পাতা বাহার পর্ব ৩ (২)
বেলা শেখ
সকাল বেলা। আজ সূর্য মামার দেখা নেই।মেঘে ঢাকা দিগন্ত। কেমন একটা গম্ভীর ভাব বিরাজমান। তবে সরকার বাড়িতে রোজকারের মতো পাখির কলকাকলিতে মুখরিত সাতসকাল। অরুণ সরকার রোজকারের মতো ফজর ওয়াক্তেই ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে হাঁটতে বের হয়। আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি। একঘন্টা হেঁটে বাড়ি ফিরে গোসল সেরে নেয়। আগে নিয়মতান্ত্রিক জিমে গেলেও এখন আর যাওয়া হয়ে ওঠে না।
বাড়িতেই জিমের কিছু যন্ত্রপাতি যেমন ট্রেডমিল, ডাম্বেল ইত্যাদি আছে সেগুলোও ব্যবহার করা হয় না আজকাল ব্যস্ততার ভিড়ে। অরুণ গোসল করে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ভোরকে কয়েকবার ডাক দেয়! ভোর বিছানায় গড়াগড়ি খেতে খেতে আবার যেমন তেমনি। অরুণ ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়ায় পাশে তাকাতেই টবের দিকে নজর আসে। তাদের বাড়িতে অধিকাংশ ফার্নিচার কাঠের। বাবার ডিজাইন করে বানানো। আর রুমের ভিতরে, বেলকনিতে ড্রয়িং রুমে প্রায় সব খানেই টবে গাছ লাগানো! সে টবে বিভিন্ন ধরনের ফুল, ঔষধি গাছ। অরুণের রুমেও আছে বেশ কয়েকটি আর বেলকনি জুড়েও! কলিয়াস, জিজি প্লান্ট, ফিগ প্লান্ট, এরিকা পাম, এলোভেরা, স্পাইডার প্লান্ট, ফিলোডেনড্রন ইত্যাদি। অরুণ ওয়াশরুম থেকে মগ ভর্তি পানি এনে গাছ গুলোতে দেয়। অল্প পানি হাতে নিয়ে ঘুমন্ত ছেলের মুখে ছিটিয়ে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” আব্বু ওঠো? সকাল হয়েছে সেই কখন! স্কুলে যেতে হবে তো!”
ভোর পিট পিট করে চোখ খুলে উঠে বসে হাই তুলতে তুলতে বলে,
-” এত জলদি সকাল হয়ে গেল? একটু আগেই না ঘুমালাম!”
অরুণ পানির মগ রেখে এসে ভোরকে কোলে নিয়ে বেলকনিতে যায়!
-” দেখ সকাল হয়ে গেছে! যদিও তোমার সূর্য মামা আজ ওঠেই নি!”
ভোর বাবার কাঁধে মাথা রেখে বলে,
-” আব্বু ঘুম পাচ্ছে আমার!”
অরুণ হেসে ছেলের পিঠে চাপড় দিয়ে বলে,
-” চলো তোমাকে গোসল করিয়ে দেই! ঘুম পালিয়ে যাবে!”
-” না না আব্বু! এখন করবো না গোসল। স্কুল থেকে ফিরে করব। তখন অনেক গরম লাগে!”
-” এখন গোসল করলে স্কুলে ভালো লাগবে। সেখানেও তো গরম। সকাল বেলা গোসল করলে সারাদিন মনটা ফুরফুরে থাকে আব্বু। আর তাছাড়াও দুপুরে তোমায় কে গোসল করিয়ে দেবে?”
ভোরের মুখটা মলিন হয়ে আসে। তার মলিন মুখ দেখে অরুণের মন খারাপ হয়।
-” আব্বু আমি একাই করে নেব গোসল!”
অরুণ রুমে ঢুকে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলে,
-” কখনো একা একা গোসল করার চিন্তা মাথায় আনবে না। তুমি খুব ছোট! বাথরুমে সাবান পানি মাখিয়ে ফেল। পা পিছলে গেলে? তাছাড়া ফ্লোরটাও পিচ্ছিল!”
