পাতা বাহার পর্ব ৭
বেলা শেখ
আরিয়ান ড্রয়িংরুমে এগিয়ে এসে অরুণের পাশে বসে। মেয়ের দিকে ক্ষনিকপল গম্ভীর মুখে বলে,
-” আনিকা এটা কেমন দুষ্টুমি? কাল তোমার জন্য ভোর কত গুলো বকা শুনলো মারও খেলো অরুণের হাতে!! ভোরের হাত ধরে স্যরি বলো? আর তুমি এমনি এমনি বকা শোনো না! খুব দুষ্টু হয়েছ! এরকম চললে বোডিং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিব বলেদিলাম? আর ভাই আমি কোন মুখে স্যরি বলবো! ভাই আমি..”
অরুন তাকে থামিয়ে দিল।
-” কি বলছিস এসব! না তোকে স্যরি বলতে হবে! না মামনিকে! ওরা বাচ্চা মানুষ ভুল হতেই পারে! বুঝিয়ে বললেই হয়! আর মামনিকে কিছু বলবি না বলে দিলাম! ও ভুল বুঝতে পেরেছে! আর কখনও মিথ্যে বলবে না! তাই না মামনি?”
আনিকা কেঁদেই দিল! কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
-” কখনো বলবো না! স্যরি ভোর! স্যরি চাচ্চু স্যরি আব্বু!”
অরুণ তাকে আদর করে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” মামনি কাঁদছ কেন? কেউ বকে নি তোমায়! কাঁদে না লক্ষিটি! কাঁদলে আনিবুড়ি কে পঁচা লাগে তো! কাঁদে না! নেক্সট ফ্রাইডে ভোর আমি তুমি পার্কে যাবো ঘুরতে! অনেক মজাও করবো! যাবে না তুমি? ”
আনিকা চোখ মুছে মাথা নাড়িয়ে জানায় সে যাবে! অরুণ আনিকার গাল মুছে সেথায় চুমু দিল। ভোর এতক্ষণ সব দেখছিল তীক্ষ্ণ চোখে। এবার অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত রেখে ঝগড়ার ভঙিতে বলে,
-” এই আনি বুড়ি তুই আমার আব্বুর আদর খাচ্ছিস কেন? হুম?”
আনিকা পিট পিট করে ভোরকে দেখে হেসে অরুণের গলা জড়িয়ে বলে,
-” আমার বড় চাচ্চু হয় তাই!!”
আরিয়ান ভোরকে কোলে বসিয়ে আদর করে বলে,
-” নাও তোমাকেও আদর করে দিলাম!”
ভোর আদর পেয়ে হেসে কুটিকুটি! আসমা বেগম সোফায় বসে নাতি নাতনি ও ছেলেদের খুনসুটি দেখতে থাকে! সবাই হাসি খুশি! আরিয়ান ভোরকে জিজ্ঞেস করে,
-” তোমার এক্সাম কবে থেকে হবে যেন? আনিকার তো স্যাটারডে থেকে।”
অরুণ ছেলের দিকে তাকায়! পরীক্ষার কথা তো সে কিছু জানে না! ভোর তাকে কিছু বলে নি তো। ভোরের মুখ এইটুকুনি হয়ে যায়! বেশ আদর খাচ্ছিল এখন এক্সামের কথা বলে মুড টা নষ্ট করার কি দরকার ছিল!! এই চাচ্চুটাও না! তার পর বাবার সামনেই বলতে হলো! অরুণ চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে ছেলেকে বলে,
-” কই আমাকে তো এক্সামের ব্যাপারে কিছু বললে না? কবে থেকে এক্সাম? ডেট দিয়েছে?”
ভোর চোখ পিটপিট করে হেহে করে হেসে বলে,
-” আমাদের স্কুলেও স্যাটারডে থেকে হবে! আব্বু তোমাকে বলবো মনেই ছিল না! আমি সব পড়া কমপ্লিট করেছি তো! মিস টুম্পা পড়িয়েছেন সব!”
অরুণ মুখটা পুনরায় গম্ভীর বানিয়ে নেয়। তার খোঁজ নেয়া উচিত ছিল! বাচ্চারা তো এক্সাম দেখে ভয় পাবেই! আর ভোর প্রথমবার এক্সাম দেবে! পড়াশোনা এমনি মোটামুটি পাড়ে। তবে গার্জেন হিসেবে তার সম্পূর্ণ ধ্যান দেয়া উচিত ছিল!
