অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ২১

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ২১
ইরিন নাজ

— “হ্যাপি বার্থডে মাই লাভ, মাই গুলুমুলু লেডি।”
কেঁপে উঠল আয়ানা। সম্বিৎ ফিরে পেলো সে। দু হাতে মুখ চেপে ধরল। আঁখি জোড়া জলে টলমল করতে লাগল খুশিতে। তার জন্মদিন, অথচ তার মনেই ছিল না। অবশ্য থাকবে কি করে! বাবা মারা যাবার পর তো আর কখনো তার জন্মদিন পালন হয় নি। তাই এই দিনটা বিশেষ ভাবে মনে রাখা হয় নি তার। কিন্তু আজ! এমন একটা সারপ্রাইজের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। তার সকল প্রিয় মানুষ একত্রে আজ তাকে জন্মদিনে উইশ করেছে। নিঃসন্দেহে এটা তার জীবনের বেস্ট একটা মুহূর্ত। আয়ানা পেছন ফিরে আদ্রিশের দিকে চাইল। টুপ করে দু ফোঁটা আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার চোখ থেকে। যত্ন সহকারে আয়ানার চোখের পানি মুছিয়ে দিলো আদ্রিশ। ইশারায় কাঁদতে বারণ করল, সামনে এগিয়ে যেতে বলল তাকে। মুহূর্ত ব্যয় না করে দৌঁড়ে গিয়ে অনামিকা বেগম কে জড়িয়ে ধরল আয়ানা। কান্নাভেজা কণ্ঠে শুধাল,

— “কেমন আছো আম্মু?”
অনামিকা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কণ্ঠে জবাব দিলেন,
— “আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, মা। আমার মেয়ে দুটো এতো ভালো আছে। আমি কি করে ভালো না থেকে পারি!”
মিনিট দুয়েক অনামিকা বেগমের বুঁকেই লেপ্টে রইল আয়ানা। অতঃপর হাসি মুখে সরে আসলো মায়ের বুঁক থেকে। পাশে চোখ যেতেই দৃষ্টি নত করল আয়ানা। ধীর কণ্ঠে সালাম দিলো মাহমুদ সাহেব কে। সালামের জবাব দিলেন মাহমুদ সাহেব। আয়ানার মাথায় হাত রেখে তীব্র অপরাধবোধের সহিত বললেন,
— “আমাকে ক্ষমা করে দাও আয়ানা মা।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বাকরুদ্ধ হলো আয়ানা। যেই মানুষ টা কখনো তার সাথে ঠিকমতো দুটো কথা অবধি বলে নি সেই মানুষটা আজ তাকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করছে! আবার ক্ষমাও চাইছে! আয়ানা নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলো মাহমুদ সাহেবের কথায়। উনি পুনরায় বলতে শুরু করলেন,

— “আমি বুঝতে পেরেছি আমি তোমার সাথে কতোটা অন্যায় করেছি। তোমার শৈশব আমি নষ্ট করেছি। আমি চাইলেই পারতাম তোমাকে সুন্দর একটা জীবন দিতে, আমি পারতাম তোমার বাবা হতে। কিন্তু বোনের ভালোবাসা আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। আমি তাকে এতোটাই বিশ্বাস করতাম যে সে যখন যা বলেছে তাই করেছি, যা বুঝিয়েছে তাই বুঝেছি। তার প্রতিটা কথা আমি অন্ধের মতো মেনে নিয়েছি। এমন কি আমার এই ভুলের জন্য মীরাকেও আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি। আপা চলে যাওয়ার পর আমি একান্তে খুব ভেবেছি আর বুঝতেও পেরেছি সে আমাকে দিয়ে কতো কতো অপরাধ করিয়েছে। তার কথায় উল্টোপাল্টা বুঝে আমি তোমার আর তোমার মায়ের সাথে কতো অন্যায় করেছি।