ভোর মাথা নাড়ে।
-” আব্বু দাদিকে বললে গোসল করিয়ে দেবে তো!”
অরুণ ছেলেকে বাথরুমের ছোট টুলের উপর বসিয়ে দিয়ে কল ছাড়ে বালতি ভরতে। মলিন মুখে বলে,
-” তোমার দাদি বয়স্ক মানুষ! ছোটমাকে কাজে বলা ঠিক হবে? তার তো এখন রেস্ট করার সময়!”
-” দাদি তো আনিকা রুপমকেও গোসল করিয়ে দেয়! আমাকে দিলে কি এমন হবে!”
অরুণ ভোরের গায়ে পানি দিয়ে বলে,
-” আমি করিয়ে দিচ্ছি তো আব্বু।”
ভোর মুখ গোমড়া করে বলে,
-” বুঝতে পেরেছি! তোমার মাকে দিয়ে কাজ করাব বলে তোমার হিংসে হচ্ছে! আমার আম্মুকে আসতে দাও? আম্মুকে বলব শুধু আমার কাজ করবে ,আমাকে ভালোবাসবে! আব্বুর কাজ করবেও না , ভালোও বাসবে না!”
অরুণের হাত থেমে যায়। শান্ত দৃষ্টিতে ছেলের মাসুম নিষ্পাপ মুখশ্রীর দিকে চায়। যেই মুখশ্রী তাকে এক আকাশ সমান ভালোবাসার আভাস দেখা দেয়,যে মুখশ্রী তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন! আবার সেই মুখশ্রীই তাকে যন্ত্রণার সমুদ্রের গভীরতায় নিক্ষেপ করে! দেখিয়ে দেয় সে কতটা হতভাগা ছেলে সাথে বাবাও !
পাতা স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নেয়। তাদের স্কুলে স্টুডেন্টসদের সাথে সাথে টিচারদেরও নির্ধারিত ড্রেস আছে। ছেলে বাচ্চাদের স্কাই ব্লু শার্ট কালো প্যান্ট আর মেয়ে বাচ্চাদের স্কাই ব্লু স্কার্ট , হোয়াইট শার্ট ও প্যান্ট। সোল্ডার, বেল্ট, টাই এগুলো নেভি ব্লু। আর টিচারদের স্কাই ব্লু রঙের শাড়ি সাদা ব্লাউজ মেয়েদের সালোয়ার কামিজ বা বোরখাও পড়তে পারে নিয়ম মেনে আর ছেলেদের কালো প্যান্ট ও সাদা শার্ট। পাতা শাড়ি পরে মাথায় হিজাব বেঁধে নেয়। হাতে ঘড়ি পড়ে হ্যাংগিং ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তুলে নিয়ে পানির পটটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে কিচেনে আসে। তার মা লাবনী আক্তার রান্না করছে। পাতার স্কুল বাসা থেকে একটু দূরে হওয়ায় জলদি বের হতে হয়। পাতা পটে পানি ভরতে ভরতে বলে,
-” মা রান্না কতদূর? আমি কি টিফিন নিয়ে যেতে পারবো?”
লাবনী আক্তার কড়াইয়ে ডিম ছেড়ে খুন্তি দিয়ে উল্টাতে উল্টাতে বলল,
-” কাজের মেয়ে পাইছোস আমায়! একটা কাজ করবি না শুধু তৈয়ার তা খাবি! সকালে উঠে কাজে তো একটু হাতও বাটাইতে পারিস! তা না! খিচুড়ি রেঁধেছি কালাই চাউল দিয়ে! ডিম ভাজছি।বাটি এনে নিয়ে যা। আর শোন রেকের ভিতরে কেকের প্যাকেট আছে দুই পিস খেয়ে পানি খেয়ে যা!”
