ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২২
Arishan Nur
সমুদ্র যখন আয়নার বাসায় পৌঁছে তখন ওলরেডি বারোটার বেশি৷ কলিং বেল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়না গিয়ে ছু’টে গেইট খুলে দেয়। ওইসময় আয়নার অবস্থাও করুণ। সে ভীষণ অস্থির হচ্ছিলো। চোখ ভেজা। এমতাবস্থায় সমুদ্রকে দেখামাত্র ভীষণ শান্তি বিরাজ করে মনে। এতোদিনের মান-অভিমান, রাগ সবটা একপাশে রেখে, কিংবা প্রায় ভুলে গিয়ে, সমুদ্রকে জড়িয়ে ধরে সশব্দে ডুকরে কেঁদে উঠে।
সমুদ্র বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেই ওকে আলতো করে জড়িয়ে নেয়। ওর খুব অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। কেমন জানি হুহু করে উঠে বুকটা। সে নিজেকে সামলে নেয়। এরপর শুধু বললো, ” আছি-ই তো।”
আর কোনো বাক্য কিংবা শব্দ উচ্চারণ করে না। আয়নার বাহু ধরে নিজের থেকে একটু দূরে সরিয়ে মুচকি হেসে সামনে পা বাড়ায়। ওই মুচকি হাসি যেন জানান দিচ্ছিলো আমার উপর ভরসা রেখো৷ আমি আছি তো বাবা৷
এরপর তোফাজ্জল হোসেনের পাশে এসে দাঁড়ালো। ওনাকে পরখ করে দেখে নেয়। অবস্থা ভালো না। হাসপাতালে নিলে ভালো হয়। সবটা চিন্তা করে, তারপর বলে উঠে, ” দাদাভাই চলেন একটু হাসপাতাল যাই।”
তোফাজ্জল সাহেব সামান্য ভয় পেয়ে উঠে বলে, ” ডাক্তার সাহেব, হাসপাতালে যেতে হবে কেন? আমি একদম ঠিক আছি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
–” হাসপাতালে একটু ঘুরে আসেন। ডাক্তার দেখায় আনি। আসেন। ঠিক আছেন সেটা তো জানি। আরোও ঠিক থাকার জন্য ডাক্তার দেখানো লাগবে।”
তোফাজ্জল হোসেনের কষ্ট হচ্ছিলো বেশ। কিন্তু বাড়িতে কোনো পুরুষ নেই আজ। দু’টো ছোট বয়সী নাতনি নিয়ে এতো রাতে বের হওয়া বিপদ জন্য রাজী হচ্ছিলেন না। কিন্তু নাতনী জামাই ডাক্তার। নিজে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। উনি খুব খুশি হন। এই যুগের ছেলে-মেয়ে গুলো এতো ভালো!
সমুদ্র ওনার বাহু ধরে দাঁড় করিয়ে দেয় এবং বললো, ” আমি আর আয়না যাই ওনার সাথে। আলিয়া আপু, তুমি তোমার দাদীর সাথে বাসায় থাকো।”
আলিয়া উত্তর দেয় না কোনো, নীরবে সায় দিলো। আয়নাকে সঙ্গে নিয়ে আগে যেই হাসপাতালে কাজ করতো, সেদিকে ছু’টে। নামীদামী প্রাইভেট হাসপাতাল। চব্বিশ ঘন্টাই খোলা। অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি আর সুবিধা দেওয়া হয় রোগীদের, তবে প্রাইভেট হওয়ায় খরচ অনেক বেশির অভিযোগ প্রায় উঠে আসে শিরোনামে। হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে নেওয়ার পর কয়েকটা টেস্ট করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুসের সমস্যা দেখা গেলো। ফুসফুসে পানি জমেছে। অক্সিজেন লাগতে পারে, রিক্স হতে পারে ভেবে ভর্তি করিয়ে দেয়। সবকিছু সমুদ্রই করে। আয়না শুধু দাঁড়িয়ে ছিলো৷ কেবিনে শিফট করার পর, উনাকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়। দুর্বলতার কারণে তোফাজ্জল সাহেব ঘুমিয়ে পরে।
সমুদ্র তখন আয়নার পাশে সোফা বসে বলে, ” তুমি বাসায় যাবে?”
–” আমি বাসায় গেলে দাদার সঙ্গে থাকবে কে? একা ফেলে যাবো নাকি!”
