শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১৪
সুমাইয়া সুলতানা
ভোরের সময় প্রকৃতি দেখা খুব মনোমুগ্ধকর একটি দৃশ্য। ভোরের আবহাওয়া শরীর, মন উভয়ের জন্যই ভালো। রোদ্দুরের চোরাবালি যেমন চিকচিক করে? ঠিক তেমনি সকালের সূর্যের থেকে আসা কিরণ গাছের পাতার উপর পড়লে সেটার ঝলকানির দেখা মেলে। মোমের কাছে ভোরের আলো চমৎকার লাগে। গ্রামে থাকতে ভোরে ঘুম থেকে ওঠে বান্ধুবীদের সাথে নদীর পাড় চলে যেতো। নদীর পানির মধ্যে সূর্যের রশ্মি পড়লে শান্ত নদীর পানি গুলে চিকচিক করতো। সেই সময় আকাশে ঝাঁক বেঁধে এক দল পাখি উড়ে যেতো।
নদীর পাড়ের ছোট ছোট ঘাস ফুল গুলো সূর্যের আলোতে যেন হেসে উঠতো। মোম এসবকিছু তৃপ্তির সাথে অনুভব করতো। কতদিন হয়ে গেল মোম এসব কিছুই দেখতে পারে না। বাবা-মা, মুনিয়ার কথা খুব মনে পড়ছে। আচ্ছা, মোম যদি মেয়ে না হয়ে ছেলে হতো তাহলে নিশ্চই বাবা-মা’র কাছে থাকতে পারতো? কেউ তাকে সম্পর্কের অযুহাত দেখিয়ে পরিবার থেকে দূরে নিয়ে আসতে পারতো না। কিন্তু সেটা কি আজও সম্ভব? মেয়ে হয়ে যখন জন্ম নিয়েছে, আজ না হোক কাল পরের বাড়ির বউ হয়ে তো যেতেই হতো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কালের নিয়ম এত নিষ্ঠুর কেন? কেন মেয়েরা ছেলেদের মতো বিয়ের পরও বাবা-মা’র কাছে থাকতে পারে না? থাকতে পারলে আজ মোমের এত কষ্ট লাগতো না। বাড়ির জন্য মন উতলা হতো না। ড্রয়িংরুমের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে গ্রিলের উপর দুই হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে কতশত ভাবনায় বিভোর, মোম। চোখ বুঝে লম্বা শ্বাস নিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় বিষন্ন মনে বসে পড়ল। সম্মুখে টিভির থেকে কার্টুনের হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। মোম গালের উপর দুই হাত ঠেকিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে। এতদিন আগুনের ফ্ল্যাটে টিভি ছিলো না। কিন্তু মোমের একাকিত্বের জন্য গতকাল টিভি এনে দিয়েছে, আগুন। আগুন আনতে চায়নি। রাশেদের কথায় আনতে বাধ্য হয়েছে।
আজকে শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আগুন এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। মোম কফি বানিয়ে ফ্লাস্কে ভরে একটি মগ সহ রুমে রেখে এসেছে। আগুন কখন ঘুম থেকে ওঠবে ঠিক নেই। ততক্ষণে কফি ঠান্ডা হয়ে যেতে পারে। সেজন্য ফ্লাস্কে ভরে রেখেছে। এমনিতে তো আগুন সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠে। তবে আজকের দেরি হওয়ার কারণ বুঝতে পারলো না, মোম। আজকে মোমের সকালের জন্য নাস্তা তৈরী করতে হয়নি। একটা ছেলে এসে হোটেলের তৈরী নাস্তা দিয়ে গিয়েছে। মোম খায়নি। গাল ফুলিয়ে বসে আছে। ভালো লাগছে না। আরো কিছুক্ষণ পর কফি হাতে ড্রয়িংরুমে আসলো, আগুন। মোম’কে দেখে ভ্রু কুঁচকে তার নিকট এগিয়ে গেল। মোম, আগুনকে একবার দেখে পুনরায় টিভি দেখায় মনোযোগ দিল। আগুন গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