অনামিকা, মীরা কে মায়ের ভালোবাসা দিলেও আমি কখনো তোমাকে বাবার ভালোবাসা তো দূরে থাক, ভালো করে দুটো কথা অবধি বলি নি। আমার না সাহস হচ্ছিলো না তোমার সামনে দাঁড়ানোর, তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার। কিন্তু তুমি ক্ষমা না করলে শান্তিও যে পাচ্ছিলাম না। কখন, কি হয়ে যায় বলা তো যায় না। আজ আছি, কাল বেঁচে নাও থাকতে পারি। এই অপরাধবোধ নিয়ে আমি দুনিয়া থেকে যেতে চাই না। তাই তো নিজের মনটাকে শক্ত করে এখানে এসেছি। নাহলে যে মরেও শান্তি পাবো না।”
চোখ জোড়া ছলছল করে উঠল আয়ানার। সে তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলো,

— “এভাবে বলবেন না প্লিজ। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘায়ু দান করুক। আমি তো খুব ছোট বয়সে বাবা কে হারিয়েছে, আমি বুঝি বাবা কি জিনিস। বাবার স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসার জন্য আমি প্রতি মুহূর্তে কতোটা অস্থির হই সেটা শুধু আমি জানি। আর সবচেয়ে বড় জিনিস টা হলো বাবা নামক বটগাছের ছায়া, যা সন্তানের মাথার উপর না থাকলে সেই সন্তানের জীবন কতোটা কঠিন হয়ে ওঠে সেটা কেবলমাত্র একজন বাবা ছাড়া এতিম সন্তানই বোঝে। আমি চাই না আমার মীরা আপুর জীবন এমন হোক। সে আরও অনেক অনেক যুগ বাবার স্নেহের ছায়াতলে থাকুক, আমি এটাই চাই।”

আয়ানা ঠিক কতোটা কষ্ট পেয়ে থাকলে কথাগুলো বলেছে তা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারলেন মাহমুদ সাহেব। চোখ জলে ভরে উঠল উনার। কি নিষ্পাপ মুখশ্রী মেয়েটার! কি নিষ্পাপ আঁখিজোড়া! এমন একটা মেয়ে কে কিভাবে এতো কষ্ট দিলেন উনি! কিভাবে এতো অন্যায় করলেন মেয়েটার সাথে! এমন কি নিজের মেয়ের কথা ভেবে অচেনা অজানা একটা ছেলের হাতে আয়ানা কে তুলে দিয়েছিলেন উনি। একটাবারও ভাবেন নি আয়ানা ভালো থাকবে কিনা। আয়ানার সাথে করা প্রতিটা অন্যায়ের কথা ভেবে নিজের প্রতি ঘৃণাবোধ তীব্র থেকে তীব্রতর হলো যেনো উনার! উনি আয়ানার সামনে হাত জোড় করে বলে উঠলেন,

— “আমি অনেক অন্যায় করে ফেলেছি মা, অনেক অন্যায় করে ফেলেছি। আর সেটা যবে থেকে বুঝতে পেরেছি তখন থেকে অপরাধবোধ আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। তুমি ক্ষমা না করা অব্দি আমি এই অশান্তি থেকে মুক্তি পাবো না। এই খারাপ মানুষটাকে কি ক্ষমা করা যায় না?”
আয়ানা দ্রুত মাহমুদ সাহেবের হাত ধরে বলল,

— “আপনি আমার গুরুজন। এভাবে কথা বলবেন না দয়া করে। আর আমার কারোর উপর কোনো রাগ নেই। আমার সাথে কে কি করল তাও আমি মনে রাখতে চাই না। আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। উনি আমাকে দুঃখ দিয়ে পরীক্ষা করেছেন, আবার তার তুলনায় বহুগুন বেশি সুখ ও দিয়েছেন। প্রতি মুহূর্তে আমার মনে হয় এই দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষটা বোধহয় আমি। আপনি শুধু মন ভরে দোয়া করবেন আমার জন্য, যেনো আমি সারাজীবন সুখে থাকতে পারি, ভালো থাকতে পারি।”
— “করব মা, অবশ্যই করব। আল্লাহ আমার দুই মেয়ে কে সবসময় সুখে রাখুক, ভালো রাখুক। আমি আজ থেকে আমার দুই মেয়ের ভালো বাবা হবো। আমাকে কি ভালো বাবা হবার একটা সুযোগ দিবে মা? একটাবার বাবা বলে ডাকবে?”

