তোমার জন্য সব পর্ব ১৪

তোমার জন্য সব পর্ব ১৪
রেহানা পুতুল

কলি মেঘমন্দ্র মুখে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“আমার পছন্দের খেতা পুড়ি। এক জীবনে যার একজন ছেলে বন্ধু জুটল না কপালে। তার আবার বিয়ের পাত্র পছন্দ। তার পছন্দের গুরুত্ব থাকলে এই কাহিনী করতে না তোমরা আমার সঙ্গে।”
কয়েকদিন আগে মাহমুদ যখন কলির সঙ্গে কথা বলল। তখনই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে সে,কলির সঙ্গে প্রেম নয় কেবল বন্ধুত্ব করাও যাবে না। সে বাসায় গিয়ে অবসর হয়ে মাকে নিজের রুমে ডাকলো। গম্ভীরমুখে বলল,

“মা কলিকে তোমার পুত্রবধূ করা যাবে না। বাদ দাও।”
“কেন? কলি রিফিউজড করেছে তোকে?”
শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো মাহফুজা।
মাহমুদ মাকে সব বলল ক্লিয়ার করে।
“আচ্ছা বুঝলাম। তোর কলিকে পছন্দ কিনা সেটা বল? বাকিটা আমি দেখছি।”
“হুম খারাপ না। যতটুকু দেখেছি ওকে। খুব ভালো মেয়ে মনে হয়েছে।”
হেয়ালি স্বরে জবাব দিলো মাহমুদ।
“খারাপ না মানে কি? দ্বিধায় থেকে বিয়ের মতো সিরিয়াস বিষয়ে এগোনো যায় না। স্পষ্ট করে বল। কলি মেয়েটাকে বিয়ে করতে চাস কি চাস না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কপালে ভাঁজ ফেলে ভ্রু কুঁচকে মৃদু ধমকে বলল মাহফুজা।
“চাই।”
নিচু স্বরে উত্তর দিলো মাহমুদ।
” গুড! তাহলে সনাতন পদ্ধতিতে যেতে হবে। তার বাবা মায়ের ফোন নাম্বার আছে তোর কাছে?”
“না। তাদের নাম্বার আমি কই পাবো?”
“তুই তাদের বাড়ি চিনিস না?”
“হুম। পৌঁছে দিলাম যেদিন। দেখলাম ত।”
“তাহলে বাড়ির কেয়ারটেকারের কাছ থেকে তার বাবার নাম্বার যোগাড় করে দে আমাকে। কালই দিস। লেট করিস না।”

রাতে মাহমুদ তার ডায়েরিটা নিয়ে বসলো টেবিলে। এই প্রথম কলিকে বা কোন মেয়েকে নিয়ে তার ডায়রিতে লিখা। রুল টানা ডায়েরির একটি খালি পৃষ্ঠায় সে লিখলো,
” পৃথিবীতে তীব্র যন্ত্রণাগুলোর মধ্যে একটি যন্ত্রণা হলো কাউকে কিছু বলতে চেয়েও বলতে না পারা।” আবার লিখলো,
“কিছুদিন ধরে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম আমি। রা*গ,ক্রোধ,বিরক্তি,অভিমান থেকেও যে ভালোলাগা জন্ম হতে পারে তা আমার কাছে অচিন্তনীয় ছিলো। বলা যায় আমার জীবনে এটা এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।

কে জানতো ক্লাসের শেষ বেঞ্চে ভর দুপুরের নিঃসঙ্গ গাঙচিলের মতো বসে থাকা শান্ত মেয়েটি আমার অবসরের কল্পনার সঙ্গী হবে। তার প্রতি আমি এক অজানা শিহরণ অনুভব করব। সে যত দূরে যায়। আমার হৃদয় তত তাকে কাছে চায়। তাকে আমি সামনের চেয়ে আড়ালে বেশি দেখি। আজকাল নিজেকে দিক হারিয়ে দিশেহারা নাবিকের মতো মনে হয়। সেই মেয়েটিই যেন আমার একমাত্র দিশা। ভালোবাসা বুঝি এমনি। যার কবলে পড়ে নিঃশ্ব হয়েছে ধরণীর কতশত মহাপুরুষগণ।”