” চুপচাপ বসে আছো কেন? মন খারাপ? ”
মোম ঠোঁট উল্টে বলল,
” আমি বাড়ি যেতে চাই। কতদিন হলো বাবা-মা কে দেখি না। ”
আগুন কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,
” সেটা এখন সম্ভব না। ”
” আমি যাবো’ই। ”
আগুন চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রাশভারী কন্ঠে জবাব দিল,
” ত্যাড়ামি করছো? ”
মোম দমে গেল। গাল ফুলিয়ে মিনমিন করে বলল,
” এমন করছেন কেন? একবার দেখো করেই চলে আসবো। থাকার জন্য বায়না করবো না। সত্যি। ”
” আমার সময় নেই। তাছাড়া, কলেজ থেকে ছুটি পাবো না। ”
কথার প্রেক্ষিতে আর কোনো ফিরতি জবাব এলো না। মোম চুপ করে আছে। মাথাটা নিচু করে নিল। আগুন নিজেই বলল,
” ছুটি পেলে নিয়ে যাবো। এখন এটা নিয়ে শুধু শুধু মন খারাপ করো না। ময়ূরী আসছে বাসায়। ”
মোম চকিতে তাকাল। চেঁচিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” ময়ূরী আপু, আসছে মানে? ”
আগুনের মেজাজ খারাপ হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” এভাবে চ্যাঁচাচ্ছো কেন? আর আসছে মানে কি! হ্যাঁ? তুমি কি চাওনা তারা আসুক? ওকে, আমি তাদের আসতে নিষেধ করে দিচ্ছি। ”
মোম ছটফট কন্ঠে বলল,
” না না, নিষেধ কেন করবেন? ময়ূরী আপু আসবে আমি তো ভীষণ খুশি। আপু একাই আসবে আর কেউ আসবে না? ”
কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে আগুন বলল,
” মনে হয় বাবা-মা, আয়মান সহ সবাই আসবে। ময়ূরী ফোন করে বলল আজকে এ বাসায় আসছে। ”
” সবাই আসলে খুব ভালো হবে। কত্ত মজা হবে। ওনারা যেহেতু সবাই আসছে, আপনি বরং কিছু বাজার নিয়ে আসুন। ঘরে যথেষ্ট বাজার আছে। তবুও আপনি আরো কিছু নিয়ে আসুন। ”
” তোমাকে বলতে হবে না। ময়ূরীর সাথে কথা বলার পরপর’ই আমি দারোয়ান কাকা কে ফোন করে বলে দিয়েছি। ”
মোম হেসে বলল,
” ধন্যবাদ, মাস্টার মশাই। ”
আগুন ভ্রু কুঁচকে চওড়া গলায় বলল,
” ধন্যবাদ কেন? ”
মোম চনমনে কন্ঠে বলে উঠলো,
” এই যে মন ভালো করার মতো একটা খবর শোনালেন। ”
” শোন, সামনে একটা ইভেন্ট আসছে। আমাদের কলেজ থেকে গেট টুগেদারের আয়োজন করা হবে। তোমাকেও নিয়ে যাবো। ”
” জ্বি, ঠিক আছে। ”
আগুন উঠে দাঁড়াল। যেতে যেতে শান্ত কন্ঠে বলল,
” মাস্টার মশাই, ডাকটা খারাপ না। চাইলে তুমি আমাকে এই নামে সম্বোধন করতে পারো। তোমার মিষ্টি কন্ঠে ডাক’টা শুনতে বেশ ভালোই লেগেছে। ”
সত্যি সত্যি আগুনের ফ্ল্যাটে রাশেদ, মিনা, ময়ূরী, আয়মান এসে হাজির। আসার সময় মোমের জন্য মিনা নিজ হাতে পাকোড়া বানিয়ে এনেছেন। মিনা জানেন, মোম পাকোড়া খেতে কতটা ভালোবাসে। মোমের তো খুশির অন্ত নেই। এতক্ষণ মন খারাপ থাকলেও শ্বশুর বাড়ির লোকদের দেখে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। সেলিনা’কে নিয়ে আসতে বললে, মিনা জানালেন সে বাড়িতে গিয়েছে। মিনা এসে রেস্টের সময় পাননি। রান্নার জন্য তোরজোড় শুরু করে দিয়েছেন। মোমের কাছে বাসাটা এতদিন মরা মরা লাগছিল। আজ যেন বাসাটা সতেজতা ফিরে পেল। হয়তো আপনজনদের আগমনে। মোম তোতোপাখির মতো রাজ্যের সকল কথা