ছলছল চোখে অনামিকা বেগমের দিকে চাইল আয়ানা। আলতো হেসে মাথা ঝাঁকালেন উনি। চোখ মুছে হাসল আয়ানাও। দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে বলল,
— “আব্বু, আপনার চোখে পানি একদম মানাচ্ছে না। ঝটফট চোখের পানি মুছে ফেলুন দেখি!”
আয়ানার কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেললেন মাহমুদ সাহেব। বাবা ডাকায় ভীষণ খুশিও হলেন। মাথা ঝাঁকিয়ে চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু মুছলেন। বাবা-মেয়ের মিলনে উপস্থিত সকলে ভীষণ খুশি হলো। মীরা এগিয়ে এসে আয়ানার পাশে দাঁড়িয়ে মুখ বেঁকিয়ে বললো,
— “আমাকে তো ভুলেই গিয়েছো, এখন সব আদর আয়ানার তাই না?”
মাহমুদ সাহেব মীরার মাথায় হাত রেখে বললেন,

— “তুমিও আর বাবার উপর রাগ করে থেকো না মা….”
— “না, আব্বু। আমি মোটেও রাগ করে নেই। অভিমান করেছিলাম। কিন্তু সেই অভিমানটুকুও এখন আর নেই। তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছো, আমার ছোট্ট বোনটাকে মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করেছো। তার জন্য আমি ঠিক কতোটা খুশি হয়েছি বলে বোঝাতে পারবোনা। আব্বু তুমি বেস্ট, বেস্ট, বেস্ট।”
অতি আনন্দের সাথে কথাগুলো বলল মীরা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন মাহমুদ সাহেব। অবশেষে নিজের ভুলটা সংশোধন করতে পেরেছেন উনি।
পরিস্থিতি অন্যরকম দেখে তা স্বাভাবিক করতে গলা খাকারি দিলো আহিল। সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মজার ছলে বলল,

— “আমার ভাইটা নিজের বউয়ের জীবনের স্পেশাল দিনটাকে আরও স্পেশাল করার জন্য এত্তো মেহনত করল। সেদিকে দেখি কারোর খেয়াল ই নেই। কিন্তু আমি একজন দায়িত্ববান ভাই। আমার সবদিকেই খেয়াল থাকে। দেখুন, দেখুন, কেমন হোপ মেরে দাঁড়িয়ে আছে আমার ভাইটা!”
আহিলের কথায় সকলের নজর এসে পড়ল আদ্রিশের উপর। মিটমিটিয়ে হাসতে লাগল সবাই। সবাইকে এভাবে একত্রে নিজের দিকে তাকিয়ে হাসতে দেখে অপ্রস্তুত হলো আদ্রিশ। পরক্ষণেই চোখ পাকিয়ে তাকালো আহিলের দিকে। ভাইকে রেগে যেতে দেখে বোকা বোকা হাসল আহিল। আদ্রিশ কে না দেখার ভান করে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। আহিল কে এই কঠিন সিচুয়েশন থেকে বের করল মিথি। গলা ঝেড়ে বলল,

— “আহিল ভাইয়া তো ঠিকই বলেছে। আজ এতো স্পেশাল একটা দিন। আর আপনারা সবাই কিনা নাকের জল, চোখের জল এক করছেন! এটা কিছু হলো!”
মিথির কথা বলার ভঙ্গিতে পুনরায় হেসে উঠল সবাই। সিদ্ধান্ত হলো এবার কেক কাটবে আয়ানা। সবাই সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই ঝট করে পেছন ফিরে আসলো আয়ানা। চোখের পলকে ঝাপ্টে জড়িয়ে ধরল আদ্রিশ কে। ধীর এবং কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ২০

— “ভালোবাসি ডাক্তার সাহেব, অনেক অনেক ভালোবাসি। ধন্যবাদ আমার জীবনটাকে এতোটা সুন্দর করার জন্য, আমার সমস্ত স্বপ্ন পূরণ করার জন্য।”

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ২২