টিভিতে কাপিল শর্মা শো চলছে। সেলিব্রিটি নিয়ে জমজমাট শো! কাপিল শর্মার সেন্স ওফ হিউমার ভালো। লোক হাসাতে পারে বেশ! লতা পাতা দুজনেই শো দেখছে আর হাসিতে ফেটে পড়ছে। পাতা খাচ্ছে আর শো দেখছে। বেশি হাসার ফলে বার বার খাবার গলায় আটকাচ্ছে তাই পানির জগ নিয়েই বসেছে তবুও শো দেখতেই হবে। দু বোন খুব মজে আছে টিভির শোতে! তাদের মজায় বাগরা দিতে ক্রলিং বেল বেজে ওঠে! দু বোন একে অপরের দিকে চায়! বাবা ভাই এসেছে বোধহয়! কিন্তু প্রশ্ন হলো কে গিয়ে দরজা খুলবে এই আনন্দ ভঙ্গ করে! পাতা যেহেতু খাচ্ছে তাই লতা কাঁদো কাঁদো মুখ বানিয়ে চলে যায় দরজা খুলতে। পাতার মনোযোগও সেদিকেই! দরজা খুলতেই আতিকুর ইসলাম,লুবমান , রুম্পা ও লাবিব ভিতরে ঢুকে। আতিকুর ইসলামের হাতে আইসক্রিমের ব্যাগ।লাবিব নানার আরেক হাত ধরে। লুবমানের কোলে রুম্পা ঘুমিয়ে!লতা ভাইয়ের কোল থেকে লতাকে কোলে নেয়!
-” আমার আম্মুটা ঘুমিয়ে পড়েছে দেখছি! কখন ঘুমিয়েছে?”
লুবমান হাত ঝাঁকিয়ে বলে,
-” গাড়িতেই! আপু তোর মেয়ে বাজারে যা দেখবে তার জন্যই কান্না শুরু করে দেবে! রাস্তায় কুত্তার বাচ্চা গুলোকে দেখে সে কি কান্না! তাদের ধরবে আদর করবে!”
বলেই হাসতে থাকে । লতা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বলে,
-” মামার মতোই হয়েছে তো তাই! আব্বু আমাদের জন্য কি এনেছো?”
আতিকুর রহমান আইসক্রিমের পলি দেখিয়ে সোফায় বসে হাসি মুখে বলেন,
-” সবার জন্যই আইস্ক্রিম এনেছি! যে যার যার টা নিয়ে নাও! জলদি নইলে গলে যাবে তো!”
বলে সামনে তাকায়! পাতা ভাতের প্লেট নিয়ে বসে। এঁটো হাত তার! এভাবে আতিকুর রহমান সামনে বসায় ইতস্তত বোধ করে! লজ্জাও পায় খানিকটা! চৌদ্দ পনের বছর পর্যন্ত যাকে খালু ডেকে এসেছে হুট করে আব্বু ডাকা ব্যপারটা অনেক অস্বস্তি জনক! পাতা এবাড়ি আসার পর প্রথম প্রথম তো তার সামনেই যেত না! লুকিয়ে লুকিয়ে থাকত! ভয় হতো! বকা না দেয় আবার! আতিকুর রহমান কখনো ডেকে এনে সে ভয় ভাঙায় নি! পারলে তাকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা যায় চলেছে! পাতা ভাতের প্লেট নিয়ে উঠে যেতে নিলে আতিকুর রহমান ডাক দেয় তাকে,
-” শোন?”
পাতা ঢোক গিলে পিছনে ফিরে তাকায়! আতিকুর রহমান খুব দরকার ছাড়া পারত পক্ষে তার সাথে কথা বলে না!
-” জি আব্বু?”
আতিকুর রহমান পলি থেকে একটা কোন আইসক্রিম বের করে পাতার দিকে বাড়িয়ে বলে,
-” তোমার ভাগেরটা!”
