এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ২৮
তানিশা সুলতানা
মাঝ রাস্তায় হাঁটু মুরে বসে পড়ে অথৈ। দীর্ঘ দিন বাদে প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে দেখতেও ছুঁতে পারলো না। মায়াভরা মুখখানার পানে তাকিয়ে কলিজা ঠান্ডা করতে পারলো না। এর থেকে বেদনা দায়ক আর কি হতে পারে? কষ্টে বুক ফেঁটে কান্না পাচ্ছে। এতোক্ষণ ফুঁপিয়ে কাঁদলেও এবার চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। মানুষ বলে না “মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় কিন্তু অবহেলা নয়”
অথৈ এতোগুলো বছর পাগলের মতো খুঁজেছে তন্নিকে। পরিক্ষার মধ্যে আধঘন্টা দেরি করে হলে ঢুকেছে। এই আধঘন্টা গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতো তন্নিকে দেখবে বলে।
শহরের অলিতে-গলিতে খুঁজেছে। নামাজ শেষে বহুবার আল্লাহকে বলেছে একবার দেখা করিয়ে দিতে তন্নির সাথে।
বন্ধুর জন্য বন্ধু কি এতোটা পাগল কখনো হয়? অথৈ হয়েছে। প্রতি মুহুর্তে অথৈয়ের মনে হয়েছে “তন্নি ছাড়া সে চলতে পারবে না”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সত্যিই পারে নি। সুখকর ছিলো না দিনগুলো।
কলেজে নতুন বন্ধু হয় নি তার। ক্লাসও করে নি তন্নিকে ছাড়া।
আজকে তন্নি কি তাকে দেখে নি? না কি দেখেও না দেখার ভান ধরে চলে গেলো?
এতোটাই অপছন্দ করে অথৈকে?
কিন্তু অথৈ কি করেছে? তার কি দোষ?
এভাবে অথৈকে কেনো কষ্ট দিচ্ছে? তবে কি কখনো ভালোই বাসে নি তন্নি?
বৃষ্টির স্রোত ধীরে ধীরে যেনো বাড়ছে। প্রতিটা ফোঁটায় ভেসে যাচ্ছে অথৈয়ের চোখের পানি। ভাড়ি মেকাপের প্রলেপ ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে। কার্ল করা চুলগুলো হতে টপটপ করে পানি ঝড়ছে। সাদা রংয়ের গর্জিয়াছ গাউন ভিজে শরীরের সাথে সেঁটে গিয়েছে। নিজের চিৎকার নিজের কান ওবদিও পৌঁছাছে না বৃষ্টির শব্দে। শুধু গলা ব্যাথা করছে।
হাতে জুসের গ্লাস নিয়ে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব। দৃষ্টি শূন্যে। আকাশ পাতাল ভাবছে বোধহয়। নয়না এতোক্ষণ জোঁকের মতো লেপ্টে ছিলো। কিছু মুহুর্ত আগেই নিধি নিয়ে গিয়েছে তাকে। অর্ণব যেনো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলো।
“বসস ভালো আছো?
বাচ্চা বাচ্চা কন্ঠস্বরের দৃষ্টি ঘুরায় অর্ণব। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। এবং মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তামিমও হাসে। তেড়াব্যাঁকা দাঁতের সেই হাসি ছিলো অপূর্ব। কালো রংয়ের শার্টখানা ফর্সা নাদুসনুদুস শরীরে একদম মানানসই। মাঝা ভর্তি ঝাঁকড়া চুলো।
ঠোঁটের কোণের হাসি চওড়া হয় অর্ণব। একদম তারই মতো হয়েছে তামিম চুল গুলো।
“ও বসসসস ভালো আছো?
অর্ণব জুসের গ্লাস নামিয়ে দুই হাতে তামিমকে শূন্যে তুলে টেবিলে বসিয়ে দেয়। এবার দুজনের মাথা সমানসমান লাগছে। ফোলাফোলা গাল দুটো টেনে অর্ণব জবাব দেয়
“ভালো আছি। তুমি ভালো আছো?