পাতার মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। একটু যত্নে তার তনুমনে ভালোলাগা ছেয়ে গেল। সচরাচর সে সকালে হালকা পাতলা বাসি খাবার খেয়েই বেড়িয়ে যায়। লাবনী আক্তার রান্না শেষ হতে তার অনেক দেড়ি হয়ে যায় । তাই ঘরে যা থাকে তাই মুখে দিয়ে যায়। স্কুল তিনটা পর্যন্ত। সব টিচার টিফিন নিয়ে যায়। সেও নিয়ে যায় বাড়ি থেকেতযেদিন রান্নাটা জলদি হয়। নইলে হোটেল থেকে রুটি অমলেট বাটিতে ভরে নিয়ে যায়।
আজ অনেক দিন পর বাড়ি থেকে টিফিন নিবে। লাস্ট কবে নিয়েছিল সে ভূলেই গেছে। সে টিফিন বক্স নিয়ে আসে। লাবনী আক্তার বক্সে খিচুড়ি দিয়ে অর্ধেক ডিম ভাজি দেয়। পাতা খুশি হয়। যদিও খিচুড়ি তার একটুও পছন্দ না। পাতা বক্সের ঢাকনা খুলে রেখে ড্রয়িং রুমের টি টেবিলে রাখে ফ্যানের নিচে একটু ঠান্ডা হওয়ার জন্য। যে গরম গন্ধ না উঠে যায়। তারপর কেকের প্যাকেট থেকে দুই পিস কেক নিয়ে বাকিটা রেখে আসে। কেক খেয়ে পানি পান করে।
আতিকুর রহমান রুম থেকে বেরিয়ে খবরের কাগজ সহ ড্রয়িং রুমে বসে। পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” তোমার আব্বু ফোন করেছিল!”
পাতার গলায় পানি আটকে যায়। বিষম খায়। পানি ছিটিয়ে পড়ে বাইরে। আতিকুর রহমান নাক সিঁটকায়। পাতা নিজের মাথায় আলতো করে থাপ্পড় দিয়ে কেশে নিজেকে সামলে বলে,
-” কি বললো?”
আতিকুর রহমান পেপার মেলে মুখের সামনে ধরে বলে,
-” তোমায় কিছুদিনের জন্য ওবাড়ি যেতে বললো!”
-” আব্বু স্কুল ছুটি নেই এর মধ্যে। আর ওখান থেকেও বেশ দূরে হয়। ছুটি হলে পড়ে যাবো।”
-” তাহলে তার সাথে কথা বলে নিও!”
আতিকুর পেপারে নজর রেখেই বলে। পাতা মাথা নাড়ে। লুবমান সোফায় বসে বলে,
-” খালু শুধু তোকেই যেতে বলে পাতু অথচ তুই কর্মজীবী ব্যস্ত নারী। আমি বেকার আমায় তো বলে না!”
পাতা টিফিন আটকে নিয়ে ব্যাগে ভরে বলে,
-” বুঝলি ভাই! সব মায়া! এককালে পালিত মেয়ে ছিলাম তাদের ঘরে! ওখানেই বড় হয়েছি। মেয়ের মতোই ভালোবাসতো। নিজের ছেলে মেয়ে আসায় ভালোবাসা কমতে থাকে। তবে একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। এখনো একটু হলেও বাসে! আব্বু ভাই আসছি আমি!”
বলেই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হয়ে যায়। আতিকুর রহমান পেপার নামিয়ে পাতার প্রস্তান দেখে। লুবমান বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” বাবা পাতাকে খালা খালুকে না দিলেও পারতে! ওতটাও অভাব ছিলো না তোমার!”