মাহমুদ কলিকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে নিদ্রা-ঘোরে হারিয়ে যায়। তার পরেরদিন সে ভার্সিটি থেকে সোজা কলিদের বাসার নিচে চলে যায়। নাম্বার নিয়ে নেয় কলির বাবা নুরুল হকের। মাহমুদা আবদুর রহমানকে বলল কলির বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে। তিনি ফোন দিলেন কলির বাবাকে।
নুরুল হক রেবেকা,বড় মেয়ে মিলি,মিলির জামাই হারুনের সঙ্গে আলাপ করলেন। তারা সহমত জানালো সব শুনে। এভাবে ফোনালাপে মাহমুদের বাবা,মা ও কলির বাবা,মা কথা আদান প্রদান করলেন প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে। রেবেকা একজন মা। তাই মায়ের মনে খচখচানি ভাবটা প্রকট। মেয়ের ভবিষ্যত কতটুকু শান্তির হবে এই আশংকা থেকে বড় মেয়ের জামাইকে ডেকে আনলো বাসায়। এবং আদেশ দিয়ে বলল,

“ভালো করে পাত্র ও পাত্রের পরিবারের খোঁজ খবর নাও লুকিয়ে।”
“আচ্ছা আম্মা। অবশ্যই। ”
জুলি বড় দুলাভাইকে দারুণ পছন্দ করে। এর বড় একটা কারণ দুলাভাইকে ভুলিয়ে ভালিয়ে মাঝে মাঝে তার প্রয়োজনীয় জিনিস আদায় করে নেয়। জুলি হারুনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“শাশুড়ী আম্মার হুকুম পালন করেন। চাপা স্বভাবের মেজো শালির জ্বালা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এবার তার দুলহা নির্বাচনে গরু দায়িত্ব পালন করেন।”

“দেখলেন আম্মা আমাকে গরু বলল জুলি।”
অধিকার সুলভ কন্ঠে নালিশ দেওয়ার মতো করে বলল হারুন।
“থুক্কু। থুক্কু। গুরু বলতে গিয়ে গরু বলে ফেলছি দুলহা ভাই।”
“হারুন তুমি যাওতো বাবা। এই ট্যাটনা থাম। কাজের সময় ফাইজলামি করে। তুই স্থির থাকতে পারস না মেয়ে? সারাদিন টইটই করিস। তোর দরকার ছিলো গ্রামে থাকা। বান্দরের মতন গাছে গাছে লটকালটকি করবি।”
জুলি ধুম করে হেসে ফেলে। মাকে বলল,
“তাহলে আমাকে তোমার সারাদিন কলা দিতে হতও। ইয়া বড় বড় কাঁদি কাঁদি কলা।”

হারুন তিন চারদিন সময় ব্যয় করে পাত্রের তথ্য যোগাড় করলো। শ্বশুরের বাসায় গিয়ে জানালো সব।
” আম্মা যতটকু জানতে পেরেছি ছেলে ভালো। চরিত্রবান। কর্মঠ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক। তবে ইতঃপূর্বে কোন মেয়ের সঙ্গে রিলেশন ছিল কিনা বা ব্রেকাপ হয়েছে কিনা জানা যায়নি। আর এটা তাদের নিজস্ব ফ্ল্যাট। তার বাবাও বসে নেই। শেয়ার বাজারে অংশীদার আছে। গ্রামে ঘরবাড়ি আছে। তারা প্রতিবছর যাওয়া আসা করে। বাসায় সর্বদা একজন গৃহপরিচারিকা নিযুক্ত আছে তাদের। ”
” ছেলের রিলেশন নাই। থাকলে তাকেই বিয়ে করতো। ছেলেরা ফ্যামিলি ম্যানেজ করে নিতে তেমন সমস্যা হয় না। সুতরাং এটা নিয়ে আমার মনে ঘাপলা নেই।”

” আম্মা কুমিল্লার ছেলে কিন্তু ইতর। বদমায়েশ। কলির মতামত নিতে হবে সব বলে।”
“সেটা আমি দেখছি। তুমি এখন আসতে পারো কাজ থাকলে।”
দুই পরিবারের সব পছন্দে মিলে গেলো। রেবেকা ফোন দিলেন মাহফুজাকে। বললেন,
“আপা ছেলে মেয়ে একবার দেখা করে কথা বলে নেওয়া দরকার। নাকি বলেন? ওরা এখন এডাল্ট। তাদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়ার দরকার আপা।”
“আপা, আপনি ও ভাই কি একটু আমাদের সঙ্গে বাইরে দেখা করবেন। দরকার ছিলো। কলি যেন না জানে। সেভাবেই আসবেন।”