“ খুব ভালো নেই।
অশিক্ষিত টাকলু রহমান আমার জীবনটা ছারখার বানিয়ে দিলো।
তামিমের আহাজারি জড়িত কথায় বেশ আগ্রহ প্রকাশ করে অর্ণব। যেনো শুনতে চাচ্ছে ঠিক কিভাবে তার জীবন ছারখার বানাচ্ছে?
তবে তামিম কিছু একটা ভেবে চিন্তিত হয়ে ওঠে
“ওহহহহহতেরি
আমি তো এসেছিলাম আপিকে খুঁজতে। আমার আপি এলো না যে।
অর্ণব ফোঁস করে শ্বাস টেনে বলে
“তোর আপি চলে গেছে।
“ কেনো কেনো?
এই বৃষ্টিতে কোন বলদ চলে যায়?
“তোর বাপের গোয়ালের বলদ যায় শালা
বিরবির করে বলে অর্ণব। তবে মুখে কিছু বলে না।
তামিম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে
“যাকক সেসব
আপি গেছে তো গেছে। কি আর করার। তুমি এসেছো তো এসেছো এবার আমার প্রবলেম সলভ করে দাও।
“করবো
তার আগে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে।
“কি কাজ?
“ আগে বল পারবি?
তামিম শার্টের কলার ঠিক করে বলে
“তামিম পারে না এমন কিছু আছে দুনিয়ায়?
অর্ণব হাসে। তবে জবাব দেয় না।
বৃষ্টির প্রবল এখনো কমে নি৷ এই বৃষ্টি যেনো পুটলি বেঁধে চলে এসেছে কিছু দিন জমিনে বসবাস করবে বলে। সাথে করে বাচ্চা কাচ্চাও নিয়ে এসেছে। বৃষ্টির বাচ্চা হচ্ছে বাতাস।
এতে তন্নির মাথাব্যথা নেই। থাকুক বৃষ্টি। তবে কিছুক্ষণের জন্য যাক। এভাবে একাধারে জমিন ভাসিয়ে দিতে থাকলে বাবা মা বাসায় ফিরবে কি করে? আর তারা নি ফিরলে ভীতু তন্নি একা রাত্রি যাপন করবে কি করে?
এতোসব ভাবনার মাঝে তন্নির মস্তিষ্কে উদয় হয় অর্ণব নামের পুরুষটির অবয়ন।
কি সুন্দর দেখতে হয়েছে মানুষটি।
দেখলেই যেনো চোখ জুরিয়ে যায়। তবে তন্নি আর কখনো দেখবে না। চোখ জুরাতে চায় না। থাকুক না তৃষ্ণান্ত। বুঝুক শূন্যতা।
কথায় আছে না “সব পেলে নষ্ট জীবন”
অন্তত জীবনে মর্ম বুঝতে অর্ণব নামক পুরুষটি না পাওয়ার খাতায় থাকুক।
বাতাসের তেজ বেড়েছে। বৃষ্টির ফোঁটা জানালার গ্রিল ভেদ করে ভিজিয়ে দিতে চাচ্ছে তন্নিকে। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে সত্তা।
অগত্য জানালা বন্ধ করে দেয়।
মানিকগঞ্জ শহর ছেড়ে ৫-৬ কিলোমিটার দূরের একটা শহরে তাদের বসবাস। পাঁচ তালা বিল্ডিং এর চতুর্থ তালায় থাকে।
ওড়না খানা বেশ ভিজেছে। গা হতে ওড়না খুলে তন্নি। ছুঁড়ে ফেলে চেয়ারে। থাকুক সেখানেই। বৃষ্টি কমলে কিংবা কাল রোদ উঠলে মেলে দেওয়া যাবে।
তখনই হতদম্ভ তামিম দৌড়ে ঢুকে পড়ে তন্নির কক্ষে। হাঁপাতে হাঁপাতে হাতের ওয়ালেট খানা এগিয়ে দিয়ে বলে
“আপি দেখ
অনুষ্ঠান বাড়িতে কেউ এটা ফেলে রেখে গিয়েছিলো বা হারিয়ে ফেলেছিলো। আমি পেয়ে নিয়ে এসেছি।
তামিমের হাত থেকে ওয়ালেট নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে তন্নি। ওজন দেখে মনে হচ্ছে বেশ অনেক টাকা রয়েছে।
“বাবাকে দাও গিয়ে
“ না না আপি
বাবা আমাকে চাপকে পিঠের ছাল তুলে ফেলবে। তুমি দেখো ভেতরে এড্রেস বা নাম্বার পাও কি না। তাহলে তাকে কল করে জানিয়ে দাও। এবং কাল চুপিচুপি গিয়ে দিয়ে আসবে।
তন্নি ছোট ছোট নয়নে তাকায় তামিমের পানে। তামিম শুকনো ঢোক গিলে
“একমাত্র ভাই না আমি তোমার? বাবাকে দিয়ে মার খাওয়াতে বুক কাঁপবে না?
