যাতনা আমার পর্ব ৩১ (২)
সানজিদা ইসলাম সূচনা
বাড়িটা কাঠের বাংলো বাড়ি। শহরের থেকে বেশ কিছুটা দুরেই। সন্ধ্যার পরেই নির্জন হয়ে আছে চারপাশ। বাড়ি টা ফাহাদ কে তার দাদু ছোট বেলায় কিনে দিয়েছিলেন। ফাহাদের জন্য এটা নিরিবিলি প্রাকৃতিক দৃশ্যের সাথে মিলে যাওয়ার বেস্ট একটা জোন।পুড়ো বাড়িটা জুড়েই সাদা বাতি চারপাশ আলোকিত করে রেখেছে। গোল আকৃতির কাঠের বাড়িটির একপাশে বড় লিভিং রুম। সেখানের কাঠের কারুকার্যের সোফা রাখা। লিভিং রুমের বিশালতার মাঝে এখন শুধু সোফা গুলোই ঠিক আছে। বাকিসব ধ্বংস স্তুপে পরিনত হয়ে আছে।
আর সেগুলো করছে নিধি। তখন রাস্তা থেকে সবাই ফাহাদের এই বাংলো বাড়িতে এসেছিলো। এখানে কি ঘটবে? তা নিধি আর ইনায়া ছাড়া সবাই অবগত ছিলো। মাঝরাস্তায় ইশানকে অবশ্য নিধি জিজ্ঞেস করে ছিলো। কোথায় যাচ্ছে তারা? ইশানের একটাই ছোট উত্তর ছিলো। তারা ঘুড়তে যাচ্ছে। বাংলোতে এসে কাজি, রেজিস্ট্রার দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলো নিধি। তার হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিলো ফাহাদ সোহানা মির্জাকে কি বলেছিলো। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলালো ইনায়াও। তাদের ভাবনা সত্য হয় যখন, সত্যিই ফাহাদ বলে, সে নিধিকে এক্ষুনি বিয়ে করবে। দ্বিমত পোষণ করা নিধি অনেক চেষ্টা করেছিলো বিয়ে টা আটকাতে। সাথে ইনায়া ও। তার কাছে সবটাই এখন বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল। সে ফাহাদ কে বোঝাতে চেয়েছিলো, ফাহাদ নিধির জন্য ঠিক হলেও এখন বিয়ের সঠিক সময় নয়। কিন্তু কি আর করার তিথি আর ইশানও ফাহাদের সাথেই ছিলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শেষ মুহূর্তে নিধি কবুল বলেছিলো ফাহাদের কথায়। নাভানের একটা ভিডিও দেখায় ফাহাদ নিধি কে। তার কথছিলো, জায়ান নাভান কে আটকে রেখেছে। নিধি যদি কবুল না বলে তাহলে খারাপ হয়ে যাবে।
এযাবৎ ইনায়া ও দমে যায়। রাজনৈতিক নেতাদের আর বিশ্বাস কি? জায়ান গুন্ডা সব করতে পারে। কিন্তু, আসল ফোকাস আসে বিয়ের পর নাভানকে সুস্থ সবল দেখে। নাভানের কাহিনী তাদের প্লেন অনুযায়ী ছিলো। তৎক্ষনাৎ নিধি ভিষন রেগে যায়। অতঃপর এই কান্ড ঘটায় বাংলোতে। অতিরিক্ত ডেসপায়ার হয়ে যাওয়ায় নিধিকে এখন ইঞ্জেক্ট করে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। তিথি সোফায় বসে ফেক নেইল ঠিক করছে। নিধিকে থামাতে গিয়ে তার অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। ইনায়া তার পাশে চুপচাপ বসে আছে। ইশান নাভান দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ইশান ভয়ে ভয়ে নাভান কে বলে,
-” যাই বলো ভাইয়া আমি বাড়িতে যেতে পারবোনা। বড়মা নিশ্চয়ই রণমুর্তি ধারন করে আছে। ”
-” কাজটা ঘটানোর আগে কই ছিলো আপনার ভয়? এটাকি আদেও ঠিক করেছেন আপনারা? ”
নাভান কিছু বলার আগেই দুজন কে জিজ্ঞেস করে ইনায়া। দু’জনেই চুপচাপ হয়ে থাকে। তিথি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনায়ার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
-” তুমি একটু বেশিই টেনশন করছো ইনায়া। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। ”
তিথি রিলাক্স মুডে বাড়ির বাইরে চলে যায়। ইশানও তার পিছু নিল। ফাহাদ আপাতত নিধির কাছে আছে। জলদি বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইনায়া হলরুমে দাঁড়ানো নাভানের দিকে দৃষ্টিপাত করেছে। এ-ই কদিনে চেহারার হাল খুবই করুন হয়েছে নাভানের। চোখের নিচের কালো দাগ ফর্সা মুখটায় জ্বলজ্বল করছে। নাভান শান্ত পায়ে হেঁটে ইনায়ার সম্মুখীন হয়। জিভ দিয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে হালকা হেসে বলে,