বিনীত গলায় বলল মাহফুজা।
রেবেকা তব্দা খেলো। তবুও বলল,
“আপা আমি সময়টা আপনার বাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে জানিয়ে দিবো।”
তার দুইদিন পর এক বিকেলে লালবাগ একটি রেস্টুরেন্টে মাহমুদের বাবা, মা ও কলির বাবা মা মুখোমুখি চেয়ারে বসলো। হালকা নাস্তার অর্ডার দিলো আবদুর রহমান। তিনি হৃদ্যতাপূর্ণ স্বরে বললেন,
“আপা, ভাই সাহেব ,কলিকে আমরা একটা সারপ্রাইজড দিতে চাই। পাত্রপক্ষের পরিচয়টা তার কাছে আপাতত গোপন রাখবেন।”

রেবেকা ও নুরুল হক একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন সন্দেহভাজন চোখে। তা দেখে হাসলেন মাহফুজা। তিনি নিজের মতো করে সব বুঝিয়ে বললেন কলির মা বাবাকে।
রেবেকা স্মিত হেসে বলল,
“হুম বুঝিয়ে বলাতে বুঝলাম আপা। কিন্তু কলি যখন দেখবে তার টিচার। তখন ত বেঁকে বসবে। যেহেতু তাদের মাঝে অন্য সম্পর্ক নেই।”
“আপা,ভাই সেটা আমার উপর ছেড়ে দিন। আমি সিচুয়েশন ও কলিকে হ্যান্ডেল করবো।”

এই ভিতরে মাহমুদ আর কোন কথা বলেনি কলির সঙ্গে। পড়াশোনা, ক্লাসের প্রয়োজনে যতটুকু দরকার। ঠিক ততটুকুই বলেছে। খেয়া ভার্সিটি আসছে না। মিসেস হেড খবর নিলো নিলো খেয়ার। জানা গেলো খেয়া এই সেমিস্টার ড্রপ দিয়েছে। কারণ তার চিকিৎসার জন্য পরিবার তাকে নিয়ে চেন্নাইতে চলে গিয়েছে। এতে মাহমুদ স্বস্তিবোধ করলো দুটো কারণে। এক খেয়ার ডিস্ট্রাব হতে রেহাই। দুই কলির সঙ্গে টুকটাক কথা বলা যাবে নানান বাহানায়। খেয়া দেখলে জেলাস ফিল করতো।

কলিকে মাত্র দুদিন আগে জানানো হলো আজ তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। তাদের সবার পছন্দ হয়েছে। কলির মিডটার্ম পরিক্ষা শুরু হলে বলে মাহমুদের পরিবারের সঙ্গে কলির পরিবারের কথা চালাচালি সবকিছুই গোপন রইলো। কলি দুঃখমাখা কন্ঠে বলল,
“আশ্চর্য! পনেরোদিন ধরে তোমরা দেখাদেখি করছো। অথচ আমি কিছুই জানিনা?”
সর্বদা খিটমিটে মেজাজে ডুবে থাকা রেবেকা হই হই করে উঠলো না মেয়ের উপর। মেয়ের অভিমানকে প্রশ্রয় দিয়ে শান্ত গলায় শান্তনার ভঙ্গিতে বলল,

“তোর পরিক্ষা চলতেছিলো। তাই তোর বাবা বলল তোকে যেনো না জানাই। পড়াশোনার ক্ষতি হবে মন অন্যদিকে গেলে। কোন মা বাবা তার সন্তানের খারাপ চায়না। যেভাবে ভালো হয়,মঙ্গল হয়। সেটাই চায় নিজেদের ক্ষতি করে হলেও। আমরা তাদের মানা করেছি কত। শুনলই না। বলল সামনাসামনি এসে এক কাপ চা খাবে। আর কিছুই না। বারবার করে বাসায় আসতে চাইলে মানা করা যায় বল?”
“ছেলে কি করে আম্মু?”