–” না, না। আমি থাকবো তো। তুমি যাও৷ তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কান্নাকাটি করে কী হাল করেছো।”
–” আমি যাব না৷”
–” আচ্ছা তাহলে সোফায় শুয়ে রেস্ট নেও কিছুক্ষণ।”
যদিও বা ডাক্তার বলেছে চিন্তার কারন নেই। তারপরও আয়নার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সে সোফায় গুটিসুটি মেরে শু’য়ে পরে। ক্লান্ত থাকায় চোখ লেগে আসে তার। কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে তাকালো কোনোকিছুর শব্দে। তৎক্ষনাৎ উঠে বসতেই চোখের সামনে সমুদ্রকে দেখলো। দাদাভাইকে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে কিসব করছে বা বলছে। আয়না অস্থির পায়ে ছু’টে যায়।
সমুদ্র তাকে দেখামাত্র বলে উঠে, ” উঠে গেলে কেন?”
–” দাদাভাইয়ের কী হয়েছে সমুদ্র? ”
–” নিশ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিলো। এখন ঠিক আছে।”
আয়নার এতোটুকুতেই ওভার প্যানিক এটাক শুরু হলো। আরেকদফা কান্না শুরু করে দেয়। তখনই নার্স আসলো। এসেই বললো, ” পেশেন্টের কী অবস্থা এখন ভাইয়া?”
–” বেটার। আরিফা আপা আপনি যান। আর আসা লাগবে না। আমি দেখবো বাকিটা।”
–” না। সমস্যা নাই। ডিউটিতে আছি। আমাকে ডাকবেন। ”
এরপর আয়নার দিকে তাকায়, তারপর বলে, ” ভাবী জেগে গেছেন। ভাইয়া বলছিলো কাঁদতে কাঁদতে আপনিই নাকি কালকে রোগী হয়ে ভর্তি হবেন।”
তারপর অমায়িক একগাল হেসে দেয়৷ সমুদ্র অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিয়ে তোফাজ্জল সাহেবকে বেডে শু’ইয়ে দিয়ে বলে, ” কেমন লাগছে এখন?”
–” একটু আরাম পাইলাম ডাক্তার সাহেব। ”
–” আচ্ছা। ”
এই হাসপাতালের ডিউটিরত নার্স আরিফা আপা এসে আরো কিছু চেক করলো। প্রেশারও মাপলো৷ আগে যখন সমুদ্র ডাক্তার হিসেবে কাজ করত আরিফা আপার সঙ্গে খাতির ছিল বেশি। এখন চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। তবুও আপা কিছুক্ষণ পরপর এসে দেখে যাচ্ছেন৷
তোফাজ্জল সাহেবকে মনমরা আর খানিক ভয়ার্ত অবস্থায় দেখে নার্স বলে উঠে, ” বাবা, দ্রুত সুস্থ হতে হবে। শক্ত হন। ভয় পাওয়ার কিছু নাই। সুস্থ হয়ে কালকেই হাঁটাহাঁটি করবেন।”
তোফাজ্জল সাহেব ভারাক্রান্ত মনে বলে, ” বয়স হয়ে গেছে। আর কতোক্ষণই বা বাঁচবো। এক জীবনে সব দেখা শেষ, মা। নাতনিও দেখলাম, নাতনিজামাইকেও দেখলাম।”
নার্স বলে উঠে, ” নাতনির বাচ্চা-কাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে যাবেন-আসবেন। কতো কাজ বাকি।”
সমুদ্র ওইসময় আয়নার পানে তাকালো। আয়না সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নেয়। সমুদ্র নার্সের কথায় হাল্কা হাসে৷ কিন্তু কিছু বলে না।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়নার দাদা গভীর ঘুমে তলিয়ে যান। তখন সমুদ্র ক্যান্টিন থেকে খাবার অর্ডার দেয়৷ খাবার আসলে জোর করে আয়নাকে বসিয়ে নিজে ওর পাশে বসে বলে, ” খেয়ে নাও। নাহলে কালকে তোমাকেও ভর্তি করাতে হবে৷”
–” খেতে ইচ্ছে করছে না৷”
সমুদ্র ওর কোনো বারণ শুনে না। ভাতের প্ল্যাটারটা তুলে নিয়ে ভাতের সঙ্গে তরকারি মাখিয়ে বলে, ” হা করো। খাইয়ে দিচ্ছি৷”
আয়না মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ও অপর হাত দিয়ে থুতনিতে রেখে তার দিকে মুখটা এগিয়ে এনে বলে, ” আমি সেকেন্ড কোনো পেশেন্ট হ্যান্ডেল করতে পারবো না। চুপচাপ খেয়ে নেও।”
শেষের কথায় ধমকের অভাস পায় আয়না৷ এরপর একপ্রকার জোর করে খাইয়ে দেয় ওকে।
সমুদ্র বলতে থাকে, ” রোগীর সঙ্গে যারা আসে, ওদের নিজের খাওয়া ঠিক রাখতে হয়। উলটা বেশি খাওয়া দরকার, এনার্জি বেশি লাগে৷ না খাইলে এনার্জি পাবে কই?”