-” আই নো ইনায়া তুমি আজকের বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছো না। কিন্তু ফাহাদ নিধির জন্য পারফেক্ট। কলুষিত এই সমাজে নিধি পারফেক্ট জীবন সঙ্গী ছাড়া চলতে পারবেনা। পদে পদে তার অতীতের সেই দিন তাকে লোকজন মনে করিয়ে দেবে। ”
ইনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতঃপর নাভানের প্রায় বিধে যাওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,
-” তা আপনি জানেন না? নিধি ফাহাদ ভাইকে পছন্দ করে না। কি করে এতো কিছুর পর সে স্বাভাবিক হতে পারবে নাভান? একটু সময় দিতেন। জোর করে কিছুই ভালো হয় না। ”
নাভান ম্লান হাসলো। তারপর মিনমিন গলায় বলে ওঠে,
-” আসলেই, জোড় করে কিছুই ভালো হয় না। যেমন তুমি আর আমি। আবার কিছু ক্ষেত্রে হয়। আমি অধম আমার ভালোটা বুঝতে পারিনি। আশা করি নিধি আমার মতো ভুল করবে না। সে মেনে নিবে সবটা। ”
-” বিয়েতে রাজি ছিলেন না আমাকে বলতে পারতেন। আমি পিছু হাটতাম নাভান। কিন্তু বাবা-মা এর রাগ আপনি আমি অবুঝের প্রতি ঝেড়েছেন। তারপর বউ থাকতেও অন্য নাড়ীর সংস্পর্শে ছিলেন আপনি। যা আমাকে খুব পুড়িয়েছে নাভান। যদি বাবা-মা থাকতো, আপনার যাওয়ার পরেরদিনই মির্জা বাড়ি থেকে নিয়ে আসতো। সেখানেই আপনার আর আমার সম্পর্কের ইতি ঘটতো। আর না আপনি নয় মাস পর ফিরে এসে আমার কাছে মাফ চাইতেন। সবটা হয়েছে আমার কপালের জন্য। সেই জন্যই নিজের আত্মসম্মান গুলিয়ে আপনার বাড়িতে থাকতে হয়েছে আমাকে৷ যাইহোক সবশেষে ডিভোর্স তো হয়ে গেছে আমাদের। ”
নাভান নিশ্চুপ হয়ে থাকলো। কথাগুলো চরম সত্য। নাভান ভাবলো আসলেই, সে কানাডায় থাকা দিন গুলোতে একদিনও ইনায়ার কথা মনে করেনি। অদিতির সত্য জানার পরেও না। অদিতি না গেলে সে বাড়ির দিকে আসতো না। ইনফেক্ট, সে এসেছিল ইনায়া কে মুক্ত করতে।
নাভান কিছু বলার আগেই সেখানে আগমন ঘটে জায়ানের। ইনায়া তার দিকেও ক্ষেপা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। জায়ান তা দেখে চমৎকার হাসলো। ইনায়া রেগে গিয়ে জায়ানের সামনে দাঁড়ায়।
-” এইসব কিছু আপনার প্লেন তাই না? আপনিই ফাহাদ ভাইকে উসকিয়েছন। ”
জায়ান মাথায় বাজ পরার মতো রিয়াকশন দিলো। অসহায় মুখ করে বলে ওঠে,
-” ট্রাস্ট মি হরিণী, আমি দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবদি ঘুমিয়ে ছিলাম। খবর পেয়ে মাত্রই আসলাম। তুমি আমাকে মিথ্যা দোষারোপ করেছো? ”
-” আপনাদের বিশ্বাস নেই। ”
কথাটা বলে ইনায়া নিধিকে যে রুমে রাখা হয়েছে সেখানে যায়। জায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনায়ার যাওয়ায় দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে ওঠে,
-” তুমি আমাকে আজোও ঠিকঠাক বুঝতে পারলে না হরিণী? ”
নাভান এতোক্ষণ ইনায়া আর জায়ানের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার মস্তিষ্কে শুধু ইনায়ার কথাই বাজছে। জায়ান ডানপাশে নাভানের দিকে লক্ষ্য করে। তারপর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে অদিতির বিষয়ে জানতে চায়। নাভান জানায় অদিতি এখোনও ভিডিও ফুটেজ দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছে। জায়ান আর নাভান ও সেই রুমের দিকে অগ্রসর হয়। ইনায়া রুমে ঢুকতেই দেখতে পায় ফাহাদ নিধির শিয়রে বসে আছে। নিধি এখনো ঘুমে। ফাহাদ ইনায়া কে দেখে ম্লান হাসলো। অতঃপর বলতে শুরু করলো,
