জ, রোবট বোনটা আছেই।যার মধ্যে আবেগ,অনুভূতি, কষ্ট,দুঃখ কিচ্ছু নেই।”
আর বসতে পারলো না স্পর্শী।প্লেট হাতে দ্রুত চলে এলো রুমে।

হ্যালো,
পরশ স্পর্শীর গলা পেয়েই চমকালো।দ্রুত গতিতে শোয়া থেকে উঠে বসলো।ঘুমের মধ্যে নাম্বার টা খেয়াল করা হয়নি।ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,
“বলো।পৌছেছো কখন?বাড়িতে যাওয়ার পর কি খুব বেশি ঝামেলা হয়েছিলো?”
এড়িয়ে গেল স্পর্শী।পরশের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললো,
“নাহ,সব ঠিক আছে।বলছিলাম, আমি ভুল করে ট্রলি টা ফেলে এসেছিলাম।আপনি কি নিয়ে এসেছেন? নাকি এয়ারপোর্টেই আছে।”
হাসলো পরশ।হেয়ালি করে বললো,
“তুমি হলে হান্ড্রেড পারসেন্ট ফেলে রেখে আসতে।কিন্তু আমি ভুল করে সাথেই নিয়ে আসছি।তা তুমি কি নিতে আসবে?নাকি আমি আগাবো।”
অস্থির কন্ঠে স্পর্শী বললো,

“না না।কোনো দরকার নেই।আপাতত আমি বাইরে বের হলে ভাইয়া ফলো করতে পারে।তাছাড়াও আপনার সাথে আমাকে আশেপাশের কেউ দেখলেও বিষয়টাকে টেনে হিঁচড়ে অনেক বিদঘুটে বানাবে।কোনো দরকার নেই।”
“ওহ,আচ্ছা।
স্পর্শী কিছুক্ষণ নিরব রইলো।এরপর বললো,
” শুনছেন?”
ডাক শুনেই হৃৎপিন্ড থমকে গেল পরশের।শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল নিচের দিকে।কলিজা টা কেমন কেঁপে উঠলো।”আরেকবার বলো প্লিজ!এভাবেই ডাকো।”খুব ইচ্ছে হলো কথাটা স্পর্শীকে বলতে। কিন্তু কিছু একটা বাঁধা দিচ্ছিলো প্রবল ভাবে।নিজেকে সামলে শ্বাসরুদ্ধ কন্ঠে বললো,
“শুনছি।তুমি বলো।”

“আসলে আমি তো ঢাকায় ছিলাম এক্সাম দেওয়ার জন্য।হুট করে আর্শির লাপাত্তা হওয়ার খবর পেয়ে ঘাবড়ে গেছিলাম।আমি বলতে চাইছি তাড়াহু
করে আসছিলাম বিধায় বেশি জামা-কাপড় আনতে পারি নি।আমার লাগেজ টা খুব প্রয়োজন ছিলো।আপনি কি রাতে একটু আসবেন?বেশিক্ষণ না ব্যাস এগারোটার দিকে আমাদের বাড়ির পেছনের সাইডে আসলেই আমি ওখান থেকে ব্যাগ টা নিয়ে যাবো।দেয়ালের বাইরে দাঁড়ালেই হবে।শুধু একটা ফোন দিয়ে আসবেন।আসলে আমি চাইছি না ব্যক্তিগত ঝামেলা গুলো রাজনৈতিক ভাবে সমাধান করতে।এমনিতেই পরিস্থিতি খারাপ।সবাই আপনাকে নিয়ে আমায় সন্দেহ করছে।আমি চাইছি না এই ভুল সন্দেহ টা আর গাঢ় হোক।”
পরশ যেন এমন কিছু আশা করে নি।তার হয়তো নতুন কিছু শোনার ইচ্ছে হয়েছিলো।আশাহতের মতো বললো,
“ওহ,রাখছি।বায়।”

একধ্যানে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো স্পর্শী।পরশ কেটে দিয়েছে ফোন।নিশ্চয়ই সে নারাজ হয়েছে।হয়তো আসবে না।দরজায় খুট খুট আওয়াজ শুনতেই বিছানা থেকে নামলো।দরজা খুলতেই দেখলো মা দাঁড়িয়ে।
“ভেতরে আসো।”
বলে পুনরায় বিছানায় উঠলো স্পর্শী।পিপাসা গম্ভীর চোখে মুখে মেয়ের পাশে বসলো।মেয়ের এক হাত নিজের দু হাতের মুঠোয় নিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
“আমি ছোটবেলা থেকে তোকে স্বাধীনভাবে বড় করেছি।সকল বিপদ -আপদ, সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় বিষয় তোর হাতেই ছেড়ে দিয়েছি।এমনকি আমি যতটা স্বাধীনতা তোকে দিয়েছি তার গন্ডির বাইরে বের হয়েও তুই চলেফেরা করছিস।
থেমে,

স্পর্শী,আমি তো তোর মা।আমাকে সত্যিটা বল।পরশ শিকদারের সাথে কি তোর কোনো সম্পর্ক আছে?না হলে ওইভাবে জুতা হাতে নিয়া কেন কোনো ছেলে হাঁটবে?আমাকে বল, ভয় পাস না।”
বিরক্তিকর শব্দ উচ্চারণ করলো স্পর্শী।বললো,
“উফফফ! মা তুমিও।আমি বললাম তো ওই লোকের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নাই।আমরা একসাথেই আর্শিকে খুঁজছিলাম।কোন কুক্ষনে যে লোকটা আমার জুতা হাতে নিয়েছে কে জানে?শোনো?আমার যদি ওই লোকের সাথে কোনো সম্পর্কই থাকে তাহলে এতো লুকোচুরি করার কি আছে?আমি তোমাদের সবার সামনে দিয়ে ওর হাত ধরে চলে গেলেও কে বাঁধা দেবে আমায়?
শুনলো পিপাসা।পুনরায় শান্ত কন্ঠে বললো,

” তোর বাবা তোর বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।তোর বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলছে শুনলাম।আমি আবারো বলছি ভেবে দেখ।উনি যখন বিয়ের নাম উঠাইছে তখন বিয়ে দিয়েই ছাড়বে।”
বিরক্ত হলো স্পর্শী। খামখেয়ালি করে বললো,
“তো?আমি কি করবো?”
অবাক হলো পিপাসা।বললো,
“কি করবি মানে?তাহলে কি তুই বিয়ে করবি?”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৩৭

“আশ্চর্য! তো বিয়ে করবোনা আমি?যথেষ্ট বয়স হয়েছে আমার।এমন না যে আমি অন্যকারো সাথে প্রেম করি।আর নাতো কারোর প্রতি পিছুটান আছে।এখন আব্বু যদি আমার বিয়ে দিতে চায় তাহলে অমত কেন করবো?ছেলে দেখে পছন্দ হলে,ভালো লাগলে বিয়ে করে নিবো।এতে অমত করার কি আছে?আমার যদি কাউকে পছন্দই থাকতো তাহলে আমি আব্বুকেই সরাসরি বলতাম,” ওকে ভালো লেগেছে, ওকে বিয়ে করবো।”এখন এমন কেউ নাই আমার।তাই দ্বিমত করার প্রশ্নই আসে না।আব্বুর দেখানো ছেলে পছন্দ হলে বিয়ে করে নিবো। এটাই ফাইনাল।তুমি শুধু শুধু এতো টেনশন করো না।”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৩৮