–” তাহলে আপনি খাচ্ছেন না কেন?”
সমুদ্র হাল্কা হেসে উত্তর দেয়, ” আমার কথায় আমাকেই ফাসাও। ”
আয়না পুনরায় বলে, ” আপনি ও খান। নাহলে আমি আর খাবো না।”
সমুদ্র উপায় না পেয়ে, প্লেট থেকে এক লোকমা তুলে, নিজের মুখে নেয়। এরপর আয়নাকে আবার খাইয়ে দেয়। তারপর বলে উঠে, ” কোথায় যেন শুনেছি, জুটা খেলে ভালোবাসা বাড়ে।”
আয়না কাঠ গলায় বলে, ” আপনার ভালোবাসা বাড়বে না।”
–” তোমার সাথে ঝগড়া করাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো।”
আয়না উঠে যেতে ধরছিলো, সঙ্গে সঙ্গে হ্যাচকা টানে সমুদ্র ওকে বসিয়ে দিয়ে বলে উঠে, ” কপাল ভালো তোমার যে, আমার ধৈর্য্য শক্তি অসীম। ছোট থেকেই সবাই বলে আমার নাকি ধৈর্য্য অনেক। এখন বুঝতেছি তোমারে সামলানো লাগবে সারাজীবন এজন্য এতো ধৈর্য্য দিসে আল্লাহ তায়ালা।”
আয়নাকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না। মুখে এক লোকমা ভাত পুড়ে দেয়৷ এরপর থেমে থেমে বলে, ” আমাকে রোবট বলো! নিজে কী মেয়ে? মেয়ে, তোমার মনটা পুরোপুরি যেন ই-মন।”
আয়নার ততোক্ষণে খাওয়া শেষ। সে ভ্রু কুচকে বলে উঠে, ” ই-মন আবার কী?”
–” ইলেকট্রিক্যাল মন৷ তোমার মধ্যে আদৌ মায়া-দয়া আছে? থাকলে এতোক্ষণে আমাকে ক্ষমা করে দিতে৷ ইলেকট্রিক্যাল মন যার, তার মনে মোহাব্বত-ইশক থাকবে এটা আশা করাই তো ভুল৷ ইলেকট্রিক্যাল মনে থাকবে কিছু সার্কিট আর লাল-নীল তার, তাও আবার ছেঁড়া তার। এজন্য দয়া-মায়া কিচ্ছুটি নেই তোমার মধ্যে।”
আয়না ভ্রু কুচকে বসে রইলো। একটা মানুষ এতো আজাইরা কথা কীভাবে বলতে পারে? হতভম্ব হয়ে যায় সে। ইলেকট্রিক্যাল মন বলেও কিছু আছে জানা ছিলো না। তার মন কী আসলেই ইলেকট্রিক্যাল মন!
