এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ৩২

এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ৩২
তানিশা সুলতানা

ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে প্রকৃতি মুখরিত। কখনো শব্দ বাড়ছে তো কখনো কমছে। ক্ষণে ক্ষণে আসমানে বিদুৎ চমকাচ্ছে। গাছপালা বোধহয় ভেঙে চুরে যাচ্ছে বাতাসের বেগে। ইতোমধ্যে আশিকের বেলকনি ভিজেপুরে একাকার হয়ে গিয়েছে। তন্নি রুমের ঠিক মাঝখানটায় হাঁটু মুরে বসে আছে। হাঁটুর ওপরে হাত দুটো ভাজ করে রেখেছে। তারপর হাতের ওপর মাথা। দৃষ্টি সামনের বাড়িটার দিকে।

ওই বাড়ির বেলকনি একটু বেশিই সুন্দর। ফুলে ফুলে সেজে উঠেছে। সেই ফুলের গায়ে এবং গাছ ভর্তি পানির বিন্দু বিন্দু ছোঁয়া। যেনো গাছ ঘেমে উঠেছে। একটা ছোঁয়া দিলেই টুপটাপ সেই পানি ঝড়ে পড়বে।
তন্নি খুব করে ইচ্ছে করছে ওই বেলকনিতে প্রবেশ করতে। গাছ গুলো ঝাঁকিয়ে হাত বাড়িয়ে পানির স্পর্শ পেতে।
কিন্তু সেটা কি আর সম্ভব? তবে নিজের বেলকনি এভাবে সাজানোর ফন্দি এঁটে ফেলে মনে মনে। বাড়িতে ফিরেই বাবার কাছে আবদার করবে ফুলগাছের।
তবে আজকে কি আর বাড়ি ফেরা হবে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বরাবরই তন্নির বৃষ্টি খুব পছন্দ।বৃষ্টির ফোঁটায় জমিন ভিজে উঠলে তন্নির মন পুলকিত হয়ে ওঠে। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে ভুলে না লোভনীয় পানি। খিলখিল হাসি লেপ্টে থাকে অধরজুরে।
কিন্তু আজকে ভালো লাগছে না। চিন্তায় বুক কাঁপছে। গোটা একটা রাত কাটিয়ে দিলো বাড়ির বাইরে। বাবা মা নিশ্চয় ভীষণ চিন্তা করছে? বাড়ি ফিরলে বকবে। জবাব চাইবে। কি বলবে তন্নি?
অর্ণব নামটা বললেই বাবা ক্ষেপে যাবে।
তারেক রহমান যদি পৃথিবীতে সব থেকে বেশি কাউকে অপছন্দ করে থাকে সেটা হলো অর্ণব। তন্নি ভেবে পায় না এতোটা অপছন্দের কারণ।
“ছকিনার মা বারবার দরজা কেন বন্ধ করো?
খোল জলদি

চমকায় বোধহয় তন্নি। চট করে মাথা তুলে। বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলো এই বাড়িতে সে ছাড়াও অন্য কেউ রয়েছে।
গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। ওড়না ঠিকঠাক করে দরজা খুলে।
অর্ণবের এক হাতে পেস্ট ব্রাশ আরেক হাতে খাবারের প্যাকেট।
” ব্রাশ করে এসো খাবো।
মুখ বাঁকিয়ে তন্নি শুধায়
“আপনি খাবেন তো আমি ব্রাশ করবো কেন?
তন্নির কপালে হাত ঠেকিয়ে পেছন দিকে ঢেলে দেয়। তারপর রুমে ঢুকতে ঢুকতে জবাব দেয়
” তুমি আমি হলাম সুই-সুঁতো, কদু-লাউ, চাঁদ-তারা
ওদের মতো।
নিশ্চয় তোমার মোটা মাথায় ঢুকলো না জ্ঞানী অর্ণবের বিবরণ?