ব্যাস্ত সড়ক। শা শা গাড়ি চলছে পুড়ো রাস্তা জুড়ে যাত্রি পার হওয়ার অবকাশ নেই। মেইন রোড বলে কথা। যাত্রি পার হওয়ার জন্য জেব্রাক্রসিং নেই তবে নির্দিষ্ট দূরত্বে ওভার ব্রিজ আছে উপর দিয়ে শুধু মানুষ চলাচলের জন্য। সিগন্যালও আছে। পাতা সিগনালে বাইকে বসে। আশে পাশে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ তাকে ডাকছে বেশ সময় ধরেই এমন ফিল হচ্ছে। কিন্তু নাহ কাউকেই নজরে আসে নি। পাতা হেলমেটের গ্লাস উঠিয়ে পাশে তাকায়! তখনই শুনতে পায় কেউ সত্যিই ডাকছে। ছোট ছোট হাত নাড়িয়ে গলা উঁচিয়ে ডাকছে,
-” মিস? পাতা মিস? এই দিকে তাকান? আমি ভোর? মিস?”
চারপাশের হর্ণ মানুষ, যানবাহনের শব্দে আওয়াজ বেশি শোনা যাচ্ছে না। পাতা সরু নজরে চায়। প্রাইভেট কারের জানালার গ্লাস অর্ধেক উঠানো। সেই ফাঁকের মধ্যেই হাত বের করে ডাকছে! কেউ বার বার তাকে ভিতরে নেয়ার চেষ্টা করছে। ভোর শুনছেই না। সিগন্যাল শেষ হয়ে যাওয়ায় সব গাড়ি চলতে থাকে। পিছনের গাড়ির হর্ণের আওয়াজে পাতা বাইক স্টার্ট করে ফুটপাতের সাইড দিয়ে ধীরে চালাতে থাকে। ভোরদের গাড়ির স্পিডও কমে পাতার বাইকের সামনে থেমে যায়। পাতা বাইক নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়াতেই ভোর মাথা বের করে বলে,
-” আসসালামুয়ালাইকুম মিস! কেমন আছেন? আপনাকে কখন থেকে ডাকছি শুনছেনি না! আমার গলা ব্যথা হয়ে গেছে।”
পাতা সালামের উত্তর নিয়ে হাত বাড়িয়ে ভোরের গাল টিপে বলে,
-” শুনতে পাই নি আমি। তবে মনে হচ্ছিল কেউ ডাকছে আশেপাশে তাকিয়েও ছিলাম। তা ভোর সরকার কেন ডাকছিলে?”
ভোর মিষ্টি হেসে বলে,
-” এমনিতেই! মিস আপনার বাইকে আমায় লিফট দিবেন?”
পাতা তার গাল টিপে বলে,
-” কেন নয়! তবে আপনি তো গাড়িতেই যাচ্ছিলেন! কোনো সমস্যা?”
ভোর মাথা নেড়ে না বোঝায়। পাশ থেকে কেউ ভোরকে ভিতরে নিয়ে বলে,
-” ভোর দেড়ি হচ্ছে তোমার স্কুলে! চলো?”
পাতা মাথাটা হালকা এগিয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে কে বলছে কথা। ভিতরে অরুণ সরকারকে দেখে সোজা হয়ে বসে। হেলমেটের গ্লাস লাগিয়ে নেয়।
ভোর বাবার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বলে,
-“আব্বু আমি মিসের সাথে স্কুলে যাই? প্লিজ? আমি কখনো বাইকে চড়ি নি! প্লিজ আব্বু?”
অরুণ শান্ত গম্ভীর গলায় বলে,
-” বাইরে অনেক গরম ভোর। আর ধুলোবালি, গাড়ির ধোঁয়া তো আছেই! তুমি গাড়িতেই যাবে ব্যস। কোনো জেদ নয়?”
ভোর নাছোড়বান্দা। সে যাবেই। অরুণকে বার বার অনুরোধ করে। পাতার বেশ মায়া হয়। মা হীন ছেলে কোথায় বাবা একটু এক্সট্রা ভালোবাসবে আবদার পূরণ করবে আদুরে গলায় কথা বলবে! তা না! গম্ভীর হয়ে অর্ডার করছে!
ভোর পিট পিট করে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” আব্বু প্লিজ? মিস আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন না আব্বুকে?”