পাতার চোখ জ্বলছে! চোখের পানি বেইমানি না করে বসে!! পাতা ডান হাত এঁটো থাকায় বাম হাতে প্লেট ধরেছিল। এখন ডান হাতে প্লেট নিয়ে ডান হাত খানিকটা বাম হাতে ঠেটিয়ে আইসক্রিম হাতে নেয়। মুচকি হাসে তার ফেভারিট বাটার স্কচ ফ্লেভারের! নিশ্চয়ই লুবমান ভাই বলেছিল।
-” ভাগের আইসক্রিম তো দিলে! আমার ভাগের ভালোবাসা,যত্ন, স্নেহ কখন দিবে আব্বু? আপু ভাইয়ের মতো কেন আদর করে ডাক না? বকা দাও না? ভালোবেসে খাইয়ে দাও না? মাথায় হাত বুলিয়ে দাও না! ভাই আপুর জ্বর হলে কত আদর কর! জল পট্টি দিয়ে সারারাত সিয়রে বসে থাকো অথচ আমার বেলায় ওষুধ এনে দিয়েই দায়িত্ব শেষ? ওদের পছন্দের খাবার সদাই আনো! আমারটা কেন আনো না? আনবে কি করে জানোই তো না! আপুর চাকরি হলে পুরো এলাকাবাসীকে মিষ্টি বিতরন করেছিলে আমার বেলায় কেন দাও নি? আপু ভাইয়ের সাথে কত কথা বলো! আমার সাথে কেন বল না? আমার ভাগের আইসক্রিমের সাথে আমার আমার ভাগের ভালোবাসা যত্ন স্নেহটাও চাই আব্বু? তোমরা আমাকে চাও নি! অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে এসেছি সেটার দায়ভার তোমাদেরও! কিন্তু এতে আমার কি দোষ আব্বু? এতে তো আমার হাত নেই ,তাই না? আমি কেন আব্বু আম্মুর ভালোবাসা থেকে বঞ্ছিত?কেন শুধু দায়িত্ব হয়ে পড়ে আছি?”
কম্পমান গলায় কথাগুলো বলে পাতা উত্তরের অপেক্ষায় থাকে না। অশ্রু চোখে চলে যায়! সে জানে কোনো উত্তর পাবে না সে! আর না ভালোবাসা!যত্ন ! স্নেহ! সে তো শুধু দায়িত্ব! ইশ তার যদি নির্ভরযোগ্য কোনো যাওয়ার জায়গা থাকতো! সেখানেই চলে যেত! এভাবে থাকতে তার আর ভালো লাগে না!
আতিকুর ইসলাম কিছু বলে না। চুপচাপ বসে। মুখাবয়ব গম্ভীর হয়ে গেছে।লতা এসে বাবার কাঁধে হাত রাখল। আতিকুর প্রতিক্রিয়া দেখায় না। লাবনী আক্তার গোসলে আছেন তাই তার দেখা নেই। লুবমান চুপ করে বসে পড়ে সোফায়! সকালে বাবার বকা শোনার পর এখন আর বলার মতো সাহস নেই! তবে অবাক হয়েছে পাতা এভাবে সরাসরি বাবার কাছে নিজের আকুলতা প্রকাশ করবে!! তবে খুশিও হয়েছে! কঠোর বাবার মন যদি একটু গলে! ভালোবাসা, যত্নের কাঙালীনি যদি একটু ভালোবাসার ছোঁয়া পায়!! লতা বাবার কাঁধে হাত রেখে বলে,
-” আব্বু পাতা তো তোমারই মেয়ে! তোমারই অংশ। আমি জানি প্রকাশ না করলেও ওর জন্য তোমার মনে সফট কর্নার আছে! মেয়েটাকে একটু বুকে টেনে নাও? ও খুব ভালোবাসে তোমাদের!”
আতিকুর ইসলাম এবার মুখ খুললেন,
-” লতা মা? জামাই কবে আসবে?”
লতার কপালে ভাঁজ পড়ে। এতো বড় ঘটনা ঘটে গেল আর বাবা নির্লিপ্ত!
-” কয়েকদিন পড়েই! আব্বু? আমি কি বললাম?”
-” রাতুল বাবা এবার আসলে পাতার বিয়েটা সেরে ফেলব!আমি রহিমের সাথে কথা বলছি! আশিকের সাথেও বলব যদি হাতে কোনো ভালো ছেলে থাকে? অনেক হয়েছে! রোজ রোজ ঝামেলা ভালো লাগে না!”
বলেই হন হন করে রুমে চলে যায়! লতা লুবমান একে অপরের দিকে চায় অসহায় হয়ে!
ব্যস্ত রাস্তা। শা শা করে গাড়ি চলছে নেই ! দুই রাস্তার একটা যাওয়ার জন্য আরেকটা আসার জন্য মাঝখানে ইট বাঁধাই করে গাছ লাগানো। মাঝে মাঝে পোল যেখানে ঝুলছে অহরহ বৈদ্যুতিক চার, কেবলের তার , ওয়াই-ফাইয়ের কানেকশন ইত্যাদি ইত্যাদি সেখানে কাকের দল কা কা করে চিল্লাতে ব্যস্ত! গ্রামে কাকের ডাককে অশুভ মানা হয়! অথচ শহরে অনবরত কা কা করে তাহলে তো শহুরে মানুষের উপর অশুভ টু দি পাওয়া ইনফিনিটি হওয়ার কথা!!