“কোন প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। পরশু আসুক। দেখবি। তোর অমতে কিছুই হবে না। আমাদের যতই ভালোলাগুক। তোর দুলাভাই ছেলে দেখেছে। তার খুব পছন্দ হয়েছে।”
“তারা কয়জন আসবে?”
“তিনজন ত বলল। চা,নাস্তা খাবে একটু।”
কলি এই দুইদিন গোমড়া মুখে ছিলো। কিন্তু বাবা মায়ের মুখের উপরে অতিরিক্ত কিছুই বলল না আর। মিলি ও হারুন চলে এসেছে। কলি বলল,

“এই সামান্যতে তোরা কেন এলি আপা?”
“আজব? আমাদের বাসায় আমি এনিটাইম আসতে পারি না।”
হেসে জবাব দিলো মিলি।
কলি শাড়ি পরে রেডি হয়ে বসে আছে। তার রুম ভিতরে। তাই ড্রয়িংরুমে কে বা কারা এলো কলি টের পায়নি। সেখানে বসে আছে নুরুল হক,হারুন,মিলি, রেবেকা,জুলি,আবদুর রহমান, মাহফুজা ও আনুশকা। রেবেকা, মাহফুজাকে বলল,
“আপা তুফান আপনি সামলাবেন কিন্তু।”
মাহফুজা সরস হেসে আস্বস্ত করলো রেবেকাকে।

মিলিকে বললো রেবেকা, কলিকে নিয়ে আসতে সঙ্গে করে। সবার বুকের ভিতর টিমটিম করছে লন্ঠনের নিভে আসা আলোর মতো। কলির বুকের গহীনেও দ্রিমদ্রিম বাজছে। এভাবে আর কোন পাত্রপক্ষের সামনে সে যায়নি।
শাড়ি পরিহিতা কলি লজ্জাশীলা নারীর মতো ড্রয়িংরুমে পা রেখে সবাইকে মুখে সালাম দিলো। মাহফুজাকে দেখে কলি অতি বিস্মিত হলো । তবুও ধরে নিলো পাত্রপক্ষের কোন রিলেটিভ হবে হয়তো তারা।
“আন্টি আপনি? উনি আনুশকা আপু না?”
চমকানো সুরে বলল কলি।
“আসো মা। কাছে এসো। বসো। আমাকে ত আর তুমি তোমাদের বাসায় আসতে বললে না। তাই নিজেই চলে এলাম গল্প করতে।”

কলি মিশ্র অনুভূতির করাতলে ঘায়েল হয়ে যাচ্ছে। মাহফুজার পাশে গিয়ে বসলো। সবার মুখ হাসি হাসি। মিলি ও জুলি মিলে দুই তিন ট্রে ভর্তি বাহারি পদের নাস্তা পরিবেশন করে দিলো সবাইকে। কলি বাবা মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে বোকা বোকা চোখে। সবাই নাস্তা খেয়ে নিলো। মাহফুজা কলির হাত ধরে নুরুল হকের দিকে চেয়ে বলল,
“ভাইসাহেব আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের কোন আপত্তি নেই আপনাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে।”
নুরুল হক ও রেবেকা আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো।
মাহফুজা কলিকে বলল,

“তোমার পরিবারের কারো বিন্দুমাত্র দোষ নেই। তুমি তাদের উপর মনঃক্ষুন্ন হতে পারবে না। তোমার পরিক্ষা ছিলো বলে আর তোমাকে সারপ্রাইজড দেওয়ার জন্য আমিই একটু লুকোচুরির আশ্রয় নিলাম মা। উনারা আমার অনুরোধেই চুপ ছিলো। তুমি ছোট বাচ্চা নও। আশাকরি বুঝতে পেরেছো।”
“আন্টি আমি কিছুই বুঝতেছি না।”
“তোমাকে সারাজীবনের জন্য আমার কাছে নিতে যেতে চাই। আপত্তি আছে মা?”
মাহফুজার কন্ঠে স্নেহ ঝরে পড়ছে।
কলি হকচকিয়ে গেলো। বলল,
“কিভাবে আন্টি?”
“তোমার মাহমুদ স্যারের বউ করে।”
প্রীতিময় কন্ঠে বলল আনুশকা।

তোমার জন্য সব পর্ব ১৩

কলির মাথায় যেন আকস্মিক বজ্রপাত হলো। তার সমস্ত শরীর দুলে উঠলো। চোখ বড় বড় করে কপালে তুলে সে কিইই বলে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আতংকিত গলায় একবাক্যে বলে উঠলো,
“অসম্ভব আন্টি! মরে গেলেও আমি এটা পারব না। উনাকে স্যার হিসেবে আমি শ্রদ্ধা করি। অন্যচোখে দেখা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব! আমাকে ক্ষমা করবেন।”

তোমার জন্য সব পর্ব ১৫