তোমার দাঁত আমার দাঁত। তুমি ব্রাশ করলেই আমার ব্রাশ করা হয়ে গেলো। শোনো নি স্বামী স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক?
যখন দ্বিতীয় বিয়ে করবো না তখন তোমারও ব্রাশ করতে হবে না। কেনো জিজ্ঞেস করো।
তন্নি জিজ্ঞেস করে না। বুকে হাত গুঁজে ছোট ছোট নয়নে দেখতে থাকে অর্ণবকে।
তন্নির থেকে জবাব না পেয়ে অর্ণব নিজে নিজেই বলে দেয়
“ওই যে বললাম স্বামী স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক। তখন আমরা তিনজন স্বামী স্ত্রী হবো। দ্বিতীয় বউ ব্রাশ করা মানে তোমার আর ব্রাশ করা হয়ে গেলো।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তন্নি৷ অর্ণবের থেকে ব্রাশ পেস্ট নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ে। অর্ণব আলতো হাসে
” তোমাকে আর তোমার টাকলু বাপকে যদি সোজা না করেছি তাহলে আমার নামও অর্ণব চৌধুরী নয়।

বৃষ্টি কমেছে। কিছুক্ষণ আগে মেঘে ঢাকা আসমানে সূর্যের দেখা মিলেছে। আশিক খাবার নিয়ে এসেছে। পরপর কয়েকবার কলিং বেল বাজিয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যে। কিন্তু দরজা খোলার নাম নেই। সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে সিনেমা হলে। ঘুম চোখ টলমল করছে।
বিরক্ত হয়ে এক চাপা কলিং বেল বাজাতেই থাকে। তখন অর্ণব দরজা খুলে দেয়। মুখে তার ব্রাশ।
“কি ভাই?
ভদ্রলোকের বাড়িতে এভাবে গুন্ডার মতো কলিং বেল কেনো বাজাচ্ছেন?
আশিক অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় অর্ণবপর মুখপানে। হাতে থাকা খাবারের ব্যাকেট উঁচু করে দেখায়।
অর্ণব ছো মেরে প্যাকেট নিয়ে নেয়
” বিকেল ওবদি কোথাও একটা থেকে আয়। ডিস্টার্ব করবি না।
নিজ বক্তব্য শেষ করে দরজা আটকে ফেলে অর্ণব। আশিক স্তব্ধ হয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। অতঃপর বিরবির করে বলে
“টাকলু উকিল কেনো নিজের আদরের কন্যা বসকে দিতে চায় না। স্পষ্ট বুঝলাম আজকে”

ফ্রেশ হয়ে নিজের লম্বা চুলে চিরুনি চালিয়েছে তন্নি। বিনুনি করতল গিয়ে বিরক্ত হয়। এতোবড় চুল বিনুনি করা চারটিখানি কথা?
শেষমেশ হাত খোঁপা করে নেয়। খিধে পেয়েছে বেশ। সেই গতকাল সকালে খেয়েছিলো। লেজ ছাড়া বাঁদর রাতে আর খেতে সাধলো না। একদমই মেনার্স জানে না লোকটা। জানবে কি করে? বেয়াদব কি না।
কয়েকবার মুখ বাঁকায় তন্নি৷ সাহস থাকলে বেয়াদব লোকটাকে মাথায় তুলে আছাড় মারতো।
“ছকিনার মা খেতে এসো।

বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে তন্নি। নাম কি আর পেলো না? শেষমেশ ছকিনার মা? এটা কোনো নাম হলো?
গাল ফুলিয়ে তেড়ে যায় ডাইনিং এ। সেখান থেকেই টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসছে।
অর্ণব প্লেটে খাবার সাজিয়েছে৷ এবং গ্লাসে পানি ভরছে। তন্নি মনে মনে ভেবেছিলো অনেক কিছু বলবে। তবে মুহুর্তেই সিদ্ধান্ত বদলে ফেলে। খাবার দেখে বোধহয় সব ভুলে গেলো। চটজলদি চেয়ার টেনপ বসে পড়ে। আর পরপর লোকমা তুলে প্লেট খালি করার যুদ্ধে নেমে পড়ে। বর্ষণমুখর দিন। গরম গরম খিচুরি আর গরুর মাংস। আহহহা
শরীর মন দুটোই তৃপ্তি পায়।