পরের দিন ইকো টেস্টে ধরা পরলো তোফাজ্জল হোসেনের হার্টে পানি জমেছে৷ সমুদ্র নিজে যেহেতু ভবিষ্যতে কার্ডিওলজি নিয়ে স্টাডি করার পরিকল্পনা করছে সে সুবাদে হাসপাতালের বড় বড় কার্ডিওলজিস্টদের সঙ্গে সখ্যতা আছে৷ তাছাড়াও এখানকার সবাই খুব ভালো, সার্পোটিভ৷ সমুদ্র একাই ডাক্তারদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলো দুপুরেই অটিতে নিতে। ফাহাদ সাহেব আসতে চাচ্ছেন।তবে ওনার আসতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে৷ সমুদ্র নিশ্চয়তা দিয়ে বলে সে যেহেতু আছে, অসুবিধা নেই। তবুও অটির আগ মুহূর্তে শায়লা চৌধুরী আসলেন৷ আব্বু-আম্মুও আসতে চাইছিলো। সমুদ্র মানা করেছে। বাবা নিজেও হার্টের পেশেন্ট। রিং পড়াতে হয়েছে। আরেক অটি পেশেন্ট দেখে এক্সট্রা টেনশন দেওয়ার মানে হয় না৷ এম্নিতেই আব্বু-আম্মু সরল, সাদাসিধা, নরম মনের। দুইজনের পরে ভয় পাবে। অতিরিক্ত চিন্তা করবে৷ আগে পরিবার নিয়ে এতো ভাবতো না। বিয়ের পর থেকে ফ্যামিলি নিয়ে অনেক ভাবা শুরু করেছে৷
ইন ফ্যাক্ট, আলিয়া ছোট এজন্য ওকেই আসতে দেয় নি। ওদের দাদীর নাকি অস্থিরতায় প্রেশার বেড়ে গেছে। দুইজনেই বাসায় আছে। এখানে এসে আরোও অসুস্থ হওয়ার মানে হয় না। তার উপর প্রাইভেট হসপিটালের কিছু নিয়ম আছে। পেশেন্টের সঙ্গে বড়জোর দুই-তিন জন এলাউ করে। রাতে মাত্র একজন পারবে পেশেন্টের সঙ্গে থাকতে।
সে গিয়ে শায়লা আন্টির সাথে কিছু কথা বললো। অটি করে সিসিইউ তে নেওয়া হয়। সেখানে কেউ এলাউ না। কাজেই সবাই যে যার বাসায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সমুদ্রের অফিস যেতে হবে। না গেলে হচ্ছে না। খুবই জরুরি কাজ আছে৷
তখন শায়লা আন্টি বলে, ” আমি আয়নাকে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি অফিসের কাজ সেরে নিজে বাসায় গিয়ে লম্বা ঘুম দিবে। কী ক্লান্ত লাগছে তোমাকে। বাসায় গিয়েই সোজা ঘুম দিবে। নাহলে আমি কিন্তু অনেক বকা দিবো। ”
সমুদ্র হাল্কা হাসলো। আয়না একবার সমুদ্রের দিকে তাকায় আসলেই গতকাল রাতে সে নিজে সোফায় ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু সমুদ্র চেয়ারেই বসে রাত কাটিয়ে দিয়েছে। আয়নার ভীষণ অনুতপ্তবোধ হলো। পুরা রাত তার ঘুমানো ঠিক হয় না। তার দাদা অসুস্থ। সে জেগে সেবা করবে। কিন্তু উলটা হলো সমুদ্রই রাত জাগলো। তবে, আয়না ক্লান্ত সুরে বলে, ” আমি একা যেতে পারবো বাসায়। সমস্যা হবে না।”
সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে বলে, ” না। না। একা যাওয়া যাবে না। তাহলে আমিই নামিয়ে দিয়ে অফিস যাই। লেইট হবে একটু। অসুবিধা নেই। ”
শায়লা চৌধুরী তখন আয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” তোমার স্বামী তোমাকে একা ছাড়বে না। ওকে আর চাপ দিও না। ওলরেডি ও ক্লান্ত। তারচেয়ে বরং আমার সঙ্গে আসো। আমি এমনিতেও তোমাদের বাসায় যাবো। দু’জন একসাথে যাই। আসো।”
আয়না সমুদ্রের দিকে একপল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে৷ ও তার উত্তরের অপেক্ষায় আছে। আয়না মানা করলে নিশ্চয়ই ওকে ড্রাইভ করে নিয়ে যাবে৷ ওকে আর কষ্ট দিতে চায় নাহ। তাই রাজী হয়ে যায়৷ যদিও একদম ইচ্ছা ছিলো না শায়লার সঙ্গে যাওয়ার। কিন্তু মহিলা তার বাসায় কেন যেতে চায়?