জুড়ে দিয়েছে। মিনা মনোযোগ দিয়ে তার সব কথা শুনছেন। তার কথার মধ্যে আগুনের নামে অভিযোগ বেশি। আগুন তাকে কথায় কথায় ধমক দেয়, হুটহাট মেজাজ দেখায়, রাগ দেখায়, এটা করবে না, সেটা করবে না, ওখানে যাবে না, সেখানে যাবে না আরো কত কি। মোমের বিচারে মিনা ঠোঁট টিপে হাসেন। আর ময়ূরী তো ময়ূরীই, এসব কথার রেশ ধরে মোমকে লজ্জা দিচ্ছে। অগত্যা মোম আর কথা বাড়াল না। চুপ হয়ে যায়। মিনা বললেন,
” মোম, তোমার শ্বশুরকে চায়ের কাপ টা দিয়ে আসো। আর এই পাকোড়া গুলো আয়মানকে দিয়ো। ছেলেটা সকালে কিছু খায়নি। ”
” জ্বি, যাচ্ছি। ”
রাশেদ, আয়মান যে রুমে থাকতো সে রুমে রেস্ট নিচ্ছেন। মোম গিয়ে দরজায় নক করে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি চাইলো। মোম’কে দেখে রাশেদের অধর কোণে হাসি ফুঁটে উঠে। হাত দিয়ে ইশারা করে কাছে যেতে বলেন। মোম ছোট ছোট কদম ফেলে এগিয়ে যায়। রাশেদ হাসি মুখে বললেন,
” বসো, মা। ”
মোম রাশের পাশে বসলো। এক হাত উঠিয়ে মোমের মাথায় রাখলেন। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বললেন,
” অনুমতি চাওয়ার কি আছে? বাবা’র রুমে মেয়ে আসবে তাতে অনুমতি নিতে হয় বুঝি? দেখো না, ময়ূরী বিনা অনুমতিতে আমার রুমে এসে পড়ে। তুমিও তো আমার আরেক মেয়ে, তাই না? আমি তো তোমাকে আমার মেয়েই মনে করি। কিন্তু তুমি কি আমাকে আজো বাবা মনে করো? ”
” ছিঃ! এভাবে বলছেন কেন, বাবা? আমি আপনাকে বাবা’ই মনে করি। তবে ছোট বেলা থেকেই মা শিখিয়েছে অনুমতি ছাড়া কারো রুমে যেতে নেই। ”
রাশেদ হেসে ফেললেন। চা’য়ের কাপ টা হাতে নিয়ে বললেন,
” তুমি আমার ঘরের লক্ষী বুঝলে? মানুষ চিনতে আমি ভুল করি না। তা মা, এখানে থাকতে তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? আগুন তোমাকে কিছু বললে, সরাসরি আমাকে জানাবে। আমি ওর ব্যবস্থা করবো। ”
” না বাবা, আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। আপনার ছেলেও তেমন কিছু বলে না। ”
” না বললেই ভালো। ”
হঠাৎ রাশেদের নজর পড়ল মোমের হাতে। ক্ষতস্থান ভালো হলেও কব্জিতে ফোসকা দুটোর দাগ এখনো আছে। রাশেদ হাতটা ধরে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠলেন,
” এই তোমার হাতে কি হয়েছে? ব্যথা পেলে কিভাবে? ”
” আপনি উত্তেজিত হবেন না। গরম তাওয়ায় হাত লেগে এরকম হয়ে গিয়েছে। আমি এখন ঠিক আছি।”
” আগুন তোমাকে কাজ করতে কেন দিয়েছে? ”
” উনি কাজ করতে নিষেধ করেছিলেন। আমি নিজেই করেছি। ওনার কোনো দোষ নেই। বাবা আমি এখন আসছি। আয়মান ভাইয়াকে পাকোড়া গুলো দিতে হবে। ”
” আচ্ছা। যাও। ”
আয়মান ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে। পা দুটো টি টেবিলের উপর রেখে নাচাচ্ছে। ঠোঁট দুটো চোখা করে বাঁশি বাজাচ্ছে। টিভিতে রোমান্টিক হিন্দি গান চলছে। আয়মানও তাদের সাথে তাল মিলিয়ে ঠোঁট নেড়ে গুনগুন করে গাইছে। টিভিতে তখন কিসিং সিন চলছিল। সেই সময় ড্রয়িংরুমে মোমের আগমন ঘটলো। মোম হাসি মুখে আয়মানের দিকে পাকোড়ার ছোট প্লেট’টা এগিয়ে দিয়ে টিভির দিকে নজর পড়তেই চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল। আয়মান রিমোট নিয়ে দ্রুত টিভি অফ করে দিল। মেকি হেসে বলল,