অর্ণব গালে হাত দিয়ে তন্নির খাওয়া দেখতে থাকে। আগের মতো টুকে টুকে খায় না। লজ্জা পেয়ে মাথাও নুয়িয়ে ফেলে না। দিন বদলানোর সাথে সাথে কি মেয়েটা লজ্জা গুলে খেয়ে ফেলেছে?
ফেললে ভালোই হয়েছে। অতন্ত্য রোমাঞ্চ করার সময় ঝামেলা হবে না।
ভাবতে ভাবতে নিজেও খাওয়া শুরু করে।

তারেক রহমানের বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা। কয়েকটা কেচের ব্যাপারে তারা আলাপ করতে এসেছে। গতকাল বাসায় ছিলো না। কোর্টেও যেতে পারে নি। সেই জন্যই আজকে ভিড় জমেছে।
উঠোনে চেয়ার পেতে বসেছে তারেক রহমান। তার মুখোমুখো কয়েকটা চেয়ারে বসে আছেন বাকি সবাই।
তামিম দরজার পাল্লা ধরে ঝুলছে। দৃষ্টি তার পাশের বাসার গেইটের পানে। সেখানে তামিম এর চার নাম্বার গার্লফ্রেন্ড আয়রা বসে আছে। হাতে তার একখানা টকটকে লাল গোলাপ। গোলাপটা মূলত তামিমই আনতে বলেছে। স্কুল থেকে ফেরার পথে আয়রার চুলের মুঠি ধরে থ্রেট করেছে। কড়া গলায় বলেছে “আমার জন্য গোলাপ না আনলে তোর দাঁত ভেঙে ব্লেন্ডারে গুড়োগুড়ো করে তাতে মধু আর কাসুন্দি মিশিয়ে জুস বানিয়ে খাবো আমি বলে দিলাম”

বেচারা আয়রা ভয় পেয়ে গোলাপখানা চুরি করেছে তার ভাইয়ের বারান্দা থেকে।
এখন সেটা তামিমকে দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু তামিম আটকা পড়েছে বাবার জন্য। এখন বাসা থেকে বের হতে গেলে টাকলু বাপ তার ঠ্যাং ভেঙে নেহারি বানিয়ে তাকেই খাওয়াবে।
মনে মনে বিরক্ত হয় তামিম।
আফসোসের সুরে বিরবির করে বলে
“প্রেম করেও শান্তি পাচ্ছি না। কাবারের হাড্ডির মতো বাপটা মাখখানে বসে আছে। কবে একটু শান্তি পাবো? কপালে কি বিয়ে লিখো নাই আল্লাহ?
তামিমের ভাবনার মাঝেই খেয়াল করে গেইট দিয়ে অর্ণব ঢুকছে। মুহুর্তেই হাসি ফুটে ওঠে তামিমের ঠোঁটের কোনে। দরজা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

অর্ণব সোজা গিয়ে তারেক রহমানের পায়ের কাছে আসে পড়ে। এবং তারেক রহমানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলে ওঠে
“আমি দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য আপনার কাছে অনুমতি নিতে এসেছি শশুর মশাই। আপনার মেয়ে অনুমতি দিয়েছে। এখন আপনি মাথা নারালেই ঘরে বউ তুলবো। মেয়েও পছন্দ করে ফেলেছি।
ঘরা মজলিসে তারেক বিপাকে পড়ে যায়। সকলের দৃষ্টি তার পানে। চোখে মুখে প্রশ্ন। তারেকের ইচ্ছে করছে বেয়াদব ছেলেটাকে জুতো পেটা করতে।
অর্ণবের তারেকের নিরবতা দেখে বলে
” অনুমতি দিয়েছেন বুঝেছি আব্বা।

এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ৩১

আপনার মতো ভালোমানুষ অনুমতি না দিয়ে থাকতে পারে? বোঝেনই তো ইয়াং ছেলে। দুইচারটা বউ না থাকলে মাথা ঠিক থাকে না।
যাইহোক
বিয়ের খরচাপাতি কিন্তু আপনিই দিবেন। আমার মীরজাফর বাপ মুখের ওপর বলে দিয়েছে একটা টাকাও তিনি আমাকে দিবে না।
আপনি টাকা না দিলে আমার বিয়েটা ঠেকে যাবে আব্ববববববা।

এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ৩৩