গাড়িতে উঠার সময় শায়লা আন্টি আয়নার সঙ্গে গাড়ির পেছনে বসে। ড্রাইভার ড্রাইভিং করছেন৷
শায়লা চৌধুরী বলে, ” তোমার দাদা ঠিক আছে। ওই বিষয় নিয়ে আর ভাবতে হবে না। আব্বুও সন্ধ্যার মধ্যে চলে আসবে।”
আয়না কিছু বলে না। এরপর হুট করেই শায়লা চৌধুরী ওর মাথায়, চুলে হাত বুলাতে থাকে। যা আয়নার তেমন একটা পছন্দ হলো না।
সে বলে উঠে, ” সমুদ্র তোমাকে নিয়ে বেশ কনসার্ণ দেখছি। তোমার স্বামী তোমার জন্য অনেক করেছে।”
–” হুম।”
–” স্বামীভাগ্য ভালো তোমার।”
আয়না জবাব দেয় না। খানিক পরে শায়লা চৌধুরীই বলে, ” জানো মেয়েদের জীবনে কোন দু’টি জিনিসে বেশি নজর লাগে? জানো কী?”
–” নাতো।”
–” স্বামীভাগ্য আর চুলে। স্বামী বেশি ভালোবাসলে, ঢোল পিটায় বেড়াবে না। আর চুল সুন্দর হলে প্রদর্শন করবে না। বুঝেছো? এ দু’টিতে নজর লাগে খুব তাড়াতাড়ি।”
শায়লা চৌধুরীর কথায় গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না সে। বাসায় এসে সে আরোও বিরক্ত হলো। শায়লা চৌধুরী এমন ব্যবহার করছেন যেন এটা তার বাসা। দাদীর প্রেশার বেড়েছে জন্য তেঁতুল কিনে এনে, তেঁতুলের শরবত বানিয়ে খাওয়ালেন। আলিয়ার নাকি মাথাব্যথা, ওকে কোথা থেকে একটা মাথাব্যথার বাম্প এনে দিলেন। এরপর রান্নাঘরে রান্না বসালেন। এসব আদিখ্যেতা দেখে বেশ আহত হয় আয়না। বাবা ঠিকই ওনাকে জানিয়েছে কখন ফিরবে কিন্তু তাকে বলেনি কিছু। এখন থেকে নিশ্চয়ই সব তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে জানিয়েই করবেন। অবশ্য তাদের জানিয়ে আজ পর্যন্ত কিছুই করেনি। শায়লা চৌধুরী রাতের রান্না আর সন্ধ্যার জন্য নাস্তা করলেন। ওদের ফুপা-ফুপু এসেছে। ওনারা আর আলিয়া খেয়ে নেয়৷ কিন্তু আয়না কিছুই মুখে দেয় না। ওনার সামনেই সশব্দে রুমের দরজা লাগিয়ে দেয় রুমের।
রাতে ফাহাদ সাহেব ফিরলেন। উনি নাকি এয়ারপোর্টে থেকেই সোজা হাসপাতালে যান৷ সমুদ্রের রেফারেন্সে সিসিইউতে অল্প সময়ের জন্য এলাউ করেছে। বাবা ভালো আছে দেখে এসেছেন। বাসায় এসেই রাতের খাবার খেয়ে নেন। শায়লা চৌধুরীকে নিজের বাসায় দেখে সামান্য হতভম্ব হলো। আয়ু কী কোনো সিনক্রিয়েট করেছে? বাসার পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে না। তার বোনের সঙ্গে বেশ সুন্দর মতো গল্প করছে শায়লা। সত্য কথা বলতে শায়লাকে এ’বাসায় দেখে সে ভড়কে গেছে৷ ও যেমন মহিলা, আসার তো কথা না এ’বাসায়। ভদ্রতা রক্ষার্থে এসেছে মনে হয়। সে ছোট করে দম ফেলে আয়নাকে ডাক দিলো। ও নাকি খায়নি দুপুরের পর থেকে।
আয়না রুম ছেড়ে বেরিয়ে এসে বাবার সামনে দাঁড়ায়।
ফাহাদ সাহেব বলে, ” তুমি রাতে খাও নি মা? আসো খেতে বসো। না খেয়ে থাকলে তোমার প্রেশার লো হয়ে যাবে।”
আয়না এতোক্ষণে মুখ খুলে। আসলে সে বাবা ছাড়া আর কারো উপর রাগ-জেদ দেখায় না। ইদানীং আরেকজনের উপর দেখাচ্ছে।
সে বলে উঠে, ” তোমার দ্বিতীয় স্ত্রীর হাতের রান্না আমি মুখেও দিবো না।!