” কিছু বলবে ভাবি? ”
” আপনার জন্য মা এগুলো পাঠিয়েছেন। ”
” দাও। ”
মোম ড্রয়িংরুম থেকে চলে আসার সময়, আয়মান পেছন থেকে ডেকে উঠে,
” ভাবি তুমি কি কিছু দেখেছ? ”
” কি দেখার কথা বলছেন, ভাইয়া? ”
” তখন টিভিতে কিছু দেখেছ কি? ”
মোম থমথমে খায়। আমতা আমতা করে বলল,
” জ্বি, না। ”
আয়মান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। পাকোড়া হাতে তুলে নিয়ে এক কামড় দিয়ে খেতে খেতে চনমনে কন্ঠে বলল,
” না দেখলেই ভালে। অবশ্য দেখলে আরও ভালো। ভাইয়ার জন্য সবকিছু সুবিধা হবে। ”
” জ্বি? ”
” কিছু না। না বুঝে থাকলে ব্রো বুঝিয়ে দিবে। টেনশন করো না। ”
মোম সেখান থেকে চলে আসে। আয়মানের কথা ওর মাথায় ঢুকলো না। আয়মান রিমোট দিয়ে পুনরায় টিভি অন করলো। ততক্ষণে চলমান হিন্দি গান’টা শেষ হয়ে গিয়েছে। এ নিয়ে আয়মানের আফসোসের শেষ নেই। কে বলে ছিল এখন পাকোড়া নিয়ে আসতে? আয়মান বলেছিল? বলে নিতো। তাহলে কেন আসলো? আসলো তো আসলো, একেবারে কিসিং সিনে আসতে হলো? আশ্চর্য! দেশে কি মানবতা বলতে কিছু নেই? নিষ্পাপ একটা বাচ্চা কে এভাবে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয়? কষ্টে ভরা মন নিয়ে আয়মান টিভির চ্যানেল পাল্টাচ্ছে। যদি আবার কোনো রোমান্টিক গান চোখে পড়ে সেই আসায়।
দুপুরে সবাই মিলে এক সাথে খেতে বসেছে। আগুনের ফ্ল্যাটের ডাইনিং টেবিলটা বেশ ভালোই বড়ো। ছয়জনের জন্য পারফেক্ট। আগুন ভীষণ তৃপ্তি করে খাচ্ছে। মায়ের হাতের রান্না তার বরাবরই পছন্দের। রাশেদ আাসার পর আগুনের সাথে তেমন কথা বলেননি। যতটুকু বলেছেন সবই মোমের ব্যাপারে। তবে ছেলের প্রতি তিনি খুশি। মোম কোনো অভিযোগ করেনি। উল্টো আগুন যে কতটা যত্নশীল সেটা জানিয়েছে। যত্নশীলের কথাটা অবশ্য মিনার থেকে জানতে পেরেছেন। তার মানে আগুন, মোম’কে ভালো রাখার চেষ্টা করছে। বিষয়টিতে তিনি চরম আপ্লূত। খাওয়া শেষ করে রাশেদ রুমে চলে গেলেন। মিনা সবকিছু গুছিয়ে তিনিও চলে গেলেন।
ময়ূরী, মোমের সাথে আগুনের রুমে আসলো। বসে বসে গল্পগুজব করছে। আগুন, আয়মান দুজনে ড্রয়িংরুমে বসা। মোটা একটা বই নিয়ে আগুন সোফায় বসলো। মনোযোগ দিয়ে একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টে কিছু খুঁজছে। টিভিতে দুপুরের নিউজ চলছে। আয়মানের রাগ হচ্ছে। খাওয়ার পর কেউ নিউজ দেখে? কোথায় ভালো দেখে একটা রোমান্টিক ইংলিশ মুভি দেখবে। সেটা থেকে আইডিয়া নিয়ে বউয়ের সাথে রোমাঞ্চ করবে। তা না করে খবর দেখছে! এরকম নিরামিষ মার্কা জামাই হলে, বউ চার দিন ও টিকবে না। হুম! কিন্তু আয়মান এমনটা কখনোই হতে দিবে না। এমনিতেই বউ ছাড়া এতিম হয়ে আছে। বউকে কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দিবে না। সারাক্ষণ আদরের উপর রাখবে। এত আদর করবে যেন, পাশের বাসার আন্টিরাও ওর বউকে দেখে হিংসা করবে। আর বলবে, ইসস! আমার স্বামী যদি আয়মানের মতো হতো?