অরুণ বিরক্ত হয়ে বসে আছে গাড়ির ভিতর। ফ্রন্ট সিটে আভারি ড্রাইভার ড্রাইভিং সিটে। আর ভোর জানালার গ্লাস একটু খুলে বাইরের দিকে মুখ করে আশেপাশে নজর রাখছে। গাড়ি চলছে না থেমে আছে! নষ্ট হয় নি! ভোর থামিয়ে রেখেছে। তার বায়না সে পাতা মিসের সাথে যাবে স্কুটারে চড়ে! তাই পাতা মিসের খোঁজে দাঁড়িয়ে আছে! অরুণের বকা ধমক কিছুই কানে যায় নি তার । জেদ ধরে বসে আছে!
-” ভোর? এটা কোন ধরনের ছেলেমানুষী? মিস পাতাবাহার যদি আমাদের আগে রওয়ানা হয়ে চলে গিয়ে থাকে?আর বাইকে চড়ার শখ তো! আমি বাইক কিনবো আজই! তাও তোমার পছন্দ মতো! এখন চল? ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দাও?”
ভোর বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” আঙ্কেল ইস্টার্ট দিবেন না! আব্বু আরেকটু ওয়েট করি না? মিস এইতো আসবে! উনি এখনো যান নিই আম সিওর! প্লিজ আব্বু?”
অরুণ ধমক দিয়ে বলে,
-” আর এক সেকেন্ডও না! দিনে দিনে অবাধ্য হচ্ছো ভোর! গাড়ি স্টার্ট দাও তো!”
ড্রাই স্টার্ট দেয়! ভোর গোমড়া মুখে বাইরের দিকে তাকিয়ে রয় এই আশায় মিস পাতা এখুনি আসবে! অরুণ ছেলেক টেনে বসিয়ে দেয় সিটে ভোর জানালায় সেঁটে যায় পুনরায়! একটা স্কুটি নজরে আসে! মিস পাতার মতো শাড়ি পরিহিত না! তবে স্কুটি টা একই! ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝতে পারে ওটা পাতা মিসই! শুধু ড্রেসাপ ব্যতিক্রম! ভোরের খুশি দেখে কে? ইয়ে বলে পাতাকে ডাকতে থাকে!
-” মিস ? পাতা মিস? আব্বু ওই দেখ মিস? আমি বলেছিলাম না তোমায় এখুনি আসবে!”
বলতে বলতে গাড়ি সামনে চলে যায় । স্কুটি পিছনে। অরুণ পেছনে তাকিয়ে বলে
-” আব্বু ওটা মিস পাতাবাহার নয়! অন্য কেউ!”
-” না আব্বু ওটাই মিস! শুধু ড্রেস আলাদা! বাইক আর মিস একই! মিস ? এই মিস? আমি ভোর? শুনতে পাচ্ছেন? আঙ্কেল ইস্পিড আস্তে কর না!”
ড্রাইভার মিররে অরুনের দিকে চায়, কমাবে কি না! অরুন সায় জানায়! স্পিড ধীর হয়। পাতার স্কুটির পাশাপাশি চলতে থাকে! অরুণ সেদিকে চায়! ভায়োলেট কালারের গোল জামা পড়নে। বড় ওড়না মাথায় ঢেকে হেলমেট পড়েছে।চেনাই যাচ্ছেনা পাতাবাহারকে! ভোর চিনলো কি করে?ভোর পাতাকে ডাক দেয়! পাশাপাশিই পাতার শুনতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়! তবে ফিরছে না কেন? একদম সামনে তাকিয়ে আশেপাশে নজরই নেই! ভোর মাথা বের করে ডাক দিল,
পাতা বাহার পর্ব ৬
-” মিস ? এই মিস? শুনছেন না কেন? মিস এইদিকে? তাকান?”
অরুণ ছেলেকে ভিতরে আনে! দেখেছো কি কান্ড! চলন্ত গাড়িতে মাথা বের করে দেয়! তাকে ধমক দিয়ে বলে,
-” এক থাপ্পড় লাগাবো তোমায়! মাথা বের করেছো কেন? কোন এক্সি..! চুপচাপ ভেতরে থাক! গ্লাস উপরে তোল!”
ভোরকে কোলে তুলে নেয় অরুণ! কলিজা তার! এদিক সেদিক হলে! আর এই পাতাবাহার শুনছে না কেন? অপসিট রাস্তার মানুষ শুনতে পাচ্ছে! কানে তুলা দিয়ে রেখেছে নাকি! অরুন গ্লাস হালকা নামিয়ে ডাক দিল,
-” মিস পাতাবাহার? শুনতে পাচ্ছেন? আশ্চর্য আমি জানি শুনতে পাচ্ছেন! সামনে স্কুটি স্ট্যান্ড করুণ!”