–” এটা কেমন কথা?”
–” বাবা, আমাকে রাগাবে না একদম। উনি যাচ্ছে না কেন এখনো?”
–” যাবে একটু পর। তুমি খেতে আসো। বাসায় ফুপা-ফুপু আছে। আমি ঝামেলা চাই না।”
সে নিজে আয়নাকে খাবার বেড়ে দেয়৷ আয়না অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসে। বাসায় গত কয়েকদিন ধরে কোনো শান্তি নেই। একটার পর আরেকটা দুঃসংবাদ৷ খেতে বসে, তার খাওয়ার রুচি হয় না। প্লেটে খিচুড়ি নাড়াচাড়া করছে সে।
শায়লা চৌধুরী এসে বলে, ” তোমার ফোন বাজছিলো। তুমি তো ফোন টেবিলে রেখেই রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়েছো। তাই রিসিভ করলাম। তোমার ভার্সিটির ফ্রেন্ড রঙ্গন কল দিয়েছিলো। তোমার সাথে কথা বলতে চায়।”
আয়নার যেন নাকে-মুখে খাবার বাজে। সে কেশে উঠে। একটু পর শুরু হলো হিচকি। এক গ্লাস পানি খেয়েও হিচকি থামে না৷
শায়লা চৌধুরী বলে, ” মনে হয় কেউ তোমাকে মনে করছে।”
আয়না চকিতে উঠে। সে ফোন হাতে রুমে চলে যায়।
রাত দশটায় শায়লা নিজের বাসার উদ্দেশ্য বের হলো। ফাহাদের বাসায় থাকতে চাইলেও এটা এখন হচ্ছে না। আরোও পরে শিফট হবে সে। আজকে কেনো যেন আয়নার জন্য তার একটুখানি মায়া-ই হচ্ছিলো। সাধারণত আয়নাকে তার একদম পছন্দ না। ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে কিন্তু তেজ খুব। মনে পড়ে যায় তিনবছর আগের সেই ঘটনায়। তখন ও সবে এসএসসি দিয়ে কলেজে। পুচকি একটা মেয়ে। শায়লা ভাবেও নি এই মেয়ে এতো জেদী হতে পারে৷ ফাহাদের সঙ্গে বিয়ের ঘোষণা দেওয়ার পরপর হুট করে এক দুপুরে এই পুচকে মেয়ে তার বাসায় আসে। তাও কাউকে না জানিয়ে। একা একা।
ওইদিন বাসায় গেস্ট ছিলো। ওদের সামনেই সে কী তেজি গলায় চিৎকার-চেচামেচি। একটা পর্যায়ে আয়না তাকে বলেছিলো, সে নাকি ডাইনি। ওদের বাবাকে ফাসিয়েছে। ছেলেমানুষী নানা ধরনের কথা। সে এসব আমলে নিতো না৷ কিন্তু আয়না যখন বললো সে ডিভোর্সি, তার চরিত্র-ব্যবহার সবকিছুই নাকি বাজে। সে খুব বাজে মহিলা। তার পরিবার নাকি খারাপ। অন্য সবকিছু বললেও সহ্য করে মেনে নিত। কিন্তু তাকে দুশ্চরিত্রা ডিভোর্সি বলায় শায়লা ভীষণ আঘাত পায়, সেইসাথে আয়নার জন্য ক্ষোভ জন্ম নেয়৷ সে কীভাবে আয়নাকে বুঝাবে, ডিভোর্স কেবল নারীর চরিত্র খারাপ হলেই কার্যকর হয় না।
ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২১
স্বামীভাগ্য ভালো হতে হয়। যার স্বামী ভালো না, সে নারী যতোই সতী হোক, একদিন পরিনতি খারাপের দিকে যাবেই। ক্ষোভ আরোও বৃদ্ধি পায় যখন ফাহাদ মেয়ের কথা শুনে বিয়ের সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে। আয়নার উপর একপ্রকার রাগ-ঘৃণা কাজ করে তার। প্রতিশোধের আগুনে দ্বগ্ধ হয় সে।
এরপর অনেক পরে, প্রায় তিন বছর পর, ইচ্ছা করেই সমুদ্রের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেয়৷ ওর ও বোঝা উচিত নারী যতোই গুণী হোক না কেন, পুরুষ ভালো নাহলে ঘর টিকে না।