” ব্রো, একটা কথা বলার ছিলো? ”
আগুন বইয়ের পাতায় নজর রেখেই জবাব দিল,
” বল। ”
” বলছিলাম কি, তুমি যদি আমাকে হেল্প করো। তাহলে আমিও তেমাকে হেল্প করবো। ”
ঠাস করে বই বন্ধ করে ভ্রু কুঁচকে আয়মানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। ভাইয়ের চাউনি দেখে আয়মান ভরকে গেল। ব্যগ্র কন্ঠে বলল,
” এভাবে তাকিও না। আামার লজ্জা লাগে। এরকম চাউনিতে ভাবি’কে দেখো। আমাকে না। ”
আগুন চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” ফাজলামি বাদ দিয়ে যা বলার সরাসরি বল। মেজাজ খারাপ করবি না। ”
আয়মান শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলে উঠলো,
” রেগে যাচ্ছো কেন? একদম ধমকাবে না। ধমক দিলে বলবো না। ”
” তোর এসব ফালতু কথা শোনার সময় নেই। ”
আয়মান বাঁকা হেসে জবাব দিল,
” শুনবে না ভালো কথা। দেখো, পড়ে আবার আফসোস করো না। ”
আয়মানের কথায় আগুন সিরিয়াস হয়ে তার দিকে তাকায়। রাশভারী কন্ঠে জানতে চাইল,
” কি হয়েছে, বল তো? এনি থিং সিরিয়াস? ”
” নাথিং সিরিয়াস। তবে আবার সিরিয়াস ও। ”
” হেয়ালি না করে বলবি এগজ্যাক্টলী কি বলতে চাস? ”
” এই মাসের আট তারিখে ভাবির জন্মদিন। ”
চমকে যায় আগুন। মোমের জন্মদিন, আর ও জানে না? আয়মান না বললে, হয়তো জানতেও পারতো না। আর না জানার চেষ্টা করতো।
” তুই কিভাবে জানলি? ”
” আসার সময় মা, ময়ূরীকে বলে ছিল। তখন শুনেছিলাম। কি সব প্ল্যান আছে নাকি। ”
” ওহ। ”
ক্ষেপে উঠল আয়মান। চাপা রাগ দেখিয়ে বলল,
” ওহ, মানে? তুই ভাবিকে সারপ্রাইজ দিবি না? ”
আগুন ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
” সারপ্রাইজ দেওয়ার কি আছে? যাগগে, এবার বল তোর কি হেল্প চাই? ”
” সময় আসুক, তখন বলবো। এতটুকু বলতে পারি, মেয়ে ঘটিত ব্যাপার। ”
আগুন চোখ রাঙিয়ে তাকায়। কিছু কড়া কথা শোনাতে চেয়েও শোনালো না। আগুনের মস্তিষ্কের ভেতর এখন মোমের জন্মদিনের তারিখ ঘুরছে।
বিকেলে সবাই চলে গিয়েছে, আগুনের ফ্ল্যাট থেকে। মোম থাকতে বলে ছিল। মিনা না করে দিয়েছেন। মানুষ ছয়জন। রুম দুই’টা। একটা তে আগুন, মোম থাকলে অন্য টিতে মিনা, রাশেদ। বাকি রইল ড্রয়িংরুম। সেখানে ময়ূরী, আয়মান এডজাস্ট করে কিভাবে থাকবে? সত্যি বলতে মিনার থাকতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু রাশেদের কথায় আর কিছু বলতে পারেননি।
অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত। আজ আকাশে চাঁদের দেখা নেই। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে আছে। বাইরে জোরে বাতাস বইছে। বারান্দার দরজা খোলা। সেখান থেকে শনশন করে বাতাস রুমের মধ্যে প্রবেশ করছে। মোম গুটিশুটি হয়ে পেটের উপর বালিশ রেখে বিছানায় বসে আছে। আগুন কিছু কাগজপত্র একটা ফাইলে গুছিয়ে রেখে বারান্দার দরজা আটকে বিছানায় এসে বসেছে। আগুনকে দেখে মোম নড়েচড়ে বসলো। আগুন ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” কিছু বলবে? ”