পাতা হচকচিয়ে যায়। সে বোঝাবে এই তাগড়া ষাঁড় কে। কোথায় সে এইটুকুনুই শরীরের বিড়াল শাবক যার আচড় দেয়ার নখ পর্যন্ত নেই আর কোথায় ওই লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ ষাঁড় তথা পুরুষ। তাকে নজরেই না ভষ্ম করে দেয়! তবুও স্টুডেন্টের সামনে ইজ্জত রক্ষা করতে আমতা আমতা করে বলে,
-” স্যার যেতে দিন না! আমি দেখেশুনে ধীরেই বাইক চালাবো।”
অরুণ গ্লাসটা পুরো নামিয়ে বাইকে বসা ছেলের মিসের দিকে চায়। মুখ দেখতে পায় না হেলমেট পড়ায় তবে গ্লাসের ভিতরে চোখ দেখা যাচ্ছে। অরুণের দৃষ্টি মহাভারতের শাকুনীর দৃষ্টির মতো লাগে পাতার কাছে। খানিকটা ঘাবরিয়ে যায়। বড়লোক ও সম্মানীয় মানুষ, প্রিন্সিপাল ম্যামের পরিচিত তাই স্যার সম্মোধন করেছে। ভুল হয়েছে কি? সে তড়িঘড়ি করে বাইক স্টার্ট করে বলে,
-” ভোর তোমার আব্বুর সাথেই যাও এই চার পা ওয়ালা গাড়িতে। এসি আছে আরামে যাবে গরমও লাগবে না। আর আমার বাইকে গরম লাগবে তারপর তুমি ছোটও ধরে রাখতে পারবে না! আসছি কেমন?”
ভোর ছলছল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে তার বাহু ঝাঁকিয়ে বলে,
-” আব্বু প্লিজ?”
অরুণ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এ কেমন জেদ।
-” ভোর তোমার মিস তোমাকে নিবে না দেখ চলে যাচ্ছে!”
পাতা বাইক স্টার্ট দিয়ে চোখ বড় বড় করে চায় অরুণ সরকারের দিকে! তাকে কালারিং বানাচ্ছে ছোট্ট বাচ্চার কাছে! হেলমেটের গ্লাস উপরে তুলে বলে,
-” আশ্চর্য! মি. ভোরের বাবা আমি কখন বললাম নেব না? আপনিই তো ছেলেকে আমার সাথে পাঠাতে চাচ্ছেন না! যেন আমি কোনো ছেলে ধরা!”
শেষের কথাটা বিড়বিড় করে বলে পাতা। অরুণ চোখ ছোট ছোট করে চায় পাতার দিকে। শারীরিক দিক ও কথাবার্তায় নিতান্তই কমবয়সী মনে হচ্ছে। আর স্যার থেকে মি. ভোরের বাবা! এ কেমন সম্মোধন? ভোর বাবার বাহু ঝাঁকিয়ে অনুরোধ করছে বারংবার।
-” দেখুন মিস লতা না পাতা?”
পাতা মুখ মোচরায়।
-” মি. ভোরের বাবা! লতা আমার বোনের নাম। আমার নাম পাতা । প-এ আ- কার পা, ত-এ আ-কার তা! পাতা সিম্পল।”
অরুণ বিরক্ত হয় বেশ,
-” মিস পাতা বাহার! শুনুন বাইক সাবধানে ও ধীরে চালাবেন বলে দিলাম! ভোর কখনো বাইকে চড়ে নি।”
ভোর বাবার পারমিশন পেয়ে খুশি হয়ে বাবার গালে চুমু খায়। অরুণ ছেলের কপালে চুমু দিয়ে দড়জা খুলে ভোরকে নামিয়ে দিল। ভোর পাতার পিছনে বসে পাতার পেট জড়িয়ে পিঠে মাথা রাখে। পাতা বলে,
-” ভোর সরকার শক্ত করে ধরবে কেমন? আর প্রবলেম হলে বলবে!”