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তন্নি।
“যাও তুমি। আমি দেখছি।
তামিমকে আর পায় কে? এক দৌড়ে চলে যায়। ওয়ালেট হাতে বিছানায় বসে তন্নি। অনুমতি ব্যতীত চেইন খুলে। এবং ভেতরে দেখতে পায় বেশ অনেক গুলো টাকা। দুটো ডেবিট ক্রেডিট কার্ড। গাড়ির লাইসেন্স এবং একটা বাটন ফোন। বাকিসব রেখে ফোন খানা তুলে নেয় তন্নি। লক খুলে কল লিস্টে ঢুকে। একটাই নাম্বার দেখতে পায়। কালবিলম্ব না করে কল দিয়ে বসে।
অর্ণব অপেক্ষার প্রহর গুনছে। সামনে ল্যাপটপ নিয়ে ফোন দিকে তাকিয়ে আছে। কখন আসবে কল?
এতোক্ষণে তো তামিম পৌঁছে গিয়েছে এবং ওয়ালেট হাতে তুলে দিয়েছে তন্নির। তাহলে কল আসছে না যে?
আসবে কি?
আকাশ কুসুম ভাবনার মাঝেই কর্কশ শব্দে কল বেজে ওঠে। একটু চমকায় বোধহয় অর্ণব। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে দুটো কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নেয়। অতঃপর রিসিভ করে কানে তুলে।
ল্যাপটপের স্কিনে দৃষ্টি রেখে ব্যস্ত স্বরে শুধায়
“কে বলছেন?
তন্নির বুক কেঁপে ওঠে। এই কন্ঠস্বর বেশ ভালো করেই চিনে সে। যুগের পরে যুগ কেটে যাবে তবুও এই কন্ঠস্বর কখনোই ভুলবে না তন্নি।
“কে বলছেন? জলদি কথা বলুন। কাজ করছি আমি।
ভীষণ ব্যস্ত বোধহয়। তন্নি চোখ বন্ধ করে বলে
“ আমি
“আমি টা কে?
“ তন্নি
“বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আপনি? যে নাম বললেই চিনে ফেলবো। আশ্চর্য
রাগ হয় তন্নির। চিনতে পারছে না? অথচ একদিন তুলে নিয়ে বিয়ে করেছিলো। এতো সহজেই ভুলে যাওয়া যায়?দুমুখো সাপ একটা। রাগ মনে রেখে
দাঁতে দাঁত চেপে বলে
“ অথৈয়ের বন্ধু ছিলাম।
অর্ণব বা কানে ফোন রেখে ডান হাত দ্বারা ল্যাপটপের কিবোর্ডে আওয়াজ তুলতে তুলতে বলে
“নাক বোচা তন্নি? বলদ টাইপের? পাটের মতো লম্বা চুল? আর গরুর মতো চোখ?
ওই তন্নি আপনি?
স্তব্ধ হয়ে যায় তন্নি। কয়েকমুহুর্ত চুপচাপ বসে থাকে। নিজের রূপের এই ভয়াবহ বিবরণ কখনোই সে আশা করে নি। পরমুহূর্তেই রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।
চিৎকার করে বলে ওঠে
“শয়তানের বাচ্চা
এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ২৭
তোর ওয়ালেট আমার কাছে। নিতে আসিস। ঠ্যাং ভে ঙে হাতে ধরিয়ে দিবো। পাটের মতো লম্বা চুল দিয়ে তোকে ফাঁ শি দিবো আমি। তোর চোখ তু লে লুডু খেলবো।
তোর ডেবিট কার্ড আর গাড়িট লাইসেন্স বুড়ি গঙ্গা থেকে তুলে নিস।