মোম যেন আগুনের কথার অপেক্ষাতেই ছিল। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,
” আজকে সময়টা অনেক ভালো কেটেছে। সবাই মিলে কত মজা হলো, বলুন? ”
” তুমি খুশি? ”
মোম অধরে হাসি বজায় রেখে উত্তর দেয়,
” খুব খুশি। ”
” কিন্তু আমি খুশি না। ”
মোমের হাসি মুছে গেল। মায়াভরা নয়নে চেয়ে শুধাল,
” কেন? ”
” আমি পাশে বসাতে তুমি দূরে সরে গিয়েছ কেন?”
মোম মুখ কালো করে বলল,
” দূরে কোথায় সরেছি? তখন তো এমনি আপনাকে জায়গা করে দিয়ে নড়েচড়ে বসলাম। ”
” আচ্ছা। তাহলে, এখন আরেকটু কাছে ঘেঁষে বসি? ”
মোম মাথা নেড়ে স্বায় জানায়। আগুন সত্যি সত্যি একদম মোমের শরীরের সাথে লেগে বসে পড়ল। আগুনের সংস্পর্শে মোমের শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। আগুন, মোমের তুলতুলে নরম একটা হাত নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় নিয়ে নিরেট স্বরে বলে উঠলো,
” মোম, মনে করো আমি তোমাকে কোনো সারপ্রাইজ দিলাম। তো তুমি এর বিনিময়ে আমাকে কি দিবে? ”
মোম গোমড়া মুখে চঞ্চল কন্ঠে বলল,
” আপনি সবসময় দেওয়া নেওয়ার কথা কেন বলেন? কিছু হলেই, আমি কি পাবো? আমাকে কি দিবে? বিনিময় ছাড়া কি আপনি কিছু বুঝেন না?”
আগুনের মেজাজ খারাপ হলো। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” এটা সবার ক্ষেত্রে না। এই বিনিময়ের ব্যাপারটা শুধু তেমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তোমাকে আমি কোনো কিছুই ফ্রী তে দিবো না। তোমাকে কোনো জিনিস দিলে, সেটার বিনিময়ে তোমাকেও আমাকে অন্য কিছু দিতে হবে। ”
মোম অবুঝের মতো প্রশ্ন করে,
” কি দিবো? ”
আগুন ফট করে নিজের হাতের মুঠোয় থাকা মোমের হাতটা উঠিয়ে, হাতের উল্টো পিঠে ঠোঁট ছুয়ে দেয়। মোম হকচকিয়ে যায়। আগুন তার বলিষ্ঠ এক হাত বাড়িয়ে মোমের মসৃণ কোমর চেপে নিজের আরও কাছে নিয়ে আসে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে নেশাক্ত গলায় বলল,
শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১৩
” এমন কিছু যেটা তেমার আমার মধ্যকার সম্পর্কের সকল দূরত্ব ঘুচিয়ে দিবে। দুজনের তপ্ত নিঃশ্বাস খুব কাছ থেকে শোনা যাবে। আমি চাইবো তুমি নিজে থেকে বোঝো, জানো। কিন্তু আমি কখনো তোমাকে মুখ ফুটে তা বলতে পারবো না। তবে সেটা তোমাকে অনুভব করানোর চেষ্টা করতে পারবো। হৃদয় নিঙড়ানো মনের গহীনের প্রেমময় উষ্ণ উত্তাপে ঝলসে দিতে পারবো। ”