ভোর মাথা নাড়ে। পাতা বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায়। অরুণ ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ড্রাইভারকে বলে,
-” ফলো হার!”
আভারি ফ্রন্ট সিটে বসে। স্কুল চলাকালীন সময় ভোরের সাথে স্কুলেই থাকে সে! এতক্ষণ চুপচাপ সব দেখছিল।
-” স্যার ম্যাডামটা ভালোই! সব বাচ্চাদেরই আদর করে! বাচ্চারা তাকে অনেক পছন্দ করে!”
অরুণ আভারির দিকে তাকিয়ে বলে,
-” বেশ খবর রেখেছ দেখছি আভারি ভাই?”
আভারি মাথা চুলকে হেসে বলে,
-” সব গার্জেনরা আলোচনা করে তো কানে আসে! তবে ম্যাডামটা একটু কিপ্টা মনে হয়!”
-” কি করে বুঝলে?”
-” সবাই বলাবলি করে তো! চাকরি করে নাস্তে একটি জুতাই পড়ে আসে! প্রতিদিন টিফিনেও নাকি শুধু রুটি ডিম! হাতে পুরনো ঘড়ি! ব্যাগটাও পুরনো! কতটাকা বেতন পায় অথচ..”
অরুণ জানালার কাঁচে হাত রেখে মাথা ঠেকিয়ে সামনে তাকায়। মিস পাতা বাহার তার ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছে।
-” আভারি ভাই একজোড়া জুতো বছর খানিক পায়ে দিলে? একই টিফিন রোজ খেলে? ব্যাগ , ঘড়ি পুরনো হলেই কিপ্টে হয়ে যায় কেউ? বুঝলে আভারি শুধু বেতন পেলাম আর ইচ্ছে মাফিক খরচ করলাম! সবার পরিস্থিতি এক হবে ? পরিস্থিতি বিবেচনা করে খরচ করতে হয়!”
আভারি বুঝল।
-” স্যার সবাই বলছিল আমি..”
-” তুমিও তো বললে? শোন লোকজন দূর থেকে দেখে পরিস্থিতি বিবেচনা না করে বস্তা বস্তা সমালোচনা করে হাসি ঠাট্টা করতে পারে! পারে না তাদের পাশে থেকে সাহস যোগাতে! বাস্তবতা অনেক কঠিন আভারি ভাই! আমার ছেলের পিছনে মাসে যত টাকা না খরচ করি, তার চেয়ে কম টাকায় অনেকে পুরো সংসার সামলাতে পারে।”
-” মিস আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”
ভোরের কথায় পাতা হেসে বলে,
-” কেন?”
-” এই যে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আর গতকালের জন্যও!”
-” তোমার বাবা বকেছিল তোমায়?
-” একটু একটু।”
-” ওহ! দেখো আজকের জেদের জন্যও বকবে। তোমার বাবা একটা নাক উঁচু লোক। দেখ এখনো পিছন পিছন আসছে। আমি কি তোমাকে কিডন্যাপ করব নাকি!”
ছোট ভোর খানিক ভেবে বলল,
-” আমার আব্বুর নাক তো ঠিকই আছে। উঁচু না। কাক্কুকে নামিয়ে দেবে স্কুলে তাই আসছে।”
পাতা হাসে খানিক। ড্রাইভে মনোযোগ দেয়। কিছু সময় পর মলিন স্বরে জিজ্ঞেস করে,
-” তোমার আব্বু তোমাকে অনেক ভালোবাসে তাই না?”
ভোর হাত প্রসারিত করে বলে
পাতা বাহার পর্ব ৩
-“অনেক। আব্বু বলেছে গাড়ি চালানোর সময় কথা বলতে নেই।”
বলেই কোমড় জড়িয়ে ধরে। পাতা আর কিছু জিজ্ঞাসা করে না। হেসে বাইক চালানোয় মনোযোগ দেয়।