-” এইছাড়া আমার কাছে আর কোনো রাস্তা ছিলো না ইনায়া। বাবা-মা ও আমার পক্ষে ছিলো না। এদিকে নাভানের বাড়ির লোকজনও বেঁকে বসেছিল। তারপর আবার অদিতি, সেই নিধিকে লোক দিয়ে গ্যাং রেপ করিয়েছে। আবার সেটার ফুটেজ দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছে নাভান কে। অদিতি আমাদের হাতে ছোয়ার বাইরে। সে যদি একবার ভিডিও লিংক শেয়ার করে দেয়, বুঝতে পারছো কি হবে? নিধি কে পাওয়ার আকাঙ্খা আমার শেষ হয়ে যেতো। তাই এই পদক্ষেপ। ”
সব শুনে ইনায়া বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। অদিতি কে আর কতো ভাবে ঘৃণা করা যায়? তার সেটা জানা নেই। একটা বাচ্চা মেয়েকে তার আর নাভানের মাঝে এনে সে ভুল করেছে। পরক্ষনেই ইনায়ার মনে হলো এইসবের জন্য নাভান দায়ী। তার ভুলের মাশুল নিধিকে গুনতে হচ্ছে। নাভান কে তার পরিবার অনেক সুযোগ দিয়েছিলো অদিতি কে ছাড়তে। শেষ সুযোগ টা ছিলো ইনায়া। সেটাতেও নাভান ব্যর্থ। কখনো কখনো কিছু ভুলের মাশুল অনেক কষ্টে দিতে হয়। আবারো কিছু ভুল নতুন ভোরের সন্ধান দেখায়। নাভান সে ভোর দেখতে পারেনি। ইনায়া মলিন মুকের নিধির দিকে তাকালো। এই মেয়েটা কেনো এতোকিছু সাফার করবে? ইনায়া ভাবনায় মশুল হতেই সেখানে নাভান জায়ানের আগমন। জায়ান ফাহাদের পাশে এসে দাঁড়াতেই সে বলে ওঠে,
-” কি ব্যাপার? বাড়িতে সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো? মাকে বুঝিয়েছিস তো? ”
জায়ানের মনে পরে বাড়ির কথা। সে তো মাকে বুঝাতে গিয়ে আরও আগুন জ্বালিয়ে এসেছে। তার হঠাৎ মিজানুল করিমের জন্য খুব মায়া হলো। না জানি তার বাবা কি সহ্য করছে। জায়ান ফাহাদের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলে ওঠে,
-” সেসব বাদ দে। একটুতো ঝামেলা বাড়বেই। তুমি একটা কাজ করো, নিধি কে এখুনি বাড়িতে নিয়ে চলো। ডোজ শেষ হবার আগেই। মায়ের বরন বাদ। সে জেগে গেলে তোমার বাড়ি যেতে চাইবে কিনা সন্দেহ। ”
ফাহাদ মাথা ঝাকায়। আসলেই জায়ানের বুদ্ধি উত্তম। সে নাভান কে বললো গাড়ি বের করতে। নাভান যেতেই ফাহাদ নিধিকে কোলে তুলে নিলো। তারপর অগ্রসর হয় বাইরে। জায়ান যেতে নিলেই ইনায়া তার সামনে এসে দাড়ায়।
-” আপনি কি করে জানলেন? নিধিকে ঘুমের ঔষধ ইঞ্জেক্ট করা হয়েছে? ”
জায়ান উত্তর দিলো না। ইনায়ার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো। ইনায়া রেগে গিয়ে বলে ওঠে,
-” কারণ টা আমিই বলছি। এইসব প্লেন আপনার করা ছিলো। ”
এবারও কিচ্ছু বললোনা জায়ান। ইনায়া শাসানোর ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
-” নিধির জ্ঞান ফিরলে আপনার নামটাই প্রথম বলবো। তারপর, এই বাড়ির জিনিসপত্রের মতো আপনার অবস্থা হবে। ”
জায়ানের হাসি আরো চওড়া হলো। ইনায়া বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো,
যাতনা আমার পর্ব ৩১
-” আপনি একটা হিংস্র বাঘ। ”
কথাটা দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েও থেমে যায় ইনায়া। আবার পিছু ফিরতে গেলেই জায়ান চওড়া গলায় বলে,
-” ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু ফিরো না নিরীহ হরিণী। এই বাঘ কিন্তু নিমিষেই বগল দাবা করে ফেলবে। ”
ইনায়া আর ফিরলো না। রাগ দেখিয়ে হনহন করে বেড়িয়ে গেলো। জায়ান এবার মুচকি হেসে ইনায়ার পথ অনুসরণ করে।